ইসলামে নারীকে কোন মর্যাদা দেয়া হয় নি, উত্তরাধিকার সহ নানা ক্ষেত্রে নারীকে ইসলামে বঞ্চিত করা হয়েছে- এ মর্মে যখন সারা বিশ্বে বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তখনই খুবই বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, পশ্চিমা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশী সংখ্যক অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহন করছে। ফলে ইসলাম এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে (যা প্রায় ২৩৫%!!)। আরো অবাক করা বিষয় হলো, এত অপপ্রচার চালানোর পরও ইসলাম গ্রহনের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই বেশী এগিয়ে রয়েছেন।
ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা গণনা করাটা একটু সমস্যাই বটে। কারণ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের জরিপের সময় ধর্মান্তরিতদের তাদের আগের ধর্মের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। ব্রিটিশ মসজিদগুলোও ধর্মান্তরিতদের কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা সংরক্ষণ করে না।
অনেক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তাদের নতুন ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি তাদের বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে গোপনও রাখেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের ট্রিনিটি সেইন্ট ডেভিডের গবেষক কেভিন ব্রাইস বলেন, ‘মসজিদগুলোকে সরবরাহ করা প্রশ্নপত্র থেকে এ হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর অন্তত ৫ হাজার ২০০ ব্রিটিশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন এবং এখন পর্যন্ত এদের মোট সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।’ আমেরিকায়ও সংখ্যাটা প্রায় কয়েক লাখ।
এছাড়া বিভিন্ন ধর্মের উপর গবেষণা পরিচালনা করে এমন একটি সংস্থা “ফেইথ ম্যাটার” এর পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে যে, এসব মুসলিমের ৭৫ শতাংশই নারী এবং তাদের অধিকাংশের গড় বয়স হলো ২৭।
কিন্তু মিডিয়া এবং তথাকথিত নারীবাদী সংগঠনগুলোর এত প্রচার-প্রচারণার সত্ত্বেও দিন দিন কেন শিক্ষিত এবং আধুনিক নারীরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে?
নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম কারণ হলো, একমাত্র সত্য ধর্ম হিসেবে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা। এব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ খোদ আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালাই পৃথিবীতে ইসলামের বিজয় এবং প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা এখানে এই মূল কারণকে সামনে রেখে অন্যান্য যে সকল কারণ আমাদের নতুন মুসলিম বোনরা তাদের ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ করেছেন, সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কারণ পশ্চিমা মিডিয়া ইসলামের সুস্পষ্ট বিজয় সত্ত্বেও “তারা শুধুমাত্র তাদের মুসলিম বয়ফ্রেন্ডদের বিয়ে করার জন্যই ইসলাম গ্রহণ করে থাকে” ধরনের ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এটি সত্য যে, তাদের অনেকেই হয়তো কোন মুসলিম নামধারী পুরুষের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি ভাবে জ্ঞান অর্জনের পর তারা তাদের সেই মুসলিম সঙ্গীকেই ত্যাগ করেছেন যারা নিজেরাই ইসলাম পালন করতো না এবং ফলস্বরুপ এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
শুধুমাত্র একটি কারণই তাদের সব দম্ভ আর অপপ্রচারের জবাব দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আর তা হলো, ঘুণে ধরা পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা।
তেতাল্লিশ বছরের ক্রিস্টিন বেকার, প্রাক্তন এমটিভির উপস্থাপিকা যিনি এক সময়ে উদার পশ্চিমা স্টাইলের জীবন যাপন করেছেন, তিনি সেই জীবনকে ফিরিয়ে ইসলামের প্রতি অনুগত হয়েছেন। কারণ কি? তার জবাব, “আমার এক সময়কার কাঙ্ক্ষিত "যা খুশী" এই উদার সমাজ আজ আমার কাছে লেফাফা দুরস্ত এক শূন্যতা বলে প্রমানিত হয়েছে। আমার চাকুরীর কারণে আমি সারা দুনিয়া ঘুরি এবং রক স্টারদের ইন্টারভিউ নেই, তাতেও আমার অন্তরে শূন্যতা থেকে যায়। এখন, সবশেষে, আমি তৃপ্তি পেয়েছি কারন ইসলাম আমাকে জীবনের অর্থ দান করেছে।”
“পশ্চিমে আমরা সবসময়ই কৃত্রিম কারণে ক্লান্ত হয়ে থাকি, যেমন, কি ড্রেস পড়ব। ইসলামে সবার লক্ষ্য উঁচু গন্তব্যের দিকে। সবকিছুই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়ে থাকে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা মূল্যবোধের জীবন। আমার এই লাইফস্টাইল সত্ত্বেও আমি ভেতরে শূন্যতা অনুভব করেছি এবং অনুভব করতে পেরেছি মুসলিম হওয়াটা কতটুকু স্বাধীনতার বিষয়। শুধু মাত্র একজন বিধাতার অনুসরণে জীবনকে পবিত্র করার মাধ্যমে। তুমি সমস্ত ক্রেজের পিছনে ছুটছ না।”
“আমি জার্মানীতে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে বড় হই, যারা খুব ধার্মিক ছিল না। আমি ড্রিংক করতাম এবং পার্টিতে যেতাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমাদেরকে ভাল হয়ে চলতে হবে কারণ পরকাল রয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের কর্মের জন্য দায়ী।”
এসেক্সের ডেগেনহামের ৩১ বছর বয়েসী লিন আলী স্বীকার করেছেন যে তিনি ছিলেন টিপিক্যাল পার্টি লাভিং টিন এজার। তিনি বলেন, “আমি বাইরে যেতাম এবং বন্ধুদের সাথে মাতাল হতাম, শরীর প্রকাশকারী কাপড় পরতাম এবং ছেলেদের সাথে ডেট করতাম। আমি পার্ট টাইম কাজ করতাম তবে মূলত ক্লাবেই কাটাতাম। খ্রিষ্টান হিসেবে আমি কিছুটা প্রার্থনা করতাম তবে আমি গডকে একজন ডাক্তার হিসেবেই নিয়েছিলাম আমার জীবনের সমস্যাগুলো ঠিক করার জন্যে। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি জবাব দিতাম আমি ফাস্ট লাইফ এনজয় করি।”
“কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন এক বোন আমাকে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দিল এবং তা যেন আমার জীবনের সাথে খাপে খাপে মিলে গেল। আমি জানি, সব কিছুর উপরে রয়েছে আমার নিজের অনুসন্ধিৎসা। আমি জীবনে যা খুজছিলাম তা হার্ড ড্রিংকিং পার্টি স্টাইল দিয়ে পূরণ হচ্ছিল না।” লিন ১৯ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।
আজকের ঘুণে ধরা সমাজে জীবনের সব ক্ষেত্র থেকে নারী এবং বৃদ্ধদের প্রতি প্রথাগত শ্রদ্ধা কমে যাওয়ায় অনেকে দুঃখবোধ করেন। এই মূল্যবোধগুলো প্রতিফলিত হয়েছে কুরআনে যা মুসলিমদের মেনে চলতে হয়।
এই মূল্যবোধই কর্নওয়ালের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়েসী ইয়োগা শিক্ষিকা ক্যামিলা লেল্যান্ডকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছে। দুই বছর বয়েসী কন্যা ইনায়ার সিঙ্গল মাদার ক্যামিলা নারীবাদী এবং বুদ্ধিবাদী মনোভাবের কারনে মধ্য বিশের দিকে ইসলাম গ্রহন করেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি নারীবাদী এবং ইসলাম - এ দুটো শব্দের একত্র উচ্চারণে মানুষ বিস্মিত হবে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে ইসলাম নারীকে সমতা দিয়ে থাকে এবং সেটা যে সময়ে এই ধর্ম জন্ম নিয়েছিল সেই সময়কার পুরুষতান্ত্রিক ধারণার বিপরীত।”
“মানুষ ভুল করে সংস্কৃতিকে ধর্মের সাথে গুলিয়ে। হ্যাঁ, অনেক মুসলিম সমাজে নারীদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই, কিন্তু আমি যখন বড় হই তখন পশ্চিমা সমাজ দিয়ে আরো নির্যাতিত বোধ করি।”
তিনি বলেন, “নারীদের উপর অব্যাহত চাপ রয়েছে ড্রিংক এবং সেক্সের ক্ষেত্রে পুরুষের মত আচরণ করার। এর সত্যিকার কোন মানে নেই। ইসলাম অনুযায়ী, তুমি যদি কোন সম্পর্ক শুরু করো তবে তা হৃদয়ের প্রতিশ্রুতি।”
অনেক নারীবাদী আবার অভিযোগ করে থাকেন যে, তাদের ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে। কিন্তু এই অভিযোগ নিতান্তই হাস্যকর। তাদের দাবি অনুযায়ীই যদি পশ্চিমা নারীরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে থাকে, তবে কোন যুক্তিতে এই অভিযোগ উত্থাপন করা যায় যে, এসব নারীদের ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে আর তারা নির্দ্বিধায় তা মেনে নিচ্ছে!!
তাছাড়া ইসলাম গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলিম নারীই বলেছেন যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করার আগে অনেকদিন যাবত এই বিষয়ে যথেষ্ট পড়ালেখা করে, বহু ভাবনা চিন্তার পর, তারপরই ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
অনেকে আবার ইসলামের বৈপ্লবিক এবং সংস্কারমূলক আহ্বানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সমপ্রতি ইসলাম গ্রহনকারী আমেরিকান নেত্রী মারিয়াম জামিলা (যিনি ইসলাম গ্রহনের পূর্বে মার্গারেট মার্কাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন) বলছিলেন, “খৃষ্টধর্মের প্রতি আমি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলাম। বিশেষত সারা সপ্তাহ কোন ধর্মীয় কাজ না করে মাত্র একদিন (রোববার) ঈশ্বরকে স্মরন করার কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার মত অনেকই এভাবে ক্রমশ তখন ধর্ম পালনের ব্যপারে নিরাসক্ত হয়ে পড়ছিল। তাছাড়া সমাজের নানা বাজে এবং মানবতা বিরোধী কমকান্ডের ব্যপারে গীর্জাগুলোর নিস্পৃহ আচরন আমাদের ভীষন অবাক করতো। আর সর্বোপরি ত্রিত্ব মতবাদ এবং যীশুর সংজ্ঞা নিয়েও নানা রকম সংশয় আমার ভেতরে জন্ম নিল। এরপর একসময় আমি ইসলাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করলাম। কুরআন পাঠ করে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ইসলাম শুধুমাত্র একটা ধর্ম বা শখের বিষয় নয়।
আমি আসলে কখনোই খৃষ্টধর্মের জটিল তত্ত্ব কিংবা নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের ক্রমাগত অধঃপতনের ব্যপারে গীর্জাগুলার নীরব ভূমিকা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাইবেল বা ইহুদী ধর্মগ্রন্থের তুলনায় কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো যে, কুরআন খুবই বৈচিত্রময় এবং এতে মানব জীবন ঘনিষ্ঠ সব সমস্যাবলীর সমাধান আলোচিত হয়েছে। এমনকি এতে অতীতের বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার উত্থান ও পতন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে যার বাস্তব সত্যতা আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখতে পাচ্ছি।”
ইসলাম গ্রহণের পর এখন কেমন আছেন তারা? তারা কি এত নিয়ম কানুন ভাল্লাগে না বলে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে গেছেন? অথবা আমাদের দেশের আধুনিকাদের মত কোন অজুহাতে হিজাব ছাড়াই চলাফেরা করছেন? আসুন তাদের মুখেই শুনি।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা তেতাল্লিশ বছর বয়েসী ব্রডকাস্টার এবং সাংবাদিক বুথ বলেছেন, তিনি যখনই বাড়ীর বাইরে যান তখনই হিজাব পরে মাথা ঢাকেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং যখনই পারেন তখনই মসজিদে যান।
লিন আলী মনে করেন সেই স্মরনীয় রাতের কথা, “আমি আমার বন্ধুর ২১তম জন্মদিনে একটি বারে যাই। আমি শালীন পোশাকে হিজাব পরা অবস্থায় ছিলাম। দেখতে পেলাম অন্যরা কি করে নিজেদের প্রদর্শনে ব্যস্ত। তারা ছিল মাতাল, প্রলাপকারী এবং সুড়সুড়ি মার্কা নাচ নিয়ে ব্যস্ত। এই প্রথম আমি আমার আগের জীবনকে একজন বহিরাগতের দৃষ্টিতে দেখলাম এবং বুঝলাম আমার আগের জীবনে আমার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি মুক্তি খুজে পেয়েছি। এই তো সত্যিকারের আমি, যে পাঁচ বার নামাজ এবং স্থানীয় মসজিদের ক্লাস নিয়ে সুখী। আমি আর এই ভেঙ্গে যাওয়া সমাজের দাসী নই।”
শেষ করছি মারিয়াম জামিলার অনুভূতি দিয়ে, “সার্বিকভাবে আমি দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারি, ইসলামই আমার অন্তরের চাহিদা পূরন করতে পেরেছে। ইসলামেই আমি সকল সত্য, ন্যায় আর সৌন্দর্যের সন্ধান পেয়েছি যা আমাকে একটি সুন্দর জীবন যাপনে এবং মৃত্যুর পরও সফলতা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া ও নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।”
______
কার্টেসি : সমকালীন ইসলামী ভাবনা
ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা গণনা করাটা একটু সমস্যাই বটে। কারণ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের জরিপের সময় ধর্মান্তরিতদের তাদের আগের ধর্মের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। ব্রিটিশ মসজিদগুলোও ধর্মান্তরিতদের কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা সংরক্ষণ করে না।
অনেক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তাদের নতুন ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি তাদের বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে গোপনও রাখেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের ট্রিনিটি সেইন্ট ডেভিডের গবেষক কেভিন ব্রাইস বলেন, ‘মসজিদগুলোকে সরবরাহ করা প্রশ্নপত্র থেকে এ হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর অন্তত ৫ হাজার ২০০ ব্রিটিশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন এবং এখন পর্যন্ত এদের মোট সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।’ আমেরিকায়ও সংখ্যাটা প্রায় কয়েক লাখ।
এছাড়া বিভিন্ন ধর্মের উপর গবেষণা পরিচালনা করে এমন একটি সংস্থা “ফেইথ ম্যাটার” এর পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে যে, এসব মুসলিমের ৭৫ শতাংশই নারী এবং তাদের অধিকাংশের গড় বয়স হলো ২৭।
কিন্তু মিডিয়া এবং তথাকথিত নারীবাদী সংগঠনগুলোর এত প্রচার-প্রচারণার সত্ত্বেও দিন দিন কেন শিক্ষিত এবং আধুনিক নারীরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে?
নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম কারণ হলো, একমাত্র সত্য ধর্ম হিসেবে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা। এব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ খোদ আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালাই পৃথিবীতে ইসলামের বিজয় এবং প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা এখানে এই মূল কারণকে সামনে রেখে অন্যান্য যে সকল কারণ আমাদের নতুন মুসলিম বোনরা তাদের ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ করেছেন, সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কারণ পশ্চিমা মিডিয়া ইসলামের সুস্পষ্ট বিজয় সত্ত্বেও “তারা শুধুমাত্র তাদের মুসলিম বয়ফ্রেন্ডদের বিয়ে করার জন্যই ইসলাম গ্রহণ করে থাকে” ধরনের ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এটি সত্য যে, তাদের অনেকেই হয়তো কোন মুসলিম নামধারী পুরুষের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি ভাবে জ্ঞান অর্জনের পর তারা তাদের সেই মুসলিম সঙ্গীকেই ত্যাগ করেছেন যারা নিজেরাই ইসলাম পালন করতো না এবং ফলস্বরুপ এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
শুধুমাত্র একটি কারণই তাদের সব দম্ভ আর অপপ্রচারের জবাব দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আর তা হলো, ঘুণে ধরা পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা।
তেতাল্লিশ বছরের ক্রিস্টিন বেকার, প্রাক্তন এমটিভির উপস্থাপিকা যিনি এক সময়ে উদার পশ্চিমা স্টাইলের জীবন যাপন করেছেন, তিনি সেই জীবনকে ফিরিয়ে ইসলামের প্রতি অনুগত হয়েছেন। কারণ কি? তার জবাব, “আমার এক সময়কার কাঙ্ক্ষিত "যা খুশী" এই উদার সমাজ আজ আমার কাছে লেফাফা দুরস্ত এক শূন্যতা বলে প্রমানিত হয়েছে। আমার চাকুরীর কারণে আমি সারা দুনিয়া ঘুরি এবং রক স্টারদের ইন্টারভিউ নেই, তাতেও আমার অন্তরে শূন্যতা থেকে যায়। এখন, সবশেষে, আমি তৃপ্তি পেয়েছি কারন ইসলাম আমাকে জীবনের অর্থ দান করেছে।”
“পশ্চিমে আমরা সবসময়ই কৃত্রিম কারণে ক্লান্ত হয়ে থাকি, যেমন, কি ড্রেস পড়ব। ইসলামে সবার লক্ষ্য উঁচু গন্তব্যের দিকে। সবকিছুই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়ে থাকে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা মূল্যবোধের জীবন। আমার এই লাইফস্টাইল সত্ত্বেও আমি ভেতরে শূন্যতা অনুভব করেছি এবং অনুভব করতে পেরেছি মুসলিম হওয়াটা কতটুকু স্বাধীনতার বিষয়। শুধু মাত্র একজন বিধাতার অনুসরণে জীবনকে পবিত্র করার মাধ্যমে। তুমি সমস্ত ক্রেজের পিছনে ছুটছ না।”
“আমি জার্মানীতে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে বড় হই, যারা খুব ধার্মিক ছিল না। আমি ড্রিংক করতাম এবং পার্টিতে যেতাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমাদেরকে ভাল হয়ে চলতে হবে কারণ পরকাল রয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের কর্মের জন্য দায়ী।”
এসেক্সের ডেগেনহামের ৩১ বছর বয়েসী লিন আলী স্বীকার করেছেন যে তিনি ছিলেন টিপিক্যাল পার্টি লাভিং টিন এজার। তিনি বলেন, “আমি বাইরে যেতাম এবং বন্ধুদের সাথে মাতাল হতাম, শরীর প্রকাশকারী কাপড় পরতাম এবং ছেলেদের সাথে ডেট করতাম। আমি পার্ট টাইম কাজ করতাম তবে মূলত ক্লাবেই কাটাতাম। খ্রিষ্টান হিসেবে আমি কিছুটা প্রার্থনা করতাম তবে আমি গডকে একজন ডাক্তার হিসেবেই নিয়েছিলাম আমার জীবনের সমস্যাগুলো ঠিক করার জন্যে। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি জবাব দিতাম আমি ফাস্ট লাইফ এনজয় করি।”
“কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন এক বোন আমাকে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দিল এবং তা যেন আমার জীবনের সাথে খাপে খাপে মিলে গেল। আমি জানি, সব কিছুর উপরে রয়েছে আমার নিজের অনুসন্ধিৎসা। আমি জীবনে যা খুজছিলাম তা হার্ড ড্রিংকিং পার্টি স্টাইল দিয়ে পূরণ হচ্ছিল না।” লিন ১৯ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।
আজকের ঘুণে ধরা সমাজে জীবনের সব ক্ষেত্র থেকে নারী এবং বৃদ্ধদের প্রতি প্রথাগত শ্রদ্ধা কমে যাওয়ায় অনেকে দুঃখবোধ করেন। এই মূল্যবোধগুলো প্রতিফলিত হয়েছে কুরআনে যা মুসলিমদের মেনে চলতে হয়।
এই মূল্যবোধই কর্নওয়ালের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়েসী ইয়োগা শিক্ষিকা ক্যামিলা লেল্যান্ডকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছে। দুই বছর বয়েসী কন্যা ইনায়ার সিঙ্গল মাদার ক্যামিলা নারীবাদী এবং বুদ্ধিবাদী মনোভাবের কারনে মধ্য বিশের দিকে ইসলাম গ্রহন করেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি নারীবাদী এবং ইসলাম - এ দুটো শব্দের একত্র উচ্চারণে মানুষ বিস্মিত হবে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে ইসলাম নারীকে সমতা দিয়ে থাকে এবং সেটা যে সময়ে এই ধর্ম জন্ম নিয়েছিল সেই সময়কার পুরুষতান্ত্রিক ধারণার বিপরীত।”
“মানুষ ভুল করে সংস্কৃতিকে ধর্মের সাথে গুলিয়ে। হ্যাঁ, অনেক মুসলিম সমাজে নারীদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই, কিন্তু আমি যখন বড় হই তখন পশ্চিমা সমাজ দিয়ে আরো নির্যাতিত বোধ করি।”
তিনি বলেন, “নারীদের উপর অব্যাহত চাপ রয়েছে ড্রিংক এবং সেক্সের ক্ষেত্রে পুরুষের মত আচরণ করার। এর সত্যিকার কোন মানে নেই। ইসলাম অনুযায়ী, তুমি যদি কোন সম্পর্ক শুরু করো তবে তা হৃদয়ের প্রতিশ্রুতি।”
অনেক নারীবাদী আবার অভিযোগ করে থাকেন যে, তাদের ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে। কিন্তু এই অভিযোগ নিতান্তই হাস্যকর। তাদের দাবি অনুযায়ীই যদি পশ্চিমা নারীরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে থাকে, তবে কোন যুক্তিতে এই অভিযোগ উত্থাপন করা যায় যে, এসব নারীদের ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে আর তারা নির্দ্বিধায় তা মেনে নিচ্ছে!!
তাছাড়া ইসলাম গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলিম নারীই বলেছেন যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করার আগে অনেকদিন যাবত এই বিষয়ে যথেষ্ট পড়ালেখা করে, বহু ভাবনা চিন্তার পর, তারপরই ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
অনেকে আবার ইসলামের বৈপ্লবিক এবং সংস্কারমূলক আহ্বানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সমপ্রতি ইসলাম গ্রহনকারী আমেরিকান নেত্রী মারিয়াম জামিলা (যিনি ইসলাম গ্রহনের পূর্বে মার্গারেট মার্কাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন) বলছিলেন, “খৃষ্টধর্মের প্রতি আমি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলাম। বিশেষত সারা সপ্তাহ কোন ধর্মীয় কাজ না করে মাত্র একদিন (রোববার) ঈশ্বরকে স্মরন করার কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার মত অনেকই এভাবে ক্রমশ তখন ধর্ম পালনের ব্যপারে নিরাসক্ত হয়ে পড়ছিল। তাছাড়া সমাজের নানা বাজে এবং মানবতা বিরোধী কমকান্ডের ব্যপারে গীর্জাগুলোর নিস্পৃহ আচরন আমাদের ভীষন অবাক করতো। আর সর্বোপরি ত্রিত্ব মতবাদ এবং যীশুর সংজ্ঞা নিয়েও নানা রকম সংশয় আমার ভেতরে জন্ম নিল। এরপর একসময় আমি ইসলাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করলাম। কুরআন পাঠ করে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ইসলাম শুধুমাত্র একটা ধর্ম বা শখের বিষয় নয়।
আমি আসলে কখনোই খৃষ্টধর্মের জটিল তত্ত্ব কিংবা নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের ক্রমাগত অধঃপতনের ব্যপারে গীর্জাগুলার নীরব ভূমিকা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাইবেল বা ইহুদী ধর্মগ্রন্থের তুলনায় কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো যে, কুরআন খুবই বৈচিত্রময় এবং এতে মানব জীবন ঘনিষ্ঠ সব সমস্যাবলীর সমাধান আলোচিত হয়েছে। এমনকি এতে অতীতের বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার উত্থান ও পতন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে যার বাস্তব সত্যতা আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখতে পাচ্ছি।”
ইসলাম গ্রহণের পর এখন কেমন আছেন তারা? তারা কি এত নিয়ম কানুন ভাল্লাগে না বলে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে গেছেন? অথবা আমাদের দেশের আধুনিকাদের মত কোন অজুহাতে হিজাব ছাড়াই চলাফেরা করছেন? আসুন তাদের মুখেই শুনি।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা তেতাল্লিশ বছর বয়েসী ব্রডকাস্টার এবং সাংবাদিক বুথ বলেছেন, তিনি যখনই বাড়ীর বাইরে যান তখনই হিজাব পরে মাথা ঢাকেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং যখনই পারেন তখনই মসজিদে যান।
লিন আলী মনে করেন সেই স্মরনীয় রাতের কথা, “আমি আমার বন্ধুর ২১তম জন্মদিনে একটি বারে যাই। আমি শালীন পোশাকে হিজাব পরা অবস্থায় ছিলাম। দেখতে পেলাম অন্যরা কি করে নিজেদের প্রদর্শনে ব্যস্ত। তারা ছিল মাতাল, প্রলাপকারী এবং সুড়সুড়ি মার্কা নাচ নিয়ে ব্যস্ত। এই প্রথম আমি আমার আগের জীবনকে একজন বহিরাগতের দৃষ্টিতে দেখলাম এবং বুঝলাম আমার আগের জীবনে আমার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি মুক্তি খুজে পেয়েছি। এই তো সত্যিকারের আমি, যে পাঁচ বার নামাজ এবং স্থানীয় মসজিদের ক্লাস নিয়ে সুখী। আমি আর এই ভেঙ্গে যাওয়া সমাজের দাসী নই।”
শেষ করছি মারিয়াম জামিলার অনুভূতি দিয়ে, “সার্বিকভাবে আমি দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারি, ইসলামই আমার অন্তরের চাহিদা পূরন করতে পেরেছে। ইসলামেই আমি সকল সত্য, ন্যায় আর সৌন্দর্যের সন্ধান পেয়েছি যা আমাকে একটি সুন্দর জীবন যাপনে এবং মৃত্যুর পরও সফলতা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া ও নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।”
______
কার্টেসি : সমকালীন ইসলামী ভাবনা
Post a Comment