মহিমান্বিত আল্লাহ’র সৌন্দর্য

সবচেয়ে মূল্যবান জ্ঞান হল মহিমান্বিত আল্লাহ’র সৌন্দর্য জানার মাধ্যমে আল্লাহ্‌কে জানা। আর এ জ্ঞান তো তার সৃষ্টির সত্যিকারের ধার্মিক সৃষ্টিকেই দেওয়া হয়, যখন কিনা অন্যান্য সৃষ্টিগুলো তার কোন একটি গুণের মাধ্যমে তাকে জানতে পারে। যারা তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানে, তারা তো তার পরিপূর্ণতা, তার গৌরব আর তার সৌন্দর্য জানার মাধ্যমেই তাকে জানতে পারে।



আল্লাহর গুনে গুণান্বিত আর কিছুই নেই। আমরা যদি সকল সৃষ্টিকেই সুন্দর হিসেবে ধরে নেই আর মনে করি যে সবচেয়ে সেরা সুন্দর সৃষ্টিকে আমরা জানি, এবং তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত আল্লাহ’র সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করি, তবে তো ব্যাপারটি সূর্যের আলোর সাথে বাতির আলোর তুলনা করার মতো হবে।

নিশ্চয়ই তিনি যদি তার চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে দেন, তবে তার চেহারার জ্যোতি তার সৃষ্টিকে গ্রাস করে ফেলবে। এই পার্থিব জীবন আর পরকালের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদানগুলোতে থাকা সৌন্দর্য তো তার সৃষ্টির প্রভাব থেকেই আসে; তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এ সৃষ্টিগুলোর স্রস্টার সৌন্দর্য কেমন হতে পারে ?


তারই তো রয়েছে সকল গৌরব, ক্ষমতা, দানশীলতা, বদান্যতা, জ্ঞান ও অনুগ্রহ। তার চেহারার জ্যোতিতে সকল অন্ধকার হয়ে যায় অদৃশ্য, যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) তাইফে দুয়া করার সময় বলেছিলেন – “আপনার চেহারার জ্যোতির মাধ্যমে আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা অন্ধকারকে আলোকিত করে দেয় এবং যার উপর দুনিয়া ও আখিরাতের উপযুক্ততা নির্ভরশীল।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ’র কাছে দিন বা রাত নেই, (বরং) আসমান ও জমিনের আলো তো তার চেহারার জ্যোতি থেকেই আসে।”
মহিমান্বিত আল্লাহ আসমান ও জমিনের জ্যোতি, আর পুনরুত্থান দিবসে মানবজাতির বিচার করার সময় দুনিয়া তো তার জ্যোতি থেকেই ঔজ্জ্বল্য লাভ করবে।
আল্লাহ নামগুলোর মধ্যে একটি নাম হল “আল-জামিল” (সবচেয়ে সুন্দর); রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর (জামিল) আর তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।” (মুসলিম – কিতাবুল ঈমান)

আল্লাহ’র সৌন্দর্যের চারটি উচ্চতা রয়েছে – তার নিজের সৌন্দর্য, তার গুণাবলীর সৌন্দর্য, তার কাজের সৌন্দর্য আর তার নামগুলোর সৌন্দর্য। তার সব নামই সুন্দর, তার সব গুণই উৎকৃষ্ট গুণ, তার সব কাজই প্রজ্ঞাপূর্ণ, ন্যায্য ও দয়াপূর্ণ, এবং তিনি তো মানুষের কল্যাণই বিবেচনা করেন।

কেবল আল্লাহই তার নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানেন, আর জানেন তার সে সৌন্দর্য কিসের মতো; তার সৃষ্টির কাছে তো কেবলই কিছু সংজ্ঞা আছে যা কিনা তিনি তার সম্মানিত কিছু গোলামদের প্রদান করেছেন। সে সৌন্দর্য অন্যান্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখে তা পর্দা ও পোশাক দিয়ে আবৃত করা হয়েছে; যেমনটি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেন, “অহংকার আমার চাদর আর শ্রেষ্ঠত্ব আমার পোশাক।” আল্লাহ তো মহান, আর তার অবস্থান সবচেয়ে উপরে, তাই তার অহংকারও মহান ও ব্যাপক হওয়ার কারনে চাদরই হল প্রাপ্য (যা তার অহংকার ঢেকে রাখার জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন)।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ নিজেকে আবৃত করেছেন তার গুণাবলী দিয়ে আর তার গুণাবলীকে আবৃত করেছেন তার কাজ দিয়ে। সে সৌন্দর্য সম্পর্কে তুমি কি মনে করো, যা কিনা উৎকৃষ্ট গুণাবলী, গৌরব আর মহিমা দিয়ে আবৃত ?”

এটা থেকে সৌন্দর্যের অন্যান্য অর্থগুলো অনুধাবন করা যায়। গোলাম প্রথমে আল্লাহ’র কাজ, এরপর তার গুণাবলী এবং এরপরে স্বয়ং আল্লাহ্‌কে জানার মাধ্যমে উন্নতি লাভ করে। যদি সে কাজগুলোর সৌন্দর্যের মধ্যে কিছু দেখতে পায়, তবে সে গুণাবলীর সৌন্দর্যে পৌঁছে যাবে, এরপর সে পৌঁছে যাবে আল্লাহ’র সৌন্দর্য জানার পর্যায়ে।

সুতরাং সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া তো মহিমান্বিত আল্লাহ’র জন্যই, তার সৃষ্টির কোন কিছুই তার প্রাপ্য অনুযায়ী তার প্রশংসা করতে সক্ষম নয়, একমাত্র তিনিই তার পরিপূর্ণ প্রশংসা করতে পারেন, আর তিনিই তো একমাত্র ইবাদাতের যোগ্য, ভালোবাসা ও প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য। তিনি তার গুণাবলী ও কাজকে ভালোবাসেন যেমনটা ভালোবাসেন নিজেকে। তার সকল কাজই তো সুন্দর ও মূল্যবান এবং তার কাজে এমন কিছুই নেই যেটার প্রতি ঘৃণা আসে।

মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া মহাবিশ্বে আর কিছুই নেই যাকে ভালোবাসা হয় আর যার প্রশংসা করা হয়। যদি তাকে ছাড়া অন্য কিছুকে তার জন্যই ভালোবাসা হয়, তবে সে ভালোবাসা বৈধ, নতুবা তা অবৈধ; আর এটিই হল রবুবিয়্যাতের বাস্তবতা। সত্যিকারের রব তো তিনিই- যাকে ভালোবাসা হয় আর যার প্রশংসা করা হয়। আর এতে যদি আমরা তার দানশীলতা, অনুগ্রহ, দয়াশীলতা, ক্ষমাশীলতা আর গভীর শ্রদ্ধা যোগ করি, তবে কেমন হবে ব্যাপারটি ?

গোলামের তো জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তার উচিত আল্লাহ’র সত্তা ও তার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহ্‌কে ভালোবাসা ও তার প্রশংসা করা। তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই যে কিনা গোপনে ও প্রকাশ্যে দয়া-অনুগ্রহ প্রদান করে, তাই গোলামের উচিত তার দয়ার কারনে তাকে ভালোবাসা।

যেহেতু আল্লাহ মতো আর কিছুই নেই, তাই আল্লাহ্‌কে ভালোবাসাটাও অন্য কিছুকে ভালোবাসার মতো নয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভালোবাসা হল এমনই এক ইবাদাত, যেটার জন্য আল্লাহ সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন। এটিই হল চূড়ান্ত নম্রতার সাথে চূড়ান্ত ভালোবাসা, আর এ ভালোবাসা আল্লাহ ছাড়া কারো প্রতিই দেখানো যাবে না। আল্লাহ ছাড়া এ ভালোবাসা অন্য কারো কাছে দেখানো হল শিরক, যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যদি সে শিরককারী ব্যক্তি শিরক থাকা অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করে।

আল্লাহ’র প্রশংসা করা দুটো বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে – তার প্রশংসনীয় কাজের ব্যাপারে জানা আর তার উৎকৃষ্ট গুণাবলীর ব্যাপারে জানা, আর এগুলোর কারনে তাকে ভালোবাসা। কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা না রেখেই তার প্রশংসনীয় কাজের কথা বলে, তবে সে তার প্রশংসা করছে না। আর যদি সে তার প্রশংসনীয় কাজগুলোর ব্যাপারে কাউকে না জানিয়ে তাকে ভালোবাসে, তবে সেও তার প্রশংসা করছে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে দুটো বিষয় একত্রিত করছে।

আল্লাহ তো নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন, আর তার ফেরেশতা, নবী রসূলগণ ও ইমানদারদের মধ্যে যারা তার প্রশংসা করেছেন, তিনি তাদের জবান দিয়ে তার প্রশংসা করিয়েছেন। তারা তো তাদের রবের ইচ্ছা ও অনুমতি অনুসারেই তার প্রশংসা করেছেন। তিনিই তো সে মহান সত্তা, যিনি তাদেরকে তার প্রশংসার ক্ষমতা দিয়েছেন, আর সব কিছুই তো তার অনুমতির কারনে ঘটে।

সব কল্যাণই তাকে দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় তাকে দিয়ে, সেগুলো শুরু হয় তার প্রশংসা করার মাধ্যমে আর শেষ হয় তার প্রশংসার মধ্য দিয়ে।
তিনি তার গোলামদের অনুপ্রাণিত করেন তাওবা করার জন্য, আর সে তাওবার ফলে তিনি খুশী হন; এটি তো তার অনুগ্রহ ও মহত্ত্ব।

তিনি তার গোলামদের অনুপ্রাণিত করেন তার আনুগত্য করার জন্য, তাদের সাহায্য করেন আনুগত্য করার জন্য, আর সেটার জন্য তিনি পুরস্কৃতও করেন !

তার তো কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই, কিন্তু সব কিছুরই সব সময়ই তার জন্য গভীর প্রয়োজন রয়েছে। গোলামের তো প্রয়োজন তার রবকে, যেন তিনি তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেন।

তিনি যেটার অনুমতি দেন নি তা তো কখনোই হওয়ার নয়, আর তার জন্য যা করা হয় না সেটার কোন মূল্যই নেই।


ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)’র কিতাব আল-ফাওাইদ থেকে 'দ্যা গ্রেটেস্ট নেশন' টিম কর্তৃক (ইংলিশ-বাংলা) অনূদিত।

Post a Comment

أحدث أقدم