বিতর্ক : কখন, কোথায়, কিভাবে ?


(সূরা আল কাসাস, ২৮:৫৫) "অবাঞ্ছিত কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।"

(সূরা আল ফুরকান, ২৫:৬৩) "রহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম।"

(সূরা আন নাহল, ১৬:১২৫) "আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সহকারে, এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনি ভালো জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।"

(সূরা আনকাবুত, ২৯:৪৬) "তোমরা কিতাবধারীদের সাথে তর্ক বিতর্ক করবে না, কিন্তু উত্তম পন্থায়; তবে তাদের সাথে নয়, যারা তাদের মধ্যে বে-ইনসাফ। এবং বলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য একই এবং আমরা তাঁরই আজ্ঞাবহ।"

জানিনা এই লেখাটি কতটুকু কার্যকরী হবে, তবুও একপ্রকার দায়িত্ববোধ থেকে লিখছি।

ফেসবুকে এবং বাস্তবে, এই দুই জায়গাতেই ইসলাম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নানারকম তর্ক-বিতর্ক ঘটতে দেখি। যারা একাজে খুব পটু; ইসলাম সংক্রান্ত নিজের জ্ঞান ও মতামতকে দৃঢ়ভাবে ডিফেন্ড করেন এবং অনলাইন-অফলাইনে প্রচুর বিতর্ক করেন, তাদের হয়তো আমার এই বক্তব্য ভালো লাগবে না। কারণ আমি সেই বিতর্কের স্কোপ নিয়ে আলোচনা করছি।

নাস্তিকের সাথে আস্তিকের ঘন্টার পর ঘন্টা ডিবেইট; এমনকি দিনের পর দিন কিংবা মাস-বছর পর্যন্ত দেখা যায়, দুইজন আস্তিক ও নাস্তিক বিতর্কে লিপ্ত (বিশেষতঃ অনলাইনে)।

মুসলমান ও অন্য ধর্মের ব্যক্তিদেরও দেখা যায় দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ দিন যাবৎ বিতর্ক করতে। আর মুসলমানদের মাঝে দুর্ভাগ্যক্রমে যেসকল দ্বন্দ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো নিয়েও প্রচুর তর্ক-বিতর্ক ছড়িয়ে আছে অনলাইন ও অফলাইন দুনিয়ায়।


আমি মূলত ইসলাম বিষয়ে সংঘটিত বিতর্কগুলোর ব্যাপারেই বলছি। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞার সাথে নির্ধারণ করতে হবে, কোন ক্ষেত্রে বিতর্ক করা সঙ্গত ?

স্থান, কাল, পাত্র ও বিষয় ভেদে বক্তব্যের বিষয়বস্তু ও বক্তব্যের ধরণকে বদলানোই হলো art of speaking, বা কথা বলার আর্ট। বিস্তারিত ব্যাখ্যার পূর্বেই যদি বলি, তবে বিতর্কের স্কোপ মোটামুটি এতটুকু হওয়া উচিত, অর্থাৎ এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রাখা উচিত :

১. আমি যেভাবে বিতর্ক করবো, সেটা তাকে সত্য পালন করতে সহায়তা করবে, নাকি আরো ভ্রান্তির মধ্যে ডুবিয়ে দেবে?
২. আমি যেখানে বিতর্ক করবো, সেটিই কি বিতর্ক করার উপযুক্ত স্থান ? শত শত মানুষের সামনে বিতর্ক করে কারো মতামতকে ভুল প্রমাণ করলে যদি সে অপমানিত বোধ করে, তবে সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে নাতো ?
৩. যার সাথে বিতর্ক করছি, সে সত্য গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে এসেছে, নাকি জেনে-শুনে মিথ্যার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে?
৪. বিতর্ক করার মাধ্যমে আরেকজনকে সত্য মানানো আমার পক্ষে কতটুকু বাধ্যতামূলক / জরুরী / লাভজনক ?
৫. প্রকাশ্যে বিতর্ক-ই কি এক্ষেত্রে উপযুক্ত, নাকি বিতর্কটি ব্যক্তিগতভাবে হওয়া উচিত ?
৬. যার সাথে বিতর্ক করছি, সে আমার প্রতি কী ধরণের মনোভাব পোষণ করে ? আমি অপাত্রে যুক্তি ঢালছি নাতো ?
৭. এই ব্যক্তির সাথে বিতর্ক করাই উত্তম, নাকি তাকে একটিমাত্র বক্তব্যের দ্বারা আমার যুক্তি, মতামত ও সত্যটি জানিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ?
৮. বিতর্ক না করে কোনো ব্যক্তিকে শুধু সত্য জানানো, নাকি একজনের পিছে লেগে থেকে বারবার একই বা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করে যাওয়া – কোনটি আমাদের আদর্শ পুরুষদের (নবী-রাসূলগণের) অনুসৃত পদ্ধতি ?
৯. যার সাথে বিতর্ক করছি, সে এই বিষয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে জ্ঞানগত দিক থেকে আমার সমান লেভেলের তো ? আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানীর কাছ থেকে আমি বিনা বিতর্কে জ্ঞান গ্রহণ করবো এবং আমার চেয়ে কম জ্ঞানীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে আমি তাকে কেবল জ্ঞানের কথাটি জানাবো।
১০. যার সাথে বিতর্ক করছি, সে কোন নিয়তে বিতর্ক করছে ? সে কি “আমাকে জিততেই হবে” এই নিয়তে বিতর্ক করছে, নাকি বিনা উত্তেজনায় শুধুমাত্র “সত্যের প্রচার” কিংবা “সত্যের উন্মোচন” এর উদ্দেশ্যে বিতর্ক করছে ?
১১. যার সাথে বিতর্ক করছি, সে বিতর্কের মৌলিক নিয়মাবলী মেনে চলছে কিনা ? সে আমাকে বিভিন্ন ফ্যালাসিতে (অপযুক্তিতে) টেনে ধরবে নাতো ? (যেমন, একটার পর একটা বিষয় অসমাপ্ত-অমীমাংসিত রেখে নতুন বিষয়ে চলে যাওয়া, ইত্যাদি।)
১২. যেকোনো ক্ষেত্রেই অশালীন ভাষা, গালিগালাজ, অশোভন কথাবার্তা নষ্ট করে দেবে যুক্তি দৃঢ়তাকে।
১৩. সর্বোপরি, আমি কেনো বিতর্ক করবো ? পূর্ববর্তী বিতর্কগুলোতে কি সফল হয়েছি (সর্বসমক্ষে যুক্তিতে জেতা অর্থে সফল নয়, বরং অন্যের হৃদয় জয় করা অর্থে সফল হওয়া।)? ভবিষ্যৎ যুক্তিতর্কেও কি প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারবো, নাকি আগের মতোই শুধু কথায় জিতবো, কিন্তু হৃদয় জয় হবে না ?
১৪. অপরের হৃদয় জয় করতে হলে নিছক যুক্তি-তর্কের পাশাপাশি কথা বলার আর কী কী কৌশল ব্যবহার করা প্রয়োজন, যা জ্ঞানের পাশাপাশি আমাকে প্রজ্ঞা দান করবে ?

শুরুতে কোরআনে কিছু আয়াত উদ্ধৃত করেছি, যা থেকে সামষ্টিকভাবে এই পয়েন্টগুলোয় উপনীত হয়েছি। সর্বাগ্রে লক্ষ্যনীয় হলো, সূরা আল কাসাস এ (২৮:৫৫) আল্লাহ তায়ালা উপদেশ দিয়েছেন অজ্ঞদের সাথে জড়িত না হতে। সুতরাং, বিতর্ক তো দূরের কথা, অজ্ঞদের সাথে যেকোনো ধরণের কথা বলার ক্ষেত্রেই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, এবং কোনোভাবেই তাদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত না। কারণ তারা আমাকে তার নিচু লেভেলে টেনে নামানোর চেষ্টা করবে, এবং সেই লেভেলে নামিয়ে অশোভন, অশালীন ও ফ্যালাসিপূর্ণ কথা দ্বারা আমাকে আঘাত করবে।

অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়গুলো মাথায় না থাকার কারণে স্থান-কাল-পাত্র-বিষয় ভেদ না করে যত্রতত্র তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হন। এক্ষেত্রে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যে জিনিসটার অভাবে গোটা বিতর্কই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তা হলো প্রজ্ঞা। আর বিতর্কের ক্ষেত্রে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করতে হলে কথা বলার শিল্পী হতে হবে, অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য করে কথা উপস্থাপন করতে হবে। তা না করে আমি কেবল ধারালো অস্ত্র চালনার মত কঠোর সব যুক্তি উপস্থাপন করে ময়দানের (সভার) সকলকে ধরাশায়ী করে বিজয়ীর বেশে ফিরে এলাম – কিন্তু ফলাফল কী ? ফলাফল শূন্য। অথচ বিতর্ক হতে হবে এমন, যেখানে উভয়ের মাঝেই সুসম্পর্ক রয়েছে, উভয়ের বিনা অহংকারে সত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত, এবং উভয়েই উত্তেজিত না হয়েই এবং কোনোরূপ ফ্যালাসিতে অবতীর্ণ না হয়েই যুক্তির আদান-প্রদানের মাধ্যমে উভয়ের ভুল-ত্রটি দূর করতে কিংবা কোনো বিষয়ে সত্যে পৌঁছাতে চান। অর্থাৎ, বিতর্কের স্কোপ আসলে খুবই সীমিত। এটি হওয়া উচিত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ীদের মাঝে (সূরা আল ফুরকান, ২৫:৬৩)। বিতর্ক হওয়া উচিত জ্ঞানগত দিক থেকে সমস্তরের মানুষের সাথে (সূরা আল কাসাস, ২৮:৫৫)। অর্থাৎ শুধু জ্ঞান থাকলে চলবে না, বক্তব্যে থাকতে হবে প্রজ্ঞার চিহ্ন(সূরা আন নাহল, ১৬:১২৫)। বিতর্কের সর্বোত্তম পন্থাটি কী, যে পন্থাটি অনুসরণ করতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-অনুসন্ধান করতে হবে, এবং সত্য প্রচারসহ কথা বলার সকল ক্ষেত্রেই নবীর সেই “উত্তম পন্থাটি” অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে। অতঃপর কেউ সত্য গ্রহণ করলো কি না করলো, তা আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রত্যেককেই নিজের হিসাব দিতে হবে, এবং অপরের ভুলের জন্য আমি দায়ী হবো না। সুতরাং আমার দায়িত্ব কেবল একটিবার সত্যকে পৌঁছে দেয়া, অতঃপর আল্লাহ তো জেনে নিয়েছেন কে উত্তম পন্থায় মানুষকে সত্যের পথে ডেকেছে, এবং কে ভুল পথে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেছে (সূরা আন নাহল, ১৬:১২৫)।

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ মুসলমানের দায়িত্ব বটে (আল কুরআন, ৩১:১৭), কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন পাপ ও ভুল হতে মুক্ত থেকে পূত-পবিত্র জীবন যাপন করা, দুনিয়ার এই পরীক্ষাক্ষেত্রে উতরে যাওয়া। অপরকে সৎপথে আনার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি নিজেকে সৎপথে প্রতিষ্ঠিত করা। আর মানুষকে সত্যের পথে আনার জন্য তো কুরআনই যথেষ্ট। তাই তর্ক বিতর্ককে যথাসম্ভব পরিহার করে কুরআনের চর্চা ও পাঠকে উৎসাহিত করাই উত্তম। আর নিতান্তই বিতর্ক প্রয়োজনীয় হয়ে পড়লে তা যেনো হয় উত্তম পন্থায় – যে উত্তম পন্থায় আমাদের আদর্শ পুরুষগণ সত্য প্রচার করেছেন।

লিখেছেন: নূরে আলম মাসুদ

Post a Comment

أحدث أقدم