ইবনে উম্মে মাখতুম (রা:) : একজন ইসলামপ্রেমী মানুষ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে এলেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ও বিলাল ইবন রাবাহকে মুসলমানদের মুয়ায্‌যিন নিয়োগ করেন। তাঁরা দু’জন ছিলেন মুসলিম উম্মাতের প্রথম মুয়ায্‌যিন। এভাবে তাঁরা প্রতিদিন পাঁচবার কালেমাতুত তাওহীদের প্রচার, মানুষকে সৎকর্মের দিকে আহ্‌বান ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহদানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। বিলাল আযান দিতেন, আর ইবন উম্মে মাকতুম দিতেন ইকামাত। মাঝে মাঝে আযান দিতেন ইবন উম্মে মাকতুম, আর ইকামাতে দিতেন বিলাল রা.। রমযান মাসে তাঁরা অন্য একটি কাজও করতেন। মদীনার মুসলমানরা তাঁদের একজনের আযান শুনে সেহরী খাওয়া শুরু করতেন এবং অন্যজনের আযান শুনে খাওয়া বন্ধ করতেন। বিলালের আযান শুনে লোকেরা সেহরীর জন্য জেগে উঠতো। এদিকে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম প্রতীক্ষায় থাকতেন সুবহে সাদিকের সুবহে সাদিক হওয়ার সাথে সাথে তিনি আযান দিতেন, আর সে আযান ‍শুনে লোকেরা খাওয়া বন্ধ করতো।

রাসূলুল্লাহর (ﷺ) হিজরাতের যুদ্ধ-বিগ্রহের পালা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু অন্ধ সাহাবী ইবন উম্মে মাকতুম(রা) স্বীয় অক্ষমতার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণে অপারগ ছিলেন। বদর যুদ্ধের পর আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীর (ﷺ) ওপর কিছু আয়াত নাযিল করেন। আয়াতগুলি মুজাহিদদের সুমহান মর্যাদা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হয়ে যারা গৃহে অবস্থান করেন, তাদের ওপর মুজাহিদদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। আয়াতগুলির বিষয়বস্তু ইবন উম্মে মাকতুমের(রা) মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুজাহিদদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি ভীষণ ব্যথিত হন। যখন এ আয়াত নাযিল হলোঃ

‘গৃহে অবস্থানকারী মু’মিনগণ এবং আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদগণ সমমর্যাদার অধিকারী হবে না।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কাতিবে অহী যায়িদ বিন সাবিতকে রা. আয়াতটি লিখতে বললেন। এমন সময় ইবন উম্মে মাকতুম সেখানে পৌঁছলেন। আরজ করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, সক্ষম হলে আমিও তো জিহাদে অংশগ্রহণ করে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করতে পারতাম।’
তারপর অত্যন্ত বিনীতভঅবে আল্লাহর নিকট দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ আমার অপারগতা সম্পর্কে অহী নাযিল করুন, হে আল্লাহ আমার ওজর সম্পর্কে অহী নাযিল করুন।’ তাঁর এ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহর নিকট এতই মনঃপূত হয়েছিল যে, সংগে সংগে অহী নাযিল করে অনন্তকালের জন্য জগতের সকল অক্ষম ব্যক্তিদের জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করেন।
নাযিল হয়ঃ
لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
‘ওজরগ্রস্তরা ছাড়া যেসব মুসলমান গৃহে অবস্থান করে, মর্যাদায় তারা তাদের সমকক্ষ নয়, যারা জান মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।’
[নিসা ৯৫]
এখানে [غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ ] বাক্যাংশ দ্বারা সকল অক্ষম ব্যক্তিকে জিহাদের হুকুম থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে এই হুকুমের কারণে তাঁর জিহাদে গমনের উৎসাহ কমার পরিবর্তে আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁর মহান অন্তঃকরণ অক্ষমদের সাথে ঘরে বসে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মহান অন্তঃকরণ সর্বদাই মহৎ কাজ ছাড়া পরিতুষ্ট হতে পারে না। ইবন হাজার আসকিলানী(র) ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে বলেনঃ অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও কখনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। মানুষকে তিনি বলতেন, ‘আমার হাতে পতাকা দিয়ে তোমরা আমাকে দু’সারির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দাও। আমি অন্ধ, পালানোর কোন ভয় নেই।’

সুবহানাল্লাহ! এই অন্ধ সাহাবীরও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য কী অসামান্য আগ্রহ।আর আজ মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন ছল-ছুতায় অজুহাতে এই মহান ইবাদত থেকে পালানোর সুযোগ খোঁজে।

ইবন উম্মে মাকতুম(রা) যদিও অক্ষমতার কারণে জিহাদের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত ছিলেন, তবে তার থেকে বড় গৌরব ও সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারদের সংগে নিয়ে মদীনার বাইরে কোন অভিযানে গমন করতেন, তখন ইবন উম্মে মাকতুমকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। এ সময় তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতির দায়্ত্ব পালন করতেন। সুতরাং আবওয়ার, বাওয়াত, যুল আসীর, জুহাইনা, সুয়াইক, গাতফান, হামরাউল আসাদ, নাজরান, যাতুর রুকা প্রভৃতি অভিযানের সময় মোট তের বার এ গৌরব তিনি অর্জন করেন। বদর যুদ্ধের সময় কিছুদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে আবু লুবাবাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

তথ্যসূত্র: "আসহাবে রাসুলের জীবনকথা"

1 Comments

Post a Comment