বিয়ে করতে কী লাগে?


বিয়ে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের ভাবনা ও জল্পনাকল্পনা একটু বেশিই হয়ে থাকে। বয়োঃসন্ধিকাল পেরুতেই এই বীজ তাদের অন্তরে প্রোথিত হয়ে যায়। তারপর এই বীজের অঙ্কুরোদগম হয় এবং সময়ের তালেতালে ছোট্ট চারাটি ডালপালা বিস্তার করে বেড়ে উঠতে থাকে। চারপাশের পরিবেশ, অন্তরের চাহিদা আর বয়সের দাবী- এসব কিছুই চারাটির গোড়ায় পানি আর আলো-হাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সেদিনের ছোট্ট চারাটি একটা সময় হয়ে ওঠে বিশাল মহীরুহ। ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। যৌবন তখন থাকে তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। বিয়েটা তখন আর শুধু কেবলই অধরা স্বপ্ন আর জল্পনাকল্পনা নয়, হয়ে দাড়ায় প্রয়োজন আর দরকারের।

আলী তানতাবির বিয়ে-ভাবনা আমার কাছে সবচে সুন্দর-সাবলীল ও যৌক্তিকতার বিচারে সবচে দারুন মনে হয়েছে। তিনি বিয়েকে ক্ষুধার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটাও এক ধরনের ক্ষুধা। ক্ষুধার্তকে খাবার দিতে হয়। নইলে সে চুরি করে হলেও খাদ্য খুঁজে নেয়। ঠিক তেমনি বিয়ের দরকার হলে সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করে নিতে হয়। নইলে সে অন্যভাবে ক্ষুধা নিবারণের পথে পা বাড়ানোর শঙ্কা থেকে যায়।

বিয়ের প্রয়োজন আছে এমন অধিকাংশ তরুণের অভিযোগ হলো, পরিবার রাজি হয় না বা হবে না। তারা বলে বা বলবে, বউকে খাওয়াবে কী। মনে হয় বউয়ের খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই কিংবা বউ এসে এক পরিবারের সকল লোকের খাবার একাই সাবাড় করে দিবে। তখন তারা সবাই পড়ে যাবে মহা সংকটে। পরিবারে দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ। তো বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই সামর্থ্যের কথাটা সর্বপ্রথম সামনে আসে দেখেছি। অসামর্থ্য হলে ইসলাম বউয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিতে বলে না। কথা ঠিকাছে। এমন ক্ষেত্রে ইসলাম সবরের কথা বলে। সিয়ামের কথা বলে। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন,

"ওহে যুবক শ্রেণি! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে এবং যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম যৌনতাড়নাকে দমন করে। [ সহীহ বুখারী : ১৯০৫; আহমাদ ৪০৩৩]

প্রশ্ন হলো, এই সামর্থ্যের পরিমাণ কতোটুকু? সর্বনিম্ন কতোটুকু আর্থিক সংগতি থাকলে শরীয়ত একজন ব্যক্তিকে সামর্থ্যবান বলে স্বীকৃতি দিবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা এখন সামর্থ্যবান বলতে সমাজের দাগ টেনে দেওয়া সীমারেখাকে মাথা পেতে মেনে নিচ্ছি। সমাজ এই দাগ টানার সময় সামাজিক অনেক ফালতু বিষয়ের কথা বিবেচনায় রাখে। ফলে সামর্থ্যবান হওয়ার স্কেলটা অনেক উঁচুতে উঠে যায়। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণ-যুবা প্রজন্ম। তাদের বিবাহের আয়োজন পিছিয়ে যায়। গুনাহে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কাটা হয় আরও প্রলম্বিত। সমাজ এমনটা করবেই। কারণ সমাজ তো আর অসামাজিক হতে পারে না। তাকে সামাজিক হয়েই থেকে যেতে হয়। এই কারণেই সমাজের সামাজিকতা না দেখে শরীয়তের সীমারেখা দেখা দরকার।

এই প্রসঙ্গে কুরআন-হাদীসের ভাষ্য আমরা দেখতে পারি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলছেন,

أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ وَلَا تُضَآرُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُوا عَلَيْهِنَّ ۚ

"তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেখানে তোমরা বসবাস কর সেখানে তাদেরকেও বাস করতে দাও, তাদেরকে সঙ্কটে ফেলার জন্য কষ্ট দিয়ো না।" [সূরা তালাক : ০৬]

এখানে মূলত তালাকপ্রাপ্তা মহিলার বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে। তাহলে যারা তালাকপ্রাপ্তা নয়, তারাও যে স্বামীর সামর্থ্যানুযায়ী বাসস্থান ও ভরণপোষণ পাওয়ার যোগ্য তা সহজেই অনুমেয়।

অন্য আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُۥ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا ۚ

"আর পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মায়েদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না।" [ সূরা বাকারা : ২৩৩ ]

এই আয়াতে বিষয়টা আরও অনেক বেশি স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে ব্যবহৃত 'মারূফ' শব্দটি এখানে বিশেষ গুরুত্ববহন করছে। কারণ কুরআন সামর্থ্যের প্রশ্নে স্বামীর ওপর নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়নি। বিষয়টা উন্মুক্ত রেখে প্রচলনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সুতরাং সমাজের প্রচলন অনুপাতে যে ব্যক্তি যেই স্তরের, তার সামর্থ্য সেই অনুপাতে নির্ধারিত হবে। ব্যক্তির আর্থিক উন্নতি-অবনতির তারতম্যের ভিত্তিতে সামর্থ্যের সীমারেখাতেও আসবে পরিবর্তন। মূলত এই কারণেই ইসলাম বিয়ের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতা বিধানের কথা বলে। কারণ যে মেয়ে রাজকন্যার মতো জীবন কাটিয়ে এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই সে বিয়ে-পরবর্তী জীবনেও সেই অনুপাতে আরামে থাকার হকদার। কুফু মেনে বিবাহ হলে সেটা বাস্তবায়িতও হবে। কারণ তখন স্বামীর সামর্থ্য থাকবে স্ত্রীকে অতীত জীবনের মতো বা তারচে আরও বেশি ভালো অবস্থায় রাখতে। এভাবে প্রতিটি মেয়েকে তার কুফু মেনে বিয়ে দিলে প্রচলন অনুপাতে সে ভালোই থাকবে আশা করা যায়।

কুরআনের অনুরূপ ভাষ্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও আমরা দেখতে পাই। তিনিও সামর্থ্য থাকা প্রমাণিত হওয়ার জন্য যাকাতের মতো কোন নেসাব বয়ান করে দেননি। প্রচলনের ওপর বিষয়টা ছেড়ে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি লক্ষাধিক সাহাবির সামনে দরাজ গলায় ঘোষণা করেছেন,
وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
অর্থাৎ, "প্রচলন অনুযায়ী / সামর্থ্যানুসারে তোমাদের ওপর তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব।" [ আবূ দাউদ : ১৯০৫ ; সহীহ ]

মুআবিয়াহ আল-কুশাইরী একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করল, 'স্বামীর উপর স্ত্রীর কী অধিকার রয়েছে?'
তিনি উত্তরে বললেন,
أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ، وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ، وَلَا تَضْرِبْ الْوَجْهَ، وَلَا تُقَبِّحْ، وَلَا تَهْجُرْ إِلَّا فِي الْبَيْتِ
"তুমি যখন আহার করবে তাকেও (একই মানের) আহার করাবে। তুমি পোশাক পরিধান করলে তাকেও (একই মানের) পোশাক দিবে। তার মুখমণ্ডলে মারবে না, তাকে গালমন্দ করবে না এবং পৃথক রাখতে হলে ঘরের মধ্যেই রাখবে।" [ আবূ দাউদ : ২১৪২; ইবনু মাজাহ : ১৮৫০ ; সহীহ ]

এসব ভাষ্য থেকে সামর্থ্যের যে ধারণাটা আমরা পাই সহজ ভাষায় তা হলো, 'আমি যেমন আছি বা থাকবো, আমার স্ত্রীকে তেমনই রাখতে পারবো।' কেউ এই স্তরে উন্নীত হওয়া মানেই তিনি তার কুফুর উপযোগী মেয়েকে বিবাহের জন্য আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান। তার বিবাহের প্রয়োজন হলে দেরি না করে বিবাহ করে ফেলা উচিত। যদি এতে অর্থনৈতিক কিছু টানাপোড়ন চলেও আসে সেক্ষেত্রে আল্লাহর সেই অঙ্গীকারকে স্মরণ করে দুআ করতে থাকা কর্তব্য। নিশ্চয়ই তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করে থাকেন।

কয়েকদিন আগে আমি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখলাম। যখনই এই সামর্থ্যের আলাপ ওঠে, কেউ স্টাবলিশ না হয়ে বিয়ে করবে না বলে, তখনই আমার মনের পর্দায় কুরআনের একটা আয়াত ভেসে ওঠে। এই আয়াত সেদিনই আমার মনের গহীনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিলো, যেদিন তাফসীরের দারসে মুহতারাম উস্তায আয়াতটি নিয়ে অসম্ভব সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী একটি আলোচনা উপহার দিয়েছিলেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَأَنكِحُوا الْأَيٰمٰى مِنكُمْ وَالصّٰلِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَآئِكُمْ ۚ إِن يَكُونُوا فُقَرَآءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِۦ ۗ وَاللَّهُ وٰسِعٌ عَلِيمٌ
"আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী। [ সূরা আন-নূর : ৩২ ]

সুবহানাল্লাহ! কুরআনের বর্ণনা-রীতি আর যথোপযুক্ত স্থানে ততোধিক যথোপযুক্ত বিষয়ের উপস্থাপনা মুগ্ধকর একটি বিষয়। কমনসেন্সের সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখতে পাই কুরআনের পাতায় পাতায়। এখানে আল্লাহ তাআলা অবিবাহিতদের বিয়ের জন্য উৎসাহীত করেছেন। বিয়ে না করার পথে সবচে বড় বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয় আর্থিক অসংগতিকে। বিয়ের কথা আসলেই সর্বপ্রথম এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। তাই আল্লাহ তাআলাও একেবারে সঠিক জায়গায় তীরটা ছুঁড়েছেন। তিনি সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছেন, 'যদি তাদের আর্থিক অসংগতি থাকে, তিনি তা দূর করে দিবেন।' তো কুরআন আমাদেরকে অভয় দিলো যে, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অতো চিন্তার কিছু নাই। নিয়ত ঠিক থাকলে এবং আল্লাহর উপর ভরসা থাকলে তিনিই সব কিছুর ব্যবস্থা করবেন। সব কাজে বরকত দিবেন। গরীবকে ধনী বানিয়ে দিবেন।

তাফসীরের দারসে মুহাতারাম উস্তায নিজের কিচ্ছা শোনালেন। তিনি আমাদের এখানে মুফতে পড়াতেন। অবৈতনিক উস্তায ছিলেন। আসতেন নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে। ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে তার। যথেষ্ট অর্থশালী মানুষ। তিনি নিজের কিচ্ছা শোনাচ্ছিলেন- আমি যখন বিয়ে করি, তখন হাত ছিলো একদম খালি। সামান্য একটা স্বর্ণের আংটি দিয়ে আমি বউকে বরণ করেছিলাম। আমার আস্থা ছিলো কুরআনের উপর। নিয়ত সহীহ ছিলো। আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলাম। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কথাকে বাস্তব করে দেখাবেন এমন আত্মবিশ্বাস ছিলো। তাই অতশত ভাবিনি। বিয়ের দরকার হয়েছে যখন, বিয়ে করে ফেলেছি। বিয়ের পর দেখলাম নানান দিক দিয়ে আমার উন্নতি হচ্ছে। যেখানেই হাত দিচ্ছি, সোনা ফলছে। ব্যবসা শুরু করছি, লাভের পর লাভ আসছে। এ কি এলাহী কারকার! বুঝলাম, কুরআনের কথাগুলো বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে আমার জীবনে। সবার জীবনে তা বাস্তব হয়ে না-ও দেখা দিতে পারে। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। হয়তো আর্থিক উন্নতি সেই ব্যক্তির ঈমানের জন্য ক্ষতিকর হবে। বরঞ্চ অভাব-অনটনই তাকে আল্লাহর বেশি নিকটে থাকতে সাহায্য করবে। আর আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন বলেই, তাকে কাছে রাখতে চান বলেই বিয়ে করার পরও আর্থিক উন্নতি থেকে দূরে রাখছেন। অনেক সময় সহীহ নিয়ত আর আল্লাহর উপর আস্থার কামতির কারণেও কারও জীবনে এই আয়াতের ঘোষণা বাস্তবায়ন না হতে পারে। কারণ হাদীসে এসেছে,
"বান্দা আমার ব্যাপারে যেমন ধারনা রাখে, বান্দার সাথে আমার আচরণ তেমন হয়।" [ বুখারী : ৭৪০৫ ; মুসলিম : ২৬৭৫ ]

এভাবে আরো অনেক কথাই মুহতারাম উস্তায বলেছিলেন। এই আয়াতের অর্থ আর মর্ম আমাদের হৃদয়মূলে গেঁথে দিয়েছিলেন। আমি এই আয়াতকে বিশ্বাস করি, খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি, বিয়ে করতে বেশি কিছুর দরকার হয় না। দরকার হয় কেবল সামান্য সামর্থ্য, খালেস নিয়ত ও আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুলের।

Writer: Brother Abdullah Al Masud

Post a Comment

أحدث أقدم