উপলব্ধি: আল-কোরআনের বৈপরীত্য – বাস্তবিক নাকি মতিভ্রম?


সেদিন বৃহস্পতিবার। যথারীতি বিকেল পাঁচটায় ক্লাস শেষ হল। ভেবেছিলাম আসরের সালাত আদায় করে ফারিসকে নিয়ে বেড়াতে যাব। কিন্তু তা আর হলো না। সালাত আদায় করে সবেমাত্র বেরিয়েছি এমন সময় বৃষ্টি শুরু হল। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর দেখলাম বৃষ্টির মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলছে। দৌড়ে আমরা পাশের যাত্রী ছাউনীতে গিয়ে উঠলাম। তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। যাত্রী ছাউনীতে আমাদের সাথে আরও বেশ ক’জন লোক ছিল।
যাত্রী ছাউনীর একটি লোক বারবার ফারিসের দিকে তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এল। এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে খানিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু বলবেন, আংকেল?”

লোকটি জবাবে বললো, “আমি জোবায়ের। জোবায়ের আহমেদ। অনুমতি দিলে একটা প্রশ্ন করি?”
“জ্বি করেন”।
লোকটি ফারিসের দিকে ইশারা করে বললো, “আচ্ছা বাবা, ঐ যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তিনি কি ফারিস?”
- হ্যাঁ আংকেল। যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে, ঐ-ই ফারিস।
- তাঁর সাথে একটু কথা বলা যাবে?
- জ্বি যাবে। দাঁড়ান আমি ডাকছি। ফারিস। এই ফারিস। এইদিকে একটু আয় তো।
.
ডাক শুনে ফারিস আসলে আমি বললাম, “এই আংকেল তোকে খুঁজছেন। কি যেন বলবেন”।
সালাম মোসাফা শেষে ফারিস বললো, “কি জানতে চান আংকেল, বলুন?”
- আমি আপনাকে অনেকদিন যাবত খুঁজছি। কিন্তু এভাবে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। যাক, দেখা হয়ে ভালই হল।
- আপনি আমায় কীভাবে চেনেন?
- অনলাইনে আপনার লিখা পড়েছি। আমার এক কলিগ আছেন যার ছেলে আপনাদের সাথে পড়ে। তার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। সে থেকেই আপনার সাথে দেখা করার অনেক ইচ্ছে। কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু কি সৌভাগ্য দেখুন - আজ কাকতালীয় ভাবে আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।
- অহ আচ্ছা। আংকেল আমি তো আপনার ছেলের বয়সী তাই আমাকে তুমি করে বললেই বেশি খুশি হব। তা আমার কাছে কি মনে করে?
- আসলে আমি একটা বিষয় নিয়ে তোমার সাথে ডিসকাস করতে চাচ্ছিলাম। তাই।
- কি ধরনের বিষয়?
- বলবো। সব বলবো। তবে এখানে নয়।
- তাহলে?
- আমার যে একটা আর্জি ছিলো?
- জ্বি বলুন।
.
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে ফারিসকে দিয়ে বললেন, “এই যে আমার কার্ড। এখানে আমার বাসার ঠিকানা আছে। আমার খুব ইচ্ছে একদিন তুমি সময় করে আমার বাসায় আসবে”।
ফারিস বললো, “কথা তো দিতে পারছি না। তবে ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো”।
ভদ্রলোকটির মুখে অপ্রসন্নতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল। তিনি ফারিসের হাত ধরে বললেন, “বাবা আমাকে কথা দাও তুমি আসবে। প্লিজ”।
লোকটি এমনভাবে মিনতি করছিলো যে, হ্যাঁ করা ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। তাই ফারিস রাজি হয়ে গেল।
ভদ্রলোকটি বেশ হাসিমুখে বললেন, “থ্যাংক ইউ মাই সান। আর হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার এই বন্ধুকে সাথে নিয়ে আসবে। আমি খুব খুশি হব।”
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কেটে গেলো। আমরা যাত্রী ছাউনী থেকে নিজ-নিজ গন্তব্যের দিকে যাত্রা করলাম।
.
প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে ভার্সিটি যেদিন বন্ধ ছিল, সেদিন আমি আর ফারিস জোবায়ের সাহেবের বাড়ীর খোঁজে রওয়ানা হলাম। প্রায় ঘণ্টা খানিক পর আমরা কাঙ্ক্ষিত বাসাটি খুঁজে পেলাম। বাসার কলিংবেল চাপতেই এক পিচ্চি এসে দরজা খুলে দিল।
এরপর বললো, “আফনারা কারা? কি চাইন?”
ফারিস বললো, “জোবায়ের সাহেব আছেন বাসায়। আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি?”
“যে আছেন। আফনারা বিতরে আইন। আমি বড় সাবরে ডাইক্কা দিতাছি”।
.
ছেলেটি আমাদেরকে বসার ঘরে বসতে দিয়ে বিদায় নিল। মিনিট পাঁচেক পর জোবায়ের আংকেল এলেন। আমাদেরকে দেখে তিনি বেশ খুশি হয়েছেন বলেই মনে হল। কুশলাদি বিনিময় শেষে বললেন, “তোমরা এসেছ আমি বেশ খুশি হয়েছি। তবে কষ্ট দেয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী”।
.
ভদ্রলোকের কথা শেষ হলে ফারিস বললো, “পাখি পালনের প্রতি আপনার বেশ ঝোঁক, তাই না?”
জোবায়ের সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “কীভাবে বুঝলে?”
- আপনার বুক সেলফ দেখে।
- মানে?
- আপনার সেলফ ভর্তি পাখি পালন, পাখির পুষ্টি, পাখির পরিচর্যা ইত্যাদি বই দিয়ে ভর্তি। আর বাসার বাইরের বড় গাছগুলোতে দেখলাম মাটির হাঁড়ি বাঁধা। বেলকোনেতে পাখির খাঁচা; তাই বললাম আর কি”।
- অহহ আচ্ছা। তুমি দেখছি অনেক জিনিস খেয়াল করেছো।
.
ফারিস যেখানেই যাক না কেন, সেখানকার অবস্থাটা সে অবশ্যই ভালোকরে বিশ্লেষণ করবে। এটা তার চিরাচরিত অভ্যাস। সে আজো তার ব্যতিক্রম করে নি। জোবায়ের আংকেলের কথা শেষ হলে ফারিস জিজ্ঞেস করলো, “কি যেন প্রবলেম ডিসকাস করবেন বলে আসতে বলেছিলেন?”
- বলছি বলছি। এত তাড়া কিসের? আগে বল কি খাবে? চা না কফি?
- কফি।
.
জোবায়ের সাহেব কাজের ছেলেটিকে ডেকে কফি দিতে বললেন। এরপর ফারিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি একটা সমস্যায় পরেছি। সেটার সমাধান দেবার জন্যই তোমাকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি”।
“কি ধরনের সমস্যা?” ফারিসের প্রশ্ন।
.
“সমস্যাটা আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার একটি মাত্র ছেলে। নাম জনি। ক্লাস টেনে পড়ে। ছাত্র হিসেবে বেশ ভাল। কিন্তু ইন্টারনেটের প্রতি তাঁর খুব ঝোঁক। সময় পেলেই ফেসবুক, গুগল, ইমু ইত্যাদি নিয়ে পরে থাকে। খুব আদরের ছেলে বলে ওর কোন কাজে আমি বাঁধা দেই নি। যা চেয়েছে তার থেকেও বেশি দেয়ার চেষ্টা করেছি। আজ সেই ছেলেটাই আমার হারিয়ে যেতে বসেছে”।
জোবায়ের সাহেবের কথা শেষ হলে আমি বললাম, “কি হয়েছে ওর? ওর কি বড় ধরনের কোন অসুখ করেছে?”
জোবায়ের সাহেব বললেন, “না, না বাবা। অসুখ করে নি। অসুস্থতা ওর সম্যসা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়”।
.
ফারিস বললো, “ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি?”
- জ্বি, জ্বি। সেজন্যেই তো তোমাদেরকে ডেকেছি। আসলে সমস্যাটা হচ্ছে, জনি দিন-দিন সংশয়বাদী হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটে নাস্তিকদের যেসব ব্লগ রয়েছে ঐগুলি সে নিয়মিত ব্রাউজ করে। আর সেখান থেকে খুঁজে-খুঁজে আজগুবি সব প্রশ্ন বের করে আমার সাথে তর্ক করে। ইসলাম সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুবই কম। যার ফলে আমি কখনো-কখনো ওর সাথে তর্কে হেরে যাই। আমার হারাটা মেজর প্রবলেম নয়। মেজর প্রবলেম হল, আমি তর্কে ওর সাথে পারি না বলে সে আমাদের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা করে। ওর কাছে মনে হয় কোরআনে অনেক স্ববিরোধী আয়াত রয়েছে। বৈজ্ঞানিক ভুল রয়েছে। তাই কোরআন কখনো স্রষ্টার বানী হতে পারে না। ভেবেছিলাম ওকে কোন আলেমের কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু কোনভাবেই রাজি করাতে পারি নি। তাই তোমাদেরকে এতটা পথ কষ্ট দিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছি। আই’ম সরি মাই সান।
- ইট’স ওকে আংকেল। জনি আছে বাসায়? কথা বলা যাবে ওর সাথে?
- আসলে কি ভাগ্য আমার, তোমরা এসেছো আর জনিও কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছে। একটু বস। আমি দেখছি।
.
এরপর ভদ্রলোক বাড়ীর ভেতরে গেলেন। মিনিট দশেক পর ফিরে এলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কফি, বিস্কুট আর চানাচুর। কফির কাপ আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সবেমাত্র কাপে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় ভেতর থেকে একটি ছেলে এল। পরনে গেঞ্জি, হাতে ট্যাবলেট ফোন, কানে ইয়ারফোন। জোবায়ের সাহেব আমাদেরকে ছেলেটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই ছেলেটাই জনি। জোবায়ের সাহেবের একমাত্র সন্তান। জনি ফারিসের মুখোমুখি বসলো।
.
ফারিস জনিকে লক্ষ্য করে বললো, “কেমন আছ ভাইয়া”?
- ভালো। আপনি?
- আলহামদুলিল্লাহ। ভালো।
- পড়াশুনা কেমন হচ্ছে তোমার?
- এইতো চলছে কোনরকম।
- জনি, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
- হ্যাঁ করেন।
- ধর আমি তোমাকে একটি ইংলিশ নোবেল বই গিফট করলাম। এরপর বললাম যে, ‘বইটা পড়ে তোমার মতামত জানাবে’। কিন্তু তুমি বইটি পড়লে না। এমন একজনের কাছ থেকে বইটি সম্পর্কে ধারণা নিলে যে ইংরেজী ভাষা জানে না। ইংলিশ গ্রামারের রুলস জানে না। সম্পূর্ণ বইটি সে পড়েও নি কোনদিন। এরপর তুমি আমাকে ইনফরম করলে যে, ‘বইটিতে অনেক সমস্যা আছে। স্ববিরোধী বক্তব্য আছে। গ্রামারটিক্যাল ভুল আছে’।
ব্যাপারটা কি ঠিক হবে, বল?
- না, না।
- তাহলে কোনটা করলে ভালো হত?
- সবথেকে ভালো হত বইটি নিজে আদ্যোপান্ত পড়ার পর মতামত দেয়া। আর নিজে না পড়তে পারলে যে ভালো ইংরেজী জানে তাঁর কাছ থেকে বইটি সম্পর্কে ধারণা নেয়া। এরপর মন্তব্য করা।
- এক্স্যাক্টলি। এক্স্যাক্টলি মাই ব্রাদার। এবার আমাকে বল, কেউ যদি নিজে কোরআন না পড়ে মুক্তমনা ব্লগ থেকে কোরআন কারীমের ভুল খুঁজতে যায় তাহলে সেটা কি ঠিক হবে?
.
জনি কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর বললো, “তারা তো ভুল কিছু প্রচার করছে না। কোরআনের যে জায়গা গুলোতে সমস্যা রয়েছে সেগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরছে। আমাদেরকে সতর্ক করছে”।
.
জনির মাথাটা যে বেশ খারাপ হয়েছে, তা ওর কথা থেকেই বুঝা যাচ্ছে। নচেৎ যে ব্লগের লেখকদের বাংলা ভাষাজ্ঞানই ঠিক নেই; তাঁরা আবার আরবী গ্রামারের ভুল ধরে কি করে? ফারিস জনির বক্তব্য শুনে মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা জনি, আমরা খোলাখুলি কথা বলি। কোরআনের কোন কোন জায়গা গুলোতে তুমি সমস্যা খুঁজে পেয়েছো? আই মিন মুক্তমনা থেকে জেনেছো?”
- অনেক জায়গায়।
- যেমন?
- একটু দাঁড়ান আমি বলছি।
.
.
জনি তাঁর মোবাইল থেকে একটি পিডিএফ ফাইল বের করলো। এরপর ফারিসকে বললো, “কোরআনের (৫১:৫৬) তে মানুষ সৃষ্টির কারণ বলা হয়েছে, কেবল আল্লাহর ইবাদত। কিন্তু ৭:১৫৮- তে বলা হয়েছে মুহাম্মাদের সুন্নাহ অনুসরণের কথা। তাহলে মানব সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? আল্লাহর ইবাদত নাকি মুহাম্মাদের সুন্নাহ অনুসরণ?”
.
ফারিস জনির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলো, “জনি সত্যি করে বল তো, তুমি কি কোরআন পড়েছো?”
“কিছুটা”। জনির উত্তর।
“কিছুটা কোরআন আর মুক্তমনা ব্লগের লিখা থেকেই কি কোরআন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়?”
.
জনি কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। ফারিস বললো, “এবার তোমার প্রশ্নে আসি। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি? স্রষ্টার ইবাদত? নাকি মুহাম্মাদের (ﷺ ) সুন্নাহ অনুসরণ? আমাদেরকে সৃষ্টি করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল, মহান আল্লাহর ইবাদত করা। অন্য সমস্ত সৃষ্টির ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। এককথায় নিজেকে শত ইলাহের গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর গোলামীতে লিপ্ত করা।
- কিন্তু কোরআন তো অন্যকিছু বলছে।
- লেট মি ফিনিস ব্রাদার। কোরআন কারীমের সূরা আন-নাজমের ২-৪ আয়াতে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেন, “তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়। এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এটাতো ওহী যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”।
সূরা আহকাফের ৯ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আমি এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র”।
এসব আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, রাসূল ( ﷺ) নিজ থেকে বানিয়ে-বানিয়ে কোন কথা প্রচার করেন নি। কোন শিক্ষা দেন নি। তিনি যা প্রচার করেছেন, যা শিখিয়েছেন তা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল তাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-হাক্কাহ এর ৪৪-৪৬ আয়াতে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করে চালাতে চেষ্টা করত – আমি অবশ্যই তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম। কেটে দিতাম তাঁর জীবন-ধমনী”।
এখন আমাকে বলতো, মুহাম্মাদের (ﷺ ) সুন্নাহ প্রকৃতপক্ষে কার শিক্ষা?
- আল্লাহর।
- হ্যাঁ, মহান আল্লাহর শিক্ষা। আর তুমি কোরআন পড়লে দেখবে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ আযযা ওয়া জাল মুহাম্মাদের (ﷺ ) সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন কারীমের সূরা আলে-ইমরানের ৩১ আয়াতে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল মুহাম্মাদকে ( ﷺ) লক্ষ্য করে বলেছেন, “তুমি বলঃ যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।
একটা জায়গায় তোমার মারাত্মক ভুল হয়েছে। আর সেটা হল, তুমি কোরআন সম্পূর্ণ পড় নি। পড়লে অবশ্যই এমন মতিভ্রম হত না। আমরা মুসলিমরা মুহাম্মাদের (ﷺ ) সুন্নাহ এই জন্যে অনুসরণ করি না যে, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। আমরা অনুসরণ করি এই জন্যে যে, আল্লাহ আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ যদি মুহাম্মাদের ( ﷺ) সুন্নাহ অনুসরণ করার নির্দেশ না দিতেন, তাহলে আমরা কখনোই করতাম না।
- বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার করলে ভালো হত।
- মনে কর, তুমি তোমার কোন প্রিয় লোককে ট্রেইনার হিসেবে কোথাও পাঠালে। তাকে সেখানে গিয়ে কি কি করতে হবে তা তুমি নিজ হাতে শিখিয়ে দিলে। এরপর বললে যে, ‘আমি যেভাবে বললাম ঠিক সেভাবেই মানুষকে শিক্ষা দিবি’। সে তাঁর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে চলে গেল। লোকটা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে মানুষকে বললো, ‘আমাকে আমার বস মিঃ জনি এখানে পাঠিয়েছেন। আর তোমাদেরকে এই এই জিনিস গুলো শিক্ষা দিতে বলেছেন’। তুমি তাকে যেখানে পাঠালে সেখানকার মানুষ তাঁর কথাগুলো ঠিক সেভাবেই মানলো, যেভাবে তুমি তাকে শিখিয়েছিলে। এখন সেখানকার লোকজন যদি তোমার পাঠানো লোকের কথা অনুসরণ করে, তাহলে আলটিমেটলি ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? লোকজন কি তোমার পাঠানো লোকটার অনুসরণ করছে? নাকি ইনডাইরেকটলি তোমাকেই ফলো করছে? তোমার কথার আনুগত্য করছে?
- অবশ্যই আমার কথার আনুগত্য করছে। কেননা আমার পাঠানো লোকটাকে তো আমিই শিক্ষা দিয়েছি। আর সে আমার শিক্ষার বিপরীতে কোন কথা প্রচার করে নি।
- আমরা মুসলিমরাও মুহাম্মাদের (ﷺ ) সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করি। কেননা আল্লাহ আযযা ওয়া যাল তাকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মুহাম্মাদ তার জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্যেরই দাওয়াত দিয়েছেন। নিজে থেকে বানিয়ে কিছু প্রচার করে নি। তিনি তাই বলেছেন, যা আল্লাহ তাকে বলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তাই করতে বলেছেন, যা আল্লাহ তাকে শিখিয়েছেন। তাই তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ মানে আল্লাহর হুকুমের অনুসরণ। আর আল্লাহর হুমুক পালনের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্যে।
.
ফারিসের কথা শেষ হলে জনি আবার মোবাইলের দিকে নজর দিলো। আমি চানাচুর খাচ্ছিলাম আর ফারিস ও জনির কথোপকথন শুনছিলাম। জোবারের আংকেল বেশ চুপচাপ হয়ে বসে আছেন আর চা পান করছেন। মনে হচ্ছে যেন পিন-পতন-নীরবতা বিরাজ করছে। ।
এভাবে কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর জনি আবার ফারিসকে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা ভাই, কোরআনকে আপনারা সমগ্র মানবজাতির জীবন বিধান হিসেবে বিশ্বাস করেন কি?”
.
“কেন করবো না? অবশ্যই করি”। ফারিসের ঝটপট উত্তর।
“কোরআনের বহু আয়াতে মুহাম্মাদের পার্সোনাল সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে। সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো বিধানে একজন নবীর জন্য আল্লাহর এত মাথাব্যথা থাকবে কেন? এ থেকে কি প্রমাণ হয়না যে, কোরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো কোন কিতাব নয়?”
.
জনির শিশুসুলভ প্রশ্ন আমাকে বেশ বিরক্ত করছিলো। কিন্তু ফারিস - ওর মুখে কোন বিরক্তির ছাপ নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে সে জনির কথাগুলো শ্রবণ করছিলো।
.
জনির প্রশ্ন শুনে বেশ হাসিমুখে বললো, “আমি তো তোমাকে খুব ব্রিলিয়ান্ট ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে হতাশ করলে ভাই। এমন একটা প্রশ্ন করলে, যা প্রশ্ন হবারই যোগ্য নয়। তবুও আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল কোরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ )-কে আমাদের সকল কর্মের মডেল বানিয়েছেন।
সূরা আন-নূরের ৫৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘বল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর; অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী; এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্বতো শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া’।
এছাড়া আরও অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসুলের ( ﷺ) আনুগত্য করার, তার সুন্নাহকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন”।
.
ফারিসের কথা শেষ না হতেই জনি বলে উঠলো, “তাতে কি আমার অভিযোগ খণ্ডন হয়?”
- আগে তো আমাকে বলতে দাও। তার পর না হয় মন্তব্য কর?
- আচ্ছা বলুন।
- ইসলাম এমন একটা দ্বীন যা, থিয়োরীর পাশাপাশি মানুষকে প্রাক্টিক্যাল শিক্ষা দেয়। ইসলাম শুধু তাঁর কোন বিধান বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হয় নি। বরং প্রত্যেকটি মৌলিক বিধান হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছে। আর হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ( ﷺ) দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যিনি একাধারে মানুষকে ওহীলব্ধ জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছেন। পাশাপাশি নিজের জীবনে তা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। প্রত্যেকটি কর্মের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে মডেল বানিয়েছেন। আদর্শিক পুরুষ বানিয়েছেন। কোরআন কারীমের মধ্যে রাসূলে ( ﷺ) পার্সোনাল সমস্যার সমাধান এ জন্য দিয়েছেন, যাতে মানুষ তাদের জন্যে প্রেরিত মডেলের জীবনী থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যাতে মানুষ জানতে পারে, তাদের আদর্শিক পুরুষ জীবনের সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। মানুষ যাতে আল্লাহকে এই অপবাদ না দিতে পারে যে, আল্লাহ যাকে মডেল বানালেন তার কর্ম গুলোকে আমাদের সামনে আনলেন না কেন? মনে কর, আমি কোন সমস্যায় পরলাম। এখন এই সম্যসার সমাধান আমি তাঁর মধ্যে খুঁজে পেলাম না, যাকে আল্লাহ আমার জন্য আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হত? এজন্যেই রাসূলের (ﷺ ) পার্সোনাল কিংবা পারিবারিক সমস্যার সমাধানগুলোও কোরআনে তুলে ধরা হয়েছে। আর আমাদের সমস্যার সমাধানও সেভাবে করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেভাবে রাসূল ( ﷺ) তাঁর সমস্যাবলির সমাধান করেছেন।
.
ফারিস এই পর্যন্ত বলে থামতেই আংকেল জনিকে বললেন, “কিরে মাথার জট খুলেছে? নাকি সব গুলিয়ে ফেলেছিস। ভালো করে জেনে নে তোর ফারিস ভাইয়ের কাছ থেকে। আমাকে আর জ্বালাতন করবি না”।
ফারিস সবেমাত্র চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছে এমন সময় জনি বলে উঠলো, “আমার আরেকটি প্রশ্ন ছিল ভাইয়া”।
ফারিস বললো, “হ্যাঁ বল”।
“আপনি কি জানেন, কোরআনের মধ্যে অনেক বৈজ্ঞানিক ভুল আছে?”
“যেমন?”
.
জনি তাঁর মোবাইল ঘেঁটে আরেকটি প্রশ্ন বের করে বললো, “কোরআনের সূরা লুকমানের ৩৪ নাম্বার আয়াতের মধ্যে বলা হয়েছে, ‘মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না’। অথচ আমরা জানি, ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলে দিতে পারে যে গর্ভের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে। তাহলে কোরআনের এই আয়াত কি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিপন্থী নয়?”
“না, অবশ্যই না”। ফারিসের উত্তর।
- কেন না?
- আচ্ছা মানুষ কি বাইরে থেকে কোনরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গর্ভের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে, এটা শিউরলি বলে দিতে পারবে?
- তা হয়তো পারবে না। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তো অবশ্যই পারবে।
- এরপরেও কিন্তু কোরআনের আয়াত ভুল প্রমাণিত হয় না।
- কেন? কেন হবে না। এটা তো আলটিমটলি ভুল হয়েই আছে।
- হাসালে জনি। এ বয়সে জ্ঞানের থেকে আবেগটা একটু বেশিই থাকে। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও। আয়াতটি সত্যিকার অর্থে কি বুঝাতে চাচ্ছে, তুমি তা অনুধাবন করতে পার নি ভাই।
- তাহলে আপনিই বলেন আয়াতের মর্মার্থ কি?
- সউদি আরবের প্রখ্যাত আলেম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (র.) ‘ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম’ নামক কিতাবের ৩৫ পৃষ্টায় বলেন, “আয়াতটি গায়েবী বিষয় সংক্রান্ত। এখানে আল্লাহ তায়ালা মোট পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তন্মধ্যে মাতৃগর্ভে কি আছে তা একটি। শিশু মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় গায়েবী বিষয়গুলো হল, ‘সে কতদিন মায়ের পেটে থাকবে। কত দিন দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে। কি রকম আমল করবে। সৌভাগ্যবান হবে না দূর্ভাগ্যবান হবে। গঠন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে (ভ্রুণ থেকে) ছেলে না মেয়ে হবে এ সম্পর্কে অবগত হওয়া’।
আর গঠন পূর্ণ হওয়ার পর মাতৃগর্ভে ছেলে না মেয়ে, এ সম্পর্কে অবগত হওয়া ইলমে গায়েবের বিষয় নয়। কেননা গঠন পূর্ণ হলে তা আর গায়েব না থেকে দৃশ্যমান হয়ে যায়।...... আর এ আয়াতে মাতৃগর্ভে ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান হওয়ার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে – একথা বলা হয় নি। হাদীছেও এই মর্মে কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই”।
.
ফারিস এই পর্যন্ত বলে থামলো। এরপর কফির কাপ তুলে চুমুক দিল। আমি চুপ করে পাশে বসে রইলাম। আংকেল চায়ের কাপটা হাত থেকে নামিয়ে বেশ বড় গলায় জনিকে বললেন, “কিরে, এমন চুপসে গেলি কেন? খুব তো পটপট করিস আমার সাথে। আমি কিছু জানি না বলে আমার সাথে তো ভালোই ভাব নিস। এখন কেন চুপ করে আছিস? আরও কিছু বলার থাকলে বল। কাল থেকে যেন আর ব্লগ ব্রাউজ করতে না দেখি। মনে থাকে যেন”।
.
আংকেলের কথা শেষ হলে জনি মাথা নীচু করে আমাদের সামনে থেকে চলে গেল। ও চলে যাওয়ার পর আংকেল কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, “একটি মাত্র ছেলে আমার। আজ ওর এই অবস্থা। নিজেকে কোনভাবেই বুঝাতে পারছি না। কোনদিন ধারণাও করি নি যে আমার ছেলেটা এমন হবে”।
আংকেলের চোখে পানি দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিলো। ছেলেকে উনি অনেক ভালোবাসেন। তাই হয়তো জনির অন্যায় দাবিগুলোও তিনি মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন। আংকেল চোখের পানি মুছে বললেন, “জানি না ওর বোধোদয় হবে কি না? হলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর আমাকে ক্ষমা করবে, তোমাদের দুজনকে আমি কষ্ট দিয়েছি। এতদূর নিয়ে এসেছি। তোমাদের ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। সময় পেলে অবশ্যই এই বুড়ো আংকেলে একবার দেখে যাবে”।
সেদিনকার মত আমরা আংকেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
.
প্রায় মাস খানিক পর জোবায়ের আংকেলের একটা মেইল এল ফারিসের কাছে। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “আসসালামু আলাইকুম ফারিস। আশা করি ভালো আছ। আমি যে আজ কতটা আনন্দিত, তা তোমাকে বুঝাতে পারবো না। আল্লাহ সত্যিই আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমার ছেলের প্রতি করুণা করেছেন। জনি অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছে। সত্যকে চিনতে শিখেছে। নিয়মিত নামাজ পড়ছে। দাড়িও রেখেছে। তুমি ওর জন্য প্রাণখুলে দোয়া করবে। আল্লাহ যাতে তাকে দ্বীনের উপর অটল রাখেন। আর আমিও আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি, তিনি যেন তোমার মত দায়ী ঘরে ঘরে তৈরি করেন। আল্লাহ তোমাকে জাজায়ে খায়ের দান করুন”।
.
.
ফারিস সিরিজ-১০
.
.
লেখক: জাকারিয়া মাসুদ (facebook id: Jakaria Masud)

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ Click Here  এবং Click Here

ফেসবুক পেজঃ Click Here

1 تعليقات

  1. আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে হেদায়েত নসিব করুন আমি।

    ردحذف

إرسال تعليق

أحدث أقدم