সুফিবাদ: জ্ঞানের উৎসই যখন ভিন্ন

সকল মাজহাবের লোকগণ ইসলামের মূলনীতি হিসেবে কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে থাকেন। কিন্তু সুফীবাদের মূলনীতি সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তাদের মূলনীতির ব্যাপারে যথেষ্ট গড়মিল রয়েছে। কতিপয় সুফীবাদে কুরআন ও হাদীছকে বাদ দিয়ে নিম্নে মূলনীতিগুলোর উপর তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকেন। আবার কতিপয় সুফী তরীকার লোকেরা কুরআন ও হাদীছের সাথে আরও অনেকগুলো কাল্পনিক মূলনীতি থেকে তথাকথিত আত্মশুদ্ধির জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে থাকে। আসুন আমরা তাদের এ মূলনীতিটি একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।

১) কাশ্ফঃ

বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সুফীগণের সবচেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য মূলনীতি হচ্ছে কাশফ। সুফীদের বিশ্বাস হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে একজন সুফী সাধকের হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় এবং তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাদের পরিভাষায় একেই বলা হয় কাশফ।

وقد عرف أهل التصوف الكشف بأنه: الإطلاع على ما وراء الحجاب من المعاني الغيبية والأمور الحقيقية وجوداً وشهوداً

সুফীগণ কাশফের সংজ্ঞায় বলেছেন, যে পর্দার আড়ালে যে সমস্ত গায়েবী তথ্য ও প্রকৃত বিষয়সমূহ লুকায়িত আছে তা পাওয়া ও দেখার নামই হচ্ছে কাশফ। কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন, আল্লাহর আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে ও জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন। এমন কি তাদের অবগতি ব্যতীত গাছের একটি পাতাও ঝড়েনা, এক বিন্দু বৃষ্টিও বর্ষিত হয় না, আসমান-যমীনের কোন কিছুই তাকে অক্ষম করতে পারে না। এমন কি লাওহে মাহফুযে যা আছে, তাও তারা অবগত হতে পারেন। এমনি আরও অসংখ্যক্ষমতা অর্জনের দাবী করে থাকেন, যা একমাত্র মহান আল্লাহর গুণ।

কাশফের একটি উদাহরণঃ

   তাবলীগি নেসাব ফাযায়েলে আমাল নামক বইয়ের মধ্যে কাশফ-এর একাধিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য আমরা এখানে মাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

   শায়খ আবু ইয়াজিদ কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ আমি শুনিয়াছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে সে দোযখের আগুন হইতে নাজাত পাইয়া যায়। আমি এই খবর শুনিয়া এক নেছাব অর্থাৎ সত্তর হাজার বার আমার স্ত্রীর জন্য পড়িলাম এবং কয়েক নেছাব আমার নিজের জন্য পড়িয়া আখেরাতের সম্বল করিয়া রাখিলাম। আমাদের নিকট এক যুবক থাকিত। তাহার সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ ছিল যে, তাহার কাশ্ফ হয় এবং জান্নাত-জাহান্নামও সে দেখিতে পায়। ইহার সত্যতার ব্যাপারে আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। একবার সেই যুবক আমাদের সহিত খাওয়া-দাওয়ায় শরীক ছিল। এমতাবস্থায় হঠাৎ সে চিৎকার দিয়া উঠিল এবং তাহার শ্বাস বন্ধ হইয়া যাওয়ার উপক্রম হইল এবং সে বলিলঃ আমার মা দোযখে জ্বলিতেছে, আমি তাহার অবস্থা দেখিতে পাইয়াছি। কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ আমি তাহার অস্থির অবস্থা লক্ষ্য করিতেছিলাম। আমার খেয়াল হইল যে, একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশিয়া দেই। যাহা দ্বারা তাহার সত্যতার ব্যাপারেও আমার পরীক্ষা হইয়া যাইবে। অর্থাৎ তাহার কাশ্ফ হওয়ার ব্যাপারটাও পরীক্ষা হইয়া যাইবে। সুতরাং আমার জন্য পড়া সত্তর হাজারের নেছাবসমূহ হইতে একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশিয়া দিলাম। আমি আমার অন্তরে ইহা গোপন রাখিয়াছিলাম। কিন্তু ঐ যুবক তৎক্ষনাৎ বলতে লাগিল চাচা! আমার মা দোযখের আগুন হইতে রক্ষা পাইয়া গিয়াছে।

কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ এই ঘটনা হইতে আমার দুইটি ফায়দা হইল। এক. সত্তর হাজার বার কালেমা তাইয়্যেবা পড়ার বরকত সম্পর্কে যাহা আমি শুনিয়াছি উহার অভিজ্ঞতা। দুই. যুবকটির সত্যতার (তার কাশ্ফ হওয়ার) একীন হইয়া গেল।

দেখুনঃ ফাযায়েলে আমাল, ১ম খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর-২০০১ ইং। দারুল কিতাব, ৫০ বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০ থেকে প্রকাশিত) এমনি আরও অনেক শির্কী ও বিদআতী কথা ফাযায়েলে আমল বইটিতে রয়েছে, যা সচেতন পাঠক একটু খেয়াল করে বইটি পড়লে সহজেই ধরতে পারবেন।

প্রিয় পাঠক ভাই ও বন্ধুগণ! জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে যতটুকু বলা হয়েছে, তা ব্যতীত অন্য কোন খবর জানার কোন উপায় নেই। কারণ এগুলো গায়েবী বিষয়। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদেরকে যতটুকু বলেছেন, আমরা শুধু ততটুকুই জানি। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এর অতিরিক্ত কিছু দাবী করে, তাহলে সে মিথ্যাবাদী। তা বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট শির্ক। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধু একজন ভীতি প্রদর্শক ও সু-সংবাদ দাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আরাফঃ ১৮৮) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ

আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমনও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ অহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না? (সূরা আনআমঃ ৫০) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ

‘‘তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত কোন রাসূল ব্যতীত। (সূরা জিনঃ ২৬-২৭) আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ

ثَلَاثٌ مَنْ تَكَلَّمَ بِوَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ قُلْتُ مَا هُنَّ قَالَتْ مَنْ زَعَمَ أَنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَبَّهُ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَة قَالَ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَتَمَ شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ وَاللَّهُ يَقُولُ يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّهُ يُخْبِرُ بِمَا يَكُونُ فِي غَدٍ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللَّهِ الْفِرْيَةَ وَاللَّهُ يَقُولُ قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ

যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে চক্ষে দেখেছেন সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যাচার করল। যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ তিনি গোপন করেছেন, সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যা রচনা করল। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ হে রসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। (সূরা মায়িদাঃ ৬৭) আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম (গায়েবের) আগাম খবর দিতে পারতেন সেও আল্লাহর উপর চরম মিথ্যা রচনা করল।’’ (তিরমিযী, হাদীছটি সহীহ)

বুখারী শরীফে রবী বিনতে মুআওভিয (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন কতিপয় ছোট মেয়ে দফ তথা একদিকে খোলা ঢোল বাজাচ্ছিল এবং বদরের যুদ্ধে নিহত তাদের পিতাদের বীরত্বগাঁথা বর্ণনা করছিল। মেয়েদের মধ্য হতে একটি মেয়ে বলে ফেললঃ

وَفِينَا نَبِىٌّ يَعْلَمُ مَا فِى غَدٍ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم  لاَ تَقُولِى هَكَذَا  وَقُولِى مَا كُنْتِ تَقُولِينَ

 ‘‘আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন, যিনি আগামীকালের খবর বলতে পারেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ বালিকার কথার প্রতিবাদ করে বললেনঃ এই কথা অর্থাৎ আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন, যিনি আগামীকালের খবর বলতে পারেন- এটি বাদ দাও। আর বাকী কথাগুলো বলতে থাকো। (সহীহ বুখারী হাদীছ নং- ৪০০১)    

   এমনি আরো অনেক দলীল-প্রমাণ কুরআন ও সহীহ হাদীছে রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া গায়েবের খবর অন্য কেউ জানে না।

২) নবী ও মৃত অলী-আওলীয়াগণঃ সুফীদের আরও কথা হচ্ছে, তারা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে জাগ্রত অবস্থায় সরাসরি মিলিত হয়ে থাকেন। শুধু তাই নয় তারা অন্যান্য নবীদের রুহের সাথেও সাক্ষাত করেন ও তাদের আওয়াজ শুনেন এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা লাভ করেন। মৃত অলী-আওলীয়া, ফেরেশতাদের সাথেও তারা সাক্ষাত করেন এবং তাদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।

৩) খিজির আলাইহিস সালামঃ

সুফীদের মধ্যে খিযির (আঃ)এর ব্যাপারে অনেক কাল্পনিক ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। তাঁর সাথে সাক্ষাতের বিষয়েও অসংখ্যকাহিনী বর্ণিত রয়েছে। তাদের ধারণা খিজির (আঃ) এখনও জিবীত আছেন। তিনি যিকির ও দ্বিনী মাহফিলে হাজির হন। সুফীরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে দ্বিনী বিষয়ের জ্ঞান, শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও যিকির-আযকার শিক্ষা করেন। তাদের এ কথাটি বানোয়াট। কোন মৃত ব্যক্তির সাথে জীবিত মানুষের কথা বলার ধারণা একটি কুফরী বিশ্বাস।

   আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শেষ জীবণে একদা আমাদেরকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করলেন। সালাম ফিরানোর পর তিনি বললেনঃ

أَرَأَيْتَكُمْ لَيْلَتَكُمْ هَذِهِ فَإِنَّ رَأْسَ مِائَةِ سَنَةٍ مِنْهَا لاَ يَبْقَى مِمَّنْ هُوَ عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ أَحَدٌ

আজকের রাত্রির গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের কোন ধারণা আছে কি? আজকের এই রাত্রিতে যারা জীবিত আছে, আজ থেকে শুরু করে একশত বছর পর পৃথিবীতে তাদের কেউ আর জীবিত থাকবেনা। (বুখারী হাদীছ নং- ১১৬)

  এই হাদীছ থেকে জানা গেল যে, খিযির (আঃ)ও ইন্তেকাল করেছেন। তিনি কিয়ামতের পূর্বে কারও সাথে সাক্ষাত করবেন না।

৪) ইলহামঃ

আল্লাহর পক্ষ হতে মুমিন ব্যক্তির অন্তরে যে ইলম পতিত হয়, তাকে ইলহাম বলে। এভাবে প্রাপ্ত অন্তরের ইলহাম অনুযায়ী মুমিন ব্যক্তি কাজ করতে পারে বা সিদ্বান্ত নিতে পারে। তবে তা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সুফীরা তাদের কল্পিত অলীদের কল্পিত ইলহামকে শরীয়তের একটি বিরাট দলীল মনে করে এবং সুফীবাদের ভক্তরা তা পালন করা আবশ্যক মনে করে। তারা মনে করে অলীরা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হন। এ জন্য সুফীরা অলীদের স্তরকে নবুওয়তের স্তর থেকে উত্তম মনে করে থাকে। কেননা নবীরা দ্বীনের ইলম গ্রহণ করতেন ফেরেশতার মাধ্যমে আর অলীরা গ্রহণ করেন সরাসরি বিনা মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট থেকে।

৫) ফিরাসাতঃ

 ফিরাসাত অর্থ হচ্ছে অন্তদৃষ্টি। সুফী সাধকরা দাবী করে যে, অন্তর্দিষ্টির মাধ্যমে তারা মানুষের অন্তরের গোপন অবস্থা ও খবরাদি বলে দিতে পারেন। অথচ কুরআন ও হাদীছের ভাষ্য দ্বারা বুঝা যায় অন্তরের খবর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَعْلَمُ خَائِنَةَ الأعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ

‘‘ চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন’’। (সূরা গাফেরঃ ১৯)

৬) হাওয়াতেফঃ

 সুফীদের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে হাতাফ। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহ্ তাআলা, ফেরেশতা, জিন, অলী, এবং খিযির (আঃ)এর কথা সরাসরি অথবা স্বপ্নের মাধ্যমে শুনতে পায় বলে দাবী করে থাকে।

৭) সুফীদের মিরাজঃ

সুফীরা মনে করে অলীদের রূহ উর্ধ্ব জগতে আরোহন করে, সেখানে ঘুরে বেড়ায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন জ্ঞান ও রহস্য নিয়ে আসতে পারে।

৮) স্বপ্নের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ প্রাপ্তিঃ

স্বপ্ন হচ্ছে সুফীদের অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য মূলনীতি। তারা ধারণা করে স্বপ্নের মাধ্যমে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে কিংবা তাদের কোন মৃত বা জীবিত অলী ও শায়েখের কাছ থেকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম প্রাপ্ত হওয়ার ধারণা করে থাকে। স্বপ্নের ব্যাপারে সঠিক কথা হচ্ছে, নবীগণের স্বপ্নই কেবল অহী এবং তার মাধ্যমে প্রাপ্ত বিধান অনুসরণযোগ্য। কিন্তু সাধারণ মুমিনদের স্বপ্নের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তা দ্বারা শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।

৯) মৃত কল্পিত অলী-আওলীয়াদের সাথে সুফীদের যোগাযোগঃ

বর্তমান চরমোনাই পীরের পিতা মৃত মাওলানা ইসহাক তার ভেদে মারেফত বইয়ে লিখেছেনঃ হযরত থানবী লিখিয়াছেন, জনৈক দরবেশ সাহেবের মৃত্যুর পর এক কাফন চোর কবর খুড়িয়া দরবেশের কাফন খুলিতে লাগিল। দরবেশ সাহেব চোরের হাত ধরিয়া বসিলেন। তা দেখে চোর ভয়ের চোটে চিৎকার মারিয়া বেহুঁশ হইয়া মরিয়া গেল। দরবেশ তার এক খলীফাকে আদেশ করিলেন চোরকে তার পার্শ্বে দাফন করিতে। খলীফা এতে আপত্তি করিলে দরবেশ বলিলেনঃ কাফন চোরের হাত আমার হাতের সঙ্গে লাগিয়াছে, এখন কেয়ামত দিবসে ওকে ছাড়িয়া আমি কেমনে পুলছেরাত পার হইয়া যাইব? (ভেদে মারেফতঃ ২৭-২৮ পৃঃ)

১০) শয়তানঃ

সুফীদের কিছু বিরাট এক দলের লেখনী থেকে জানা যায় যে, তারা শয়তানের কাছ থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকেন। তাবলিগী নিসাব ফাযায়েলে আমাল বইয়ে হজরত জুনাইদ (রঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি একবার শয়তানকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মানুষের সামনে উলঙ্গ হইয়া থাকিতে তোর কি লজ্জা হয় না? শয়তান বলিল, ইহারা কি মানুষ? মানুষ তো উহারা, যাহারা শোনিযিয়ার মসজিদে বসা আছেন। যাহারা আমার শরীরকে দুর্বল করিয়াছি, আমার কলিজাকে পুড়িয়া কাবাব করিয়া দিয়াছে। হজরত জুনাইদ (রহঃ) বলেন, আমি শোনিজিয়ার মসজিদে গিয়া দেখিলাম কয়েকজন বুযুর্গ হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়া মোরাকাবায় মশগুল রহিয়াছেন। তাঁহারা আমাকে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, খবীস শয়তানের কথায় কখনও ধোকায় পড়িও না।

মাসূহী (রহঃ) হইতেও অনুরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে যে, তিনি শয়তানকে উলঙ্গ দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মানুষের মধ্যে এইভাবে উলঙ্গ হইয়া চলাফেরা করিতে তোর লজ্জা হয় না? সে বলিতে লাগিল, খোদার কসম, ইহারা তো মানুষ নয়। যদি মানুষ হইত তবে ইহাদের সহিত আমি এমনভাবে খেলা করিতাম না, যেমন বাচ্চারা ফুটবল নিয়া খেলা করে। মানুষ ঐ সমস্ত লোক, যাহারা আমাকে অসুস্থ করিয়া দিয়াছে। এই কথা বলিয়া সে সুফিয়ায়ে কেরামের জামাতের দিকে ইশারা করিল।

(দেখুনঃ ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ৩৭৬-৩৭৭ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ থেকে ২০০১ সালে প্রথম প্রকাশিত)

ইহা জানা কথা যে শয়তান হচ্ছে মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু। সে সর্বদা মানুষকে ঈমান থেকে বিচ্যুত করে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে আল্লাহর সাথে এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করেছে। তার কথা আল্লাহ্ তাআলা কুরআন মযীদে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ثُمَّ لَآَتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ

‘‘সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদ্ভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বামদিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’’। (সূরা আরাফঃ ১৬-১৭) এতে সহজেই বুঝা যায় একজন মানুষ কতটুকু মূর্খ এবং অজ্ঞ হলে ইবলীসকে সঠিক দিক নির্দেশক ও পরামর্শ দাতা হিসেবে বিশ্বাস করতে পারে। অথচ আমার তাবলীগ জামাতের ভাইগণ আল্লাহ্ দ্রোহী পাপিষ্ঠ ইবলীস শয়তানকেও তাদের গুরু মনে করে থাকেন। ফাযায়েলে আমাল বইয়ের এ জাতীয় বানোয়াট কাহিনীগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও কি তারা বইটির পক্ষে উকালতি করবেন? বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর এই বইটি বাদ দিয়ে কুরআন ও হাদীছের নির্ভেজাল ইসলামের দিকে ফিরে আসার সময় কি এখনও হয় নি?

উপসংহারঃ

পরিশেষে বলতে চাই যে, বর্তমানে মুসলিমরা যে সমস্যার সম্মুখীন তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সুফীবাদের বিভ্রান্তি। এই পঁচা মতবাদের কারণেই মুসলিম জাতি দুনিয়ার বুকে তাদের মর্যাদা হারিয়েছে। সুবিশাল উছমানী খেলাফতের সুলতানগণ ইসলামের সঠিক আকীদাহ থেকে সরে গিয়ে যখন সুফীবাদের বেড়াজালে আটকে পড়েন তখন থেকে তাদের শক্তিতে ভাটা পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে উছমানী সম্রাজ্যের ভিত্তি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পতনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে।

তাই আজ মুসলিমদের হারানো শক্তি ও মর্যাদা ফেরত পেতে চাইলে খোলাফায়ে রাশেদার যুগের ন্যায় নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে ফেরত আসতে হবে। অন্যথায় তারা দ্বীন ও দুনিয়ার উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন করার চেষ্টা করে কখনই সাফল্য লাভ করতে পারবে না।

আল্লাহ্ তাআলার কাছে দুআ করি তিনি যেন পথহারা এই জাতিকে সুফীবাদসহ সকল বিভ্রান্তি থেকে উদ্ধার করেন এবং নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে ফেরত আসার তাওফীক দেন। আমীন

মূল:

কুরআন ও হাদীছের মানদন্ডে সুফীবাদ
আব্দুল্লাহ্ শাহেদ আল-মাদানী

Post a Comment

Previous Post Next Post