আশুরা : করণীয় ও বর্জনীয় কি?

● আশুরা শব্দটি আরবী‘’আশেরা’ শব্দ থেকে রূপান্তরিত। আর‘আশেরা হচ্ছে ‘আশারা’ শব্দের বিশেষণ। যার, সাধারণ বাংলা অর্থ হচ্ছে দশ, দশক, দশজন বা দশটি (১০) অর্থাৎ ‘আশারা একটি আরবী সংখ্যার নাম যার বাংলা অর্থ দশ। দেখা যাচ্ছে, আরবী সংখ্যা ‘আশারা’ (১০) থেকে ‘আশেরা’ (দশম)। আর ত থেকে ‘আশুরা’ শব্দটি নির্গত হয়েছে যার অর্থ, মুহররম মাসের ১০ তারিখ। [লিসানুল আরব, ৪/৫৬৯]

এই শাব্দিক পরিবর্তনের ফলে অতিরঞ্জন এবং সম্মানের অর্থ পাওয়া যায়। [ফাত্ হুল্ বারী, ৪/৩১১ ]


● আশুরার দিন নির্ণয়:

আশুরার দিনটি মুহররম মাসের নবম দিন না দশম দিন? এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ উলামার মতে মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। কারণ শব্দের নামকরণ ও ব্যুৎপত্তি, দশ তারিখকেই সমর্থন করে। [ফাতহুল বারী, ৪/৩১১]
তাছাড়া আশুরা বিষয় হাদীসগুলি দ্বারা দশ তারিখ বুঝা যায়; নয় তারিখ নয়।


● ইসলাম পূর্বে আশুরার রোযা:

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ الله عنها ، قالت : كَانَتْ قُرَيْشٌ تَصُومُ عَاشُورَاءَ فَي الجَاهِلِيَّةِ ، وَ كَانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم يَصُومُهُ ، فَلمّا هَاجَرَ إلى المدينةِ ، صَامَهُ و أمَرَ بصَوْمِهِ ، فَلمّا فُرِضَ شَهْرُ رَمَضَانَ قال : مَنْ شَاءَ صَامَهُ و مَنْ شَاءَ تَرَكَهُ )رواه مسلم)

অর্থ: আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: কুরাইশ গোত্র জাহেলী যুগে আশুরার রোযা রাখতো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও রোযা রাখতেন। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি নিজে রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখার আদেশ করলেন। তার পর যখন রমযান মাসের রোযা ফরয করা হল, তখন তিনি বললেন: “ইচ্ছা হলে রোযা রাখো না হলে রাখো না”। [মুসলিম, সিয়াম, নং ২৬৩২]


● ইসলামে আশুরার রোযা:

ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন, তখন ঈহুদী সম্প্রদায়কে আশুরার দিনে রোযা পালন করতে দেখলেন। তাই তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন:

مَا هذا اليومُ الذي تَصُومُونَهُ ؟ قَالوا هذا يَومٌ عَظِيْمٌ ، أنْجى اللهُ فيهِ موسى و قَومَهُ ، وَ غَرَّقَ فِرْعَونَ و قَومَهُ ، فصَامَهُ موسى شكراً . فنحنُ نصومهُ ، فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : فنحنُ أحَقُّ و أولى بموسى مِنْكُمْ ، فصامَهُ رسُولُ الله صلى الله عليه و سلم ، و أمَرَ بِصِياَمِ (رواه مسلم)

“এটা এমন কোন্ দিন, যে দিনে তোমরা রোযায় আছো? তারা বললোঃ এটি একটি মহান দিন, আল্লাহ তায়ালা এই দিনে মুসা (আঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের লোকজনকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার অনুসারী লোকজনকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তাই মুসা (আঃ) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা রাখেন। অতএব আমরাও রোযা করি। তার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তাহলে তো মুসা (আঃ) এর ব্যাপারে তোমাদের তুলনায় আমরা বেশি হকদার। অতঃপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোযা রাখেন এবং রোযা রাখার আদেশ দেন।[মুসলিম, সিয়াম, নং ২৬৫৩ ]

● আশুরার রোযার ফযীলত:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোযার ফযীলত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,

يُكَفِّرُ السَّنَةَ المَاضِيَةَ

“এটা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা। “অর্থাৎ এর মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা হয়।


● আশুরার রোযার হুকুম:

ইমাম নবভী বলেন: “উলামাগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, আশুরার রোযা সুন্নত। ওয়াজিব (আবশ্যক) নয় “। [শারহ মুসলিম,৭-৮/২৪৫]


● আশুরার রোযা কয়টি ?

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহররম মাসের দশম তারিখে (আশুরার দিনে) রোযা রাখতেন, যেমন পূর্বে বর্ণিত হাদীসগুলিতে এবং অন্যান্য একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর পূর্বে নবম তারিখেও রোযা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করার ইচ্ছা করেন তাও সুন্নত।

ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোযা রাখেন এবং অন্যদের রাখার আদেশ করেন, তখন সাহাবাগণ বললেন: এটি একটি এমন দিন যাকে ইহুদী ও খৃষ্টানেরা সম্মান করে থাকে। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আগামী বছর আসলে ইনশাআল্লাহ নবম তারিখেও রোযা রাখবো।” হাদীস বর্ণনাকারী বলেন: আগামী বছর আসার পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা যান। [মুসলিম, সিয়াম, হাদীস নং ২৬৬১]

দশ তারিখের সাথে নয় তারিখেও রোযা রাখার কারণ সম্পর্কে কিছু আলেম বলেন: শুধু দশ তারিখে রোযা রাখলে ইহুদীদের সাদৃশ্য হয়। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন করার ইচ্ছা করেছিলেন। [শারহু মুসলিম, নবভী,৭-৮/২৫৪]

অতএব বুঝা গেল, আশুরার রোযা হবে দুটি: নবম এবং দশম তারিখ । আর এটিই হচ্ছে আশুরার রোযার উৎকৃষ্ট স্তর। কারণ এর সমর্থনে সহীহ প্রমাণ বিদ্যমান। অনুরূপ শুধু দশম তারিখে একটি রোযাও রাখা যেতে পারে। কারণ এটিই ছিল নবীজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমল। তবে উলামাগণ এটিকে আশুরার রোযার নিম্ন স্তর বলেছেন।

উল্লেখ থাকে যে, অনেকে আশুরার রোযা সহ তার পূর্বে ও পরে আরও একটি অর্থাৎ মোট তিনটি রোযা রাখাকে সর্ব্বোত্তম স্তর বলেছেন। [ফতহুল্ বারী, ৪/৩১১-১২/ নায়লুল আউতার, ৩-৪/৭৩৩/ তুহফাতুল আহ ওয়াযী,৩/৩৮২]


● আশুরার রোযার সাথে হুসাইন (রাযিঃ) এর শাহাদাতের কোন সম্পর্ক আছে কি ?

অনেককে এই দিনে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতে শুনা যায়: এই দিনে হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন তাই আমরা রোযা আছি। দ্বীনের বিষয়ে এটি একটি বিরাট অজ্ঞতা। সাধারণ লোকদের এই উত্তরের পিছনে আছে শিয়া সম্প্রদায়ের কৃতিত্ব। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পৌত্র হুসাইন (রা:) এই দিনে ইরাকের কারবালা মাঠে মর্মান্তিক ভাবে শহীদ হয়েছিলেন। তাই শিয়ারা এই দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। দেশে তাদের প্রোগ্রামগুলি রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রচার করা হয়। এমনকি এই দিনে সরকারি ছুটিও থাকে। তাই সাধারণ লোকদের নিকট এই দিনটির পরিচয় এবং মর্যাদার কারণ হচ্ছে, হুসাইন (রা:) এর শাহাদত। আর এ কারণেই হয়ত: তারা বলে থাকে যে, হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন তাই রোযা করছি। দীনী ভাইয়েরা! এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা। কারণ যেই দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেছেন সেই দিন থেকে সমস্ত অহী (প্রত্যাদেশ) বন্ধ হয়ে গেছে যার মাধ্যমে ইসলামের আদেশ-নিষেধ আসতো। ইসলাম পূর্ণতা লাভ করার পরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাই তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের নামে কোন বিধান আবিষ্কৃত হবে না। কেউ এমন করলে তা বিদআত (দ্বীনের নামে নতুন বিধান) হবে, যা প্রত্যাখ্যাত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَنْ أَحْدَثَ فِي أمْرِنَا هذا ما ليسَ مِنهُ فَهُوِ ردٌّ
( بخاري و مسلم)

“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করলো যা, এর অংশ নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী, মুসলিম]

তাই যারা এই নিয়তে রোযা করে থাকে যে, এই দিনে হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন, তাহলে তাদের রোযা তো হবেই না বরং তাদের এই আমল বিদআতে পরিণত হবে। আর অনেক ক্ষেত্রে শিরকও হতে পারে যদি কেউ হুসাইন (রা:) এর উদ্দেশ্যে তা পালন করে থাকে। কারণ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা শিরক।


● মুহররম ও আশুরাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত কিছু বিদআত :

১- ঢোল-বাজনা, লাঠি খেলা এবং অন্যান্য প্রোগ্রামের মাধ্যমে মুহররম উদযাপন করা।
২- তাজিয়া তৈরি করা এবং তাজিয়াকে সম্মান করা।
৩- মাতম করত: কাল জামা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করা।
৪- কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে মুরছিয়া গাওয়া ইত্যাদি।

———————————–
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
দাঈ, দাওয়াত সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব।
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

Post a Comment

Previous Post Next Post