.
#নাস্তিক_প্রশ্ন: কুরআন আল্লাহর পাঠানো বানী হলে তাতে সর্বদা থাকবে পুরুষবাচক শব্দ(যেমন Quran 2:38) কিন্তু কুরান জুড়েই রয়েছে তিনি/যিনি/তার/
আমরা/আল্লাহ(নিজের নাম) ইত্যাদি সহস্র ব্যাকরনগত ভুল (Quran 1:1-7, 2:7-10. 26-29,31, 33.... 3:2-9, 18-21, 32-34, 40-41, 50-55, 62-63, 70, 73-74..... 4:1,5,11-15,17,
19-26,29,32,34,36..... 5:7-8,11-12,47,
51,54-56..... ইত্যাদি)! এ থেকে কি এটাই প্রতিয়মান হয় না যে কুরান নিরক্ষর মুহম্মদের নিজের মুখের কথা?
.
#উত্তরঃ প্রথমেই কুরআনের আল্লাহর নিজের ক্ষেত্রে বহুবচন ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হবে।
.
ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﻧَﺰَّﻟْﻨَﺎ ﭐﻟﺬِّﻛْﺮَ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻪُۥ ﻟَﺤَـٰﻔِﻈُﻮﻥَ
.
আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর ১৫ঃ৯)
.
এছাড়া ও আল্লাহ কুরআনের বহু স্থানেই নিজেকে আমরা বলে সম্বোধিত করেছেন। তাই এটি আল্লাহর একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি কুরআনের ব্যাকরণগত ভুল!!!(নাউযুবিল্লাহ)
.
এটা এমন এক তথাকথিত ভুল যা সেইসময়কার কাফির যারা বর্তমানের বঙ্গদেশীয় অভিযোগকারীদের থেকে অনেক বেশি আরবী ভাষা, তার কাব্য ও রীতি-নীতি সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলো তারা ধরতে না পারলেও বঙ্গদেশীয় ভাঙ্গাআরবি ভাষাবিদরা ঠিকই ধরে ফেলেছেন!!! সুবহানআল্লাহ!!!
.
মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক;
.
একজন কখনো কখনো নিজেকে বহুবচন রুপে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে এটি আরবি ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য, শুধুমাত্র আরবি নয় বরং ইংরেজী, ল্যাটিন, জার্মান, হিন্দী, উর্দু সহ অন্যান্য ভাষাতেও এই রীতি লক্ষ্য করা যায়।
.
.
ল্যাটিন ভাষায় একে “প্লুরালিস ম্যাজেসটাটিস” “Pluralis Mejestatis” বলা হয়ে থাকে।
.
একে হিন্দী(हम) ও উর্দু (ﮨﻢ ) ভাষায় ‘হাম’ বলা হয়ে থাকে।
.
চীনা ভাষায় এই মর্যাদাজ্ঞাপক বহুবচন এই চিহ্ন (朕) দ্বারা প্রকাশ করা হত।
.
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, এই মর্যাদাজ্ঞাপক বহুবচন ব্যবহার কখনোই কোনো ভাষার ত্রূটি নয় বরং তা নির্দিষ্ট ভাষার ক্ষেত্রে অতীব স্বাভাবিক, তবে কুরআনের বেলায় ত্রুটি বলা, এমন দ্বিমুখী নীতি কেন???
.
আরবী ভাষাতেও মর্যাদাজ্ঞাপক বহুবচনের ব্যবহার আছে যাকে আরবী ভাষায় একে “যমীরুল আযমাহ” ( ﺿﻤﻴﺮ ﺍﻟﻌﻈﻤﺔ ) বা মহিমাজ্ঞাপক সম্বন্ধ বা সর্বনাম বলা হয়ে থাকে। আরবী ভাষাবিদগন একে সরাসরি বহুবচন না বলে মহিমাজ্ঞাপক একবচনের সর্বনাম বলে থাকেন। এই ধরনের সর্বনামকে তারা উপরোক্ত নামে ও পরিচয় ( ﻧﻮﻥ ﺍﻟﻌﻈﻤﺔ، ﺿﻤﻴﺮ ﺍﻟﻤﺘﻜﻠﻢ ﺍﻟﻤﻌﻈﻢ ﻧﻔﺴﻪ، ﺿﻤﻴﺮ ﺍﻟﻤﺘﻜﻠﻢ ﺍﻟﻮﺍﺣﺪ ﺍﻟﻤﻄﺎﻉ، ﻟﻔﻆ ﺍﻟﻤﺘﻜﻠﻢ ﺍﻟﻤﻄﺎﻉ )
.
বাংলা ভাষায় এই নীতি প্রচলিত নেই সকল ভাষার রীতি-নীতি এক রকম নয়, যেমন বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম প্রকাশে সাধারন, তুচ্ছতাজ্ঞাপক ও গৌরববোধক পর্যায় আছে যেমনঃ তুমি চলো, তুই চল, আপনি চলুন এই প্রকাশগুলো আরবি বা ইংরেজীতে সম্ভব নয় সেখানে আরবীতে “আনতা” ও ইংরেজীতে “You” দিয়েই কাজ চালাতে হয় এইগুলো ভাষার ত্রূটি নয় বরং স্বকীয়তা।
.
এই মর্যাদাজ্ঞাপক বা রাজকীয় “আমরা” বা বহুবচন কেন ব্যবহ্রত হয়?
.
উত্তর হলো এটি বক্তাপক্ষের প্রতিপত্তি বুঝানোর জন্য বা কখনো কখনো একজন যখন অনেকের পক্ষ হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে তখন এমনটা ব্যবহ্রত হয়ে থাকে।
.
যেমন “Royal We” এর এসেছে,
.
The use of “we” instead of “I” by an individual person, as traditionally used by a sovereign.
.
.
আরবি ভাষার এই দিক নিয়েই অনেক ভাষাবিদই আলোচনা করেছেন। ইমামুন নাহব রাযীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (মৃ-৬৮৬হি) “আল-ওয়াফিয়া শারহে কাফিয়া” তে লিখেন,
.
“ ﻭﻳﻘﻮﻝ ﺍﻟﻮﺍﺣﺪ ﺍﻟﻤﻌﻈﻢ ﺃﻳﻀﺎ : ﻧﻔﻌﻞ ﻭﻓﻌﻠﻨﺎ، ﻭﻫﻮ ﻣﺠﺎﺯ ﻋﻦ ﺍﻟﺠﻤﻊ ﻟﻌﺪﻫﻢ ﺍﻟﻤﻌﻈﻢ ﻛﺎﻟﺠﻤﺎﻋﺔ ”
.
অর্থাৎ, অর্থাৎ সম্মানী ও মহান ব্যক্তি একজন হলেও বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার করে বলেন, ﻧﻔﻌﻞ বা ﻓﻌﻠﻨﺎ । এটি বহুবচনের রূপকার্থ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কারণ, একজন মহান ব্যক্তি একাই অনেক জনের সমষ্টিতুল্য।
.
আল্লাহ অবশ্যই সকল দিক থেকে লা-শারীক বা অংশীদারমুক্ত তবে তিনি অবশ্যই মহা সম্মান, প্রতিপত্তি, ইজ্জাহ ও জালালাতের অধিকারী আর সেই কারনেই আল্লাহর মহান প্রতিপত্তি বর্ণনা করার জন্যে বা কখনো পাঠকের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য কুরআনে এই মহিমাজ্ঞাপক গৌরবার্থক বহুবচন ব্যবহ্রত হয়েছে। এতে কালাম পরিপূর্ণ, মহিমাসম্পন্ন, সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষনীয় হয় যা আরবি ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য ও কুরআনের বালাগাতের (অলংকারশাস্ত্র) একটি সৌন্দর্য ও বটে, এটি মোটেও কুরআনের ব্যাকরনগত কোনো সমস্যা নয়।
.
এই বিষয়ে বিশদে জানতে হলে মাসিক আল কাওসারের নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি পড়া যেতে পারে আশা করি উপকারী হবে-
.
.
কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ নিজের ক্ষেত্রে ১ম পুরুষ ব্যবহার না করে ৩য় পুরুষ ব্যবহার করাঃ
.
কুরআন সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। তাই কুরআনে ভাব প্রকাশের জন্য আরবী বিভিন্ন দিকই প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করা হয়েছে। এটি আরবী ভাষার একটি সুপরিচিত ব্যাপার যে বক্তাকে একই ধরনের বক্তব্যে স্থির না থ মাঝে মাঝে বক্তব্যে পুরুষ (Gender) পরিবর্তন করে থাকে যাকে আরবী ব্যাকরনের ভাষায় বলা হয় “ইলতিফাত” যার অভিধানিক অর্থ কোনো দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া/ ফিরিয়ে নেওয়া। অবশ্য আরবি ভাষাবিদগন বিভিন্ন নামে পরিচয় দিয়ে থাকেন যেমন “আস-সরফ” বা “ইনসিরাফ” “তালওয়ীন” “তালওয়ীনুল খিতাব” “ই’তিরাদ” ইত্যাদি। আরবি ভাষা প্রাচীন কাল থেকেই কবিতারুপে ব্যাপকভাবে ব্যবহ্রত হয়ে থাকে আরবরা যেমন কবিতা শূনতে তেমনি কবিতা লিখতে, তৈরী করতে অত্যন্ত ভালোবাসত। তো কখনো কবিতা একই পুরুষে বা একই ভাবে শুনতে শুনতে শ্রোতার যাতে বিরক্ত না আসে এই কারনে কখনো কখনো বক্তা তার ভাব বা পুরুষ পরিবর্তন করে কথা বলতে পারে যাকে “ইলতিফাত” বা ঘুরিয়ে দেওয়া বলা যেতে পারে। ইমাম বাদরুদ্দীন যারকাশী(রাহ) এই সম্পর্কে বলেন,
.
“কথার মাঝে ভাবের পরিবর্তন করা, এতে বক্তার কথাকে অধিক সূচারুরুপে উপস্থাপন করতে, শ্রোতার মনোযোগ বৃদ্ধি বা আগ্রহ বৃদ্ধির কারনে আবার কখনো একই ধরনের কথা শোনার দরুন শ্রোতামন্ডলীর বিরক্তিভাব দূর করতে সাহায্য করে”
.
[আল-বুরহান ফি উলূমিল কুরআন, ৩/৩১৪]
.
ইলতিফাত বিভিন্ন ভাবেই হতে পারে, যেমনঃ
.
(১) পুরুষে ইলতিফাত;
(২) বচনে ইলতিফাত;
(৩) খিতাব বা সম্বোধনে ইলতিফাত;
(৪) কাল বা সময়ে (Tense) ইলতিফাত;
(৫) বিশেষ্যের স্থলে বিশেষন ব্যবহার করে ইলতিফাত;
.
কুরআনে বেশির ভাগই পুরুষে (Gender) “ইলতিফাত” লক্ষ করা যায়। যেমনটি অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে এটি কুরআনের ব্যাকরনগত ভুল !!!!তবে তাদের অনেকেরই আরবী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনেই হয়ে থাকে।
.
ইলতিফাত কেন করা হয়ে থাকে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে
.
(ক) কুরআন সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে তাই এতে আরবির বিভিন্ন কাব্যিক ভাবই ব্যবহ্রত হয়েছে। এতে কুরআন শ্রুতিমধুর হয়েছে, কুরআন বুঝতে সহজবোধ্যতা তৈরী হয়েছে।
.
(খ) কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কালাম। একে আল্লাহ সেভাবেই করেছেন যেভাবে তার বান্দাদের বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন সূরা ফাতিহায় আল্লাহ নিজেকে ৩য় পুরুষে সম্বোধন করেছেন এতে করে তার বান্দারা যখন সূরাটি পাঠ করবে এতে তারা কুরআনকে অধিক নিকটবর্তী, তাদের অন্তরের কথাগুলোই কুরআনে খুজে পাবে, অন্তরের প্রার্থনাগুলোকে তাদের ভাষায় কুরআনে খুজে পাবে;
.
(গ) কুরআন অন্যান্য বর্তমানের বিকৃত কিতাবগুলোর মত নয় বরং এটি সদাজাগ্রত একটি কিতাব একে প্রত্যহ নামাযে বা নামাযের বাইরে পাঠ করা হয়, তাই আল্লাহ প্রয়োজনমত পুরুষের পরিবর্তন করে দিয়েছেন যাতে কুরআন পাঠক পাঠ করতে পুলকিত বোধ করেন এতে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ও ভিন্ন আঙ্গিকে কুরআনকে বুঝতে পাঠক আগ্রহী বোধ করবেন।
.
(ঘ) এতে কুরআনের ভাবগাম্ভীর্যতা বৃদ্ধি পায়। যেমনঃ কোনো রাজা কোনো নির্দেশ প্রদানের সময় আমি না বলে “রাজা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে যে……………” এটি অধিক ভাবগাম্ভীর্যতা প্রকাশ পায় আর আল্লাহর কালাম সবচাইতে অধিক ভাবগাম্ভীর্যতার অধিকারী;
.
(ঙ) এটি আরবী ভাষার একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যা বক্তা প্রয়োজন মাফিক পরিবর্তন করতে পারেন এতে করে ভাষায় নমনীয়তা, সূক্ষ্মতা বজায় থাকে, তাছাড়া শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষন বা বিরক্তিও দূর করে থাকে;
.
বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে চাইলে এই প্রমানসমৃদ্ধ আর্টিকেলটি পড়া যেতে পারে-
.
.
এইগুলো মোটেও কুরআনের সহস্র ব্যাকরনগত ভুল বা ত্রুটি নয় বরং যারা কুরআন বুঝতে চায় না তাদের জন্য কুরআন তার রহস্যের দরজা খুলে না তাই হয়ত তারা বুঝতে পারেনা, কারন তারা যে কুরআন বুঝতেই চায় না, তারা কুরআনের দিকে দৃকপাত করেই থাকে শুধুমাত্র তার ভুল অন্বেষণের জন্যেই।
.
লেখকঃ হোসাইন শাকিল [ফেসবুক id: Hossain Shakil]
অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ shottokothon.com এবং response-to-anti-islam.com
ফেসবুক পেজঃ fb.com/shottokothon1
Post a Comment