একজন একাকী মানুষের কথা


আবু যার মক্কা ফিরে এসে গোত্রীয় লোকদের সাথে মরুভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। একে একে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি মদীনায় এলেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অবলম্বন করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে আবেদন করলেন তাঁর খিদমতের সুযোগ দানের জন্য। তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করা হল। মদীনায় অবস্থানকালে সবটুকু সময় তিনি অতিবাহিত করতেন রাসূলুল্লাহর সা. সেবায়। এটাই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয় কাজ। তিনি নিজেই বলতেনঃ
‘‘রাসূলুল্লাহর সা. খিদমত করতাম, আর অবসর সময়ে মসজিদে এসে বিশ্রাম নিতাম।’’

রাসূলুল্লাহর সা. সংগে তাঁর যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। তবে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণের একটি ঘটনা আল্লামা ইবন হাজার আসকিলানী-‘আল–ইসাবা’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতঃস্তত ভাব প্রকাশ করতে লাগলো। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, অমুক আসেনি।’ জবাবে তিনি বলতেন, ‘যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয় তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। অন্যথায় আল্লাহ তাকে তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার দিক থেকে তোমাদের নিরাপদ করেছেন।’ এক সময় আবু যারের নামটি উল্লেখ করে বলা হল ‘সেও পিঠটান দিয়েছে।’ প্রকৃত ঘটনা হল, তাঁর উটটি ছিল মন্থরগতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানযিলে রাসূলুল্লাহ সা. সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাঁকে দেখে বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, রাস্তা দিয়ে কে যেন একজন আসছে।’ তিনি বললেনঃ ‘আবু যারই হবে।’ লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পার। বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, এতো আবু যারই।’ তিনি বললেনঃ
‘আল্লাহ আবু যারের ওপর রহম করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামাতের দিন একাই উঠবে।’ (তারীখুল ইসলামঃ আল্লামা জাহাবী, ৩য় খণ্ড) রাসূলুল্লাহর সা. ভবিষ্যদ্বানীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

আবু যার(রা) ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়া বিরাগী ও নির্জনতা-প্রিয় স্বভাবের। এ কারণে রাসূলে পাক সা. তাঁর লকব দিয়েছিলেন- ‘মসিহুল ইসলাম’। রাসূলের সা. ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনও প্রশমিত হয়নি। এ কারণে আবু বকরের(রা) ইনতিকালে তাঁর ভগ্ন হৃদয় আরও চুরমার হয়ে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে তখন মদীনার সুশোভিত উদ্যানটি পত্র-পল্লবহীন বলে প্রতিভাত হয়। তিনি মদীনা ত্যাগ করে শামে (সিরিয়া) প্রবাসী হন।

আবু বকর ও উমারের রা. খিলাফতকাল পর্যন্ত ইসলামের সহজ ও সরল জীবন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। বিজয় ও ইসলামী খিলাফতের বিস্তৃতির সাথে যখন ধন ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য দেখা দেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই চাকচিক্য ও জৌলুস সে স্থান দখল করে নেয়। উসমানের রা. যুগেই বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে শানশওকাত দেখা যায়। সাধারণ জনজীবনে এর কিছুটা প্রভাব পড়ে। তাদের মধ্যে নবীর সা. আমলের সরলতার পরিবর্তে ভোগ ও বিলাসিতার ছাপ ফুটে ওঠে। আবু যার মানুষের কাছে নবীর সা. আমলের সেই সহজ সরল আড়ম্বরহীন জীবনধারার অনুসরণ আশা করতেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল সকলেই তাঁর মন ধন-দৌলতের প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হউক। তাঁর আল্লাহ নির্ভর বিশ্বাস ও মতবাদে আগামীকালের জন্য কোন কিছুই আজ সঞ্চয় করা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্যকে অভুক্ত ও উলংগ রেখে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার কোন অধিকার কোন মুসলিমের নেই। সাহাবী মুআবিয়া রা. ও অন্যান্য আমীরগণ মনে করতেন সম্পদশালী লোকদের ওপর আল্লাহ যে যাকাত ফরয করেছেন তা সঠিকভাবে আদায় করার পর অতিরিক্ত অর্থ জমা করার ইখতিয়ার প্রতিটি মুসলিমের আছে। এ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঝগড়া ও বচসার রূপ লাভ করে। আবু যার অত্যন্ত নির্ভীকভাবে ঐ সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের লক্ষ্যবস্তু বলে গণ্য করতে থাকেন।
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
– ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।’ (আত্‌ তাওবাহঃ ৩৪)
এ আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের আলোচনা এসেছে। এ কারণে আমীর মুআবিয়া(রা)র বক্তব্য ছিল, এ আয়াতের সম্পর্ক ঐ সব বিধর্মীদের সাথে। আর আবু যার(রা) মনে করেন, আয়াতটির উদ্দেশ্য মুসলিম অমুসলিম সকলেই। দ্বিতীয়তঃ আবু যার(রা) আল্লাহর পথে ব্যয় না করার অর্থ এই বুঝাতেন যে, সে নিজের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দেয় না। আর আমীর মুআবিয়ার(রা) ধারণা ছিল এটা কেবল যাকাতের সাথে সম্পৃক্ত। এভাবে আবু যার(রা) স্বীয় চিন্তা-দর্শন ও ইজতিহাদ অনুযায়ী অত্যন্ত কঠোরভাবে সমালোচনা আরম্ভ করেন। মুআবিয়া রা. মনে করেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে শামে যে কোন সময় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তিনি খলীফা উসমানকে রা. নাজুক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং অনুরোধ করলেন তিনি যেন আবয যার(রা) কে মদীনায় ডেকে পাঠান। উসমান(রা) তাঁকে মদীনায় ডেকে পাঠান।

একদিন আবু যার(রা) বসে আছেন। তাঁরই সামনে খলীফা ’উসমান রা. কা’বকে রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ পুঞ্জিভুত করে, তার যাকাত দেয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ও করে- এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী ধারণা পোষণ করেন?’ কা’ব রা. বললেনঃ ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো আশা পোষণ করা যায়।’ এ কথা শুনে আবু যার(রা) তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কা’বের(রা) মাথার ওপর হাতে লাঠিটি তুলে ধরে বললেন, ‘ইয়াহুদী নারীর সন্তান, (কা’ব ইয়াহুদীর সন্তান ছিলেন) তুমি এর মর্ম কি বুঝবে। কিয়ামাতের দিন এমন ব্যক্তির অন্তরকেও বৃশ্চিক দংশন করবে।’ উসমান(রা) শেষ পর্যন্ত আবু যার(রা)কে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে থাকুন, দুগ্ধবতী উটনী প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আপনার দরজায় হাজির হবে।’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘তোমার এ দুনিয়ার কোন প্রয়োজন আমার নেই।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। অবশেষে উসমান(রা) তাঁকে অনুরোধ জানালেন, মদীনা থেকে বহুদূরে মরুভূমির মাঝখানে ‘রাবজা’ নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করার জন্য। অনেকে মতে তিনি স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। লোকালয়ে থেকে বহুদূরে নির্জন প্রান্তরে ভোগ বিলাসী জীবনকে পরিহার করে আল্লাহর রাসূলের সা. পরকাল-আসক্ত জীবনকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে আমরণ সেখানে পড়ে থাকেন। আবু যারের(রা) ওফাতের কাহিনীটাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং চমকপ্রদও বটে। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনের তিনি ‘রাবজা’র মরুভূমিতে ইনতিকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ

‘‘আবু যারের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়লো, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছো কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহৃত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল সা.-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘যে মুসলিমের দুই অথবা তিনটি সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য তাই-ই যথেষ্ট। তিনি কতিপয় লোকের সামনে, তার মধ্যে আমিও ছিলাম, বলেছিলেনঃ তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণ সময়ে মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে।’ আমি ছাড়া সেই লোকগুলির সকলেই লোকালয়ে ইন্তিকাল করেছে। এখন একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সে ব্যক্তি আমি। আমি কসম করে বলছি, আমি মিথ্যা বলছিনা এবং যিনি এ কথা বলেছিলেন তিনিও কোন মিথ্যা বলেননি। তুমি রাস্তার দিকে চেয়ে দেখ গায়েবী সাহায্য অবশ্যই এসে যাচ্ছে।’ আমি বললামঃ ‘এখন তো হাজীদেরও প্রত্যাবর্তন শেষ হয়েছে, রাস্তায়ও লোক চলাচল বন্ধ।’ তিনি বললেন, ‘না’ তুমি যেয়ে দেখ।’ সুতরাং এক দিকে গৌড়ে গিয়ে টিলার ওপর উঠে দূরে তাকিয়ে দেখছিলাম, অপর দিকে ছুটে এসে তাঁর শুশ্রুষা করছিলাম। এরূপ ছুটাছুটি ও অনুসন্ধান চলছিল। এমন সময় দূরে কিছু আরোহী দৃষ্টিগোচর হলো। আমি তাদেরকে ইশারা করলে তারা দ্রুতগতিতে আমার নিকট এসে থেমে গেল। আবু যার সম্পর্কে তারা প্রশ্ন করলো, ‘ইনি কে?’ বললামঃ ‘আবু যার।’ ‘রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী?’ বললামঃ ‘হাঁ।’ ‘মা বাবা কুরবান হউক’- একথা বলে তারা আবু যারের কাছে গেল। আবু যার প্রথমে তাদেরকে রাসূলের সা. ভবিষ্যৎ বাণী শানালেন। তারপর অসিয়ত করলেন, ‘যদি আমার নিকট অথবা আমার স্ত্রীর নিকট থেকে কাফনের পরিমাণ কাপড় পাওয়া যায় তাহলে তা দিয়েই আমাকে দাফন দেবে।’ তারপর তাদেরকে কসম দিলেন, যে ব্যক্তি সরকারের ক্ষুদ্রতম পদেও অধিষ্ঠিত সে যেন তাঁকে কাফন না পরায়। ঘটনাক্রমে এক আনসারী যুবক ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য সকলেই কোন না কোন সরকারী দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। আবু যার তাকেই কাফন পরাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কাফিলাটি ছিল ইয়ামনী। তারা কুফা থেকে আসছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.। এ কাফিলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যারের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাঁকে ‘রাবজার’ মরুভূমিতে দাফন করেন।’

আবু যার(রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট আটাশ। তন্মধ্যে বারোটি হাদীস মুত্তাফাক আলাইহি অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছে। দু’টি বুখারী ও সাতটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদের তুলনায় তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ তিনি সবসময় চুপচাপ থাকতেন, নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং মানুষের সাথে মেলামেশা কম করতেন। এ কারণে তাঁর জ্ঞানের তেমন প্রচার হয়নি। অথচ আনাস ইবন মালিক(রা) , আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা) প্রমুখের ন্যায় বিদ্বান সাহাবীগণ তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। ইবন আসাকির তাঁর ‘তারীখে দিমাশক’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

আলী রা. কে আবু যারের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে ‍জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘এমন জ্ঞান তিনি লাভ করেছেন যা মানুষ অর্জন করতে অক্ষম। তারপর সে জ্ঞান আগুনে সেক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্ত তা থেকে কোন খাদ বের হয়নি।’ এ মহান সাধক ও দুনিয়া নিরাসক্ত সাহাবী সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘আসমানের নীচে ও যমীনের ওপরে আবু যার সর্বাধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।’
______
[তথ্যসূত্র: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ]

Post a Comment