সীরাতের পাতায় নব্যুওয়তের দশম বছরের আলাদা একটি নাম রয়েছে। একে বলা হয় “শোকের বছর”। কুরাইশদের দ্বারা বছর খানেক দীর্ঘ বয়কট কেবল শেষ হয়েছে। প্রায় সাথে সাথেই রাসূল (সা.) তাঁর চাচা আবু তালিবকে হারান। কুরাইশদের ভয়ঙ্কর অত্যাচারে যিনি রাসূল (সা.) এর জন্য ঢালের মত হয়েছিলেন। আবু তালিবের মৃত্যুর পর খাদিজা (রা.) ও পৃথিবী ত্যাগ করেন। রাসূল (সা.) হারান তাঁর প্রিয় স্ত্রীকে, যার সাথে কেটেছে তাঁর পঁচিশ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন। আবু তালিবের মৃত্যুর পর কুরাইশরা রাসূল (সা.) কে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়া শুরু করে। রাসূল (সা.) বলেন, “আবু তালিবের মৃত্যুর আগে কুরাইশরা আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারেনি যা আমাকে কষ্ট দেয়।”[১]
এ সময়ে রাসূল (সা.) এর দুই মেয়ে উম্মে কুলসুম(রা.) ও ফাতেমা (রা.) অবিবাহিতা ছিলেন। তাই তাদের দেখাশুনার জন্য রাসূল (সা.) বিয়ে করেন সওদা বিনতে যাম‘আহ (রা.) কে। তিনি ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। সওদা (রা.) এর প্রভাবে তার স্বামীও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল।[২] তিনি আর তার স্বামী হাবশায় হিজরত করেন। হাবশা থেকে আবার মক্কায় ফেরত আসার পর তার স্বামী সাকরান মারা যান। রেখে যান পাঁচ-ছয় জন সন্তান। তাদের নিয়ে সওদা (রা.) অকুল পাথারে পড়েন। রাসূল (সা.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা খুশিমনে গ্রহণ করেন।[৩] রাসূল (সা.) তার সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বসহ সওদা (রা:) কে বিয়ে করেন।[৪] এ সময়ে রাসূল (সা.) আর সওদা (রা.) দুইজনেরই বয়স ছিল পঞ্চাশ।[৫]
.
রাসূল (সা.) সংসার করেছিলেন সর্বমোট ১১ জন স্ত্রীর সাথে। এর মধ্যে খাদিজা (রা.) এবং জয়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.), রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর পূর্বেই মারা যান।[৬] স্ত্রীদের সাথে তিনি পালাক্রমে থাকতেন। কাউকে বেশী ভালোবাসালেও এ ক্ষেত্রে তিনি অবিচার করতেন না। আল্লাহ্র নিকট এই বলে দু’আ করতেন,
“ হে আল্লাহ! যা আমার নিয়ন্ত্রণে (অর্থাৎ স্ত্রীগণের প্রতি আচার-ব্যবহার ও লেনদেন) তাতে অবশ্যই সমতা বিধান করি; কিন্তু যা আমার নিয়ন্ত্রণে নয় (অর্থাৎ কারো প্রতি ভালোবাসা) তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো।”[৭]
.
আরবের নারীরা যেমন খুব কম বয়সে যৌবন প্রাপ্ত হতো ঠিক তেমনি খুব অল্প বয়সে বুড়িয়ে যেতো। যেমন: মাত্র চৌদ্দ-পনের বছর বয়সেই আয়েশা (রা.) এর শরীর ভারি হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (সা.) যখন সওদা (রা.) কে বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল পঞ্চাশ। এ বয়সেই তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি হজ্জে পর্যন্ত যেতে পারেননি অক্ষমতার কারণে।[৮] তাই বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর তার যে পালা রাসূল (সা.) এর সাথে ছিল তা তিনি আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দেন।[৯] সে সময়ে শারীরিকভাবে তার কোন চাহিদা ছিল না।
.
ইসলাম বিদ্বেষীদের কাজ হচ্ছে রাসূল (সা.) যা ই করেছেন তা নিয়ে সমালোচনা করা। তাই রাসূল (সা.) যখন নয় বছরের আয়েশা (রা.) এর সাথে সংসার করেছিলেন তখন তা নিয়ে তারা সমালোচনা করে। মধ্যবয়স্কা উম্মে হাবীবাহকে(৩৬) বিয়ে করা নিয়েও সমালোচনা করে। এমনকি সওদা (রা.) এর মত বিগত যৌবনা এবং বিধবা নারীর সাথে তাঁর সংসার জীবনেরও সমালোচনা করে। তারা দাবী করে যে, সওদা (রা.) যখন শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন রাসূল (সা.) তাকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা করেন। তাই তালাক থেকে বাঁচতে সওদা (রা.) নিজের পালা আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দেন।
.
কিন্তু সীরাত থেকে আমরা এমন কোনো সহীহ বর্ণনা পাই না, যেখানে রাসূল (সা.) সরাসরি সওদা (রা.) কে তালাক দেয়ার ইচ্ছা করেছেন কিংবা এ বিষয়ে কারো সাথে কথা বলেছেন। একমাত্র যে বর্ণনাটি তারা উপস্থাপন করে সেটি আছে তাফসীর ইবনে কাসিরে। সূরা নিসার ১২৮ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসির (রহ.) একটি হাদীস বর্ণনা করেনঃ
“রাসূল (সা.), সওদা (রা.) এর নিকট তালাকের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। তিনি তখন আয়েশা (রা.) এর নিকট বসেছিলেন। রাসূল (সা.) সেখানে প্রবেশ করলে সওদা (রা.) বলেন, ‘যে আল্লাহ্ আপনার উপর স্বীয় বাণী অবতীর্ণ করেছেন এবং স্বীয় সৃষ্টির মধ্যে আপনাকে মনোনীত করেছেন তাঁর শপথ! আমাকে ফিরিয়ে নিন। আমার বয়স খুব বেশী হয়ে গেছে। পুরুষের প্রতি আমার কোন আসক্তি নেই। কিন্তু আমার একান্ত ইচ্ছা যেন কিয়ামতের দিন আমাকে আপনার একজন স্ত্রী হিসেবে উঠানো হয়।’ রাসূল (সা.) তাতে সম্মত হন এবং তাকে ফিরিয়ে নেন। তখন সওদা (রা.) বলেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি আমার পালার দিন ও রাত আপনার প্রিয় স্ত্রী আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দিলাম।”
.
এটা সত্যি যে তাফসীর ইবনে কাসিরে এমন একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এই হাদীসটি সম্পর্কে ইবনে কাসির (রহ.) নিজেই কি মন্তব্য করেছেন তা এই বিজ্ঞ(!) বিশ্লেষকরা কখনোই উল্লেখ করেন না। ইবনে কাসির (রহ.) এই হাদীসটিকে “মুরসাল” বলেছেন।[১০] হাদীসের পরিভাষায়, মুরসাল বলতে এমন হাদীসকে বোঝানো হয় যাতে বর্ণনাকারীদের মধ্যে ধারাবাহিকতা নেই। অর্থাৎ একজন বর্ণনাকারী এখানে অনুপস্থিত। এমন হাদীসকে কখনোই পরিপূর্ণ আত্নবিশ্বাসের সাথে রাসূল (সা.) এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা যাবে না।
.
এটা সত্যি যে, সওদা (রা.) তার পালাটুকু আয়েশা(রা.) কে দিয়েছিলেন। সেটা তালাক থেকে বাঁচতে নয়, বরং রাসূল (সা.) এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে। কারণ, তখন আর তাঁর নিজের চাহিদা ছিল না। এর মধ্যে তার প্রতি রাসূল (সা.) এর কোন অবিচার ছিল না বরং তিনি নিজেই স্ব-প্রণোদিত হয়ে এমনটা করেছিলেন। সহীহ বুখারীতে এসেছেঃ
“যখন আল্লাহ্র রাসূল কোন ভ্রমণে বের হতেন তখন সাথে কোন স্ত্রীকে নিবেন তার জন্য লটারী করতেন। লটারীতে যার নাম আসতো, তিনি তাকেই নিতেন। তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর( সাথে থাকার জন্য) রাত ও দিন নির্দিষ্ট করে দিতেন। কিন্তু সওদা আল্লাহ্র রাসূলকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজ পালা আয়েশাকে দিয়ে দিলেন।”[১১]
.
আয়েশা (রা.) তাই সওদা (রা.) সম্পর্কে বলেন,
“আমি সাওদা বিনতে যাম‘আহ এর চেয়ে অধিক স্নেহময়ী কোন নারীকে দেখিনি। আমি যদি একদম তার মতো প্রেমময়ী হতে পারতাম!" [১২]
.
শুধু সওদা (রা.) নয়, রাসূল (সা.) এর অন্যান্য স্ত্রীরাও মাঝে মাঝে তাদের পালা আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দিতেন। এর মাধ্যমে তারা রাসূল (সা.) কে সন্তুষ্ট করতে চাইতেন। যেমনঃ
“ একবার রাসূল (সা.), সাফিয়া(রা.) এর প্রতি খুব রাগ করলেন। সাফিয়া (রা.) তখন আয়েশা (রা.) এর নিকট গেলেন এবং বললেন, ‘তুমি কি এমন কিছু করতে পারবে যাতে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) আমাকে মাফ করেন? তাহলে আমি আমার দিনটা তোমাকে দিয়ে দিব।’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ’।
তারপর আয়েশা (রা.) তার হলুদ রঙের ওড়নাটি নিলেন। তাতে সুগন্ধী লাগালেন আর রাসূল (সা.) এর পাশে বসে পড়লেন। রাসূল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা! আমার কাছ থেকে দূরে থাকো। আজকে তোমার দিন না।’ আয়েশা (রা.) জবাবে বললেন, ‘আল্লাহ্র রহমত আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন।’ তারপর তিনি পুরো ব্যাপারটা রাসূল (সা.) কে বুঝিয়ে বললেন। রাসূল (সা.) তখন সাফিয়া (রা.) কে ক্ষমা করে দেন।[১৩]
.
সীরাতকাররা রাসূল (সা.) এর বহুবিবাহের পিছনে যে যুক্তি প্রদান করেন, তার মধ্য অন্যতম হচ্ছে- বহুবিবাহের মাধ্যমে রাসূল (সা.) অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের সাথে রাজনৈতিক সম্প্রীতি স্থাপন করেছিলেন।[১৪] ইসলামবিদ্বেষীরা সওদাহ (রা.) এর উদাহারণ টেনে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, অসহায় নারীদের আশ্রয় দেয়া নয় বরং নারীদেহ ভোগই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এতোক্ষণের আলোচনায় আমাদের নিকট এটা স্পষ্ট যে, তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
.
তাদের দাবীতে যে কোন সত্যতা নেই সেটা আরো পরিষ্কার বোঝা যাবে যদি আমরা রাসূল (সা.) এর অন্যান্য স্ত্রীদের দিকে তাকাই। রাসূল (সা.) এর ১১ জন স্ত্রীদের মধ্যে দশ জনই ছিলেন হয় বিধবা না হয় তালাক প্রাপ্তা। কেউ আবার একইসাথে বিধবা ছিলেন আবার তালাকপ্রাপ্তাও ছিলেন। মক্কার সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হয়ে পঁচিশ বছরে বিয়ে করেছিলেন তাঁর চেয়ে পনেশ বছরের বড় একজন নারীকে। আর তাঁর সাথে টানা পঁচিশ বছর সংসার করেছিলেন। অনেকে বলেন, খাদিজা (রা.) এর ভয়ে তিনি তখন আর বিয়ে করতে পারেননি। তারা কি বলতে পারেন যদি ভয়েই তিনি এমনটা করে থাকেন, তবে ঠিক কোন ভয়ে তিনি খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর বহু বছর পর তার গলার হার দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন?[১৫] কেন তিনি তার মৃত্যুর বহু বছর পরও ভালোবাসার স্মরণে তার বান্ধবীদের নিকট গোশত উপহারস্বরূপ পাঠাতেন?[১৬] ঠিক কোন ভয়ে বহু বছর পর খাদিজা (রা.) এর বোন হালাহ (রা.) এর কণ্ঠস্বর শুনে তিনি এতোটা আবেগতাড়িত হয়েছিলেন যে আয়েশা(রা.) পর্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন?[১৭]
.
খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুর পর তার জীবনের বাকী বিয়েগুলো করেন ৫০-৬৩ বছর বয়সে। যে সময়টাতে পুরুষরা নারীদের প্রতি আকর্ষণ হারাতে থাকে, তাদের শারীরিক চাহিদা কমতে থাকে, সে বয়সেই তিনি এ বিয়েগুলো করেন। ঠিক কতটুকু অযৌক্তিক হলে তাঁকে এরপরেও “নারীলোভী” বলা যায়? আমরা যদি রাসূল (সা.) এর কয়েকজন স্ত্রীদের সাথে তাঁর বিয়ের কারণগুলো দেখি তাহলে ইসলামবিদ্বেষীদের যুক্তিগুলোর অসারতা আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হবে।
.
হাফসা বিনতে উমার (রা.): তাঁর স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ উহুদ যুদ্ধে আহত হন এবং পরবর্তীতে মারা যান।[১৮] উমার (রা.) মেয়ের ব্যাপারে উসমান (রা.) কে প্রস্তাব করলে তিনি নাকচ করে দেন। এতে কিছুটা আহত হয়ে আবু বকর (রা.) কে প্রস্তাব দিলে তিনি মৌনতা অবলম্বন করেন। এতে উমার (রা.) আরো কষ্ট পান। পরবর্তীতে রাসূল (সা.), হাফসা (রা.) কে বিয়ে করেন। বিয়ের ফলে উমার (রা.) প্রচণ্ড খুশি হন।
.
যয়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.): পর পর দুই স্বামীকে হারিয়ে তিনি বিয়ে করেন রাসূল (সা.) এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রা.) কে। তিনিও উহুদ যুদ্ধে প্রাণ হারালে রাসূল (সা.) তাঁকে বিয়ে করেন। রাসূল(সা.) ছিলেন তাঁর চতুর্থ স্বামী। গরিব আর অসহায়দের প্রতি খুব দানশীল হবার কারণে তাকে “উম্মুল মাসাকীন” বা “মিসকীনদের মা” বলা হতো। তিনি রাসূল (সা.) এর সাথে কেবল তিন মাস সংসার করার পর মৃত্যুবরণ করেন।[১৯]
.
উম্মে হাবীবাহ রামালাহ বিনতে সুফিয়ান (রা.): স্বামী উবাইদুল্লাহ বিন জাহশের সাথে তিনি হিজরত করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে, তার স্বামী হাবশায় হিজরত করার পর মুরতাদ হয়ে যান। ফলে, তাদের বিয়ে ভেঙ্গে যায়। দূরদেশে তিনি একা হয়ে পড়েন। রাসূল (সা.) তখন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়ের প্রস্তাবে তিনি প্রচণ্ড খুশী হন। এতোটাই খুশি হন যে নাজশী বাদশাহর যে দূত বিয়ের সংবাদ নিয়ে যায় তাকে তিনি দুইটি কাঁকন, পায়ের দুইটি রুপার মল আর আঙ্গুলসমূহের রূপার আংটিগুলো দান করেন।[২০] তখন তার বয়স ছিল ৩৬ বছর। আবু সুফিয়ান সে সময়ে রাসূল (সা.) এর প্রধান শত্রু ছিলেন। এমনকি তিনিও মেয়ের সাথে রাসূল(সা.) এর সাথে বিয়ের সংবাদ শুনে বলেন, “মুহাম্মদের চেয়ে উত্তম স্বামী আর কে আছে?”[২১] উম্মে হাবীবাহ (রা.), রাসূল (সা.) এর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। একবার পিতা আবু সুফিয়ান মদিনায় তার ঘরে আসলে তিনি বিছানা সরিয়ে ফেলেন। আবু সুফিয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “হে আমার মেয়ে! তুমি কি মনে করছো যে বিছানা আমার জন্য উপযুক্ত না, না আমি বিছানার জন্য উপযুক্ত না?” উম্মে হাবীবাহ (রা.) তখন জবাব দেন, “এ হচ্ছে রাসূল(সা.) এর বিছানা, আপনি হচ্ছেন অপবিত্র মুশরিক।”[২২]
.
উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া (রা.): তাঁর স্বামীও উহুদ যুদ্ধেও আহত হয়ে মারা যান। রেখে যান দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। তাদের সাথে নিয়েই রাসূল (সা.) তাকে বিয়ে করেন।[২৩] তার পরামর্শ হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ে বেশ ফলপ্রসূ হয়।[২৪]
.
জুয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ(রা.): বনু মুসতালিকের যুদ্ধে পুরো গোত্রসহ বন্দী হন। রাসূল (সা.) এর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জুয়াইরিয়া (রা.) খুশীমনে তা গ্রহণ করেন। মোহর হিসেবে রাসূল (সা.) বনু মুসতালিকের ৪০ জনকে মুক্ত করেন। সাহাবীদের নিকট বিয়ের সংবাদ পৌঁছালে তারাও সকল দাসদের মুক্ত করে দেন। কারণ, বিয়ের ফলে তার গোত্রের লোকেরা রাসূল (সা.) এর শ্বশুর বাড়ীর লোকজন হয়ে যান। আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূল (সা.) কর্তৃক জুয়াইরিয়াকে বিয়ের ফলে বনু মুসতালিকের একশ পরিবার মুক্ত হয়ে যায়। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য জুয়াইরিয়ার চেয়ে অধিক বরকতময় কোন নারী ছিল বলে আমার জানা নেই।”[২৫]
.
মায়মুনা বিনতুল হারেছ (রা.): তিনি প্রথমে মাসউদ ইবনে আমরকে বিয়ে করেন এবং তালাকপ্রাপ্তা হন। পরে, তিনি আবু রাহেমকে বিয়ে করেন এবং এ স্বামী মারা যায়। ফলে, তিনি বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্তা হন। পরবর্তীতে, রাসূল (সা.) তাকে বিয়ে করেন।[২৬] তখন তার বয়স ছিল ৩৬ বছর।
.
রাসূল (সা.) জোর করে কাউকে ঘর সংসার করতে বাধ্য করেননি। বরং সবাই খুশি মনে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। উমাইমা বিনতুন নুমান(কারো কারো মতে ফাতিমা বিনতুয যাহহাক) নামে এক মহিলাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তার নিকট নিভৃতে গেলে সে বলে উঠে, “আমি আপনার হাত হতে আল্লাহ্র স্মরণ গ্রহণ করছি।” রাসূল (সা.) তার উপর একটুও জোর করলেন না। বললেন, “তুমি এক মহান স্মরণদাতার স্মরণ গ্রহণ করেছ। নিজ পরিবারের কাছে চলে যাও।” মহিলাটি পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। তাই সে উটের লেদ কুড়াতো আর বলত, “আমি দূর্ভাগা নারী।”[২৭]
.
অনেক সমালোচক যুক্তি প্রদর্শন করে যে, উম্মুল মুমিনীনরা রাসূল(সা.) এর ভয়ে তাঁর জীবদ্দশায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেনি। মৃত্যুর পর ঠিকই একজন বিয়ে করা হারাম হওয়ার পরেও বিয়ে করেন।[২৮] এ ক্ষেত্রে যার কথা বলা হচ্ছে তার নাম কাতীলা বিনতে কায়স। রাসূল (সা.) তার সাথে ঘর করেননি এমনকি তাকে দেখেনও নি। মৃত্যুর কেবল দুইমাস আগে তাকে তিনি বিয়ে করেন। তার ব্যাপারে রাসূল (সা.) ওসীয়ত করে যান যে, “কাতীলাকে এখতিয়ার দেয়া হবে। সুতরাং সে ইচ্ছা করলে তার উপর নবীপত্নীসুলভ পর্দার হুকুম সাব্যস্ত হবে এবং মুমিনদের জন্য তাকে হারাম করা হবে। আর নতুবা যাকে ইচ্ছা তাকে সে বিয়ে করতে পারবে।” মৃত্যুর ঠিক আগেও রাসূল (সা.) একজন নারীর জীবনের দিকে খেয়াল রেখেছিলেন। পরবর্তীতে, সে ইকরিমা ইবনে আবু জাহলকে বিয়ে করে।[২৯]
.
উম্মে হানী (রা.) নামে রাসূল (সা.) এর এক চাচাতো বোন ছিল। তার সাথে রাসূল (সা.) কে জড়িয়ে এক শ্রেণীর নাস্তিকরা খুব কুরুচিপূর্ণ কথা লিখে। তিনি যখন প্রায় ৬০ বছরের কাছাকাছি ছিলেন তখন রাসূল (সা.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উম্মে হানি (রা.) তখন বলেন, “আমার বয়স হয়ে গেছে। আমার অনেক সন্তান আছে। আমার ভয় হয় ওরা আপনাকে কষ্ট দিবে।” রাসূল (সা.) তখন খুশীমনে এ প্রস্তাব ফিরিয়ে নেন।[৩০] একজন অসহায় নারীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা নিয়ে এতো অশ্লীল কথা লেখার কারণ আমার নিকট পরিষ্কার না।
.
.
অবশ্য সমকামিতা, অযাচারের পক্ষে যারা কলম ধরেন তাদের নিকট বহুবিবাহ কিভাবে অশ্লীলতা হয় সেটাই তো একটা গবেষণার ব্যাপার।
------
.
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন [ফেসবুক id: Shihab Ahmed Tuhin]
#সত্যকথন
.
--------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
[১] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [তৃতীয় খণ্ড, ২৩২ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[২] ইবনে হিশাম ১/৩২১-৩৩২
[৩] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [তৃতীয় খণ্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[৪] সিলসিলা সহীহাহ, হাদীস নং ২৫২৩
[৫] সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)- মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব [পৃষ্ঠা ৭৬৩]
[৬] সীরাতুল হাবীব- সাইফুদ্দিন বেলাল [ পৃষ্ঠা ১৪৬]
[৭] আবু দাউদ
[৮] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [তৃতীয় খণ্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[৯] আর রাহেকুল মাখতুম- আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী(রহ.) [পৃষ্ঠা ১৬০]
[১০] তাফসীর ইবনে কাসির- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [সূরা নিসার ১২৮ নং আয়াতের তাফসীর, পৃষ্ঠা ৫৮৫]
[১১] সহীহ বুখারী, খণ্ড-৩, হাদীস নং-৭৬৬
[১২] সহীহ মুসলিম, খণ্ড-৮, হাদীস নং-৩৪৫১
[১৩] ইবনে মাজাহ, কিতাবুন নিকাহ।
[১৪] আর রাহেকুল মাখতুম- আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী(রহ.) [পৃষ্ঠা ৫৪১-৫৪৬]
[১৫] সীরাতে মোস্তফা- মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী(রহ.) [পৃষ্ঠা ৩৬৮]
[১৬] মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- আব্দুল হামিদ মাদানি
[১৭] সাহাবী চরিত- মাওলানা যাকারিয়া(রহ.)
[১৮] সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)- মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব [পৃষ্ঠা ৭৬৪]
[১৯] সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)- মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব [পৃষ্ঠা ৭৬৫]
[২০] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [চতুর্থ খণ্ড, ২৬৭ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[২১] Young Ayesha – Anwar Al Awlaki
[২২] আর রাহেকুল মাখতুম- আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী(রহ.) [পৃষ্ঠা ৪৫৪]
[২৩] সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)- মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব [পৃষ্ঠা ৭৬৫]
[২৪] সহীহ বুখারী, হাদীস নংঃ ২৭৩২
[২৫] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [চতুর্থ খণ্ড, ২৯৩ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[২৬] সীরাতুল হাবীব- সাইফুদ্দিন বেলাল [ পৃষ্ঠা ১৪৬]
[২৭] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [পঞ্চম খণ্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
[২৮] কুর’আনে রাসূল(সা.) এর স্ত্রীদের উম্মুল মুমিনীন বলা হয়েছে। শব্দটির অর্থ মুমিনদের মা। তাই তারা সকল মুসলিমদের কাছে বিবাহের জন্য হারাম ছিলেন।
[২৯] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- হাফিজ ইবনে কাসির(রহ.) [পঞ্চম খণ্ড, ৪৮৯ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ Click Here এবং Click Here
ফেসবুক পেজঃ Click Here
Post a Comment