ইমামতির বিবিধ মাসায়েল

 ১-যে ইমামকে মুসল্লীগণ অপছন্দ করে তার ইমামতি:
এমন ইমাম যাকে মুসাল্লীরা অপছন্দ করে সেই ইমামের ইমামতি করা মাকরূহ। তবে বিদ্বানগণ মনে করেন, অপছন্দের কারণ যেন দ্বীনী কারণ হয়; কোন দুনিয়াবী কারণ না হয়। অনুরূপ অপছন্দকারীর সংখ্যা যেন বেশী হয়, দু-চার জনের অপছন্দ করা যথেষ্ট নয়। [নায়লুল আউত্বার, শাওকানী,৩/২২৫]


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তিন শ্রেণীর লোকের নামায তাদের মাথার উপর থেকে এক বিঘতও উঠানো হয় না (অর্থাৎ তাদের নামায আল্লাহর নিকট কবূল হয় না)।
১-যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ইমামত করে অথচ তাকে তারা অপছন্দ করে।
২-সেই মহিলা যে রাত্রি যাপন করে অথচ তার স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট।
৩-পলাতক দাস”। [সহীহ সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস নং-৭৯২]
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বিষয়টিকে (ছোট ইমামতি) নামাযের ইমামতির সাথে সম্পর্কিত মনে করেন, বড় ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে মনে করেন না। কারণ রাষ্ট্রপরিচালকের ইমামতি বেশীরভাগ লোকেই অপছন্দ করে। [নায়লুল আউত্বার,৩/২২৫] (বড় ইমামত ও ছোট ইমামত বিষয়টি ১ম পর্বে দেখুন)


২-নফল নামায পাঠকারীর পিছনে ফরয সালাত আদায় করাঃ
কোন ব্যক্তি কোথাও ফরয নামায পড়েছে অতঃপর এমন লোকদের ইমামতি করতে চায়, যারা এখনো সেই ফরয পড়েনি, তাহলে এমন করা বৈধ। এটা ইমামের জন্য নফল হবে এবং লোকদের জন্য ফরয। উলামাগণ এই বিষয়টিকে নফল নামায পাঠকারীর পিছনে ফরয নামায আদায় করা হিসাবে জানেন। সাহাবী মুয়ায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ইশার নামায আদায় করতেন এবং নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে পুনরায় সেই নামায ইমাম হয়ে আদায় করতেন। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ সালাত, নং৪৬৫] অন্য বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে, সেটা তার জন্য (মুআযের জন্য) নফল হবে এবং অন্যদের জন্য ফরয। [শাফেয়ী ও দ্বারা কুত্বনী বর্ণনা করেন। দেখুন নায়লুল আউত্বার,৩/২১৩ এবং সঊদী স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড, ফতোয়া নং ৪৭০৬, লাজনা দায়িমাহ,৭/৪০১]
উক্ত দলীলের আধারে বুঝা যায় যে, রামাযান মাসে যদি কোন ব্যক্তি ইশার নামায আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে, লোকেরা ইশার নামায শেষ করে তারাবীহ পড়ছে, তাহলে সে ইশার ফরয নামাযের নিয়তে তাদের সাথে নামায পাঠ করবে এবং ইমামের সালাম ফিরানোর পর বাকি রাকায়াত পূর্ণ করবে। [সউদী ফতোয়া বোর্ড, নং৬৪৯৬]


৩-ফরয সালাত আদায়কারীর পিছনে নফল সালাত আদায় করাঃ
ফরয নামায আদায়কারী ইমামের পিছনে নফল নামায আদায় করা বৈধ। ইবনু কুদামাহ (রহঃ) বলেনঃ ‘আহলে ইলমদের এ বিষয়ে কোন মতভেদ আমাদের জানা নেই’। [মুগনী,৩/৬৮]
আবু যার গেফারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমার অবস্থা কেমন হবে, যখন শাষকগণ নামায সঠিক সময়ে না পড়ে বিলম্বে পড়বে? আমি বললামঃ এমন সময় আমার করণীয় কি? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

‘‘তুমি সঠিক সময়ে নামায পড়ে নিবে অতঃপর তাদের সাথে সেই নামায পেলে তাও পড়ে নিবে; কারণ সেটা তোমার জন্য নফল হবে’’। [মুসলিম]

ইয়াজীদ বিন আসওয়াদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে ফজরের নামায আদায় করেন। নামায শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ব্যক্তিকে দেখেন, যারা তাঁর সাথে নামায পড়ে নি। তখন তিনি তাদের দু জনকে ডাকেন। তারা ভয়ে ভয়ে কাছে আসলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বলেনঃ ‘‘তোমরা দুই জনে আমাদের সাথে নামায পড়লে না কেন”? তারা বললঃ আমরা নিজ বাড়িতে নামায পড়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “এমন করো না, যখন তোমরা আপন বাড়িতে নামায পড়বে এবং ইমামকে এমতাবস্থায় পাবে যে, সে এখনো নামায পড়ে নি, তাহলে তার সাথে নামায পড়ে নিবে। কারণ; এটা তোমাদের জন্য নফল হয়ে যাবে”। [আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, দ্বারা কুত্বনী, ইবনুস সাকান এবং ইবনু হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আবু দাঊদ, আলবানী, নং৫৯০]


৪-নির্দিষ্ট ফরয সালাত আদায়কারীর পিছনে অন্য ফরয আদায় করাঃ
ফরয সালাত আদায়কারী ইমামের পিছনে মুক্তাদী অন্য ফরয নামায আদায় করতে পারে। উদাহারণ স্বরূপ ইমাম আসরের নামায পড়াচ্ছে আর তার সাথে কেউ যহরের নিয়তে যহর আদায় করছে। চাই ইমাম ও মুক্তাদীর নামাযের রাকাআত সংখ্যা এক হোক যেমন আসর আদায়কারীর পিছনে যহর পড়া কিংবা উভয়ের নামাযের রাকাআত সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হোক। যেমন ইশার ফরয নামায আদায়কারী ইমামের পিছনে মগরিব পড়া, কারণঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ মানুষের আমলসমূহ নির্ভর করে তার নিয়তের উপরে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায়, যার সে নিয়ত করে থাকে”। [বুখারী, ১ম হাদীস] তাই এখানে মুক্তাদী ও ইমাম যে যেই নিয়তে নামায পাঠ করবে, সে সেই অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।
এ বিষয়ের বৈধতায় উলামাগণ ঐসব দলীল উল্লেখ করেছেন যা, ইতিপূর্বে ফরয আদায়কারীর পিছনে নফল আদায় করা এবং নফল আদায়কারীর পিছনে ফরয আদায় করার দলীল হিসাবে উল্লেখ হয়েছে। কেননা যদি ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত একই হওয়া শর্ত হতো, তাহলে উপরোক্ত বিষয়দুটি বৈধ হত না।
ইবনু হাযম (রহঃ) বলেনঃ ‘না কুরআনে, না সুন্নতে, না ইজমায়, না কিয়াসে এমন কিছু এসেছে যা, ইমাম ও মা’মূমের (মুক্তাদীর) নিয়ত এক হওয়া জরূরী করে। তাই প্রত্যেক এমন বিধান যা কুরআন, সুন্নত এবং ইজমা জরুরী করে না, তা জরুরী নয়’। [মুহাল্লা,৪/৩১৬-৩১৭]
একই ফরয নামাযে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হওয়ার সময় যদি তাদের নামাযের রাকাআত সংখ্যা এক হয়, তাহলে ইমামের পিছনে নামায পাঠকারীর কোন বাড়তি বা ঘাটতি কিছু করতে হয় না, যেমন যহর আদায়কারীর পেছনে আসর পড়া। কিন্তু মাগরিব আদায়কারীর পিছনে যদি কেউ ইশা পড়ে, তাহলে সে কী করবে? কারণ এখানে মুক্তাদীর রাকাআত সংখ্যা বেশী। শাইখ ইবনে উসায়মীন (রহঃ) বলেনঃ সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর উঠে এক রাকাআত পড়ে নিবে। এই ভাবে যদি কেউ ইশার নামায সম্পাদনকারীর পিছনে মাগরিব পড়ে, তাহলে সে কী করবে? কারণ এক্ষেত্রে ইমামের থেকে তার রাকাআত সংখ্যা কম। তিনি বলেনঃ সে দুই নিয়মের যে কোন একটি করতে পারে। তৃতীয় রাকাআতের পর যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআতের জন্য দাঁড়াবে তখন সে বসে তাশাহ্হুদের দুআ পড়ে ইমামের সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করবে, যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআত পড়ে সালাম ফিরাবে তখন সেও ইমামের সাথে সালাম ফিরাবে কিংবা তৃতীয় রাকাআত শেষে যখন ইমাম চতুর্থ রাকাআতের জন্য দাঁড়াবে, তখন সে নিজে তাশাহ্হুদ দিয়ে সালাম ফিরাবে’। এমন দৃষ্টান্ত সালাতুল খাওফের পদ্ধতিতে রয়েছে।[দেখুন,শারহুল মুমতি,৪/২৬১]


৫-নামাযরত অবস্থায় একাকী নামাযের নিয়ত পরিবর্তন করে ইমামতির নিয়ত করা কিংবা ইমামতির নিয়ত পরিবর্তন করে মুক্তাদীর নিয়ত করাঃ
প্রত্যেক নামাযীকে নামাযের সময় ফরয, নফল, ইমামতি বা মুক্তাদী ইত্যদির নিয়ত অন্তরে করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এক ব্যক্তি একাকী নামায পড়ার নিয়তে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে কেউ তার সাথে শরীক হল, এখন কি সে একাকীর নিয়ত থেকে ইমামতির নিয়ত করতে পারে? কিংবা ইমামের অনুপস্থিতে কেউ ইমামতি করতে দাঁড়িয়েছে এমতাবস্থায় ইমাম উপস্থিত হয়েছে, তাহলে সে কি ইমামকে আগে করে দিয়ে মুক্তাদীর নিয়ত করতে পারে? বিষয়টিকে উলামাগণ নামাযরত অবস্থায় নিয়ত পরিবর্তন করা শিরোনামে উল্লেখ করেছেন।
একাকী নামাযী প্রয়োজনে নামাযরত অবস্থায় তার নিয়ত পরিবর্তন করে ইমামতির নিয়ত করতে পারে। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেনঃ একদা আমি আমার খালা মায়মূনা (রাযিঃ) এর নিকট রাত যাপন করি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে উঠে নামায (তাহাজ্জুদের নামায) শুরু করেন, তখন আমিও তাঁর সাথে তাঁর বাম পাশে নামাযে দাঁড়ালাম। তিনি আমার মাথা ধরে ডান দিকে করে দেন”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৯৯] বুঝা গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একা নামাযের নিয়তে দাঁড়ান অতঃপর ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) মুক্তাদী হলে, তাঁকে ইমাম হতে হয়। অন্যদিকে একদা রামাযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে একা নামায শুরু করলে ধীরে ধীরে অনেক সাহাবী পিছনে তাঁর ইক্তিদা করে নামায আদায় করেন। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৭৩০-৭৩১]
অনুরূপ ইমামতির নিয়ত থেকে মুক্তাদী হওয়াও প্রমাণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানু আমর বিন আউফ গোত্রে মীমাংসা করতে গেলে নামাযের সময় হয়। কোন কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপস্থিতিতে বিলম্ব হলে মুআয্ যিন আবু বকর (রাযিঃ) কে ইমামতি করতে বলেন। তিনি ইমাম হয়ে নামায শুরু করলে নবী উপস্থিত হন। লোকেরা ইশারা করলে আবু বকর (রাযিঃ) পিছনে সরে আসেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতি করেন। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৮৪] বুঝা গেল, আবু বকর (রাযিঃ) ইমামতির নিয়ত পরিবর্তন করে মুক্তাদী হলেন।


লেখক: শাইখ আব্দুর রাকীব মাদানী,
লিসান্স, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
সম্পাদক: শাইখ আবদুল্লাহিল-হাদী মু. ইউসুফ
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

Post a Comment

Previous Post Next Post