হাদীসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সুপ্রিয় বন্ধুগণ, বর্তমান যুগে অগণিত ফিতনার মাঝে একটি বড় ফিতনা হল হাদীস অস্বীকার করা ফিতনা। এই হাদীস অস্বীকার কারীর দল তাদের নোংরা নখর বের করে সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বত্বা এবং হাদীসে রাসূলের উপর কঠিন ভাবে আক্রমণ শুরু করেছে। কারণ, হাদীস থেকে মুসলমানদের দূরে সরাতে পারলে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো পানির মত সোজা। এ জন্য তারা ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও ওয়া মাহফিল, সভা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের এই জঘন্য অপ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে তারা হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তার মানহানি করছে। হাদীসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। তারা বলতে চায় শুধু কুরআন যথেষ্ট। হাদীস মানার প্রয়োজন নাই। হাদীস বা সুন্নাহ শব্দটি তারা শুনতে চায় না। যার কারণে এরা নিজেদেরকে নাম দিয়েছে আহলে কুরআন বা কুরআনের অনুসারী।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যৎ বাণী কত সত্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে!! তিনি বলেছেন:
(ألا إني أوتيت الكتاب ومثله معه لا يوشك رجل شبعان على أريكته يقول عليكم بهذا القرآن فما وجدتم فيه من حلال فأحلوه وما وجدتم فيه من حرام فحرموه)

“জেনে রাখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সাথে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস (তা হল হাদীস)। অচিরেই দেখা যাবে, এক লোক ভরা পেটে তার খাটের উপর থেকে বলবে: তোমরা এই কুরআনকে আঁকড়ে ধর। এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে সেগুলোকে হালাল মনে কর, আর যে সব বস্তুকে হারাম পাবে সেগুলোকে হারাম মনে কর।“ (আবু দাউদ, মিকদাদ ইবনে মাদিকারাব থেকে বর্ণিত, সনদ সহীহ)

উক্ত হাদীসটি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ বহন করে। কারণ, নবুওয়তের যুগ পার হওয়ার পরপরই শিয়া ও খারেজী সম্প্রদায়ের হাত ধরে বিভিন্ন দল তৈরি হয় তারা হাদীসের উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা বলে কুরআনই যথেষ্ট এবং হাদীস ও সু্ন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে নতুন করে এই ভ্রান্ত মতবাদের উৎপত্তি হয়। তারপর তা পাকিস্তানে জায়গা নেয়। এরপরে ক্রমান্বয়ে তা আরও বিভিন্ন মুসলিম দেশে সংক্রমিত হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ তাদের জমজমাট কার্যক্রম রয়েছে। এমতের অনুসারীদের কেউ কেউ ইউরোপ-আমেরিকায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের এই বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। ফেসবুকে গড়ে তুলেছে বড় একটা গ্রুপ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামে হাদীসের মর্যাদা ও হাদীসের অস্বীকার কারীদের পরিণতি সম্পর্কে নিন্মোক্ত প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে যেন, বাংলাভাষী মুসলমানগণ হাদীসের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তার হেফাজতের জন্য সর্ব শক্তি নিয়োগ করে এবং বাতিলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকে। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তাওফীক দান করুন।

প্রবন্ধটি লিখেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট, দাঈ, ও গবেষক শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আমীন। -সম্পাদক

লেখকের ভূমিকা: আল হামদুলিল্লাহ্ ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া মান ওয়ালাহ।

মহানবী মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে জাতির সাধারণ মানুষদের মতই জীবন-যাপন করতেন। আল্লাহ তাকে নির্বাচিত করে পথভ্রষ্ট সমগ্র মানব জাতিকে (৩৪:২৮) সঠিক পথে আহ্বানের জন্যে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করলেন। শিক্ষা দিলেন কুরআন ও ঈমান। তারপর দায়িত্ব দিলেন সেই পথে মানুষকে আহ্বানের।

আল্লাহ বলেন:
 وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

“আর এইভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী করেছি রূহ (কুরআন) আমার নির্দেশে; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি ও ঈমান কি, পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে দেই। আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক পথে মানুষকে আহ্বান করতেই থাকবেন।”(সূরা শূরা: ৫২)
আল্লাহ্‌ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আদেশ করলেন মানুষকে হেদায়াত করার, আর মানুষকে আদেশ করলেন তিনি যা বলেন তা গ্রহণ করার।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দিয়েছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। আল্লাহ বলেন:
 وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا

“রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর: ৭)
 এই রাসূল আমাদেরকে যেমন কুরআন দিয়েছেন, সেই সাথে কুরআনকে কিভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হও, তাও আল্লাহর নির্দেশ মোতাকেব দিয়েছেন। আর বাস্তব জীবনের ঐ প্রয়োগটাই হচ্ছে বিদগ্ধ বিদ্বানদের ভাষায় হাদীছ।



* মতভেদ হলে আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ থেকে সমাধান নিতে হবে:

অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর কথা মেনে নেয়ার সাথে সাথে রাসূলের কথাকেও মানতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর..।” (মুহাম্মাদঃ ৩৩) আরও সূরা নূর: ৫৪।

রাসূলের কোন কথা না থাকলে আলাদাভাবে তাঁর অনুগত্য করার জন্যে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহারের দরকার ছিল না। পার্থক্য লক্ষ্য করুন, সূরা নিসার ৫৯নং আয়াতে আল্লাহ্‌ তাঁর এবং রাসূলের অনুগত্য করার সাথে সাথে উলুল আমর তথা মুসলিম শাসকেরও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের শাসকবর্গের।”

 এখানে أَطِيعُوا শব্দটি যেমন আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে একইভাবে রাসূলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়েছে; কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্যের ক্ষেত্রে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়নি। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহর আনুগত্য যেমন বিনাবাক্য ব্যয়ে করতে হবে, অনুরূপ রাসূলের আনুগত্যও। কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্য করার সময় খেয়াল রাখতে হবে তার কথা আল্লাহ এবং রাসূলের কথার সাথে মিল আছে কি না। অর্থাৎ তাঁর অনুগত্য তাঁদের আনুগত্যের মাপকাঠিতে হতে হবে।

এই জন্যে মতভেদ বা সমস্যা হলে সমাধান কিভাবে করতে হবে আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ্‌ তা বলে দিয়েছেন:
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ

"তোমরা কোন বিষয়ে মতবিরোধ করলে তার সমাধানে জন্যে আল্লাহ্‌ এবং রাসূলের শরণাপন্ন হবে।”

এখানে আর উলুল আমরের কথা বলা হয়নি। কেননা তাদের সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। সমাধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল দিবেন। অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে। তিনি জীবদ্দশায় নিজে সমাধান দিয়েছেন, আর তাঁর মৃত্যুর পর কুরআন এবং সেই সাথে তাঁর রেখে যাওয়া সমাধান সমূহ যার অপর নাম হাদীছ।


রাসূলের ফায়সালা ও আদেশ-নিষেধের গুরুত্ব কত বেশী যে তা না মানলে মানুষ মুমিনই থাকবে না। আল্লাহ্‌ বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

 “আপনার পালনকর্তার শপথ তারা ইমানদার হতে পারবে যে পর্যন্ত তারা পরস্পর বিরোধের বিষয়ের সমাধানের জন্যে আপনাকে বিচারক বা ফায়সালা কারী হিসেবে মেনে না নিবে, তারপর আপনি যে ফায়সালা করবেন তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না এবং তার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করবে।”  (সূরা নিসা: ৬৫)

এখানে ভাষার প্রয়োগ রূপটা দেখুন কিভাবে তাঁকে সম্বোধন করে ‘উপস্থিত একবচন’ শব্দ يُحَكِّمُوكَ “আপনাকে বিচারক মানবে” এবং قَضَيْتَ “আপনি ফায়সালা করেন।” আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বিচার বা ফায়সালা করেছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যদি কোন ফায়সালা না থাকে বা তাঁর কথার কোন দরকার না থাকে, তবে তাঁকে বিশেষভাবে সম্বোধন করে এভাবে কথা বলা অনর্থক হয়ে যায়।


Post a Comment

Previous Post Next Post