ইসলামের দৃষ্টিতে নারী

সমাজে নারীর অবস্থান যখন ছিল অমানবিক এবং অতি করুণ তখন থেকেই ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা উন্নয়নের জন্য নজীরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে। সে সকল পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

(ক) নারী সম্মানিত সৃষ্টি:

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ অতীব সম্মানিত ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম জন্মগতভাবে মানুষকে এ মর্যাদা দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘‘আর নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি’’। [সূরা আল-ইসরা/বনী ইসরাইল: ৭০]

বস্তুত মানুষ সম্পর্কে ইসলামের এ ঘোষণা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই সমানভাবে শাশ্বত ও চিরন্তন। মানবিক সম্মান ও মর্যাদার বিচারে নারী ও পুরুষের মাঝে কোনই পার্থক্য নেই। নারীকে শুধু নারী হয়ে জন্মাবার কারণে পুরুষের তুলনায় হীন ও নীচ মনে করা সম্পূর্ণ জাহেলী ধ্যান-ধারণা, এরূপ চিন্তাভাবনা ইসলাম স্বীকার করে না। অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে নারী হচ্ছে মহান স্রষ্টা আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি।


(খ) ঈমান ও আমলই নারী-পুরুষের মর্যাদা নির্ণয়ের সঠিক মাপকাঠি:

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা সুস্থ চিন্তা ও সঠিক কর্মের সাথে সম্পৃক্ত। যে আদর্শ ও মতবাদ নারীকে শুধু নারী হওয়ার কারণে নীচু ও লাঞ্ছনার যোগ্য মনে করে, মানবতার উচ্চ আসন থেকে দূরে নিক্ষেপ করে এবং পুরুষকে শুধু পুরুষ হওয়ার কারণে উচ্চতর আসনের উপযুক্ত মনে করে, ইসলাম তাকে জাহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসলাম পরিস্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, মর্যাদা লাঞ্ছনা এবং মহত্ত্ব ও নীচতার মাপকাঠি হলো তাকওয়া-পরহেযগারী এবং চরিত্র ও নৈতিকতা। এ মাপকাঠিতে যে যতটা খাঁটি প্রমাণিত হবে মহান আল্লাহর কাছে সে ততটাই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে। আল্লাহ বলেন,

‘‘পুরুষ বা নারীর মধ্য থেকে যে-ই ভালো কাজ করলো সে ঈমানদার হলে আমি তাকে একটি পবিত্র জীবন যাপন করার সুযোগ দেব এবং তারা যে কাজ করছিল আমি তাদেরকে তার উত্তর পারিশ্রমিক দান করব।’’ [ সূরা আন-নাহল: ৯৭]

আল্লাহ আরো বলেন,

‘‘তাদের রব তাদের দো‘আ কবুল করলেন এ মর্মে যে, পুরুষ হোক বা নারী হোক তোমাদের কোনো আমলকারীর আমল আমি নষ্ট করব না।’’ [সূরা আলে-ইমরান: ১৯৫]

অর্থাৎ মানব জাতির দু’টো শাখার মধ্য হতে যে-ই কর্মের পবিত্রতার দ্বারা তারা আমলনামা উজ্জ্বল করবে, আল্লাহর কাছে মর্যাদা ও সফলতার প্রাপ্তি ঘটবে তারই। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বহু নারী ঈমান ও আমলে বহু পুরুষকে ছাড়িয়ে গেলে নিঃসন্দেহে তারা সে সব পুরুষের চেয়ে মর্যাদাবান বিবেচিত হবেন।

(গ) নারী ও পুরুষ উভয়ই সভ্যতার নির্মাতা:
আল-কুরআন আল-কারীমের বক্তব্য থেকে এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত যে, জীবনের সবরকমের তৎপরতা ও উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে সর্বদাই নারী ও পুরুষ পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে। উভয়ে মিলে জীবনের কঠিন ভার বহন করেছে এবং উভয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সভ্যতা ও তামাদ্দুনের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। আল্লাহ বলেন,

‘‘আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে।’’ [সূরা আত-তাওবাহ: ৭১]

(ঘ) নারী সম্পর্কে ভুল দৃষ্টিভঙ্গির অপনোদন:
ইসলাম আগমনের পূর্বে গোটা দুনিয়া নারী জাতিকে একটি অকল্যাণকর তথা সভ্যতা ও তামাদ্দুনের জন্য অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে কর্মক্ষেত্র থেকে অপসারিত করেছিল। তাকে অধঃপতনের এমন এক অন্ধকার গুহায় নিক্ষেপ করেছিল যেখান থেকে তার উন্নতি ও ক্রমবিকাশের আশা করা ছিল বাতুলতা মাত্র। দুনিয়ার এ আচরণের বিরুদ্ধে ইসলাম উচ্চ কন্ঠে প্রতিবাদ করে বললো যে, গতিশীল জীবন নারী ও পুরুষের উভয়ের মুখাপেক্ষী। নারীকে এ জন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে, সে ধাক্কা খেতে থাকবে এবং তাকে জীবনের রাজপথ থেকে তুলে কাঁটার মত দূরে নিক্ষেপ করা হবে। কারণ পুরুষকে সৃষ্টি করার যেমন একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে তেমনি নারীকে সৃষ্টিরও একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। মানুষের এ দু’টো শ্রেণী দিয়ে আল্লাহ অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করেছেন,

‘‘আসমানসমূহ ও যমীনের মালিকানা আল্লাহরই, তিনি যা চান তা-ই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা তাকে কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা পুত্র-কন্যা উভয় প্রকার সন্তান দান করেন, আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন।’’ [সূরা আশ-শুরা: ৪৯–৫০]

ইসলাম নারী জাতিকে লাঞ্ছনা ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে দ্রুততার সাথে উঠিয়ে এনে এমনই অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে কথা বলতে এবং প্রাণ খুলে মেলামেশা করতেও ভয় পেতাম, এ ভেবে যে, আমাদের সম্পর্কে কোনো আয়াত যেন নাযিল না হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর আমরা প্রাণ খুলে তাদের সাথে মিশতে শুরু করলাম।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫১৮৭]

এ নির্যাতিত শ্রেণীটির বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। আল-কুরআন বললো যে, না, তারাও জীবিত থাকবে এবং যে ব্যক্তিই তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে, মহান আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

‘‘আর যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’’ [সূরা আত-তাকভীর: ৮,৯]

আব্দুল্লাহ ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‘‘যে ব্যক্তির কন্যা সন্তান আছে, আর যে তাকে জ্যান্ত কবরস্থ করে নি কিংবা তার সাথে লাঞ্ছনাকর আচরণ করে নি এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার দেয় নি, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’’ [সুনান আবু দাউদ, হাদীস নম্বর: ৫১৪৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,

‘‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন পালন করেছে, তাদেরকে উত্তম আচরণ শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সাথে সদয় আচরণ করেছে সে জান্নাত লাভ করবে।’’ [সুনান আবু দাউদ, হাদীস নম্বর: ৫১৪৯]

নারীদের প্রতি কোমল ব্যবহারের গুরুত্ব প্রকাশ করছে কুরআনের নিম্নোক্ত নির্দেশ,

‘‘আর নারীদের সাথে সদয় আচরণ কর।’’ [সূরা আন-নিসা: ১৯]

এক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ উটের পিঠে সফর করছিলেন। স্ত্রীদের কাঁচের সাথে তুলনা করে তিনি বললেন,

‘‘কাঁচগুলোকে (স্ত্রীদেরকে) একটু দেখে শুনে যত্নের সাথে নিয়ে যাও।’’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬১৮২]

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নারী জাতি সম্পর্কে ইসলাম মানুষের মধ্যে যে মেজাজ, আবেগ ও সহানুভূতি সঞ্চার করতে চেয়েছে তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।

1 تعليقات

إرسال تعليق

أحدث أقدم