- আমি একজন নাস্তিক। আমার নাস্তিকতার কারণ অনেকগুলো প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। মোল্লা-মুন্সি থেকে সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছি। কেউই উত্তর দিতে পারেনি। আপনারা দাবি করেন আল্লাহ ন্যায় বিচারক। কিন্তু আমি আবিষ্কার করেছি তিনি (যদি আসলেই থেকে থাকেন) সবচেয়ে বড় অবিচারক। ‘আল্লাহ ন্যায় বিচারক’ এর প্রমাণ কী?
- আপনাকে তো আমার মানুষ মনে হচ্ছে না, কুত্তার বাচ্চা মনে হচ্ছে।
- ওকে থ্যাংক্স, আমার উত্তর পেয়ে গেছি...
- কী উত্তর পেলেন?
- আমাকে গালি দেওয়ার কারনটা জানতে পারি? আমি নাস্তিক এ জন্যই? আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন ভালো কথা, গালি দেবেন কেন?
১.
খেয়াল করুন, আমি কিন্তু আপনাকে সরাসরি কুত্তার বাচ্চা বলিনি, প্রথমে বলেছি “মানুষ মনে হচ্ছে না”। কথাটা আপনার প্রশ্নটার উত্তরে বলা। বাস্তবতা আর মানুষের ধারণার মধ্যে অনেক তফাত আছে এটা বোঝানোর জন্য বলা। মানুষ অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার মানুষ। সে খুব অল্প জিনিস থেকেই অন্যের ব্যাপারে একটা ধারণাতে চলে আসে। চলে যে আসে তার উদাহরণ দিয়েছিলাম আপনাকে, আপনি তলিয়ে চিন্তা করলে ধরতে পারতেন।
শোনেন ভাই, আমি আপনাকে মানুষ মনে করি আর না করি তাতে আপনার সত্ত্বায় বদল আসবে না। আমি বললেই আপনি কুত্তার বাচ্চা কিংবা বান্দরের বাচ্চা হয়ে যাবেন না। আপনি হোমো স্যাপিয়েনস থাকবেন। তাই কোনো বাস্তবতার ব্যাপারে আমাদের সমস্যা থাকলে বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। ধারণাকে বদলানো উচিত, বাস্তবতাকে নয়।
২.
সাদা চোখে গালি মনে হলেও, আমি আপনাকে 'কুত্তার বাচ্চা' শব্দের মাধ্যমে একটা বিশেষণ দিয়েছি। সত্যিকারে গালি দিতে চাইলে সম্মানসূচক 'আপনি' ব্যবহার করতাম না। এই যে চরম নেতিবাচক একটা বিশেষণ দিলাম এটাতে আপনার মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমি কে? কেউ না। আপনি আমাকে কোনোদিন দেখেননি। আপনার আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তাও আপনার মনে একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
ধরেন, এই বিশেষণটা যদি আপনাকে আপনার খুব আপন কেউ দিত। ধরুন, আপনার সন্তানকে এক বছর বয়সে রেখে আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করল। আপনি বাচ্চার হাগু সাফ করলেন, রাত জেগে দুধ খাওয়ালেন। একজন মা যা করে তা করলেন, একজন বাবা যা করে তা-ও করলেন। এই ছেলেটা ২০ বছর পরে যদি আপনাকে বলে 'কুত্তার বাচ্চা' কেমন লাগবে? তাকে আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন যে আপনার স্ত্রীর একটা মানসিক সমস্যা ছিল যা আপনার কাছে লুকানো হয়েছিল? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন আপনি আপনার স্ত্রীর চিকিৎসার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন আপনি আপনার একমাত্র স্ত্রীকে ভয়াবহ মানসিকরোগটা সহই ভালোবেসে ফেলেছিলেন? এতটাই যে আপনি আর কখনও বিয়ে করেননি? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন যে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণেই আপনার ছেলের মামারা আপনার নামে মিথ্যা কথা বলে আজ আপনাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে?
আপনার ছেলের যদি বিবেক থাকে হয়ত বুঝবে। নয়ত মনে করবে আপনি চামড়া বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, ‘ভালো’ ‘ভালো’ কথা বলছেন। ত্যানা প্যাচাচ্ছেন। আপনার সপক্ষে মোল্লা-মুন্সি, ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার যে যাই বলুক—আপনার ছেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আপনি কুত্তার বাচ্চা।
সমস্যাটা ধারণার, বাস্তবতার নয়।
৩.
আল্লাহ নিজের নাম বলেছেন, ‘আল আদল’—তিনি ‘দ্য ন্যায়বিচারকারী’। পৃথিবীতে বহু ন্যায়-পরায়ণ মানুষ আছে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। কেউ নিজের সন্তানের জন্য ন্যায়বিচার শিকেয় তুলে রাখেন। কেউ সন্তান পর্যন্ত ঠিক থেকে নিজের বেলায় এসে দুর্নীতি করেন। কেউ কেউ সেটা পার হয়ে আসেন—যেমন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কিন্তু তাও তার মানবিক দুর্বলতা থেকে যায়—তিনি আল-আলিম নন যে! অর্থাৎ ঘটনার আড়ালের সবকিছু তিনি জানেন না। ফলে দোষী চাপার জোরে তার কাছ থেকে রায় পেয়ে যায়, নির্দোষ হয় বঞ্চিত। অবশ্য রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে মানুষকে সাবধানও করেছেন তার সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে।[1] মানুষ বিচারকের সাথে আল্লাহর তুলনা চলে না। মানুষ আইন প্রণয়নকারীর সাথেও আল্লাহর তুলনা চলে না। তুলনা যে চলে না এটা বোঝাই প্রথম কর্তব্য।
কিন্তু আল্লাহর এমন কোনো, কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। হুজুররা যে খালি বলে, ‘সুবহানাল্লাহ’—তার মানে এটাই; আল্লাহ এমন সব সম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত, পবিত্র। আল্লাহ সব কিছু জানেন, দেখেন এবং শোনেন। শুধু তাই নয় তিনি মনের খবরও জানেন। তিনি জানেন কোনটা খুন, কোনটা মৃত্যু। সেটা ইচ্ছাকৃত না দুর্ঘটনা—আল্লাহ জানেন এবং তার ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। আল্লাহর কাছে কোনো সাজানো মামলা নেই। কোনো মাল্টি-বিলিয়নিয়ার উকিল নেই। প্রত্যেকটা মানুষ যবে যা করেছে সব কিছু রেকর্ড আছে। মনের খবরের হদিসসহ।
আল্লাহর ন্যায়বিচারে কোন ফাঁক নেই। ‘ফাঁক নেই’ কথাটা সংজ্ঞাতে আল্লাহ কী শব্দ ব্যবহার করেছেন জানেন? ফাতিলা। খেজুর খেয়েছেন নিশ্চয়ই। খেজুরের বীচির ওপরে পাতলা একটা আবরণ থাকে, ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন। এই আবরণ যে আঁশ দিয়ে তৈরী সেই আঁশের একটা সুতো পরিমাণ অবিচার করা হবে না—সূরা নিসার ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন। একটা ছাগল যদি আরেকটা ছাগলকে গুঁতা মেরে থাকে দুনিয়াতে, আখিরাতে তারও বিচার হবে। জ্বি, আল্লাহর ন্যায়বিচার এতটাই সূক্ষ। আপনার-আমার কাছে যে ব্যাপারটা প্রায় অর্থহীন সেটার ক্ষেত্রেও আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতায় বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।
এখন আল্লাহ যে ন্যায় বিচার ছাড়া অন্য কিছুই করেন না—এটা আপনি মানতে পারছেন না, ভালো কথা। আপনি আল্লাহকে কী ভাবেন তাতে আল্লাহর যেমন কিছু এসে যায় না তেমন আল্লাহর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনও হয়ে যায় না। মধ্যখান থেকে আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কষ্ট পাচ্ছেন। মাত্র কয়েকটা খুন করে এরশাদ শিকদার ফাঁসির রশি পড়ল আর লাখো খুনের নির্দেশদাতা ইয়াহিয়া খানের কিছু হলো না, ভুট্টোর সাথে আমাদের নেতা কোলাকুলি করে আসলেন। পৃথিবীতে এত বড় বড় অন্যায় হবে আর তার কোনো প্রতিকার কোনোদিন হবে না—এই চিন্তাটাই একটা চিন্তাশীল অবিশ্বাসীকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহকে যে বিশ্বাস করে, তাকে আল-খালিক হিসেবে মেনে নেয়, আর-রব হিসেবে বিশ্বাস করে, আর-রহমান হিসেবে আবিষ্কার করে তার জন্য আল্লাহকে আল-আদল হিসেবে মেনে নেওয়া কোনো ব্যাপারই না। সে আল্লাহর প্রত্যেকটি কাজে ন্যায় বিচার খুঁজে পায়। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটি নব্বই লক্ষ মানুষকে অন্ধ বানালেও বাকিদের তো আল্লাহ দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন।[2] বিনামূল্যে দিয়েছেন। অথচ নির্জীব পাথরের চোখ কিনতে টাকা দিতে হয়, অন্ধের ছড়ি কিনতে টাকা গুণতে হয়। অথচ সারা পৃথিবীর সব মানুষকে যদি আল্লাহ অন্ধ বানাতেন মানুষের কিছু বলার ছিল না, করার ছিল না। ০.৫৫ শতাংশ মানুষ কেন অন্ধ হলো—বাকিরা কেন চোখ পেল—এটা নিয়ে যারা চিন্তা করে না তারাই আসলে আসল অন্ধ। এই অন্ধরাই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সামনে বিলবোর্ডে লেখে ‘দৃষ্টি আমার অধিকার’। আমরা মানুষেরা আল্লাহকে কী দিয়েছি যার বদলে ‘অধিকার’-এর মতো শব্দ ব্যবহারের স্পর্ধা আমরা দেখাই?
আর যাদের মনের চোখ খুলেছে, বিবেকের দ্বার খুলেছে তারা বোঝে অন্ধত্ব আমাদের জন্য একটা নিদর্শন। যেন আমরা কৃতজ্ঞ হই। পৃথিবীতে আসার কারণ নিয়ে ভাবি। আর আল্লাহ যাদের চোখ দেননি তাদের জন্য কিছু করি। পৃথিবীকে আল্লাহ যে পরীক্ষার স্থান বলেছেন সেখানে প্রশ্নপত্র তো এটাই—চোখ থাকতেও আমরা কী করছি? কী দেখছি? এর ব্যবহার কী আল্লাহর সন্তুষ্টিতে না ক্রোধে?
যে আল্লাহর তাওহিদ বুঝেছে সে তার অন্তর্দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার নয় বরং আল্লাহর দয়া দেখতে পায় সবসময়। তার কর্তব্য দেখতে পায়। সে জানে আল্লাহ আখিরাতে ন্যায়বিচার করবেন। এই ন্যায়বিচারকে সে ভয় পায়। মানুষ হিসেবে আমরা কত অকৃতজ্ঞ সেটা সে বোঝে। সে জানে আল্লাহর সাথে করা মানুষের অকৃতজ্ঞতার বিচার করলে আর কোন মুক্তি নেই। সে তাই পাপকে এড়িয়ে চলে, সাধ্যমতো ভালো কাজ করে আর পুরষ্কারের ব্যাপারে আল্লাহর দয়ার ভরসা করে।
একজন বিশ্বাসী কোনো ঘটনার পেছনে আল্লাহর প্রজ্ঞা নিয়ে চিন্তা করে। যেটার প্রজ্ঞা সে বোঝে না সেখানে সে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাতে আত্মসমর্পণ করে। সবকিছুই সবাইকে বুঝতে হবে এটা মানবজীবনের সবচে বড় ফ্যালাসি। কিন্তু এই ফ্যালাসি মানুষ ডাক্তারিবিদ্যায় খাটায় না, এনজিনিয়ারিং-এও খাটায় না। খাটায় খালি আল্লাহর কাজ কর্ম বুঝতে গিয়ে। ধরি একজন গড় মানুষের শরীরে কোষ থাকে ৩৭২০০ কোটি।[3] এর মধ্যে একটা কোষে কতগুলো এনজাইম আছে সেটা মানুষ জানে না। তারা কী কাজ করে তাও জানে না। একটা এনজাইম কী কাজ করে তা খুঁজতে গিয়ে একজন পিএইচডি ছাত্রের জীবনের সাতটা সোনালী বছর হারিয়ে যায় রিসার্চ ল্যাবে। ‘কেন করে’ সে প্রশ্ন করলে মাথা চুলকে ছাত্রটি শেষ ভাইভাতে একটা ফর্দ দিয়ে বলে—এসব কাজ করতে পারে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না।
আর আমরা এই এনজাইমের স্রষ্টা, কোষের স্রষ্টা, মানবদেহের স্রষ্টা, ৭০০ কোটি বর্তমান জীবিত মানবাত্মার স্রষ্টার কাজকর্ম এর যৌক্তিকতা বুঝতে চাই। না বুঝতে পারলে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলি, আল্লাহর ন্যায়বিচার নেই। আমাদের চেয়ে বড় অবিবেচক বিচারক আর কে আছে? মানে আমরা বাংলাদেশিরা। আমাদের দেশে খুনেদের রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক বিবেচনায় মাফ করে দেয়। এ দেশে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান হয়, তারপরে রাজপথে মিছিল করে ফাঁসি চেয়ে নেই। আমাদের বিচারে মৃত্যুদণ্ড বিচারের বিষয় নয়, আবদার করে চেয়ে নেওয়ার বিষয়। ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমাদের বেশ সাজে!
একটা গল্প বলি...
এক দার্শনিক সমুদ্রের ধারে বসে চিন্তা করছিল পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট—সৃষ্টিকর্তা করেন কী? এক ছেলে তার এই গভীর ভাবনায় টাশকি খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বালতি নিয়ে সাগর থেকে পানি ভরে আর ঢালে। ভরে আর ঢালে। অনেকক্ষণ দেখার পর দার্শনিক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো: "এই কী করছ?" ছেলেটি বলল: "বালতিতে সমুদ্রটাকে ভরছি।" দার্শনিক বললেন: "এটা কী সম্ভব নাকি?" ছেলেটি বলল, আমার বালতি আর সমুদ্রের তাও তো একটা তুলনা চলে, অঙ্ক কষে একটা সংখ্যা বের করা যাবে কিন্তু মানুষের মাথা আর আল্লাহর জ্ঞানের যে কোনো তুলনাই চলে না।
৪.
আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসি। আল্লাহ ন্যায়বিচারের চাক্ষুস প্রমাণ আপনি পরকালে পাবেন; ইহকালে না। দুঃখিত। অর্থাৎ, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমিও দিতে পারলাম না। তবে আল্লাহ আপনাকে যে দয়াগুলো করেছেন—এমনকি আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখানোর সুযোগ দিয়েছেন—এই দয়াগুলো যদি আপনি না বোঝেন তবে আল্লাহর ন্যায়বিচার আপনার জন্য সুখকর পরিণতি বয়ে আনবে না। আপনি মানুষের বাচ্চা—আপনার বিবেকের কাছে দাবী—সেই বিবেক যা আপনাকে কুত্তার বাচ্চা থেকে আলাদা করেছে, সেই বিবেকের কাছে দাবী। আপনার ধারণার তালগাছটিকে ছেড়ে দিন। আগে নিজে ন্যায়বিচার করুন। অকৃতজ্ঞতা বড় অবিচার। স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতা সবচেয়ে বড় অবিচার। ধন্যবাদ।
[1] সহীহ বুখারি (ইফা), অধ্যায়ঃ ৩৮/ যুলম ও কিসাস | হাদিস নাম্বার: ২২৯৬
[2] বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান - http://www.who.int/mediacentre/factsheets/fs282/en/
[3] An estimation of the number of cells in the human body, Bianconi et. El. বিস্তারিত: http://informahealthcare.com/doi/abs/10.3109/03014460.2013.807878
লিখেছেন: শরীফ আবু হায়াত অপু
- আপনাকে তো আমার মানুষ মনে হচ্ছে না, কুত্তার বাচ্চা মনে হচ্ছে।
- ওকে থ্যাংক্স, আমার উত্তর পেয়ে গেছি...
- কী উত্তর পেলেন?
- আমাকে গালি দেওয়ার কারনটা জানতে পারি? আমি নাস্তিক এ জন্যই? আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন ভালো কথা, গালি দেবেন কেন?
১.
খেয়াল করুন, আমি কিন্তু আপনাকে সরাসরি কুত্তার বাচ্চা বলিনি, প্রথমে বলেছি “মানুষ মনে হচ্ছে না”। কথাটা আপনার প্রশ্নটার উত্তরে বলা। বাস্তবতা আর মানুষের ধারণার মধ্যে অনেক তফাত আছে এটা বোঝানোর জন্য বলা। মানুষ অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার মানুষ। সে খুব অল্প জিনিস থেকেই অন্যের ব্যাপারে একটা ধারণাতে চলে আসে। চলে যে আসে তার উদাহরণ দিয়েছিলাম আপনাকে, আপনি তলিয়ে চিন্তা করলে ধরতে পারতেন।
শোনেন ভাই, আমি আপনাকে মানুষ মনে করি আর না করি তাতে আপনার সত্ত্বায় বদল আসবে না। আমি বললেই আপনি কুত্তার বাচ্চা কিংবা বান্দরের বাচ্চা হয়ে যাবেন না। আপনি হোমো স্যাপিয়েনস থাকবেন। তাই কোনো বাস্তবতার ব্যাপারে আমাদের সমস্যা থাকলে বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। ধারণাকে বদলানো উচিত, বাস্তবতাকে নয়।
২.
সাদা চোখে গালি মনে হলেও, আমি আপনাকে 'কুত্তার বাচ্চা' শব্দের মাধ্যমে একটা বিশেষণ দিয়েছি। সত্যিকারে গালি দিতে চাইলে সম্মানসূচক 'আপনি' ব্যবহার করতাম না। এই যে চরম নেতিবাচক একটা বিশেষণ দিলাম এটাতে আপনার মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমি কে? কেউ না। আপনি আমাকে কোনোদিন দেখেননি। আপনার আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তাও আপনার মনে একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
ধরেন, এই বিশেষণটা যদি আপনাকে আপনার খুব আপন কেউ দিত। ধরুন, আপনার সন্তানকে এক বছর বয়সে রেখে আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করল। আপনি বাচ্চার হাগু সাফ করলেন, রাত জেগে দুধ খাওয়ালেন। একজন মা যা করে তা করলেন, একজন বাবা যা করে তা-ও করলেন। এই ছেলেটা ২০ বছর পরে যদি আপনাকে বলে 'কুত্তার বাচ্চা' কেমন লাগবে? তাকে আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন যে আপনার স্ত্রীর একটা মানসিক সমস্যা ছিল যা আপনার কাছে লুকানো হয়েছিল? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন আপনি আপনার স্ত্রীর চিকিৎসার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন আপনি আপনার একমাত্র স্ত্রীকে ভয়াবহ মানসিকরোগটা সহই ভালোবেসে ফেলেছিলেন? এতটাই যে আপনি আর কখনও বিয়ে করেননি? আপনি কী দিয়ে বোঝাবেন যে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণেই আপনার ছেলের মামারা আপনার নামে মিথ্যা কথা বলে আজ আপনাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে?
আপনার ছেলের যদি বিবেক থাকে হয়ত বুঝবে। নয়ত মনে করবে আপনি চামড়া বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, ‘ভালো’ ‘ভালো’ কথা বলছেন। ত্যানা প্যাচাচ্ছেন। আপনার সপক্ষে মোল্লা-মুন্সি, ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার যে যাই বলুক—আপনার ছেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আপনি কুত্তার বাচ্চা।
সমস্যাটা ধারণার, বাস্তবতার নয়।
৩.
আল্লাহ নিজের নাম বলেছেন, ‘আল আদল’—তিনি ‘দ্য ন্যায়বিচারকারী’। পৃথিবীতে বহু ন্যায়-পরায়ণ মানুষ আছে। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। কেউ নিজের সন্তানের জন্য ন্যায়বিচার শিকেয় তুলে রাখেন। কেউ সন্তান পর্যন্ত ঠিক থেকে নিজের বেলায় এসে দুর্নীতি করেন। কেউ কেউ সেটা পার হয়ে আসেন—যেমন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কিন্তু তাও তার মানবিক দুর্বলতা থেকে যায়—তিনি আল-আলিম নন যে! অর্থাৎ ঘটনার আড়ালের সবকিছু তিনি জানেন না। ফলে দোষী চাপার জোরে তার কাছ থেকে রায় পেয়ে যায়, নির্দোষ হয় বঞ্চিত। অবশ্য রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে মানুষকে সাবধানও করেছেন তার সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে।[1] মানুষ বিচারকের সাথে আল্লাহর তুলনা চলে না। মানুষ আইন প্রণয়নকারীর সাথেও আল্লাহর তুলনা চলে না। তুলনা যে চলে না এটা বোঝাই প্রথম কর্তব্য।
কিন্তু আল্লাহর এমন কোনো, কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। হুজুররা যে খালি বলে, ‘সুবহানাল্লাহ’—তার মানে এটাই; আল্লাহ এমন সব সম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত, পবিত্র। আল্লাহ সব কিছু জানেন, দেখেন এবং শোনেন। শুধু তাই নয় তিনি মনের খবরও জানেন। তিনি জানেন কোনটা খুন, কোনটা মৃত্যু। সেটা ইচ্ছাকৃত না দুর্ঘটনা—আল্লাহ জানেন এবং তার ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। আল্লাহর কাছে কোনো সাজানো মামলা নেই। কোনো মাল্টি-বিলিয়নিয়ার উকিল নেই। প্রত্যেকটা মানুষ যবে যা করেছে সব কিছু রেকর্ড আছে। মনের খবরের হদিসসহ।
আল্লাহর ন্যায়বিচারে কোন ফাঁক নেই। ‘ফাঁক নেই’ কথাটা সংজ্ঞাতে আল্লাহ কী শব্দ ব্যবহার করেছেন জানেন? ফাতিলা। খেজুর খেয়েছেন নিশ্চয়ই। খেজুরের বীচির ওপরে পাতলা একটা আবরণ থাকে, ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন। এই আবরণ যে আঁশ দিয়ে তৈরী সেই আঁশের একটা সুতো পরিমাণ অবিচার করা হবে না—সূরা নিসার ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন। একটা ছাগল যদি আরেকটা ছাগলকে গুঁতা মেরে থাকে দুনিয়াতে, আখিরাতে তারও বিচার হবে। জ্বি, আল্লাহর ন্যায়বিচার এতটাই সূক্ষ। আপনার-আমার কাছে যে ব্যাপারটা প্রায় অর্থহীন সেটার ক্ষেত্রেও আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতায় বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।
এখন আল্লাহ যে ন্যায় বিচার ছাড়া অন্য কিছুই করেন না—এটা আপনি মানতে পারছেন না, ভালো কথা। আপনি আল্লাহকে কী ভাবেন তাতে আল্লাহর যেমন কিছু এসে যায় না তেমন আল্লাহর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনও হয়ে যায় না। মধ্যখান থেকে আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কষ্ট পাচ্ছেন। মাত্র কয়েকটা খুন করে এরশাদ শিকদার ফাঁসির রশি পড়ল আর লাখো খুনের নির্দেশদাতা ইয়াহিয়া খানের কিছু হলো না, ভুট্টোর সাথে আমাদের নেতা কোলাকুলি করে আসলেন। পৃথিবীতে এত বড় বড় অন্যায় হবে আর তার কোনো প্রতিকার কোনোদিন হবে না—এই চিন্তাটাই একটা চিন্তাশীল অবিশ্বাসীকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহকে যে বিশ্বাস করে, তাকে আল-খালিক হিসেবে মেনে নেয়, আর-রব হিসেবে বিশ্বাস করে, আর-রহমান হিসেবে আবিষ্কার করে তার জন্য আল্লাহকে আল-আদল হিসেবে মেনে নেওয়া কোনো ব্যাপারই না। সে আল্লাহর প্রত্যেকটি কাজে ন্যায় বিচার খুঁজে পায়। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটি নব্বই লক্ষ মানুষকে অন্ধ বানালেও বাকিদের তো আল্লাহ দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন।[2] বিনামূল্যে দিয়েছেন। অথচ নির্জীব পাথরের চোখ কিনতে টাকা দিতে হয়, অন্ধের ছড়ি কিনতে টাকা গুণতে হয়। অথচ সারা পৃথিবীর সব মানুষকে যদি আল্লাহ অন্ধ বানাতেন মানুষের কিছু বলার ছিল না, করার ছিল না। ০.৫৫ শতাংশ মানুষ কেন অন্ধ হলো—বাকিরা কেন চোখ পেল—এটা নিয়ে যারা চিন্তা করে না তারাই আসলে আসল অন্ধ। এই অন্ধরাই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সামনে বিলবোর্ডে লেখে ‘দৃষ্টি আমার অধিকার’। আমরা মানুষেরা আল্লাহকে কী দিয়েছি যার বদলে ‘অধিকার’-এর মতো শব্দ ব্যবহারের স্পর্ধা আমরা দেখাই?
আর যাদের মনের চোখ খুলেছে, বিবেকের দ্বার খুলেছে তারা বোঝে অন্ধত্ব আমাদের জন্য একটা নিদর্শন। যেন আমরা কৃতজ্ঞ হই। পৃথিবীতে আসার কারণ নিয়ে ভাবি। আর আল্লাহ যাদের চোখ দেননি তাদের জন্য কিছু করি। পৃথিবীকে আল্লাহ যে পরীক্ষার স্থান বলেছেন সেখানে প্রশ্নপত্র তো এটাই—চোখ থাকতেও আমরা কী করছি? কী দেখছি? এর ব্যবহার কী আল্লাহর সন্তুষ্টিতে না ক্রোধে?
যে আল্লাহর তাওহিদ বুঝেছে সে তার অন্তর্দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার নয় বরং আল্লাহর দয়া দেখতে পায় সবসময়। তার কর্তব্য দেখতে পায়। সে জানে আল্লাহ আখিরাতে ন্যায়বিচার করবেন। এই ন্যায়বিচারকে সে ভয় পায়। মানুষ হিসেবে আমরা কত অকৃতজ্ঞ সেটা সে বোঝে। সে জানে আল্লাহর সাথে করা মানুষের অকৃতজ্ঞতার বিচার করলে আর কোন মুক্তি নেই। সে তাই পাপকে এড়িয়ে চলে, সাধ্যমতো ভালো কাজ করে আর পুরষ্কারের ব্যাপারে আল্লাহর দয়ার ভরসা করে।
একজন বিশ্বাসী কোনো ঘটনার পেছনে আল্লাহর প্রজ্ঞা নিয়ে চিন্তা করে। যেটার প্রজ্ঞা সে বোঝে না সেখানে সে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাতে আত্মসমর্পণ করে। সবকিছুই সবাইকে বুঝতে হবে এটা মানবজীবনের সবচে বড় ফ্যালাসি। কিন্তু এই ফ্যালাসি মানুষ ডাক্তারিবিদ্যায় খাটায় না, এনজিনিয়ারিং-এও খাটায় না। খাটায় খালি আল্লাহর কাজ কর্ম বুঝতে গিয়ে। ধরি একজন গড় মানুষের শরীরে কোষ থাকে ৩৭২০০ কোটি।[3] এর মধ্যে একটা কোষে কতগুলো এনজাইম আছে সেটা মানুষ জানে না। তারা কী কাজ করে তাও জানে না। একটা এনজাইম কী কাজ করে তা খুঁজতে গিয়ে একজন পিএইচডি ছাত্রের জীবনের সাতটা সোনালী বছর হারিয়ে যায় রিসার্চ ল্যাবে। ‘কেন করে’ সে প্রশ্ন করলে মাথা চুলকে ছাত্রটি শেষ ভাইভাতে একটা ফর্দ দিয়ে বলে—এসব কাজ করতে পারে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না।
আর আমরা এই এনজাইমের স্রষ্টা, কোষের স্রষ্টা, মানবদেহের স্রষ্টা, ৭০০ কোটি বর্তমান জীবিত মানবাত্মার স্রষ্টার কাজকর্ম এর যৌক্তিকতা বুঝতে চাই। না বুঝতে পারলে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলি, আল্লাহর ন্যায়বিচার নেই। আমাদের চেয়ে বড় অবিবেচক বিচারক আর কে আছে? মানে আমরা বাংলাদেশিরা। আমাদের দেশে খুনেদের রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক বিবেচনায় মাফ করে দেয়। এ দেশে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান হয়, তারপরে রাজপথে মিছিল করে ফাঁসি চেয়ে নেই। আমাদের বিচারে মৃত্যুদণ্ড বিচারের বিষয় নয়, আবদার করে চেয়ে নেওয়ার বিষয়। ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমাদের বেশ সাজে!
একটা গল্প বলি...
এক দার্শনিক সমুদ্রের ধারে বসে চিন্তা করছিল পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট—সৃষ্টিকর্তা করেন কী? এক ছেলে তার এই গভীর ভাবনায় টাশকি খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বালতি নিয়ে সাগর থেকে পানি ভরে আর ঢালে। ভরে আর ঢালে। অনেকক্ষণ দেখার পর দার্শনিক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো: "এই কী করছ?" ছেলেটি বলল: "বালতিতে সমুদ্রটাকে ভরছি।" দার্শনিক বললেন: "এটা কী সম্ভব নাকি?" ছেলেটি বলল, আমার বালতি আর সমুদ্রের তাও তো একটা তুলনা চলে, অঙ্ক কষে একটা সংখ্যা বের করা যাবে কিন্তু মানুষের মাথা আর আল্লাহর জ্ঞানের যে কোনো তুলনাই চলে না।
৪.
আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসি। আল্লাহ ন্যায়বিচারের চাক্ষুস প্রমাণ আপনি পরকালে পাবেন; ইহকালে না। দুঃখিত। অর্থাৎ, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমিও দিতে পারলাম না। তবে আল্লাহ আপনাকে যে দয়াগুলো করেছেন—এমনকি আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখানোর সুযোগ দিয়েছেন—এই দয়াগুলো যদি আপনি না বোঝেন তবে আল্লাহর ন্যায়বিচার আপনার জন্য সুখকর পরিণতি বয়ে আনবে না। আপনি মানুষের বাচ্চা—আপনার বিবেকের কাছে দাবী—সেই বিবেক যা আপনাকে কুত্তার বাচ্চা থেকে আলাদা করেছে, সেই বিবেকের কাছে দাবী। আপনার ধারণার তালগাছটিকে ছেড়ে দিন। আগে নিজে ন্যায়বিচার করুন। অকৃতজ্ঞতা বড় অবিচার। স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতা সবচেয়ে বড় অবিচার। ধন্যবাদ।
[1] সহীহ বুখারি (ইফা), অধ্যায়ঃ ৩৮/ যুলম ও কিসাস | হাদিস নাম্বার: ২২৯৬
[2] বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান - http://www.who.int/mediacentre/factsheets/fs282/en/
[3] An estimation of the number of cells in the human body, Bianconi et. El. বিস্তারিত: http://informahealthcare.com/doi/abs/10.3109/03014460.2013.807878
লিখেছেন: শরীফ আবু হায়াত অপু
Post a Comment