খুলাফায়ে রাশেদীন


খলিফা শব্দের অর্থ প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত। খলিফা শব্দের হচ্ছে বহুবচন খুলাফা, অর্থ প্রতিনিধিগণ। রাশেদীন অর্থ সঠিক পথপ্রাপ্ত, হেদায়েতপ্রাপ্ত, ন্যায়নিষ্ঠ। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুর পর আমাদেরকে হেদায়েতপ্রাপ্ত খলিফাগণের আদর্শ অনুসরণের জন্য আদর্শ করেছেন।

ইরবাজ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সালাত আদায় করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশ্য একটি জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো। তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! (আপনার এই ভাষণ) যেন কারো বিদায়ী ভাষণ! সুতরাং আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দিবেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি তোমাদেরকে তাক্বওয়া (আল্লাহকে ভয়ে করে চলার), (মুসলিমদের নেতার কথা) শোনা ও এবং মানার উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সেই (আমীর) একজন হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই (মুসলমানদের মাঝে) অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। আর (দ্বীনের মধ্যে) প্রতিটি নব আবিষ্কার সম্পর্কে তোমরা সাবধান থাকবে! কেননা (দ্বীনের মধ্যে) প্রত্যেক নব আবিষ্কার হচ্ছে বিদআ’ত আর প্রত্যেক বিদআ’ত হচ্ছে পথভ্রষ্টতা।” আবু দাউদঃ ৪৬০৭, তিরমিযী, আহমাদ। হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রহি’মাহুল্লাহ।

খুলাফায়ে রাশেদীন কারা?

ইসলামের ইতিহাসে চারজন সাহাবী খুলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত এবং গ্রহণযোগ্য। তাঁরা হচ্ছেনঃ

(১) আবু বকর ‘সিদ্দীক্ব’ বিন আবু ক্বুহাফা রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা। শাসনকাল ১১ হিজরী থেকে ১৩ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ২ বছর।

(২) উমর ‘ফারুক্ব’ বিন খাত্তাব রাদিয়ল্লাহু আ’নহু। শাসনকাল ১৩ হিজরী থেকে ২৩ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর।

(৩) ‘যুন-নুরাইন’ উষমান বিন আফফান রাদিয়ল্লাহু আ’নহু। শাসনকাল ২৩ হিজরী থেকে ৩৫ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর।

(৪) আলী বিন আবু তালিব রাদিয়ল্লাহু আ’নহু। শাসনকাল ৩৫ হিজরী থেকে ৪০ হিজরী পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর।

এই চারজন সাহাবী যে হেদায়েতপ্রাপ্ত খলিফা ছিলেন তা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়ঃ

সাফিনাহ রাদিয়ল্লাহু আ’নহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নবুওয়াতের ভিত্তিতে পরিচালিত খিলাফাত ত্রিশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা তাঁর রাজত্ব দান করবেন।”

এই হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন তাবেয়ী সাঈদ রহি’মাহুল্লাহ বলেন, আমাকে সাফিনাহ রাদিয়ল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “তুমি (সেই ত্রিশ বছর) হিসেব করো, আবু বাকর রাদিয়ল্লাহু আ’নহু দুই বছর, উমার রাদিয়ল্লাহু আ’নহু দশ বছর, উসমান রাদিয়ল্লাহু আ’নহুবারো বছর ও আলী রাদিয়ল্লাহু আ’নহু এতো বছর খিলাফাতের দায়িত্ব পালন করেছেন।” হাদীসটি হাসান সহীহ, তিরমিযী, নাসায়ী, সুনানুল কুবরা, আহমাদ।


মুসলমানদের পঞ্চম খলিফা কে ছিলেন?

ইসলামী সাহিত্যে অনেক লেখক কিংবা বুদ্ধিজীবি তাবেয়ী বিদ্বান উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহি’মাহুল্লাহ, যিনি “দ্বিতীয় উমর” হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁকে “ইসলামের পঞ্চম খলিফা” বা “পঞ্চম খুলাফায়ে রাশেদীন” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এটা ভুল এবং একপ্রকার বিভ্রান্তি। কেননা উমর ইবনে আব্দুল আজীজের পূর্বে হাসান বিন আলী রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা; এই দুইজন মুসলমানদের খলিফা ছিলেন। শাসক হিসেবে হাসান এবং মুয়াবিয়া রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমার মর্যাদা উমর ইবনে আব্দুল আজীজের চাইতে অনেক বেশি। কেননা উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহি’মাহুল্লাহ ছিলেন একজন তাবেয়ী আর হাসান এবং মুয়াবিয়া রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা এই দুইজন ছিলেন সম্মানিত সাহাবী। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আক্বীদাহ অনুযায়ী সাহাবীদের মধ্যে সবচাইতে কম মর্যাদার একজন তাবেয়ীদের মধ্যে সবচাইতে উত্তম ব্যক্তির চাইতেও শ্রেষ্ঠ।

পঞ্চম খলিফার ইতিহাসঃ

চল্লিশ হিজরীতে পথভ্রষ্ট খারেজী আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম ইরাকের কুফা শহরের মসজিদে ফযরের নামায পড়া অবস্থায় বিষাক্ত ছুরি দিয়ে আঘাত করে আলী রাদিয়ল্লাহু আ’নহুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো। তাঁর শাহাদতের পর মুসলমানদের নেতৃত্ব হাসান বিন আলী রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা; এই দুইজনের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। এই দুইজনই মুসলমানদের খলিফা ছিলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর মৃত্যুর ছয় মাস পর মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি এবং রক্তপাত এড়ানোর জন্য হাসান বিন আলী রাদিয়ল্লাহু আ’নহুমা স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব মুয়াবিয়া রাদিয়ল্লাহু আ’নহুর কাছে হস্তাস্তর করেন। এইভাবে মুসলমানদের দুইটি দলের মাঝে সন্ধি হওয়ার কারণে সেই বছরকে ইয়াওমুল জামাআ’হ বা ঐক্যের বছর বলা হয়। আর হাসান রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর এই অনন্য ভূমিকার কথা হাদীসে পূর্বেই ঘোষণা করে তাঁকে সাইয়্যিদ বা নেতা উপাধি দেওয়া হয়েছে।

আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি, ঐ সময় হাসান রাদিয়াল্লাহু আ’নহু তাঁর পার্শ্বে ছিলেন। তিনি একবার উপস্থিত লোকদের দিকে আবার হাসান রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমার এই সন্তান হচ্ছে সাইয়্যিদ বা নেতা। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে বিবদমান দুই দল মুসলমানের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিবেন। সহীহ বুখারীঃ ৩৭৪৬।

যাই হোক, আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলী - এই চারজনের খিলাফতের মেয়াদ ছিলো ২৯ বছর ৬ মাস ছিলো। এরপর ছয় মাস খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন হাসান রাদিয়ল্লাহু আ’নহু। একারণে অনেক আলেম হযরত হাসান রাদিয়ল্লাহু আ’নহুকে “পঞ্চম খুলাফায়ে রাশেদীন” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তাঁদের এই মত খুলাফায়ে রাশেদীন ৩০ বছর পর্যন্ত জারী থাকবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। উপরোক্ত ইতিহাস ইমাম আয-যাহাবী রহি’মাহুল্লাহর “আত-তারিখ আল-কাবীর”, ইমাম ইবনে কাসীর রহি’মাহুল্লাহর “আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ”, ইমাম সুয়ুতী রহি’মাহুল্লাহর “তারিখ আল-খুলাফা” তে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ সবচাইতে ভালো জানেন।


শীয়াপ্রেমী এমন রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাসী একশ্রেণীর লোকেরা অন্যায়ভাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আ’নহুকে খারাপ মনে করে তাঁর সমালোচনা করে। কিন্তু তারা উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহি’মাহুল্লাহর প্রশংসা করে। এটা আসলে তাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং নিজেদেরকে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া আর কিছুই না। আসুন দেখি আমাদের পূর্ববর্তী গুরুজনেরা এ ব্যাপারে কি মন্তব্য করেছেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আ’নহুর নাকের ধূলা-বালি উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহি’মাহুল্লাহর চাইতে উত্তম।” শাযরাতুদ-দাব।

ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহি’মাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “কে উত্তম? মুয়াবিয়া নাকি উমর ইবনে আব্দুল আজীজ? উত্তরে তিনি বলেন, “মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আ’নহু যখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলেন তখন তাঁর নাকের ধূলা-বালি উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহি’মাহুল্লাহর চাইতে হাজারগুণ উত্তম।” ওফায়াতুল আ’ইনঃ ৩৩/৩।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহি’মাহুল্লাহকে এমন এক ব্যক্তির সম্পর্কে বলা হয়েছিলো, যে কিনা মুয়াবিয়ার চাইতে উমর ইবনে আব্দুল আজীজকে উত্তম মনে করতো। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহি’মাহুল্লাহ শুনে বললেন, “তোমরা তার সাথে পানাহার করোনা, সে অসুস্থ হলে তাঁকে দেখতে যেয়োনা (কেননা সে একটি বিদআ’তী চিন্তা-ভাবনা পোষণ করে)।” দায়লুত-তাবাক্বাত।

Post a Comment

أحدث أقدم