আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা) : ছোট্ট দলটির একজন


ইমাম বুখারীর মতে জাহিলী যুগে আবদুর রহমান ইবন ’আউফের নাম ছিল ’আবদু ’আমর। ইবন সা’দ তাঁর ‘তাবাকাতে’ উল্লেখ করেছেন, জাহিলী যুগে তাঁর নাম ছিল ’আবদু কা’বা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা. তাঁর নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান’।

রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথম পর্যায়ে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাঁদেরই একজন। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিনই হযরত আবু বকরের বাড়ীতে বৈঠকে মিলিত হতেন। আবদুর রহমানও ছিলেন এ বৈঠকের একজন নিয়মিত সদস্য। আবু বকরের সাথে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের বাড়ীর এ বৈঠকের নিয়মিত পাঁচজন সদস্যের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমনঃ উসমান, সা’দ, তালহা, যুবাইর এবং আবদুর রহমান। তাঁদের সকলেই আবু বকরের দাওয়াতে প্রথম পর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের জন্য অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।

নবুওয়াতের পঞ্চম বছর রজব মাসে যে এগারজন পুরুষ ও চারজন নারীর প্রথম কাফিলাটি মক্কা থেকে হাবশায় হিজরাত করে তার মধ্যে আবদুর রাহমানও ছিলেন। আবার রাসূলের সা. মদীনায় হিজরাতের পর তিনিও মদীনায় হিজরাত করেন। যাঁরা হাবশা ও মদীনা দু’স্থানেই হিজরাত করেছিলেন তাঁদেরকে বলা হয় ‘সাহিবুল হিজরাতাইন’। মদীনায় তিনি হযরত সা’দ ইবন রাবী’ বলে আল-খাযরাজীর গৃহে আশ্রয় নেন এবং তাঁর সাথেই রাসূল সা. ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন। এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী একাধিক সনদের মাধ্যমে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে আনাস রা. বলেনঃ ‘আবদুর রহমান ইবন ’আউফ হিজরাত করে মদীনায় এলে রাসূল সা. সা’দ ইবন রাবী’র সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দেন। সা’দ ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান দু’ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দু’জন স্ত্রী আছেন। আমি চাই, আপনি তাদের দু’জনকে দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন।’ আবদুর রহমান বললেনঃ ‘আল্লাহ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দান করুন! ভাই, এসব কোন কিছুর প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।’

ইসলামী ভ্রাতৃত্বে হযরত সা’দের এ দৃঢ় আস্থা ও অতুলনীয় উদারতার দৃষ্টান্ত ইসলামী উম্মাহ তথা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে হযরত আবদুর রহমানের মহত্ব, আত্মনির্ভরতা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্পও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

মদীনায় অবস্থানের দ্বিতীয় দিন আবদুর রহমান রা. তাঁর আনসারী ভাই সা’দকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বেচাকেনা হয় এমন কোন বাজার কি এখানে আছে?’’ বললেনঃ ‘‘হাঁ, ইয়াসরিবে (মদীনায়) কায়নুকার বাজার তো আছে।’’ আব্দুর রহমান রা. এক স্থান থেকে কিছু ঘি ও পনির খরিদ করে বাজারে যান। দ্বিতীয় দিনও তিনি এমনটি করলেন। এভাবে তিনি বেচাকেনা জারি রাখেন। কিছু পয়সা হাতে জমা হলে তিনি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন।

বিয়ের পর তিনি একদিন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলেন। তাঁর কাপড়ে হলুদের দাগ দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বিয়ে করেছ?’ বললেন, ‘হাঁ’। জিজ্ঞেস করলেন কাকে?’ তিনি বললেন, ‘এক আনসারী মহিলাকে।’ রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোহর কত নির্ধারণ করেছ?’ তিনি বললেন, ‘কিছু সোনা।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করে নাও।’

তিনি ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছুদিন পর তার হাতে আরও কিছু অর্থ জমা হলে রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশমত ওয়ালিমার কাজটি সেরে নেন। ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হয়। মক্কার উমাইয়া ইবন খালফের সাথে একটি ব্যবসায়িক চুক্তিও সম্পাদন করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ রা. বদর, উহুদ ও খন্দক সহ সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। বদর যুদ্ধে আবদুর রহমান পায়ে আঘাত পান।

উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধেও তিনি অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। রাসূল সা. উহুদ পর্বতের এক কোণে আশ্রয় নিয়েছেন, উবাই ইবন খালফ এগিয়ে এলো আল্লাহর রাসূলকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে। আবদুর রহমান রা. তাকে জাহান্নামে পাঠাবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে রাসূল সা. তাঁকে বাধা দেন। অতঃপর রাসূল সা. নিজেই হারিস ইবন সাম্মার নিকট থেকে বর্শা নিয়ে উবাই ইবন খালফের গর্দানে ছুড়ে মারেন। সামান্য আহত হয়ে সে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে যায় এবং মক্কার পথে ‘সারফ’ নামক স্থানে নরক যাত্রা করে।

ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উহুদের যুদ্ধে আবদুর রহমান অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। বালাযুরী তাঁর ফুতুহুল বুলদান, ইবনে হাজার তাঁর আল–ইসাবা এবং ইবন খালদুন তাঁর তারীখে বর্ণনা করেছেন, এ যুদ্ধে তিনি সারা দেহে মোট একত্রিশটি আঘাত পান।

ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে রাসূল সা. মদীনা থেকে প্রায় তিন শো মাইল উত্তরে ‘দুমাতুল জান্দালে’ একটি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব দেন আবদুর রহমান রা.কে। যাত্রার পূর্বে তিনি উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। রাসূল সা. নিজ হাতে আবদুর রহমানের মাথার পাগড়ীটা খুলে রেখে দিয়ে অন্য একটি কালো পাগড়ী তার মাথায় বেঁধে দেন। তারপর যুদ্ধের পলিসি সংক্রান্ত কিছু হিদায়াত দিয়ে তিনি আবদুর রহমানকে রা. বিদায় দেন।

মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সা. মুহাজিরদের যে ছোট্ট দলটির সংগে ছিলেন, আবদুর রহমান রা.ও ছিলেন সেই দলে।
______
[তথ্যসূত্র: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ]

Post a Comment