'ভ্রান্তিবিলাস' বই রিভিউ


বইঃ ভ্রান্তিবিলাস।
লেখকঃ Jakaria Masud
সম্পাদনাঃ মুহাম্মাদ জুবায়ের।
শার'ঈ সম্পাদনাঃ Munirul Islam Ibn Jakir
প্রচ্ছদঃ আবুল ফাতাহ মুন্না।
প্রকাশনীঃ Somorpon Prokashon.
রিভিউ লেখকঃ Sazzad S Parvez.
প্রকাশঃ জানুয়ারী, ২০১৯
মুদ্রিত মূল্যঃ ২২৫৳

'ইসলাম' স্রষ্টার মনোনীত একমাত্র দ্বীন। এর বাহিরে আর কোন দ্বীন স্রষ্টার নিকট গ্রহনযোগ্য হবে না। যুগে যুগে জ্ঞানপাপী নাস্তিক, মুর্তাদ, সংশয়বাদীরা যখন যেভাবে পেরেছে ইসলামকে জেনে-বুঝে সত্য গোপন করে যেভাবে ইচ্ছা আক্রমন করেছে। নিজেদের অদর্শের প্রচার প্রসার করেছে।

সুযোগটা করে দিয়েছি মুলত আমরাই। আমরা তাদের কাউন্টার এট্যাকে না গিয়ে ময়দান ছেড়ে আরামে চুপ মেরে ঘুমিয়ে ছিলাম। আর জ্ঞানপাপীরা দিনের পর দিন তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত আবর্জনা মানুষকে গেলাতে লাগলো, যখন গলা পর্যন্ত এসে মুখভর্তি হওয়ার উপক্রম হল তখন আমাদের ঘুম ভাঙলো।

বাংলাদেশে একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন আমাদের সাহিত্যাঙ্গন, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া নিয়ন্ত্রন করতো সেক্যুলার পাপিষ্ঠরা। গত ৩ বছরে প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। পাপিষ্ঠদের ভীত আজ নড়বড়ে। পায়ের তলায় মাটি নেই বললেই চলে। ইনশা'আল্লাহ বাংলার মাটিতে এদের বানোয়াট আদর্শের দাফন হবে।

★ বইয়ের মূল আলোচনায় আসি,
বইয়ের প্রচ্ছদ বেশ সাদামাটা; বাইন্ডিং, পেজ কোয়ালিটি, স্পেস, পৃষ্ঠাসজ্জা সবকিছুই অসাধারন হয়েছে।

ভ্রান্তিবিলাস বইটা কেন রচিত হল?
বইয়ের প্লেফ কাভার থেকে হুবহু তুলে ধরছি,
"কিছু মানুষ তাদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনাগুলো সাহিত্যের মোড়কে বাজারজাত করে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সমাজের একটা শ্রেনি ওদের লেখনী দ্বারা প্রভাবিত হয়, ধীরে ধীরে পা বাড়ায় ভ্রান্তির জগতে। ভ্রান্তির জগত কালো অন্ধকারে ঢাকা। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মতো আলো সেখানে নেই। ওই জগতটা মানুষকে অমানুষ করে দেয়। নামিয়ে দেয় পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট স্তরে। আর যাতে কেউ ওদিকে পা না বাড়ায়, সে প্রত্যাশায় রচিত আমাদের এই বইটি।"

ভ্রান্তিবিলাস বইটি মূলত বাংলা সাহিত্যের সবচে নোংরা কুরুচীপূর্ণ লেখক (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিনদেশী লিখা অনুবাদকরে নিজের নামে চালাতেন) হুমায়ুন আজাদ তার নারী বইয়ে ইসলাম নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন তার ভ্রান্তি নিরসন নিয়ে।

বইয়ের শুরুতে 'সম্পাদকের চোখে' শিরোনামে লেখাটা পড়ে খুবই খালাসা একটা ধারণা পাওয়া যাবে বইটি সম্পর্কে।

এরপর 'শুরুর কথা'তে লেখক বইটি সম্পর্কে বলেছেন যে, বইটি কখন, কেন, কি জন্য লিখেছেন।


★ এবার আসি বিষয়ভিত্তিক আলোচনার দিকে.....
সালাফ'রা কালাম শাস্র অপছন্দ করতেন। আমিও অপছন্দ করি। তবে সময়ে, প্রয়োজনে এর দরকার অস্বীকার করিনা। আজীবন এটাতে বুদ হয়ে থাকাকে কল্যাণকর মনে করিনা।

বইটি পুরো শেষ করার পর একটা বিষয় সবচে বেশি ভাল লেগেছে সেটা হল, নারী বইয়ের রিফিউটেশনে লিখিত ভ্রান্তিবিলাস বইটি সম্পূর্ণ কুর'আন ও হাদিসকে বেস করে লিখা হয়েছে। কোন মানবীয় যুক্তির আশ্রয় এখানে নেওয়া হয়নি।

১. স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
নাস্তিকদের কমন হ্যাস্যকর প্রশ্ন। এতে প্রমাণ হয় ইতিহাস বিষয়ে এদের কোন জ্ঞান নেই। আসল কথা হল প্রশ্নটাই ভুল। স্রষ্টা মাত্র একটা ধর্ম পাঠিয়েছেন আর সেটি হল ইসলাম।

লেখক খুবই সুন্দরভাবে বেশ গোছালো রেফারেন্স টেনে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। পূর্ববর্তী কিতাব, আল-কুরআন ব্যতীত অন্যান্য পূর্ববর্তী কিতাবের বিকৃতি সাধন, মহান স্রষ্টাকর্তৃক আল কুরআন সংরক্ষনের ওয়াদা, ইসলামই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন, সকল নবিই মুসলিম ছিলেন ইত্যাদি বিষয়ে দলিলের আলোকে বেশ প্রাঞ্জল আলোচনা বইতে রয়েছে।

২. জান্নাতে নারীর অবস্থান:
পাপিষ্ঠ আজাদ ইসলাম সমন্ধে বেসিক জ্ঞানও রাখেনা তা এ বইয়ের পরতে পরতে প্রমান হবে। অন্যান্য বিকৃত ধর্মের সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলে এবং নিজের অন্তরের বিদ্ধেষ উগড়ে দিয়ে ইসলামকে যেভাবে পেয়েছে আঘাত করেছে। এবং তার অন্ধ মুরিদেরা সেটা ওহীর মত বিশ্বাস করে নিয়েছে অথচ বাস্তবত মোটেও এমন না।

আজাদ তার বইয়ে লিখেছে পার্থিব নারীরা জান্নাতে অনুপস্থিত। অথচ এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি। বরং তাঁরা জান্নাতি হুরদের চেয়েও সুন্দরী ও উত্তম হবে।

পার্থিব নারীরা কি জান্নাতে অনুপস্থিত, জান্নাতে পার্থিব নারীর মর্যাদা, জান্নাতি নারীদের ভোগবিলাসের ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হয়েছে বইতে।

*"তাদের ইচ্ছার ভিন্নতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে" এ লেখাটি আমার কাছে বেশ দারুন লেগেছে।

এছাড়াও জান্নাতি নারীদের নিয়ামত সম্পর্কে রয়েছে একটি তথ্যবহুল আলোচনা।

৩. ঋতুকালীন অবস্থা ও ইসলামি দৃষ্টিকোন:
এখানেও ওই গন্ডমূর্খ্য সঠিকটা না জেনে অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামকে এক করে ফেলেছে।

লেখক খুবই সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে আজাদের অসাড় কথার খন্ডন করেছেন। কুরআন যে কিছু কিছু মানুষের জন্য গোমরাহীর কারন তার উৎকৃষ্ট উদাহরন এই আজাদ।

ইসলাম ঋতুমতি নারীদের কতটা সম্মান ও সমীহের চোখে দেখে তা যদি অমুসলিম নারীরা জানতো তবে দলে দলে ফিরতো ইসলামে। সে সময়কালীন অপবিত্রতা হেতু শারীরিক মিলন ছাড়া বাকি সকল কাজ যেমন, একসাথে খাওয়া, ঘুমানো, সময় কাটানো ইত্যাদি তাদের সাথে করা যাবে। তাদের সে সময়কালীন নামাজ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষ ইসলাম শুধুমাত্র নারীদের অপবিত্র ঘোষণা করেনি পুরুষদের ও অপবিত্র ঘোষণা করেছে।

৪. তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র:
সুবহানাল্লাহ কত সুন্দর উপস্থাপনা। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। চিন্তাতেও আসেনি নারী আর শস্যক্ষেত্রের এত্ত মিল। মাস্ট পড়া উচিত। শেখার আছে অনেক। ইচ্ছা করছে পুরো লিখাটা তুলে দেই।

৫. জাহেলী যুগে নারীর অধিকার:
মদ খেয়ে বই লিখলে যা হয় আরকি আজাদের ক্ষেত্রে সেটাই দেখছি। একই বইতে বিপরীতমূখী অবস্থান তার। তার ভাষ্যমতে জাহেলী যুগে নারীরা স্বাধীন ছিল অথচ আমরা দেখি ভিন্ন কিছু। তখনকার অবস্থা কতটা লোমহর্ষক ও করুণ ছিল বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন। এখানে লেখক কুরআন, হাদিস, ইতিহাসের কিতাব ও অমুসলিম লেখকদের কলামে আরবের ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগের অবস্থা তুলে ধরেছেন। ইসলাম সেসব অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে বাতিল ঘোষণা করে।

৬. ইসলামে নারী:
আজাদের ভ্রান্তি, নারী অধিকারের ইশতেহার( দারুন), ইসলামে নারীদের অবস্থান অসাধারন তথ্য উপাত্তের সম্মিলন ঘটেছে এ অধ্যায়ে।

৭. পবিত্র স্থান ও নারী:
আজাদের জ্ঞান দেখে বাচ্চারাও হাসবে। পাতায় পাতায় মিথ্যায় ভরপুর কথাবার্তা। তার দাবি ধর্ম নারীদের পবিত্র স্থানে গমন, পবিত্র বস্তু ছোঁয়া, পবিত্র খাদ্য স্পর্শে নিষেধ করে। অথচ ইসলামে এসবের কিছুই নেই। অন্য ধর্মে থাকতেও পারে।

মাসজিদে গমন, পবিত্র মাক্কা-মাদিনায় গমন, যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহন, খাদ্যগ্রহণের নীতি নিয়ে ইসলামের বয়ান কি তা বইয়ে সুন্দর ভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন।

৮. স্ত্রী কি চুক্তিবদ্ধ দাসী:
আবার সে হাস্যকর আক্রমন। ইসলামের ব্যাপারে আজাদ কতটা মিসকিন তা সহজে অনুমেয়।

বিয়েতে নারীর অনুমতি ব্যাপারে ইসলামের স্পষ্ট বয়ান থাকার পরেও আজাদ মিথ্যাচার করেছে। কনের অনুমতি ছাড়াতো বিয়েও দেওয়া হয় না ইসলামে। পাত্র পছন্দ না হলে বিয়ে বাতিল করার সুযোগ একমাত্র ইসলামে আছে।

আজাদ বিয়েকে চুক্তিবদ্ধ দেহদান বলেছে, আরো কত কি। অথচ ব্যাপারটা তেমন না। সত্য হল বিয়ে হচ্ছে ব্যভিচার, যেনা থেকে বিরত থাকার কার্যকরী মাধ্যম। আর একটা পুরুষ চাইলেই বিয়ে করতে পারেনা তাকে অবশ্যই কিছু শর্ত পুরা করতে হয়। অথচ ইসলামে বিয়েতে নারীর লাভ বেশি। তারা মোহরের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। স্ত্রী হিসেবে উত্তম আচরন পায়।


৯. পর্দা কী ও কেন?
বর্তমান সময়ে পর্দার কথা উঠলেও নাস্তিক পাড়ায় চুলকানির পাশাপাশি নামধারী মুসলিমদের ও চুলকানি শুরু হয়। এরা আসলে পর্দার উদ্দেশ্য ও এর ব্যপকতা বুঝেই নিই। এখন তো পর্দা মানে মাথায় বাঁধাকপি সদৃশ বাঁধা, কালারপুল এট্রাক্টিভ বোরকা পড়ে রাস্তায়, ভার্সিটি, শপিংমলে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ানো।

লেখক এখানে ইসলাম কেন পর্দাকে ফরয করেছে, ধর্ষণ ও উন্নত বিশ্ব, যৌনরোগের মহামারি, ভ্রুন হত্যা, গর্ভপাত, সর্বপরি জন্মহার হ্রাস, ওদের দেশে কেন এগুলো ছড়াচ্ছে? বাঁচার উপায় কি? সংশয় নিরসন ইত্যাদি নিয়ে বেশ তথ্যবহুল আলোচনা পেশ করেছেন।

সর্বশেষ "একজন নও মুসলিম নারীর দৃষ্টিতে পর্দা" প্রবন্ধটি ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ রচিত 'ইসলামে পর্দা' বই থেকে নেওয়া হয়েছে। আমি পর্দা নিয়ে এমন লিখা কখনো পড়িনি। বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছি একজন নারীর অনুভূতি। আল্লাহু আকবার!

প্রতিটি বোনের পড়া উচিত এ বই। ভাইদের তো অবশ্যই।


★কিছু টাইপিং ভুল:
১/ ২৬ নং পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ৫ নং লাইনে তাদের শব্দটি ২ বার আসছে।

২/ ৩৪ পৃষ্ঠার ইবনু কাসীর রাহিমাহুল্লাহর ব্যাখ্যার শুরুতে কিয়ামতে শব্দটি কিয়ামতের হবে।

৩/ ৪৭ পৃষ্ঠার শেষের দিকে সাধারনত মেয়েদের যখন ১১ বা ১৩, এখানে বয়স শব্দটা এড করা যায়,
যখন ঋতুস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তখন (লিখা আছে যখন) সেটিকে Menopause বলে (লিখা আছে শুরু হয়)।

৪/ ৪৮ পৃষ্ঠায় আয়াতটির শানে নূযুলে,

কিন্তু এরা আবার এই সময়ে যৌনমিলনও করত (লিখা আছে তারা)।

৫/ ৯৬ পৃষ্ঠার নিচ থেকে ৭ নং লাইনে আজাদ যদি কোন হাদীসগ্রন্থের 'হজ অধ্যায়' এখানে অধ্যায় বানানটি ভুল আসছে।

আর কোন ভুল চোখে পড়েনি।


১৬০ পৃষ্ঠার এ বইটি আমি বলব অন্যন্য অসাধারন কিছু। পড়লে যে কেউ মুগ্ধ হবে নিশ্চিত। জাকারিয়া মাসুদ ভাই প্রচার বিমুখ একজন মানুষ। আল্লাহর কাছে এ বইয়ের বহুল প্রচারের জন্য দু'আ করছি।

সর্বশেষ এ বইয়ের সম্পাদক জুবায়ের ভাইয়ার লেখার একটা উদৃতি দিয়ে শেষ করছি,

"যারা ডা. আজাদের মতো লোকদের আদর্শের উপাসনা করে তারা হয়তো বইটি পড়লে টের পাবে তাদের আদর্শগুরুরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কতটা অসৎ।

সোর্স: 'ইসলামী বই' রিভিউ ফেইসবুক গ্রুপ।


Post a Comment

أحدث أقدم