জ্ঞানের ফেরিওয়ালা

ইন্টারনেটের বদৌলতে আজকাল জ্ঞান অর্জন করা যেমন সহজ, তেমনি জ্ঞান বিতরণও অনেক সহজ। হেন কোন বিষয় নাই, যা প্রফেসর গুগল জানেন না! কথার কথায় অনেকে তো এমনও বলে যে, “যা গুগলে নাই, তার অস্তিত্ব নাই।” কিছুটা হলেও কথাটা সত্য বটে।

ইসলামকে নিয়ে জানাশোনাও আজকে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। ইন্টারনেটের কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমেই আজ আমরা জেনে নিতে পারি কুর’আনের ক্ল্যাসিক থেকে আধুনিক প্রায় সব তাফসীর। বুখারি-মুসলিমের হ়াদীস় তো ঐ দেখা যায়—শুধু সার্চ দেওয়ার ব্যাপার। হুরমুর করে হ়াদীস় সংবলিত বেশ কয়েকটা ওয়েবসাইটের লিংক আপনার মনিটরের চার কোণার মাঝে দৌড়ে আসবে। শুধু কি কুর’আন আর সুন্নাহ—ইসলামের তস্য গলি ঘেঁটে যা কিছু আপনি জানতে চান সবই এখন আপনার আঙুলের ডগায়। কিন্তু বিপত্তিটা যে এখানেই।


জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার আমাদের সামনে এমন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে থাকায় আমরা যেনতেনভাবে এই জ্ঞান খাবলে নিচ্ছি। এ যেন বিশাল সমুদ্রের বুকে প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়া—ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আমরা নিজের অজান্তেই ডুবে যাচ্ছি অতলে। নিজে তো যাচ্ছিই, সঙ্গে আহ্বান করার ছলে নিয়ে যাচ্ছি আমার অনুসারী-সঙ্গীসাথীদের।

কুর’আন, সুন্নাহ, ফিক়হ, ফাতাওয়া—ইসালমিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো গল্প-উপন্যাসের মতো কোনো চটুল বিষয় না যে, একবার পড়লাম আর আমি তার উস্তায বনে গেলাম; আর পরক্ষণেই—‘আলিমদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না-করে—‘নিজে’ যা বুঝলাম, তাই উগড়ে দিলাম। ইসলামিক জ্ঞান অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। অনেক গভীর এই জ্ঞান। একজন ‘আলিমকে বছরের পর বছর ধরে নিরলস অধ্যাবসায়, প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই জ্ঞানগুলো অনুপুঙ্খভাবে রপ্ত করতে হয়। তবেই না তিনি ‘আলিম। অথচ আমরা সেই তুলনায় হয়তো ‘আলিমদের ধারে কাছেও নাই, তবু দিব্যি ফেরি করে বেড়াচ্ছি আধো-জ্ঞান। একবারও ভাবছি না, বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধান ছাড়াই নিজের মনগড়া ইসলামের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছি তা কতটা ইসলামিক!

এই হ়াদীস়টি হয়তো কমবেশি আমরা সবাই জানি, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করে না, যতক্ষণ-না আমি তার কাছে তার সন্তান, তার বাবা, ও সব মানুষের চেয়ে প্রিয় না-হই।” [সাহ়ীহ় বুখারি, সাহ়ীহ় মুসলিম]

কেউ একজন হয়তো নেট ঘেঁটে কোনো আর্টিকেল কিংবা হ়াদীস় কালেকশানের কোনো ওয়েবসাইটে এই কথাটি পেয়েছেন। হ়াদীস়টির বাহ্যিক অর্থ পড়ে তার হয়তো এই বুঝ হলো, কোনো মানুষই মুসলিম হতে পারবে না, যতক্ষণ-না সে নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী কিংবা পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে ভালো না-বাসে। ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক হবে ভেবে দেখুন তো? আমরা সবাই কাফির?

অথচ ‘আলিমরা এই হ়াদীস়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,
“এখানে ঈমানের পরিপূর্ণতার স্তরের ব্যাপারে বলা হয়েছে। যদি বাহ্যিক অর্থে হ়াদীস়টিকে গ্রহণ করা হয় তাহলে আমাদের অনেকেই আর মুসলিম থাকবে না।” [এভল্যুশন অফ ফিক়হ, ড. বিলাল ফিলিপ্‌স, পৃ. ১৭৫]

শুধু এই হ়াদীস়টাই না, এমন অনেক হাদীসই আছে যেগুলোর অগভীর অধ্যয়ন আমাদের বিপথে নিতে পারে। তাই ‘আলিমদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তত্ত্বাবধান বা পরামর্শ ছাড়া আমরা যদি ইন্টারনেট চষে এভাবে নিজের মনগড়া ইসলামিক জ্ঞান বিলানো শুরু করি তাতে নিজে তো সাগরে ডুববই, সঙ্গে ডোবাব আরও কিছু মানুষকে।

আশা করি, সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধের মাধ্যমে মূল বিষয়টা সবাইকে বোঝাতে পেরেছি। ভবিষ্যতে হুট করে কিছু বলার আগে আমরা কয়েকবার ভেবে নেব—এই প্রত্যাশা সবার কাছে।


- মাসুদ শরীফ, অনুবাদক ও সহকারী ম্যানেজার, সিয়ান পাবলিকেশন


Post a Comment

Previous Post Next Post