নূহ আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে অনেক অনেক বছর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু অবাধ্য কওম তাঁর ডাকে কোনো সাড়াই দিতে চায় না। তারা আল্লাহর নবি নূহ আলাইহিস সালামকে অত্যাচার-নির্যাতন করে, তাঁর দাবিকে অস্বীকার করে এবং তাঁর নুবুওয়াতের ব্যাপারে যা খুশি তা বলতে থাকে। অবাধ্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ যাকে বলে! তাদের সেই ক্রমাগত অত্যাচার-নির্যাতন, নিরন্তর অবাধ্যতা এবং সীমা লঙ্ঘনের কারণে তাদের ওপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আযাব আসাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নূহ আলাইহিস সালামকে একটা নৌকা বানানোর আদেশ দিলেন। তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা—বানের পানিতে তিনি ডুবিয়ে মারবেন এই অবাধ্য জাতিটাকে!
নৌকা বানানোর কাজে লেগে পড়লেন নূহ আলাইহিস সালাম। কিন্তু এমন কড়কড়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে, এমন শুষ্ক আবহাওয়ার সময়ে বানের পানি থেকে বাঁচতে নৌকা বানাতে দেখে নূহ আলাইহিস সালামকে ঠাট্টা করতে শুরু করেছিলো কাফিরেরা।
وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِّنۡ قَوْمِهِ سَخِرُوۡا مِنْهُ ۚ
“নূহ নৌকা তৈরি করছিলো। আর যখনই তার জাতির প্রধান ব্যক্তিরা নূহের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তারা তাঁকে নিয়ে উপহাসে মেতে উঠছিলো।” (১)
তাদের মনে হয়তো এই ভাবনার উদয় হয়েছিলো যে—আরেহ! কী সুন্দর আবহাওয়া প্রকৃতিতে বিরাজ করছে, আর এই লোকটা এসেছে আমাদেরকে বানের জলের গল্প শোনাতে! পাগল নাকি!
তারা হয়তো আরও ভেবেছে—ধরে নিলাম অঝোর ধারার বৃষ্টি হবে। কিন্তু তাই বলে কী নৌকায় উঠে সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হবে আমাদের? আমাদের ঘরগুলো কি ডুবে যাবে নাকি? এমনটা হয়েছে কখনো? এমন ঘটনা না আমরা দেখেছি আর না আমাদের বাপ-দাদারা দেখেছে কোনোদিন!
ভাবনা মিথ্যে নয়। নূহ আলাইহিস সালামের কওম কেবল নয়, তাঁর আগের কোনো জাতিই এতো ভয়াবহতম বন্যা অবলোকন করেনি এবং কিয়ামতের আগে হয়তো আর কোনো জাতি সেটা অবলোকন করবে না। যেহেতু এমনকিছু যে ঘটতে পারে সেই অভিজ্ঞতা তাদের কাছে ছিলো না, তাই নূহ আলাইহিস সালামকে এমন কড়কড়ে রোদে কাল্পনিক বৃষ্টি আর বন্যার কথা ভেবে নৌকা বানাতে দেখে উপহাস করতে শুরু করে তারা।
তাফসীর থেকে জানা যায়—নূহ আলাইহিস সালাম গোটা একশ বছর ধরে সেই নৌকা বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ—যেদিন থেকে নূহ আলাইহিস সালাম সেই নৌকা বানানো শুরু করেছিলেন, তার আরও একশ বছর পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আযাবের সেই বন্যা নূহ আলাইহিস সালামের কওমকে গ্রাস করেছিলো।
এই জায়গায় একটা চমৎকার ব্যাপার আমার মাথায় এলো। সেই নৌকাটা বানাতে যেহেতু নূহ আলাইহিস সালামের একশ বছর লেগেছিলো, তাহলে গোটা একটা শতাব্দী ধরে কাফিরদের ঠাট্টা-মশকারি, লাঞ্ছনা আর উপহাস তাঁকে কি সহ্য করে যেতে হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। যদি রাতারাতি সেই আযাব চলে আসতো, যদি নূহ আলাইহিস সালাম নৌকা বানানোর কাজে হাত দেওয়া মাত্রই প্রকৃতিতে নেমে আসতো অঝোর ধারার বর্ষণ, তাহলেও নূহ আলাইহিস সালামের সতর্কবার্তাকে খানিকটা হলেও সত্য মনে করতো তারা। খুব বেশি উপহাস করতে পারতো না। কিন্তু গোটা একশ বছর যেখানে লেগে গেলো, এতো লম্বা একটা সময় ধরে যে উপহাস, বিদ্রুপ আর তিরস্কারের ভেতর দিয়ে নূহ আলাইহিস সালামকে যেতে হয়েছে তা কি কল্পনা করা যায়?
কিন্তু দেখুন—সেই লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, উপহাস, বিদ্রুপ আর তিরস্কারের বিপরীতে কী সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে গেলেন নূহ আলাইহিস সালাম! ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। নূহ আলাইহিস সালামের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা তো দূর, কখনো সেই বাঁধের একটা বালুকণাও নড়চড় করেনি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতিশ্রুত আযাব আসতে এতো সুদীর্ঘ সময় লেগে গেলেও, তিনি কখনোই প্রশ্ন করে বসেননি যে—ইয়া আল্লাহ, আপনি তো বলেছেন এই কাফিরদের জন্য আযাব পাঠাবেন। কিন্তু এতোগুলো বছর হয়ে গেলো তবুও আপনার কোনো আযাব এদের ওপর আপতিত হলো না এখনো৷ এরা তো আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে তাদের তিরস্কার আর বিদ্রুপে। মাবূদ, কবে পাঠাবেন আপনার সেই প্রতিশ্রুত আযাব?
কখনোই নয়! নূহ আলাইহিস সালাম একটাবারের জন্যও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে এভাবে জিজ্ঞাসার বাণে ফেলেননি। আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব আসতে সুদীর্ঘ সময় লেগেছে ঠিক, এরই মধ্যে কাফিরেরা তাঁকে উপহাস, তিরস্কার আর বিদ্রুপে জর্জরিত করেছে সেটাও ঠিক, কিন্তু সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ওপর ভরসা করে ছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কখন সেই আযাব পাঠাবেন, সেই সময়ের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থেকেছেন।
জীবনে আমরাও আল্লাহর নিয়ামত লাভের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকি। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে জীবনের দরকারে এটা-ওটা লাভের দুআ করি৷ কিন্তু যখনই আমাদের প্রত্যাশিত বস্তু লাভে আমরা ব্যর্থ হই কিংবা সেই বস্তু আমাদের হস্তগত হতে সময় লেগে যায়, আমরা তখন ব্যাকুল হয়ে উঠি। আমরা হাপিত্যেশ করে বলি, ‘আহা! আল্লাহ কেন যে আমার দুআ কবুল করেন না! কেন যে তিনি আমার ডাকে সাড়া দেন না!’
চিন্তা করে দেখুন—নূহ আলাইহিস সালামকে যে আযাবের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দিয়েছেন তা পাঠিয়েছেন আরও একশ বছর পরে, কিন্তু কাফিরদের নিরন্তর উপহাস সত্ত্বেও এতে নূহ আলাইহিস সালামের কোনো হাপিত্যেশ কিংবা কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো না। তিনি ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে গেছেন। কিন্তু আমরা—আমাদের প্রত্যাশিত বস্তু আজকে চেয়ে কালকে না পেলে অস্থির হয়ে যাই৷ পেরেশানিতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারি না। আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর নূহ আলাইহিস সালামের যে সীমাহীন ভরসা ছিলো, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেই ভরসার ছিটেফোঁটা আছে কি?
রেফারেন্স:
১. সূরা হুদ, আয়াত-৩৮
'কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ' বই থেকে নেওয়া টুকরো অংশ।
লিখেছেন: ভাই আরিফ আজাদ
Post a Comment