ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান


নবুওয়াতের দশম বর্ষের যুল ক্বা‘দাহ মাসে (৬১৯ খ্রীষ্টাব্দের জুনের শেষ কিংবা জুলাইয়ের প্রথম ভাগে) রাসূলুল্লাহ(সাঃ) ত্বায়িফ থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তন করেন এবং পুনরায় নতুনভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিদের দাওয়াত দেওয়া আরম্ভ করেন। যেহেতু তখন সময়টা ছিল হজ্জ্ব মৌসুমের কাছাকাছি সেহেতু নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেজনেরা পদব্রজে ও যানবাহনে হজ্জ্ব পালনের জন্য মক্কা শরীফে আসতে আরম্ভ করেছিলেন। তারা তাদের কল্যাণার্থে এবং কয়েক দিন আল্লাহর স্মরণার্থে লোকেরা এখানে একত্রিত হচ্ছিলেন। ফলে নাবী কারীম(সাঃ) এই সময়টাকে দাওয়াত দানের জন্য বেশ উপযোগী মনে করে এক এক গোত্রের নিকট গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন যা তিনি নবুওয়াতের ৪র্থ বছর থেকে করে আসছিলেন। অধিকন্তু তিনি(সাঃ) এই দশম বছর থেকে লোকদেরকে তাঁকে সাহায্য-সহযোগীতা করা, আশ্রয় কামনার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত রিসালাতের বাণী প্রচার করতে থাকেন।

যে সকল গোত্রের নিকট ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছিলঃ
  ইমাম যুহরী(রঃ) বলেছেন, নাবী কারীম(সাঃ) যে যে গোত্রের নিকট গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন তাদের মধ্যে নিম্নের গোত্রগুলোর কথা আমাকে বলা হয়েছে। গোত্রগুলো হচ্ছে যথাক্রমে:
  বনু ‘আমির বিন সা‘সা‘আহ, মুহারিব বিন খাসাফাহ, ফাযারাহ, গাস্‌সান, মুররাহ, হানীফাহ, সালীম, ‘আবস, বনু নাসর, বনুল বাক্কা-,কিনদাহ, কালব, হারিস বিন কা‘ব, ‘উযরাহ ও হাযারিমাহ। কিন্তু এদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করেন নি।   (তিরমিযী মুখতাসারুস সিরাত, শাইখ আবদুল্লাহ পৃঃ ১৪৯)
  প্রকাশ থাকে যে, ইমাম যুহরী যে সকল গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের সকলের নিকট একই বছর অথবা একই হজ্জ্বের মৌসুমে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয় নি। বরং নবুওয়াতের ৪র্থ বছর থেকে আরম্ভ করে হিজরতের পূর্বের শেষ হজ্জ্ব মৌসুম পর্যন্ত দশ বৎসর সময়ের মধ্যে এ দাওয়াত পেশ করেছিলেন। কোন নির্দিষ্ট গোত্রের দাওয়াত পৌঁছানোর ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময় নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এর অধিকাংশ ছিল দশম সনে।   (রহমাতুলিত আলামীন ১/৭৪ পৃঃ)
  ইবনে ইসহাক্ব কোন কোন গোত্রের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা এবং তাদের উত্তরের অবস্থা, রকম, ধরণ ইত্যাদি সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রদান করেছেন নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত সার প্রদান করা হল:
  ১. বনু কালবঃ নাবী কারীম(সাঃ) বনু কালব এর একটি শাখা বনু আবদুল্লাহর নিকটে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে নিজেকে তাদের সম্মুখে পেশ করেন। আলাপ আলোচনা সূত্রে তিনি তাদের বলেন, ‘হে বনু আবদুল্লাহ, আল্লাহ তোমাদের পূর্ব পুরুষদের যথেষ্ট অনুগ্রহ করেছেন এবং মর্যাদা দিয়েছেন। তোমাদের উচিত আল্লাহর এ আহ্বানে সাড়া দেয়া। কিন্তু এ গোত্র তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন নি।’
  ২.বনু হানীফাহঃ নাবী কারীম(সাঃ) তাদের তাঁবুতে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর আহ্বান জানিয়ে নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। কিন্তু তারা এমন অশ্রাব্য উত্তর প্রদান করে যা আরবের অন্য কেউই প্রদান করে নি।
  ৩.‘আমির বিন সা‘সা‘আহঃ রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এ গোত্রের লোকজনদেরও আল্লাহর পথে আহ্বান জানিয়ে নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। উত্তরে এ গোত্রের বাইহারাহ বিন ফিরাস নামক একটি লোক বলে যে, ‘আল্লাহর কসম! যদি আমি কুরাইশদের এ যুবককে গ্রহণ করি তবে তাঁর দ্বারা সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলব।’ আবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা বলুন, যদি আমরা আপনার নিকট এ ধর্মের উপর অনুগত্য স্বীকার করি এবং আল্লাহ আপনাকে বিপক্ষবাদীদের উপর জয়ী করেন তবে আপনার পরে নেতৃত্বের দায়িত্ব কি আমাদের উপর অর্পিত হবে?’
  উত্তরে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বললেন, ‘নেতৃত্বের চাবি কাঠি তো আল্লাহর হাতে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে তিনি নেতৃত্বের স্তম্ভ স্থাপিত করবেন।’
  লোকটি বলল, ‘ভাল, আপনার রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের বক্ষ আপনার প্রতিপক্ষ আরবদের নিশানায় থাকবে, কিন্তু আল্লাহ যখন আপনাকে জয়ী করবেন তখন কর্তৃত্বের চাবিকাঠি অন্য কারও হাতে থাকবে এটা কখনই হতে পারে না। কাজেই আপনার ধর্মের আমাদের কোন প্রয়োজনই নেই।’ মোট কথা তারা তাঁকে অস্বীকার করল।
  এর পর বনু ‘আমির গোত্রের লোকেজনেরা নিজ অঞ্চলে ফিরে গিয়ে এক বৃদ্ধকে যিনি বার্ধক্যের কারণে হজ্জ্ব গমনে সক্ষম হন নি সমস্ত ঘটনা শুনালো এবং বলল যে, আমাদের নিকট কুরাইশ খানদানের বনু আব্দুল মুত্তালিবের এক যুবক এসেছিল। তার ধারণা যে, সে আল্লাহর নাবী। সে দাওয়াত দিল যে, আমরা ইসলাম গ্রহণ করে যেন তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং আমাদের অঞ্চলে তাঁকে নিয়ে আসি।’
  এ কথা শ্রবণে বৃদ্ধ লোকটি দু’হাত দিয়ে মাথা ধরে ফেলল এবং বলল, ‘হে বন্ধু ‘আমির! এখন কি এ ভুল সংশোধনের কোন পথ আছে? আর যা হস্তচ্যুত হয়েছে তার কি অনুসন্ধান করা যেতে পারে? সে সত্ত্বার শপথ! যাঁর হাতে উমুকের প্রাণ আছে ইসমাঈল(আঃ)-এর গোত্রের কারও পক্ষে এ (নবুওয়াতের) মিথ্যা দাবী করা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই সত্য নাবী। তোমাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কি লোপ পেয়েছিল?     (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৪-৪২৫ পৃঃ)

ঈমানের শিখা মক্কার বাইরেঃ
  যেভাবে মহানাবী (সাঃ) গোত্র ও দলসমূহকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন তেমনভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকেও ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। এর মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির নিকট থেকে ভাল সাড়া পাওয়া যায়। অধিকন্তু হজ্জ্বে এ মৌসুমের কিছুদিন পর কয়েক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। নিম্নে তাঁদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিপিবদ্ধ করা হল:
  ১. সুওয়াইদ বিন সামিতঃ তিনি কবি, গভীর জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী এবং মদীনার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপক্কতা, অভিজ্ঞতা, কাব্যচর্চা, সামাজিক মর্যাদা এবং বংশমর্যাদার কারণে জাতি তাঁকে ‘কামিল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। হজ্জ্ব এবং ‘উমরাহ করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় আগমণ করলে নাবী কারীম(সাঃ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে তিনি রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমার নিকট যে জিনিস রয়েছে সম্ভবত আপনার নিকটও সে জিনিস রয়েছে।’ উত্তরে নাবী কারীম(সাঃ) বললেন, ‘আপনার নিকট কী কী জিনিস রয়েছে?’ সুওয়াইদ বললেন, ‘হিকমতে লোকমান।’ রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বললেন, ‘তা নিয়ে এসো’ এবং তিনি তা নিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই একথা ভাল। কিন্তু আমার কাছে যা আছে তা এ থেকেও উত্তম এবং তা হচ্ছে আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআন যা আল্লাহ আমার উপর অবতীর্ণ করেছেন। তা হেদায়েত ও জ্যোতি।’ এর পর নাবী কারীম(সাঃ) তাকে কুরআন পাঠ করে শোনালেন এবং ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘এতো খুব ভালো কথা। তারপর তাঁর মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর পরই বু‘আসের যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং সে যুদ্ধে তাঁকে হত্যা করা হয়। (ইবনে হিশাম ১/৪২৫-৪২৭ রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৭৪ পৃঃ) নবুওয়াতের একাদশ বর্ষের প্রথম ভাগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (তারীখে ইসলাম আকবরশাহ নাজীবাবাদী ১/১২৫)

 ২. ইয়াস বিন মু‘আযঃ তিনিও মদীনার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন নব্য যুবক। নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে বু‘আসের যুদ্ধের কিছু পূর্বে আউস গোত্রের একটি দল খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে কুরাইশদের মিত্রতা ও সহায়তা লাভের সন্ধানে মক্কা আগমন করেন। ইয়াস বিন মু‘আযও সে দলের সঙ্গে এসেছিলেন। সে সময় ইয়াসরিবে আউস ও খাযরাজ এ উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। যুদ্ধে আউসদের তুলনায় খাযরাজদের সংখ্যাধিক্য ছিল। আউসদের মক্কা আগমনের কথা অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) তাঁদের নিকটে গেলেন এবং যুদ্ধের বিভীষিকা ও ক্ষয় ক্ষতির কথা ভেবে তাদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘আপনারা যে উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন তার চেয়েও কি উত্তম বস্তু গ্রহণ করতে পারেন?”
  তাঁরা বললেন, ‘তা কী জিনিস?’
  উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে নিজ বান্দার নিকট এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, আমি যেন তাঁদের এ কথার দাওয়াত দেই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকেও শরীক করবে না। আল্লাহ আমার উপর কিতাবও অবতীর্ণ করেছেন। ইসলাম সম্পর্কে তিনি আরও কিছু আলাপ আলোচনা করলেন এবং কুরআন মাজীদের কিয়দংশ পাঠ করে শোনালেন।
  ইয়াস বললেন, ‘হে আমার গোত্রীয় ভাইয়েরা, আল্লাহর শপথ তোমরা যে জন্য আগমন করেছ, এ হচ্ছে তার চাইতে অনেক বেশি উত্তম।’ কিন্তু দলের একজন সদস্য আবুল হায়সার আনাস বিন রাফি‘ এক মুষ্ঠি কঙ্কর উঠিয়ে ইয়াসের মুখে মারল এবং বলল, ‘এ কথা ছাড়। আমার বয়সের শপথ! আমরা এ স্থানে অন্য উদ্দেশ্যে আগমন করেছি।’ এ কথা শোনার পর ইয়াস নীরবতা অবলম্বন করল। নাবী কারীম(সাঃ)-ও সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। দলটি কুরাইশদের সঙ্গে মিত্রতা ও সহায়তা চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয় নি, তারপর এক রাশ নৈরাশ্য নিয়ে তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে।
  মদিনায় প্রত্যাবর্তনের অল্প কিছুদিন পরেই ইয়াস মৃত্যুবরণ করেন।মৃত্যুর সময় তিনি তাহলীল(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর(আল্লাহু আকবার), হামদ ও তাসবী জপতে ছিলেন। এ কারণে অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তাঁর মৃত্যু ইসলামের ঈমানের উপর হয়েছিল।      (ইবনে হিশাম ১/৪১৭, ৪২৮ পৃঃ)
  ৩. আবূ যার গিফারীঃ তিনি ইয়াসরিবে বসবাস করতেন। যখন সুয়াইদ বিন সামিত ও ইয়াস বিন মু‘আয মারফত রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর আর্বিভাবের কথা তিনি শ্রবণ করলেন তখন তাঁর কর্ণকুহরে তিনি প্রচন্ড একটি ধাক্কার মতো অবস্থা অনুষব করলেন এবং সেটাই তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়ে দাড়াল।
  তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে ‘আব্বাস(রাঃ)-এর বর্ণনা মতে আবূ যার(রাঃ) বলেছেন, ‘আমি ছিলাম গিফার গোত্রের একজন লোক। আমি জানতে পারলাম যে, মক্কায় এমন একজন লোকের আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে নাবী বলে দাবী করছেন। আমি আপন ভাইকে বললাম তুমি লোকটির নিকট গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বল এবং খবর নিয়ে এসো। সে সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ফিরো এলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর এনেছ? সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি এমন মানুষ দেখেছি যিনি ভালোর জন্য আদেশ ও মন্দের জন্য নিষেধ করছেন। আমি বললাম, তুমি সন্তোষজনক উত্তর দিলে না। শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই কাঁধে খাদ্যের ঝুলি এবং হাতে লাঠি নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করলাম। সেখানে পৌঁছে গেলাম, কিন্তু তাঁকে (সাঃ) চিনতাম না এবং তাঁর(সাঃ) সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করব তাও সাহস পাচ্ছিলাম না।
     ফলে আমি যমযমের পানি পান করতাম এবং মসজিদুল হারামে পড়ে থাকতাম। শেষ পর্যন্ত আমার নিকট দিয়ে ‘আলী(রাঃ) পথ অতিক্রম করছিলেন। তিনি বললেন, ‘লোকটিকে অপরিচিত মনে হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘জ্বী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘ভালো কথা, আমার বাসায় চলুন।’ আমি তাঁর সঙ্গে চললাম। তাঁর সঙ্গে নেহাৎই মামুলি গোছের কিছু কথাবার্তা হল। তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। যে উদ্দেশ্যে আমার আগমন সে সম্পর্কে আমিও তাঁকে তেমন কিছু বললাম না। এভাবে রাত্রি অতিবাহিত হল।
  সকাল হতে না হতেই আমি এ উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারামে গেলাম যে, সেখানে নাবী(সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। কিন্তু সেখানে এমন কেউ ছিল না যিনি তাঁর সম্পর্কে কিছু বলবেন। শেষ পর্যন্ত দেখলাম আবারও ‘আলী(রাঃ) সেখান দিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে তিনি কিছুটা যেন নিজে নিজেই বললেন, ‘এ লোক তো দেখছি এখনো তাঁর ঠিকানা জানতে পারেন নি।’
  আমি বললাম, ‘জ্বী না।’ তিনি বললেন, ‘ভালো, আপনি আমার সঙ্গে চলুন।’ এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা বলুন তো আপনার ব্যাপারটি কী? কি উদ্দেশ্যে আপনি এ শহরে এসেছেন?’
  আমি বললাম, ‘আমার আগমনের উদ্দেশ্য আমি যা বলব আপনি যদি তা গোপন রাখেন তাহলে আমি বলব?’
  তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে আমি তাই করব।’
  এ প্রেক্ষিতে আমি বললাম, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, এখানে এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে আল্লাহর নাবী বলে দাবী করছেন। আমি আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য, কিন্তু সে ফিরে গিয়ে সন্তোষজনক কিছুই বলতে সক্ষম হয় নি। এ জন্য আমি ভাবলাম যে, নিজে গিয়েই সাক্ষাৎ করে কথাবার্তা বলে আসি।
  ‘আলী(রাঃ) বললেন, ‘ভাই তুমি সঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছ। দেখ আমার যাত্রা তাঁর দিকেই। আমি যেখানে প্রবেশ করব তুমিও সেখানে প্রবেশ করবে। আর যদি এমন কোন লোক দেখি যে, তোমার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে তাহলে আমি তখন কোন প্রাচীরের গায়ে এমনভাবে থাকব যাতে মনে হবে যেন আমি আমার জুতো ঠিক করছি। তুমি কিন্তু তখন পথ চলতেই থাকবে।’
  এরপর ‘আলী(রাঃ) যাত্রা শুরু করলেন। আমিও তাঁকে অনুসরণ করলামতিনি রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হয়ে আরয করলাম ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ(সাঃ)! আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন।’ হৃদয়স্পর্শী ভাব ও ভাষার মাধ্যমে তিনি আমার নিকট ইসলামের মূল বক্তব্য পেশ করলেন। বিষয় ও বক্তব্যে অভিভূত হয়ে আমি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘হে আবূ যার, এ ব্যাপারটি গোপন রাখ এবং নিজ এলাকায় চলে যাও। যখন আমার বিজয়ের সংবাদ অবগত হবে তখন চলে আসবে। আমি বললাম, ‘ঐ মহান সত্ত্বার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যের বাণীবাহক হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমি তাদের মধ্যে উচ্চ কন্ঠে এ সত্য প্রচার করব।’
  এরপর আমি মসজিদুল হারামে এলাম। কুরাইশ গোত্রের কিছু সংখ্যক লোকজন সেখানে উপস্থিত ছিল। আমি তাদের লক্ষ্য করে বললাম,
  ‘অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ(সাঃ) আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।
  আমার মুখ থেকে তাওহীদের বাণী শ্রবণ করা মাত্র কুরাইশগণ বললো, এ লোককে শায়েস্তা করো। ফলে তারা এমনভাবে আমাকে মারপিট শুরু করল যেন, আমি মরে যাই। এমন এক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন ‘আব্বাস(রাঃ)। জনতার ভিড়ের মধ্যখানে উঁকি দিয়ে তিনি আমাকে দেখতে পেলেন এবং কুরাইশদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা ধ্বংস হও! তোমরা গিফার গোত্রের একজন লোককে মারপিট করছ অথচ তোমাদের সফর ও ব্যবসার জন্য যাতায়াতের পথই হচ্ছে গিফার গোত্রের মধ্য দিয়ে। এ কথা শ্রবণের পর তারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল।
  দ্বিতীয় দিন সকাল হলে আমি আবারও সেখানে গেলাম এবং গতকাল যা বলেছিলাম আজও তা বললাম। অর্থাৎ উচ্চ কন্ঠে উচ্চারণ করলাম তাওহীদ বাণী ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ও রাসূলুহু।’ আমার উচ্চারিত কালেমা শাহাদাত শ্রবণের পর গতকালের মতই তারা বললো, এ লোককে শায়েস্তা করো, তারা আমাকে মারপিট শুরু করল। আজও ‘আব্বাস(রাঃ) ওদের হাত থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি আমার প্রতি ঝুঁকে পড়ে কুরাইশদের লক্ষ্য করে আবারও সেই কথাগুলো বললেন যা বলেছিলেন গতকাল।
      (সহীহুল বুখারী কিস্‌সাতে ১ম খন্ড ৪৯৯-৫০০, ‘বাবু ইসলামে আবী যার’’ ১/৫৪৪-৫৪৫)
  ৪. তুফাইল বিন ‘আমর দাওসীঃ তিনি দাওস গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন কবি এবং একজন শরীফ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁর গোত্রের কোন কোন সদস্য ইয়ামেনের কোন কোন অঞ্চলে রাজত্ব করত। তিনি নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে মক্কা গমন করেন। সেখানে উপনীত হলে পূর্বাহ্নে মক্কাবাসী কাফেরগণ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর তাঁর নিকট এ বলে আরয করে যে, ‘হে সম্মানিত মেহমান তুফাইল! আমাদের শহরে আগমনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু একটি লোকের কারণে আমাদের সব আনন্দ নিরানন্দে পর্যবসিত হচ্ছেসে নানা ধরনের নতুন নতুন কথাবার্তা বলে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, আমাদের একতা বিনষ্ট করেছে এবং শৃঙ্খলা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। তাঁর কথাবার্তা অনেকের উপর যাদুর মত প্রভাব বিস্তার করছে, সে পিতা-পুত্র, ভা্‌ই-ভাই এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ভাঙ্গন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমরা যে বিপদে পড়েছি আপনি এবং আপনার সম্প্রদায় যেন অনুরূপ বিপদে না পড়েন। অতএব আপনি অবশ্যই তাঁর সঙ্গে কোন কথাবার্তা বলবেন না, কিংবা তাঁর কোন কথাও শুনবেন না।’
  তুফাইল যেভাবে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছে, ‘আল্লাহর শপথ! তাঁরা আমাকে বারবার বুঝাতে থাকল এবং এ প্রেক্ষিতে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমি তাঁর কোন কথা শ্রবণ করব না, তাঁর সঙ্গে কোনরূপ কথাবার্তাও বলব না। এমনকি আমি যখন মসজিদুল হারামে গেলাম তখন কানের ভিতরে খানিকটা তুলো প্রবেশ করিয়ে নিলাম যাতে তাঁর কোন কথা আমাদের কর্ণগোচর না হয়অতঃপর আমি সকাল সকাল মাসজিদুল হারামে উপস্থিত হলাম, সে সময় তিনি(সাঃ) কা‘বাহর সম্মুখে সালাত আদায় করছিলেন। যা হোক আমি তাঁর নিকটেই দাঁড়ালাম। হয়তো এটাই আল্লাহর ইচ্ছে ছিল যে, তাঁর কথা আমাকে শুনতে হবে। ফলে খুব ভালভাবেই আমি তাঁর কথাবার্তা শুনতে পেলাম। তারপর আমি মনে মনে বললাম, হায়! আমার সর্বনাশ হোক! আল্লাহর শপথ! আমি তো প্রভুর কৃপায় একজন বুদ্ধিমান মানুষ এবং কবি। আমার নিকট ভালোমন্দ গোপন থাকবে না, তবে কেন আমি সে ব্যক্তির কথা শুনব না? যদি তাঁর কথাবার্তা ভালো হয় তা গ্রহণ করে নিব, যদি মন্দ হয় ছেড়ে দিব। এ সব কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমি থেমে গেলাম এবং যখন তিনি বাসায় ফেরার জন্য পথ ধরলেন তখন আমিও তাঁর পিছনে চললাম।
  পথ চলতে চলতে গিয়ে তিনি গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমিও প্রবেশ করলাম এবং আমার আগমনের উদ্দেশ্য, কুরাইশগণের আমাকে ভয় দেখানো, তাঁর কথাবার্তা না শোনার জন্য শ্রবণ পথে তুলা দিয়ে রাখা, তা সত্ত্বেও তাঁর কথাবার্তা শ্রবণ করা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তাঁর কাছে বর্ণনা করলাম। তারপর বললাম, ‘আপনার বক্তব্য এখন পেশ করুন।’
  তিনি আমার নিকট ইসলামের কথা পেশ করলেন এবং কুরআন মাজীদ থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শোনালেন। আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষী আছেন। এর চেয়ে উত্তম কথা ও ইনসাফের বাণী ইতোপূর্বে আমি আর কক্ষনো শ্রবণ করি নি। কুরআনুল মাজীদের বাণী এবং তাঁর বক্তব্যের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে আমি তখনই ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করলাম। তারপর এ কথা বলে তাঁর নিকট আরয করলাম যে, ‘আমার সম্প্রদায় আমার কথা মান্য করে। আমি তাদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করব। অতএব, আপনি আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু‘আ করবেন যেন তিনি অনুগ্রহ করে আমাকে কোন নিদর্শন প্রদান করেন।’ এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আল্লাহর সমীপে দু‘আ করলেন।
  রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর দু‘আর বরকতে তুফাইলকে যে নিদর্শন দেয়া হয়েছিল তা ছিল, যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলেন তখন তাঁর মুখমন্ডল ছিল প্রদীপের আলোর মত আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু তাঁর মানসিক কিংবা অন্য কোন অসুবিধার প্রেক্ষিতে তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ মুখমন্ডলের পরিবর্তে অন্য কোন স্থানে এ নিদর্শন প্রকাশিত হোক। আমার ভয় হয় মানুষ তাকে বিকৃত বলবে। ফলে এ জ্যোতি তাঁর লাঠিতে প্রত্যাবর্তিত হয়েছিল। এরপর তিনি তাঁর পিতা ও স্ত্রীকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন এবং উভয়েই তা গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যান। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরা ইসলাম গ্রহণে যথেষ্ট বিলম্ব করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ফলে দেখা যায় যখন তিনি খন্দকের যুদ্ধের পর হিযরত করেন তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর সম্প্রদায়ের ৭০টি থেকে ৮০টি গোত্রের লোক ছিল। তুফাইল(রাঃ) ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সাধন করে ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন।
  ৫. যিমাম আযদীঃ তিনি ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী এবং আযদে শানূওয়াহ গোত্রের এক ব্যক্তি। তাঁর কাজ ছিল মানুষের অসুখ বিসুখের ক্ষেত্রে ঝাড় ফুঁক করা এবং প্রেতাত্মা দূরীভূত করা। মক্কায় আগমনের পর ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে পরস্পর অবগত হলেন যে, মুহাম্মদ(সাঃ) একজন পাগল। তারা তাঁকে তাঁর নিকট যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি এ ভেবে চিন্তে তাঁর নিকট যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আল্লাহ যদি চান তাহলে তিনি তাঁর হাতে সুস্থ হতেও পারেন। কাজেই তিনি রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘আমি প্রেতাত্মা ভালো করার জন্য ঝাড়ফুঁক করে থাকি। আপনার কি সেরূপ কোন প্রয়োজন আছে।’ উত্তরে তিনি বললেন,
  অর্থঃ অবশ্যই সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করছি এবং তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। যাকে আল্লাহ সৎপথ দেখান তিনি পথভ্রষ্ট হন না এবং যাকে তিনি বিপথে চালিত করেন তাকে কেউই সৎপথে চালিত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনই ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনই অংশীদার নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ(সাঃ) আল্লাহর রাসূল এবং বান্দা।
  তারপর যিমাদ বললেন, আপনার কথাগুলো পুনরায় বলুন, আমি শুনি। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) পুনরায় একাদিক্রমে তিন বার অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। এ কথা শ্রবণে ভাবগদগগদ যিমাদ বললেন, ‘আমি জ্যোতিষ, যাদুকর এবং কবিদের কথাবার্তা শুনেছি কিন্তু আপনার কথার মতো এত চিত্তোদ্দীপক ও হৃদয়স্পর্শী কথাবার্তা কখনই শুনিনি। গভীরতম সমুদ্রের তলদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহা প্রবাহের মতো এ আমার অন্তরের গভীরতম প্রদেশকে ভাব ও আবেগ আন্দোলিত এবং উচ্ছ্বসিত করে তুলছে।’
  তারপর তিনি নাবী কারীম(সাঃ)-এর দিকে অত্যন্ত ভক্তিভরে হাত বাড়িয়ে কম্পিত কন্ঠে বললেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ(সাঃ)! আপনি এ হাত গ্রহণ করে ইসলামের প্রতি আমার আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করুন। যিমাদ এভাবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

ইয়াসরিবের (মদীনার) ছয়টি পূণ্যবান আত্মাঃ
  একাদশ নবুওয়াত বর্ষে (জুলাই ৬২০ খৃষ্টাব্দে) হজ্জ্বের মৌসুম ফিরে এলো। ইসলামী দাওয়াতের কয়েকটি কার্যকরী বীজ হস্তগত হল যা দেখতে দেখতে বিরাট বৃক্ষে পরিণত হল। এর ঘন শাখা প্রশাখা ও পত্র পল্লবের সুশীতল ছায়ায় বসে মুসলিমগণ বহু বছরের অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের উত্তাপ থেকে কিছুটা আরামও শান্তি পেলেন।
  মক্কাবাসী মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার এবং লোকজনকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখার জন্য প্রতিবন্ধকার যে দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছিল তা এড়িয়ে চলার জন্য রাসূলুল্লাহ(সাঃ) তাঁর স্ট্রাটেজী বা কর্ম কৌশল পরিবর্তন করে নিলেন। মুশরিকরা যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে তদুদ্দেশ্যে দিবা ভাগের পরিবর্তে তিনি রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গোত্রের নিকট যাতায়াতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকেন।
  এ কর্মকৌশল বা পদ্ধতির অনুসরণে একরাত্রি রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আবূ বাক্‌র(রাঃ) ও ‘আলী(রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বনু যুহ্‌ল ও বনু শায়বান বিন সা‘লাবাহগণের বাসস্থানের নিকট দিয়ে যাবার সময় ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বললেন। আলাপ আলোচনার সময় তাদের সাড়া খুব অনুকূল বলে মনে হলেও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তমূলক কোন কিছুই তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গেল না। এ সময় আবূ বাক্‌র(রাঃ) ও বনু যুহলের এক ব্যক্তির সঙ্গে বংশ পরম্পরা সম্পর্কে খুব হৃদ্যতাপূর্ণ কথাবার্তা হল। উভয়েই বংশধারা সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন।             (শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ ১৫০-১৫২পৃঃ)
  এরপর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) সঙ্গীদের নিয়ে মিনার ঢাল দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় অদূরে কিছু সংখ্যক লোকের কথোপকথন তাঁর শ্রুতিগোচর হল।(রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮৪ পৃঃ) কাজেই, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তিনি সে দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের নিকট পৌঁছলেন। এ দলে ছিলেন ইয়াসরিবের খাযরাজ গোত্রের ছয় জন যুবক। তাঁদের নাম হল যথাক্রমেঃ
  (১) আস‘আদ বিন যুরারাহ,         (বনু নাজ্জার গোত্রের)
  (২) ‘আওফ বিন হারিস বিন রিফা‘আহ  (বনু নাজ্জার গোত্রের)                 (ইবনে ‘আফরা-),
  (৩) রাফি‘ বিন মালিক বিন আজলান,  (বনু যুরাইক্ব গোত্রের)
  (৪) কুত্ববা বিন ‘আমির বিন হাদীদাহ,  (বনু সালামাহ গোত্রের)  
  (৫) ‘উক্ববাহ বিন ‘আমির বিন নাবী,  (বনু হারাম বিন কা‘ব গোত্রের)     
  (৬) হারিস বিন আবদুল্লাহ বিন রিআব। (বনু ‘উবাইদ বিন গান্‌ম গোত্রের)
  এটা ইয়াসরিববাসীগণের সৌভাগ্য যে, তাঁরা তাঁদের মিত্র ইহুদিদের নিকট থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, এ যুগে একজন নাবী প্রেরিত হবেন এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। ইহুদীরা বলতেন যে, ‘আমরা তাঁর অনুসারী হয়ে তাঁর সঙ্গে তোমাদেরকে ইরম ও ‘আদদের মতো হত্যা করব।   (যা‘দুল মা‘আদ ২য় খন্ড ৫০ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৯ ও ৫৪১ পৃঃ।)
  রাসূলুল্লাহ(সাঃ) চলতে চলতে তাঁদের নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা খাযরাজ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ তিনি বললেন, ‘অর্থাৎ ইহুদীদের মিত্র?’ তাঁরা বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘আপনারা বসুন না, কিছু কথাবার্তা হোক।’
  রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর এ কথা শ্রবণের পর তাঁরা বসে পড়লেন। তিনি তাঁদের সম্মুখে ইসলামের হাক্বীকত বর্ণনা করার পর কুরআন মাজীদ থেকে তেলাওয়াত করে শোনালেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত পেশ করলেন।
  রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর থেকে দাওয়াত লাভের পর তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, ‘ইনিতো সেই নাবী বলে মনে হচ্ছে যাঁর উল্লেখ করে ইহুদীগণ তোমাদেরকে ধমকাচ্ছে। কাজেই ইহুদীগণ যেন তোমাদেরকে পিছনে ফেলতে না পারে।’ এ কথা বলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ ইসলামের দাওয়াত কবূল করে মুসলিম হয়ে গেলেন।
  এঁরা ইয়াসরিবের জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। সাম্প্রতিককালে ইয়াসরিবে যে যুদ্ধ হয়ে গেল এবং যার ধোঁয়া এখনো ইয়াসরিবের আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, যুদ্ধ তাঁদেরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে। এ জন্য তাঁরা আশা করেছিলেন যে, ইসলামের এ দাওয়াতই এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর একটা সূত্র হতে পারে। এ জন্য তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এমন এক অবস্থায় রেখে এসেছি যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে এমন শত্রুতা ও দুশমনীর সৃষ্টি হয়েছে, যার কোন নজির নেই। আশা করি আপনার দাওয়াতই তাদেরকে একত্রিত করে দিবে। আমরা সেখানে ফিরে গিয়ে লোকেদের আপনার কাজের প্রতি আহ্বান জানাব এবং আপনার দাওয়াতের কারণে আল্লাহ যদি তাঁদের একত্রিত করে দেন তবে আপনার চেয়ে অধিক আর কেউ সম্মানিত হবে না।

  এরপর তাঁরা যখন মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন তখন সেই সঙ্গে ইসলামের সংবাদ ও পয়গাম নিয়ে গেলেন। যার ফলে সেখানে ঘরে ঘরে রাসূল(সাঃ)-এর দাওয়াত প্রসার লাভ করল। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৮ ও ৪৩০ পৃঃ)

______
তথ্যসূত্র: আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ১৭৬-১৮৩

Post a Comment