সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
মুসলিম শাসকের কর্তব্য হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদের জন্য যথাপোযুক্ত ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া। অনুরূপভাবে- আলেম সমাজ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি মজলিসে শুরা বা পরামর্শসভা গঠন করা। সাধারণ মানুষ বা চাটুকারদের এ পরিষদে স্থান দেয়া উচিত নয়। এটা করলে তারা তাদের আত্মীয়স্বজন বা দলীয় লোক বা যে ব্যক্তি বেশি অর্থ প্রদান করবে সেসব লোকদের দায়িত্ব দিবে।
শাইখ সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান বলেন: খলিফার নীচে যেসব পদ রয়েছে সেসব পদে নিয়োগ দেয়ার অধিকার খলিফার। খলিফা যোগ্য ও আমানতদার ব্যক্তিদের নির্বাচন করবেন এবং তাদেরকে সেসব পদের জন্য নিয়োগ দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যারা আমানত ধারণের যোগ্য তাদেরকে আমানত দিবে। আর যখন মানুষের মাঝে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভাবে ফয়সালা করবে।”। এ আয়াতে কারীমাতে শাসকবর্গকে উদ্দিষ্ট করা হয়েছে। আর আমানত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও পদসমূহ। আল্লাহ তাআলা শাসকের কাছে এটাকে আমানত রেখেছেন। যোগ্য ও বিশ্বস্ত লোককে এসব পদের জন্য নির্বাচন করা হলে এ আমানত যথাযথভাবে আদায় হবে। যেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন যারা এসব পদের জন্য যোগ্য ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম তাদেরকে এসব দায়িত্বের জন্য নির্বাচন করতেন। বর্তমান যামানায় পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে এটি ইসলামী পদ্ধতি নয়। এসব নির্বাচন বিশৃঙ্খলা, ব্যক্তিগত পছন্দ, স্বজনপ্রীতি ও লোভ-লালসার কেন্দ্রবিন্দু। এসব নির্বাচনে গণ্ডগোল ও রক্তপাত হয়ে থাকে। এভাবে প্রকৃত উদ্দেশ্য হাছিল হয় না। বরং এসব নির্বাচন ভোটবাজারে পরিণত হয়। যেখানে ভোট বেচাকেনা চলে এবং সব মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চলে। সমাপ্ত [দৈনিক আল-জাজিরা, সংখ্যা- ১১৩৫৮]
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফা তিনটি প্রদ্ধতির কোন একটির মাধ্যমে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন।
এক: আহলে হিল্ল ও আকদ এর পক্ষ থেকে মনোনীত বা নির্বাচিত হয়ে। উদাহরণতঃ আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর সমস্ত সাহাবী তাঁর খিলাফতের পক্ষে ঐক্যমত্য পোষণ করেন, তাঁর হাতে বায়াত করেন এবং তাঁর খিলাফতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
অনুরূপভাবে উসমান বিন আফফান (রাঃ) এর খিলাফতও এভাবে সাব্যস্ত হয়েছিল। উমর (রাঃ) তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করার জন্য শীর্ষস্থানীয় ছয়জন সাহাবীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শসভা গঠন করেছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে আব্দুর রহমান বিন আওফ মুহাজির ও আনসারদের সাথে পরামর্শ করলেন। যখন দেখলেন যে, লোকেরা উসমান (রাঃ) কে চাচ্ছে তখন তিনিই প্রথম তাঁর হাতে বায়াত করেন। এরপর ছয়জনের অবশিষ্ট সাহাবীগণও তাঁর হাতে বায়াত করেন। এরপর মুহাজির ও আনসারগণ তাঁর হাতে বায়াত করেন। এভাবে আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অনুরূপভাবে আলী (রাঃ) এর মনোনয়ন ও নির্বাচনও অধিকাংশ আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।
দুই: পূর্ববর্তী খলিফার দেয়া প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অর্থাৎ পূর্ববর্তী খলিফা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে তাঁর পরবর্তী খলিফা হিসেবে প্রতিশ্রুতি দিবেন। এর উদাহরণ হচ্ছে- উমর (রাঃ) এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত আবু বকর (রাঃ) এর দেয়া প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছিল।
তিন: শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। অর্থাৎ কেউ যদি তার অস্ত্র ও ক্ষমতা বলে তাকে মেনে নিতে মানুষকে বাধ্য করে এবং স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হন সেক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা অপরিহার্য, তিনি মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। উদাহরণতঃ কিছু কিছু উমাইয়া খলিফা ও আব্বাসী খলিফা এবং তাদের পরবর্তীতে কিছু কিছু খলিফা এভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এটি শরিয়ত বিরোধী, বেআইনী পদ্ধতি। কারণ অন্যায়ভাবে, জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। তবে উম্মতের একজন শাসক থাকুক সে মহান কল্যাণের দিক এবং দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মত সাংঘাতিক অকল্যাণের দিক বিবেচনা করে জোরপূর্বক ও অস্ত্রবলে ক্ষমতা গ্রহণকারী আল্লাহর দেয়া শরিয়ত অনুযায়ী শাসন করলে তার আনুগত্য করতে হবে।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: যদি কোন লোক বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করে নেয় তাহলেও তার আনুগত্য করা মানুষের উপর ওয়াজিব। এমনকি সে ক্ষমতাগ্রহণ যদি জবরদস্তিমূলক হয়; মানুষের অসম্মতিতে হয় তবুও। কারণ সেতো ক্ষমতা নিয়েই ফেলেছে।
এর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে- এই যে ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে তার সাথে যদি ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি করা হয় তাহলে মহা অঘটন ঘটে যাবে। যেমনটি ঘটেছে বনি উমাইয়া রাষ্ট্রে। সুতরাং কেউ যদি জবরদস্তি করে ও প্রভাব খাটিয়ে করে ক্ষমতা নিয়ে নেয় তাহলে সে খলিফা হয়ে যাবে, তাকে খলিফা ডাকা হবে এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তার আনুগত্য করতে হবে। সমাপ্ত।[শরহুল আকিদা আল-সাফারিনিয়্যা, পৃষ্ঠা-৬৮৮]
এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত, রাষ্ট্রীয় কর্মনীতি ও কর্মের কাঠামো জানতে পড়ুন আবুল হাসান আল-মাওয়ারদি আল-শাফেয়ি এর ‘আল-আহকাম আল-সুলতানিয়া’ এবং আবু ইয়ালা আল-ফাররা আল-হাম্বলি এর ‘আল-আহকাম আল-সুলতানিয়া’ এবং আল-কিত্তানি এর ‘আত-তারতিব আল-ইদারিয়্যা’। এই গ্রন্থে অতিরিক্ত অনেক জ্ঞান ও তথ্য রয়েছে।
আল্লাহই ভাল জানেন।
তথ্যসূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
Post a Comment