ইসলামে তালাকের বিধান

‘তালাক্ব’ (الطلاق) অর্থ : বদ্ধনমুক্তি। যেমন বলা হয়: أُطْلِقَ الْأسِيْرُ ‘বন্দী মুক্ত হয়েছে’। শারঈ পরিভাষায় তালাক অর্থ : স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা। ইসলামে তালাককে অপসন্দ করা হয়েছে। যদিও বেদ্বীনী, অবাধ্যতা, যেনাকারিতা প্রভৃতি চূড়ান্ত অবস্থায় এটাকে জায়েয রাখা হয়েছে এবং তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। দরসে বর্ণিত আয়াতের আলোকে এক্ষণে আমরা ইসলামের তালাক বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করব।

ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসকাল যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। 

তালাকের পদ্ধতি :

(১) স্ত্রীকে তার ঋতুমুক্তির পর পবিত্র অবস্থার শুরুতে মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত করতে পারে। অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ইদ্দতকাল শেষ হওয়ার পরে ফেরত নিতে চাইলে তাকে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে হবে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা।
(২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)। ইসলামের সোনালী যুগে এই তালাকই চালু ছিল। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لاَ تُخْرِجُوْهُنَّ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ وَلاَ يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِيْنَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ وَمَنْ يَّتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لاَ تَدْرِيْ لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْراً µ  (الطلاق ১)-

‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহ’লে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হ’তে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহ’লে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।

উক্ত আয়াতের তাৎপর্য এই যে, তালাক হ’ল মূলতঃ ইদ্দতের তালাক, আকস্মিক বা যুগপৎ তালাক নয়। স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই নির্ধারিত ইদ্দত গণনা করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে তিন ঋতু মুক্তির তিন মাস স্বামী অবকাশ পাবেন যে, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারবেন কি-না। এছাড়াও স্ত্রীকে স্বামীগৃহেই অবস্থান করতে হবে। এর দ্বারা উভয়কে পুনর্মিলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, এগুলি হ’ল আল্লাহকৃত ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা, যা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ।

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল : এক মজলিসে একসাথে তিন তালাক বায়েন দিলে উক্ত সীমারেখা পালন করা যায় কি? যেখানে প্রথম তালাকের ইদ্দতকাল এক ঋতু শেষে ২য় তালাক। অতঃপর ২য় তালাকের ইদ্দতকাল ২য় ঋতু শেষে ৩য় তালাক- এভাবে হিসাব করে বিরতিসহ ইদ্দত গণনার কোন সুযোগ থাকে কি? যদি না থাকে, তাহ’লে সেটা কোন্ ধরনের তালাক হবে? কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথাও এরূপ তালাকের কোন অস্তিত্ব আছে কি?

বিভিন্ন ফিক্বহ গ্রন্থে তালাককে আহসান, হাসান ও বিদ‘আত তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং কুরআন-হাদীছে বর্ণিত উপরোক্ত তালাক বিধানকে ‘সুন্নী তালাক’ ও আবিষ্কৃত একত্রিত তিন তালাককে ‘বেদ‘ঈ তালাক’ নামে অভিহিত করা হয়েছে (হেদায়া ২/৩৫৪-৫৫)। অথচ মুসলমান ‘সুন্নাত’ মানতে পারে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘বিদ‘আত’ মানতে পারে না। কেননা দ্বীনের নামে সকল প্রকার বিদ‘আত প্রত্যাখাত[1] এবং বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল জাহান্নাম।[2] অথচ বিদ‘আতী তালাককে আইনসিদ্ধ করার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে পাপের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। সুন্নাতী তালাকের স্থলে বিদ‘আতী তালাক সিদ্ধ করে ‘তাহলীল’-এর ন্যায় জাহেলী আরবের নোংরা কুপ্রথাকে অসিদ্ধ ফাসিদ ক্বিয়াসের মাধ্যমে ইসলামী সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যার সরাসরি ও অসহায় শিকার হচ্ছে এদেশের সরল-সিধা মুসলিম নারী সমাজ।

উল্লেখ্য যে, সূরায়ে তালাক্ব-এর ২য় আয়াতের وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنْكُمْ) ) আলোকে ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ও ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ), তাবেঈগণের মধ্যে আত্বা, ইবনু জুরায়েজ ও ইবনু সীরীন এবং ইমামিয়া শী‘আ বিদ্বান মন্ডলী তালাকের ক্ষেত্রেও দু’জন ন্যায়বান সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেন। যেরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। তবে প্রাচীন ও আধুনিক সকল যুগের অন্যান্য বিদ্বানদের নিকটে তালাক কেবলমাত্র স্বামীর অধিকার। এর জন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। কেননা এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও জমহূর ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কোনরূপ প্রমাণ নেই’।[3]

উপরোক্ত তালাক বিধানে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম বাধ্যগত অবস্থায় তালাক জায়েয রাখলেও মূলতঃ সেটা তার কাম্য নয়। বরং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি ও তাদেরকে পুনরায় দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসার সকল বৈধ সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাকে এক মাস, দু’মাস, তিন মাস যাবত চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে। ইদ্দতকালে স্ত্রীকে স্বামীগৃহে অবস্থানের সুযোগ দিয়েছে। সবশেষে দ্বিতীয়বার পর্যন্ত ‘তালাক্ব’ শব্দটি উচ্চারণ করলেও কুরআন ‘তৃতীয় তালাক’ বা ‘তালাক্বে বায়েন’ (বিচ্ছিন্নকারী তালাক) কথাটি উচ্চারণ করেনি। বরং ইঙ্গিতে বলেছে, দ্বিতীয়বার তালাক দেওয়ার পরে এক্ষণে সে তার স্ত্রীকে সুন্দরভাবে রাখুক অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।

জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কুরআনে দু’বার তালাক দেবার কথা পাচ্ছি। কিন্তু তৃতীয় তালাক কোথায়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’।[4] অর্থাৎ আল্লাহ চান না যে, বান্দা স্বীয় স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দিক। কেননা তৃতীয় তালাক দিলে সে আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাবে না। যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং সেই স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়। আর সেটা নিতান্তই কল্পনার বস্ত্ত।

কুরতুবী বলেন, বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, أَوْ تَسْرِيْحٌ بِإِحْسَانٍ ‘অথবা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বিদায় করুক’ দ্বারা দুই তালাকের পরে তৃতীয় তালাক বুঝানো হয়েছে। আর এটা বুঝা গেছে পরবর্তী বক্তব্য فَإِنْ طَلَّقَهَا.... ‘অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়’ আয়াতাংশ দ্বারা। অতঃপর বিদ্বানগণ এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দিবে, সে ব্যক্তি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু যদি তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহ’লে ঐ স্ত্রী তার জন্য আর হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করবে’। আর এটিই কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য (محكم القران)। যাতে কারু কোনরূপ মতভেদ নেই’।[5]

আল্লাহ এতই মেহেরবান যে, সর্বশেষ তৃতীয়বার তালাকের কারণে উক্ত স্বামী ও স্ত্রীকে চিরকালের মত পরস্পরের জন্য নিষিদ্ধ করেননি। বরং যদি কখনও দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তখন সে পুনরায় তার পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারে, যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাযী হয়। এতেই বুঝা যায় যে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনকে আল্লাহ পাক কত বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য কতভাবেই না বান্দাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।


____
[1]. মু্ত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১০৪ ‘কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘কিভাবে ঈদায়নের খুৎবা দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।

[3]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯০-৯২ পৃঃ।

[4]. আহমাদ, ইবনু আবী হাতেম, ইবনু মারদুভিয়াহ, ইবনু কাছীর ১/২৭৯-৮০ পৃঃ।

[5]. তাফসীরে কুরতুবী, বাক্বারাহ ২২৯।


_____

প্রশ্ন: স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে কি? এ সময় মোহরানার হুকুম কী?

উত্তর:
স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। তবে স্ত্রী যেকোন সময়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাবার অধিকার রাখে। যাকে শরী‘আতে ‘খোলা’ বলে। এ সময় স্ত্রী তার মোহরানা স্বামীকে ফেরৎ দিবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ছাবেত ইবনু ক্বায়েসের স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আসল এবং বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ)! আমি ছাবেত ইবনে কায়েসের দ্বীনদারী এবং চাল-চলনের নিন্দা করি না, তবে আমি মুসলিম নারী হয়ে (তার অসুন্দর হবার কারণে) তার নাফরমানী করব, এটা চাই না। তখন নবী (সাঃ) বললেন, তুমি কি তার মোহর বাবত বাগান ফেরত দিবে? মহিলা বলল, হ্যাঁ দিব। নবী করীম (সাঃ) ছাবেতকে বললেন, বাগান গ্রহণ কর এবং তাকে ‘খোলা’ হিসাবে এক তালাক প্রদান কর (বুখারী, মিশকাত হা/৩২৭৪)।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী স্বামীকে সরাসরি তালাক দিতে পারে না, তবে তালাক নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এমতাবস্থায় স্বামীকে মোহরানা ফেরত দিতে হবে। আর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে স্ত্রীর প্রাপ্য মোহর পূরণ করে দিতে হবে। অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি এখানে বিবেচ্য নয় (নাসাঈ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৩৩১৭ ‘লি‘আন’অনুচ্ছেদ; বুলূগুল মারাম হা/১০৯৮-এর আলোচনা)।

Post a Comment

Previous Post Next Post