গান-বাজনা : শেষ এখানেই


প্রারম্ভিক কথা:

কোন সুসংবাদ কিংবা দুঃসংবাদ শুনলে আপনার মুখ দিয়ে প্রথমে কি কি শব্দ বেরিয়ে আসে। সুবহান'আল্লহ্, আলহামদুলিল্লাহ্ কিংবা আল্লহু আকবার নাকি একগুচ্ছ ইংরেজী অশ্লীল শব্দগুচ্ছ। একটু খেয়াল করুন, যেখানে আপনি সম্পূর্ণ সচেতন আর সুস্থ মস্তিষ্কে আপনার মনন আর চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হচ্ছেন না, সেখানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কঠিন মুহূর্তে আপনি শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?

কিংবা কোন গান কিংবা সঙ্গীতের মুর্ছনা যখন আপনি মনযোগ সহকারে শুনেন আর তার অস্তিত্ত্ব আর গুন্জন আপনার মস্তিষ্কে রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ কিংবা দীর্ঘদিন। এবার ভাবুন তো, সচল মস্তিষ্ক যেখানে এ ধরনের গুন্জনকে বাধা দিতে সমর্থ নয় কিংবা অবচেতন মনকে তা গ্রাস করে রাখে সেখানে কিভাবে আপনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শাহাদাহ্ দিতে সমর্থ হবেন?


ইমাম আয-যাহাবী তার কিতাবুল কাবায়ের গ্রন্থে এরকম কিছু মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেছেন যার পরিণতি ছিলো মন্দ। আর এমন পরিণতির কারণ তাদের ধারাবাহিক পাপাচারে নিমজ্জিত থাকা। এরূপ একব্যক্তি যার ছিলো এক মহিলা গায়িকার গানের প্রতি আসক্তি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন ঐ ব্যক্তি লড়ছিলেন তখন তার ঘরে ঐ মহিলা গায়িকার গান বাজছিল। এ সময়ে একজন শায়খ তার ঘরে উপনীত হয়ে বলেন এসব বন্ধ করে কুর'আন তিলাওয়াত দেয়ার জন্য কিন্তু তখন ঐ ব্যক্তি বলে উঠল তার এসব সহ্য হয় না। সে ঐ মহিলা গায়িকার গানেই শান্তি পায়। এবার বুঝুন তার পরিণতি।

গান-বাজনার প্রকৃত স্বরূপ:

আমি এখনো গান হালাল কি হারাম সে প্রসঙ্গ টানছি না। শুধু এটুকু চিন্তা করুন যেখানে গান-বাজনা হয় সেখানকার পরিবেশের কথা। সেখানে থাকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সেখানে থাকে মদ কিংবা নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা, সেখানে থাকে অশ্লীলতা-অভব্যতার ছড়াছড়ি। এবার আপনিই ভাবুন ঐখানকার পরিবেশ কি আপনাকে আল্লাহ্'র নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে নাকি সীমালঙ্গনে?

কিংবা গানে কি আপনি কখনো শুনেছেন নৈতিকতার কথা, ছ্বলাত আদায়ের তাগিদ কিংবা পিতা-মাতার আদেশ মান্য করার হুকুম। না এসব কখনোই আপনি গানে শুনবেন না। এখানে শুনবেন অবৈধ প্রেম কিংবা সম্পর্কের কথা, আত্মম্ভরিতার কথা, হতাশার স্মৃতিচারণ কিংবা সুললিত নারীকন্ঠে যিনা'র [ব্যভিচার] আহবান।

এখানে আপনি শুনবেন LP'র 'Crawling in my skin...these wounds they'll not heal'। আর এ গান তো আপনাকে heal করবেই না বরং wounds কে scar বানিয়ে আপনাকে hell এ পাঠাবে। কিংবা Snoop-Dogg'র হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গালাগালি। কোন সুস্থ মানুষ কি এরূপ কোন হেলমেট পড়ুয়া ব্যক্তির উপদেশ গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই না। কিংবা Akon এর আত্মম্ভরিতা 'Me..me...and me' এ জাতীয় কথাবার্তা যেখানে কেবল প্রবৃত্তিরই জয়গান করা হয় কিংবা কোন নারীর কন্ঠকে শয়তানের স্বরমিশ্রিত করে কুপ্রস্তাবনার দিকে আহবান।

সঙ্গীত-তারকাদের দুর্দশার কথা না বলে কেবল যদি তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীদের তালিকা করা হয় তা অনেক দীর্ঘ হবে। সঙ্গীতের নামে কপটতা, অপরের দুঃখের ফিরিস্তি, আত্ম-গরিমা আর হতাশার বিকিকিনি কেবল সাময়িক মোহ তৈরী করে; যা জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে রাখে। সঙ্গীত তারকাদের পাঁচ মিনিটের মিউজিক ভিডিও কিংবা ষাট মিনিটের আলব্যামে আপনি যা শুনেন আর দেখেন তার সাথে তাদের বাস্তবজীবনের সংযোগ সামান্যই। মূলতঃ তারা মিউজিক ইন্ড্রাস্টি আর দুরাচারী জীবনেরই দাসত্ব করছে।

গান-বাজনার কুফল:

পূর্ববর্তী সালাফদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে গান আর কুর'আন একই অন্তরে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াহ্'র সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে। তারা গানকে বিভিন্ন মন্দ নামে আর গায়ককে বিভিন্ন মন্দ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যেমন এক সালাফ বলেছেন: "গান হচ্ছে যিনা'র রুকইয়া" অর্থ্যাৎ গান-বাজনা ব্যভিচারের ইন্ধন প্রদানকারী।

আর গান মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে কপটতা কিংবা নিফাক। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ

‘পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।’[বাইহাকী : ২১৫৩৬; ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২]

সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী গান ও বাদ্যযন্ত্র বহু গুনাহর সমষ্টি। যেমন : ক. নিফাক বা মুনাফেকির উৎস খ. ব্যভিচারে অনুপ্রাণিতকারী গ. মস্তিষ্কের ওপর আবরণ ঘ. কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টিকারী ঙ. আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ. গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ. জিহাদি চেতনা বিনষ্টকারী। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭]

কুরআন আর সুন্নাহ্'য় গানের বিধান:

আসলে গান-বাজনার ক্ষতিকারিতা এত বেশি যে তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। তদুপরি মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু ভাষ্য থেকে তা হারাম হওয়া প্রমাণিত। যেমন : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:



وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ

‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।’[সূরা লুকমান, আয়াত : ০৬]

গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে তিনি বলেন:



لاَ تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوهُنَّ وَلاَ خَيْرَ فِى تِجَارَةٍ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ

‘তোমরা গায়িকা (দাসী) কেনাবেচা করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণও নেই। জেনে রেখ, এ থেকে প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’ [তিরমিযী : ১৩২৯; ইবন মাজা : ২১৬৮]



অন্যত্র তিনি বলেন:



لَيَشْرَبَنَّ أُنَاسٌ مِنْ أُمَّتِى الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا وَتُضْرَبُ عَلَى رُءُوسِهِمُ الْمَعَازِفُ يَخْسِفُ اللَّهُ بِهِمُ الأَرْضَ وَيَجْعَلُ مِنْهُمْ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ ».

‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মাটিতে ধ্বসিয়ে দেবেন। এবং তাদের মধ্যে অনেককে শূকর ও বাঁদর বানিয়ে দেবেন।’[বাইহাকী, সুনান : ১৭৮৪৫; ইবন মাজা : ৪০২০; ইবন হিব্বান : ৬৭৫৮]



তিনি আরও বলেন:



لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।’[বুখারী : ৫৫৯০]

আরেক জায়গায় তিনি বলেন:



بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً وَهَدًى لِلْعَالَمِينَ وَبَعَثَنِي لِمَحْقِ الْمَعَازِفِ وَالْمَزَامِيرِ، وَأَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ

‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা অবলুপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’[মুসনাদ আহমদ : ২২৩৬১ ; বাইহাকী : ৬১০৪]

চার ইমামের ভাষ্য:

গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম মালেক রাহ. কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে। [কুরতুবী ১৪/৫৫]

ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন যে, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহমক। তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না। [ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫]

হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম। [আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮]

ইমাম শাফেয়ী রাহ. শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস : ৫১৪৭, ৫১৬২ মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়। [ফাতহুল বারী ৯/২২৬]

শেষকথা:

গান-বাজনার কুফল নিয়ে আলোচনার ব্যাপক অবকাশ রয়েছে। এখানে এর স্বরূপ, কুফল আর শরীয়াহ্'র দলিলসমূহ পেশ করা হলো। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর তার অনুসরন করব নাকি প্রবৃত্তির অনুসরন করবো?

[মুল ভাবনা: ভাই কামাল এল-মাক্কী'র লেকচার 'The End of Music']

Post a Comment

Previous Post Next Post