বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর আবিস্কারই কি সব?



মুসলিমরা যখনই পৃথিবীর কোথাও ‘প্রকটভাবে’ নির্যাতনের শিকার হন তখনই আমাদের মধ্যে তাদেরকে রক্ষা করার এবং গোটা উম্মাহকে হেফাজত করার একটা প্রবল আগ্রহ দানা বেঁধে ওঠে। এবং আমরা জাতির মুক্তির উপায় নিয়ে নানা রকম পরামর্শ খয়রাত দেওয়া শুরু করি। যাদের যোগ্যতা আছে তারা যতটা দেন তার চেয়ে অন্যরা পরামর্শ একটু বেশিই দিয়ে থাকেন।


প্রকটভাবে বলছি একারণে যে, মুসলিমরা কিন্তু প্রতিনিয়তই এমন জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি খোদ গাযাতে যে ধরণের নির্যাতন হচ্ছে তার সমমান কিংবা অনেক জায়াগায় এর চেয়েও বেশি এবং এটা প্রতিনিয়ত। ওগুলো আমাদের দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারটা যেহেতু কিছু বছর বিরতি দিয়ে দিয়ে হয় এবং এর সাথে বাইতুল মাকদিসের একটা সম্পর্ক আছে তাই আমরা প্রতিবার একটা প্রকট অনুভুতি নিয়ে ‘আবার জেগেছি’ টাইপ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব গ্রহণ করি।


সে যাই হোক, জাতির মুক্তির এই আলোচনায় খুবই প্রবলভাবে যে বিষয়টি প্রায়ই উঠে আসে তা হলো ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি’। আজ সকালেও এমন একটা কুল ভিডিও দেখলাম। বক্তাকে বেশ কনফিডেন্ট মনে হলো। তার মত ভুল হওয়ার কোনো রকম সম্ভাবনা যে কিছুতেই থাকতে পারে না—তা তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বেশ স্পষ্ট।


এসব আলোচনায় যা বলা হয়ে থাকে তার সারকথা হলো অতীতে মুসলিমরা অনেক আবিস্কার উদ্ভাবন করেছে; এই যেমন এলজেবরার জনক হলেন আল-জাবির, এলগোরিদমসহ বিজ্ঞানের বহুত টার্মিনোলজি আরবি ভাষায়, এই আকাশের তারাদের সব নাম আরবি ইত্যাদিসহ আরও অনেক তথ্য ও তত্ত্ব-উপাত্ত চলে আসে এসব আলোচনায়। এসবের দ্বারা অতীতে মুসলিম জাতির জ্ঞান-গবেষণায় উন্নতির ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়। এরপর উপসংহার টানা হয় যে, মুসলিমরা তাদের এই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির কারণেই পৃথিবি শাসন করতে পেরেছে; আর বর্তমানে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান-তথ্য-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকার কারণেই মার খাচ্ছে। মুক্তি পেতে হলে আমাদের আগে এসব দিকে উন্নতি করতেই হবে, অন্যথা সম্ভব নয়।


মজার ব্যাপার হলো এসব আলোচনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির এবং আবিস্কার উদ্ভাবনির যেসব নাম নেওয়া হয় তার প্রায় সবই আব্বাসী খিলাফত ও তার পরবর্তী সময়ের। উমাইয়্যা খিলাফতের সময় উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নাও থাকতে পারে; থাকলেও যৎসামান্য। আর এর পূর্বের খিলাফাতে রাশেদা কিংবা নববি যুগে তেমন কোনো উদাহরণই পাবেন না।


প্রশ্ন হলো তাহলে ইসলামী ইতিহাস কি কেবল আবিস্কার উদ্ভাবনির যোগ্যতা দিয়েই রচিত হয়েছিল, না কি আবিস্কার উদ্ভাবনি ছিল ইতিহাস রচনার একটি সুফল, যা ইতিহাস রচনার কারণেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে? যদি আবিস্কার উদ্ভাবনী দিয়েই ইতিহাস রচনা হত তাহলে সবচেয়ে বেশি উদাহরণ আমরা দেখতে পেতাম নবির যুগে এবং খুলাফায়ে রাশেদার যুগে।


জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিকে জাতির ইতিহাস নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত করার উপসংহারটি ভুল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো জাতির ইতিহাস নির্মান ও উত্থান পতনের সাথে আবিস্কার উদ্ভাবনীর সম্পর্ক সবসময়ই দ্বিতীয় তৃতীয় পর্যায়ের। বরং আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, এর সম্পর্ক ইতিহাস নির্মাণের সাথে নয়; বরং নির্মাণের পর তাকে উজ্জ্বলতর ও দীর্ঘায়িত করার সাথে।


যে কোনো জাতির রাজনৈতিক উত্থান পতনের পর্যালোচনা করলে আপনারা অবধারিতভাবে দুটো জিনিস পাবেন।


১. রাজনৈতিক প্রজ্ঞা


২. যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব


আর কোনো জাতির শাসনের ইতিহাস দীর্ঘ ও উজ্জ্বলতর হলে সেখানে উল্লিখিত দুটোর সাথে যুক্ত হবে নিম্নোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট:


১. ন্যায় পরায়নতা, উত্তম আচরণ


২. মানবিক মূল্যবোধ


৩. বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জ্ঞান গবেষণা


এই ব্যাপারগুলো মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান। ইসলামকে বাদ দিয়ে যদি পৃথিবীর অন্য সকল ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা লাগানো হয় তাহলে এই ক’টি বিষয়ই তার ফলাফল নির্ধারণ করবে।


ইসলামের ক্ষেত্রে এসে এমন দু’টি বাড়তি বিষয় যুক্ত হয়েছে, যা মুসলিমদেরকে এক বিশেষ অনন্যতা দান করেছে। উল্লিখিত কমন বৈশিষ্টগুলোর সাথে যখন মুসলিমরা এই গুণদুটি অর্জন করে তখন কোনো জাতির পক্ষেই তাদের কমপিটিটর হওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে হারানো কোনো জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। সেই দুটি হলো:


১. ওয়াহিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা—যেখানে কোনো কুসংস্কারের জায়গা নেই


২. ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য জীবন ও জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করার প্রবল আগ্রহ


প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে উল্লিখিত পাঁচটি বৈশিষ্ট সকল জাতির জন্যই কমন। এগুলো ছাড়া কোনো জাতি বেশি দিন পৃথিবিতে শাসন করতে পারবে না। কিন্তু সকল জাতি থেকে পৃথিবি শাসনের যোগ্যতার দাবীতে শেষের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কারণেই মুসলিমরা এগিয়ে থাকে—যদি তা তাদের মধ্যে থাকে।


আপনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ, খুলাফা আর রাশেদার যুগে বিজ্ঞান প্রযুক্তির তেমন কোনো উন্নতি খুঁজে পাবেন না। ততকালীন পরাশক্তিগুলোর তুলনায় মুসলিমদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বলতে কিছু ছিলই ন বলা চলে। কিন্তু উল্লিখিত কমন ও বিশেষ—উভয় বৈশিষ্ট্যে তাদেরকে পাবেন পৃথিবির শ্রেষ্ঠতম স্থানে। আমার বক্তব্য নয়, ইতিহাস তার সাক্ষী।


এই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে তারা যে জাতির ইতিহাস নির্মান করে দিয়েছেন সেখানেই পরবর্তীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞান বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; গবেষনার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করার সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে; সর্বোপরি আবিস্কার উদ্ভাবনিকে জাতির কল্যাণে কাজে লাগানোকে নিশ্চিত করা গেছে।


খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা ছাড়া বাকি সবগুলো বৈশিষ্ট অর্জন মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য—কেবল তাকে সত্যিকার মানুষ—সত্যিকার মুসলিম, সাহসী ও আন্তরিক হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলী নিজের কমফোর্ট জোন ত্যাগ করার জন্য, জান ও মালের নজরানা পেশ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা সেটা করতে না পারা, তেমন হতে না পারার অযোগ্যতাকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির অপ্রতুলতার ঘাড়ে চাপিয়ে কিছুটা নির্ভার হতে চাই। বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিতে চাই।


আমি বিশ্বাস করি, মুসলিমরা নানা রকম বৈষম্যের শিকার হওয়া সত্ত্বেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পৃথিবিতে যে পরিমাণ জ্ঞানী-গুণী যোগ্য মানূষ আছেন তাদের যোগ্যতাকে ক্যাপিটালাইজড করার মতো শক্ত একটা ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা থাকলে প্রযুক্তিতেও ইউরোপ আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়া সম্ভব; অন্ততপক্ষে তাদের উপর নির্ভরতা ছাড়াই সফলভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব হত। কিন্তু সেই শক্ত ইসলামী শাসনব্যবস্থাটা কায়েম করার জন্য যে সামষ্টিক পরিমাণ ত্যাগ দরকার, যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার, যে আন্তরিকতা দরকার তা আমাদের এখনো নেই।


শেষ কথা হোলো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নতি জাতির ইতিহাস নির্মান করে না, ইতিহাস নির্মিত হওয়ার পর তাকে আলোকিত করে, তার শান-শওকত বাড়ায়, তার স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করে। এই সহজ সত্যটা মাথায় রাখলে অনেক বিষয় আমাদের জন্য বোঝা সহজ হবে। এসব ঘ্যানঘ্যানানি শুনলে তাড়াতাড়ি অন্য কিছুতে সুইচ করে সময়টাকে অপচয় হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে।


Collected from: সিয়ান । বিশুদ্ধ জ্ঞান । বিশ্বমান

Post a Comment

أحدث أقدم