সূরা আসর ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাসীহা


সূরা আসর। মাত্র ৩ আয়াত বিশিষ্ট খুব ছোট্ট একটা সূরা। এই সূরাটি মুখস্থ নেই এমন মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এর আয়াত সংখ্যা যত কম, তাৎপর্য যেন ততই বেশি। এই তিন আয়াতেই যে কত শিক্ষা এবং রহস্য লুকিয়ে আছে আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারলে তা আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে ইন শা আল্লাহ।

পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু, সফলতা ও বিজয় দানকারী আল্লাহ তায়ালা'র নামে, শেয়ার করতে যাচ্ছি 'সূরা আসর নিয়ে আমার ভাবনাটুকু'। তার আগে একঝলক বাংলা অনুবাদ সহ দেখে নিই,

وَ الۡعَصۡرِ ۙ
(১) সময়ের কসম,

اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَفِیۡ خُسۡرٍ ۙ

(২) নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত।

اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ۬ۙ وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ

(৩) তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।


❒ আয়াত-১ঃ আল্লাহ তায়ালা সময়ের তথা যুগের নামে কসম করেছেন।

অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, মানুষের সব কর্ম, গতিবিধি, উঠাবসা ইত্যাদি সব যুগের মধ্যে সংঘটিত হয়। সূরায় যেসব কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলোও এই যুগ-কালেরই দিবা-রাত্ৰিতে সংঘটিত হবে। এরই প্রেক্ষিতে যুগের শপথ করা হয়েছে। [সাদী, ইবন কাসীর] কোন কোন আলেম বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলার মহত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজ্ঞা ও কুদরতের প্রমাণ-নিদর্শন সময় বা যুগেই রয়েছে; তাই এখানে সময়ের শপথ করা হয়েছে। [মুয়াসসার, বাদায়িউত তাফসীর]

আমরা এত কঠিন ভাবে না বুঝে যদি সহজ ভাবে বুঝতে চাই, তাহলে ব্যাপারটা এভাবে বুঝেছি যে, আমরা কোনো বস্তুর গুরুত্ব বোঝাতে আল্লাহ তায়ালার শপথ করি। আর আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো জিনিসের গুরুত্ব আমাদের বোঝাতে চান তখন তিনি ঐ বস্তুর শপথ করেন।

ইসলামে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা নেয়ামত। যেমন সময়ের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘দুইটি নেয়ামতের ব্যাপারে দুনিয়ার বহু লোক উদাসীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; তা হলো স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ [বোখারি : ৬০৪৯]


❒ আয়াত-২ঃ

এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সমস্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সমস্ত মানে সমস্ত। তিনি কোন আলেম, পীর, বুজুর্গ, আস্তিক, নাস্তিক, জাহেল, কাফির, নেতা, জনগণ, পুরুষ, নারী পার্থক্য করেন নি। আল্লাহ তায়ালা যখন হুশিয়ারী দেন তখন উক্ত হুশিয়ারী থেকে স্বয়ং নবী রাসুল গণকেও তো বাদ দেন না। এখানে ব্যাপারটা স্পষ্ট করতে অন্য একটা সূরার প্রসংগ টানতে হবে।

যেমন সূরা যুমারের ৬৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁর প্রিয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, "আপনিও যদি শিরকের মধ্যে লিপ্ত হতেন, আপনার সমস্ত আমল আমি আল্লাহ বরবাদ করে দিতাম আর আপনিও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন"

তার মানে নবী রাসুল থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কোন মানুষই ক্ষতির বাইরে নয়।

আল্লাহ তায়ালা কি কেবল এটুকু বলেই থেমে যেতে পারতেন না?

কিন্ত সূরা যারিয়াতের ৪৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন প্রতিটি বস্তুকে তিনি জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তাফসীরে কুরতুবীতে এই জোড়ার ব্যাখায় বলা হয়েছে, প্রতিটি বস্তুর বিপরীত দিক আছে, যেমন রাত-দিন, কুফরী-ঈমান, সাদা কালো, সমস্যা সমাধান ইত্যাদি।

তাহলে এখানেও একটা মিরাকল ব্যাপার লুকিয়ে আছে তা হলো, 'আয়াত-২' এবং 'আয়াত-৩' পরস্পর বিপরীতমুখী। 'আয়াত-২’ এ আল্লাহ তায়ালা সমস্যার কথা বলেছেন, দেখুন ঠিক পরের আয়াতে অর্থাৎ 'আয়াত-৩' এ আল্লাহ তায়ালা নিজেই সমাধান দিয়ে দিলেন।


❒ আয়াত-৩ঃ

পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে এবার উত্তরণের পথ বলে দিলেন এবং ৪ টি গুণে মুমিনদের ডিফাইন করলেন। এই ৪ শ্রেনীর মানুষ যারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেনা। গুন ৪ টাঃ-
.
[ক] ঈমান
[খ] সৎকর্ম
[গ] অপরকে সত্যের উপদেশ প্রদান
[ঘ] অপরকে সবরের উপদেশ প্রদান

এখানেও সৌন্দর্য্যের রহস্যটা খেয়াল করুন।

প্রথম জোড়া মানে 'ক' ও 'খ' বৈশিষ্ট্যদ্বয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং পরের জোড়া মানে 'গ' ও 'ঘ' বৈশিষ্ট্যদ্বয় অপর মুসলিমদের সংশোধন সম্পর্কিত। দারুন না?

তাহলে ক্ষতি থেকে বাঁচতে...

[১] প্রথমত আমাদের ঈমান আনতে হবে। ঈমান কীসের উপর আনতে হবে তা প্রিয় শিক্ষক রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শিখিয়ে দিয়েছেন।

أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّه

‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে ও শেষ দিবসে (আখিরাতে) এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের (ভাগ্যের) ভাল ও মন্দে।’ [সহীহ মুসলিম: ১/৩৫-৩৬]

[২] দ্বিতীয়ত সৎকর্ম। সাধারন মানুষের কাছে যেকোন ভাল কাজই হয়ত সৎকর্ম। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী সৎকর্মের ডিফাইনেশন আলাদা। একে বলা হয় আ'মাল সালেহা। একটা কাজ যতই ভাল হোক যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তার রাসুল (সাঃ) প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনা। এই জন্যই সৎকর্মের আগেই ঈমানের কথা বলা হয়েছে। কারণ একজন কাফিরও ভাল কাজ করতে পারে, কিন্তু সেটা কখনই এই 'সৎকর্ম' বলে গণ্য হবেনা। কারণ তার ঈমান ই নেই।

[৩] তৃতীয়ত সত্যের উপদেশ। আয়াতে আরবি শব্দটি 'হক'। এই হকের অর্থ একেকজন একেকভাবে বর্ণনা করেছেন। কারোর মতে [কুরতুবী] এই হক দ্বারা ঈমান ও তাওহীদ, আবার কারোর মতে [ইবনে কাসীর] শরীয়ত নির্দেশিত কাজ করা ও শরীয়ত পরিপন্থী কাজ নিষেধ করাকেই বুঝানো হয়েছে। যাইহোক সার্বিকভাবে আকীদা ও ঈমান এর সাথে সম্পর্কিত সকল ভাল কাজই হক। তবে কেবল নিজে সৎ কাজ করে গেলেই আমরা ক্ষতি থেকে বাঁচবনা।সাধ্যমত অন্য মুসলিমকেও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা আমাদের ফরয দায়িত্ব। আমাদের মধে অনেকেই আছে নিজে ভাল কাজ করে থেকে যাচ্ছি, ঐদিকে মহল্লা সমাজ জাতি উচ্ছন্নে গেল আমাদের মাথা ব্যাথা নেই। এমন হলেও আমরা ধ্বংস থেকে বাঁচতে পারব না।

মানুষকে হকের উপদেশ দেওয়া বলতে, দ্বীনের পথে দাওয়াত দেওয়া, বাতিল থেকে দূরে থাকতে বলা, এলেম প্রচার করা ইত্যাদি।

যেমন কেউ জামায়াতে নামাজ পড়েনা তাকে নামাজে নিয়ে আসা, কেউ টিভি তে সিনেমা দেখতে ব্যস্ত তাকে সেখান থেকে সরিয়ে তাফসিরে মাহফিলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা ইত্যাদিই মুলত এই হকের উপদেশ দেবার অন্তর্ভুক্ত। কিংবা বেপর্দা করে চলা কাউকে পর্দার দিকে নিয়ে আসা; যে কোরআন পারেনা তাকে কোরআন শেখার অনুরোধ করা, হারাম ব্যবসাকারীকে হালাল, দ্বীনমুখী করা, শরীয়তের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা ইত্যাদি।

মুলত অপরকে দ্বীনের দিকে নিয়ে আসার দাওয়াত এর এই কাজ উম্মতকেই করতে হবে।

অনেকে আছে যে, "আমি আমার মত আছি। কারোর ধার ধারিনা।" এসব বলে পার পাওয়া যাবেনা। কেবল নিজে আমল করে গেলেই ভাল মুসলমান হওয়া যাবেনা ও ক্ষতি থেকে বাঁচা যাবেনা।

[৪] চতুর্থত, সবরের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এখানে সবরের কথা কেন আসল? কারন দ্বীনের পথে চলতে গেলে সবর লাগে।

এই যে ফজরে ঘুম থেকে উঠে মসজিদে যাওয়া, রমাদানে রোজা রাখা ইত্যাদি সব নেক কাজেই কষ্ট আছে। আবার বোনদের অনেক কে পর্দা করে চলার জন্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়, দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে বিপত্তি আসে ইত্যাদি। এটা স্বীকার্য। তাই সবর লাগবে।

আবার গুনাহ'র কাজ থেকে বেঁচে থাকতেও সবর লাগবে। কারন গুনাহের কাজে অনেক মজা (সাময়িক) পাওয়া যায়। যেমন আপনার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে অশ্লীল ভিডিও, কিংবা সদ্য হারাম সম্পর্ক থেকে বের হয়ে এসেছেন আবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিংবা কারোর উপর খুব রাগ উঠেছে সেটা নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি সব গুনাহ'র কাজ থেকে নিজেকে সংবরণ করতেই প্রয়োজন অনুপম সবর।

ড. কারী, তাফসীর সূরাতিল আসর পৃ. ৬২-৬৩ তে এই লাইনটাকে এভাবে ব্যাখা করা আছে যে, হককে সমর্থন করতে ও তার অনুসারী হতে গিয়ে যেসব সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এ পথে যেসব কষ্ট, পরিশ্রম, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও বঞ্চনা মানুষকে নিরন্তর পীড়িত করে তার মোকাবেলায় তারা পরস্পর অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। সবরের সাথে এসব কিছু বরদাশত করার জন্য তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে সাহস যোগাতে থাকবে। আর মুমিন মাত্রই অপর মুসলিমকে স্বান্তনা দিবে, সাহস যোগাবে।

অতএব, যদি আমরা সময় থাকতেই (এই দুনিয়াতে হায়াত থাকতেই) সময়ের গুরুত্ব বুঝি এবং উক্ত চারটা গুণের প্রতি আমল করতে পারি ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালার নসীহত মোতাবেক, তাঁর ওয়াদা মোতাবেক ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে বেঁচে যাবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য সহজ করে দিন। আমীন।

Writer: Brother Shah Mohammad Tonmoy

Post a Comment

أحدث أقدم