আমাদের ভুল ধারণা ও বড়লোকের সীমাহীন অপূর্ণতা

এই হাদিসটি আমরা অনেকেই পড়েছি, শুনেছি কিন্তু এর বাস্তবতা সত্যিকারভাবে উপলদ্ধি করা কঠিন, অন্তত জীবনের একটি সময় দুনিয়ার পেছনে ঘুরে হয়রান না হলে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, "হে আদম সন্তান, আমার ইবাদতের জন্য তুমি নিজের অবসর সময় তৈরি কর ও ইবাদতে মন দাও, তাহলে আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার অভাব দূর করে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাতকে ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব কখনোই দূর করব না।" --[ইবনে মাজাহ ৪১০৭, আহমাদ ৮৬৮১, সহীহ তারগীব ৩১৬৬]

একসময় নানারকম ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিলাম, ইনকাম মানে ব্যাবসায় টাকার ইনফ্লো প্রচুর ছিল, কিন্তু অভাব যেতনা।

মানসিক শান্তি বলে কিছু ছিলনা বরং সবসময়ই কিছু না কিছু সমস্যা লেগে থাকতো, বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নানা রকম ফন্দিফিকিরে থাকতে হত। মেশিন পুরানো হয়ে যাচ্ছে, নতুন টেকনোলজি চলে আসছে, প্রতিযোগীরা অমুক সারটিফিকেশান নিয়েছে, প্রডাকশান না বাড়ালে কস্টিং মেলেনা, প্রডাকশান বাড়ানোর পর যথেষ্ট অর্ডার নেই, শ্রমিক সমস্যা, নেতাদের সীমাহীন ডিমান্ড মানে সেই এক হুলুস্থুল কারবার। ইসলাম পালন বলতে ছিল ওয়াক্তের শেষ প্রান্তে এসে কোনরকমে ফরজ আদায় করা। অন্যান্য আমল বলতে কিছু ছিলনা। ইচ্ছে করত কিন্তু পারতামনা। যেমন অনেক সময় দেখা যেত নফল রোজা রেখেছি, কিন্তু অফিসে যেয়ে একের পর এক ঝামেলা মিটাতে মিটাতে মন মেজাজ বিগড়ে যেত, মাথা কাজ করতনা, চা বা কফি খেয়ে ফেলতাম।

আমার এক বন্ধু, বড় ব্যবসায়ি, সে বলে ইন্ডাস্ট্রি চালানো হলে বাঘের পিঠে সওয়ারি হওয়া। যতদিন যুদ্ধ করে পিঠে বসে থাকতে পারবে ততদিন টিকে থাকতে পারবে। পড়ে গেলেই বাঘ খেয়ে ফেলবে। বাইরের মানুষ মনে করে কতনা সাহসের কাজ, কতনা মজা, কিন্তু যে বাঘের পিঠে আছে সে জানে তার সত্যিকারের অবস্থা। সে যে কি বিপদে আছে জান নিয়ে তা বাইরের মানুষ বুঝেনা।

তাফসির ইবনে কাসিরে পড়েছিলাম সম্ভবত, বা অন্য কোথাও হতে পারে। দুনিয়া হল গরুর মত। সবাই এর পিঠে উঠতে চায়। অধিকাংশ সফল হতে পারেনা, গরুর লাথি ঘুতা খেতে থাকে। যারা সফল হয়,তাদের পিঠ থেকে ফেলে দেবার জন্য গরু অনবরত লাফাতে থাকে। সফল ব্যাক্তি কোনরকমে গরুর পিঠ আঁকড়ে বসে থাকে যতদিন পারে। একসময় হাল ছেড়ে দেয়। বুদ্ধিমান হল সে যে গরু থেকে কেবল উপকারটুকু নিয়ে চলে যায়।

ছাত্রজীবনে চাকরি বা সফল ব্যাবসায়িদের দেখতাম আর ভাবতাম ওদের মত হব ইনশাআল্লাহ। একটু বড় হবার পর দেখলাম অধিকাংশ সফল ব্যাবসায়িরাই ডায়াবেটিস আর হার্টের অসুখ। ঘরে অশান্তি। ছেলে মেয়ের সীমাহীন চাহিদা। স্ত্রীর স্ট্যাটাস টিকিয়ে রাখার অনবরত প্রেশার। বন্ধুমহলে ইজ্জত ধরে রাখার জন্য ক্লাবে টাকা দেয়া লাগে, আরও কত কি।

বড় প্রমশান পাওয়া চাকরিজীবী বন্ধুদের গল্প শুনি। কি পরিমাণ পলিটিক্স আর কাজের প্রেশার। জীবনের জন্য চাকরি আর থাকেনা জীবনটাই হয়ে যায় চাকরিকে খুশী রাখা।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে যায় অতৃপ্তি। যেমন ধরুন আপনার দামী ফার্নিচারের শখ। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে খাট বানালেন। সবচেয়ে দামী কাঠের, ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের। কিনে ফেলার পর কিন্তু শখ শেষ। ২ মাস পরে আম কাঠের চৌকির উপর ঘুমাচ্ছেন না দুনিয়ার সবচেয়ে দামী খাটে এ কথা আর মাথায় থাকেনা। দামী খাবার, বিদেশে বেড়ানো, দামী গাড়ি, কাপড় সবই এক পর্যায়ে এসে ডালভাত হয়ে যায়। কিন্তু এসব অর্জন করতে যা অপরাধ করেছিলাম, যত আল্লাহর নফরমানি করেছিলাম, মানুষের হক নষ্ট করেছিলাম, সুদের উপর ঋণ নিয়েছিলাম তা রয়ে যায়। এ যে কি এক অশান্তির জীবন তা বলে বোঝানো সম্ভব না।

আমি একসময় ভাবতাম কেন বড়লোকরা এত নিষ্ঠুর বা কৃপণ। কেন তারা তাদের এত থাকার পরও আরেকজনেরটা মেরে দিতে চায়। এখন বুজি তাদের সীমাহীন অভাব আর অতৃপ্তি যা এই দুনিয়ার সমস্ত কিছু পেয়ে গেলেও মিটবেনা।

- জাহিদ ইসহাক অপু ভাই

1 Comments

Post a Comment

Previous Post Next Post