মৃত্যুর বিভীষিকা : কবরের আযাব


হযরত সামুরা বিন জুনদুব(রা) বলেন, রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায়ই তার সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করতেন যে, তোমাদের মাঝে কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ ?একদিন সকালে তিনি নিজেই বলতে লাগলেন যে, আজ রাতে আমার নিকট দুজন লোক এল এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে নিয়ে গেল।যাওয়ার পথে আমরা শায়িত একটি লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। এই শায়িত লোকটির মাথা অপর একটি লোক পাথর দিয়ে কেচতেছিল। পাথর মারার পর মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাথরটি দূরে ছিটকে পড়ছে। পুনরায় মারার জন্যে লোকটি পাথর সংগ্রহ করতে গেলে এই ফাকে মাথা পুনর্জন্ম নিয়ে নেয় এবং ঐ লোকটি ফিরে এসে আবার পাথর মারে। এভাবে অনবরত চলছে।

আমি আমার সাথীকে বললাম, সুবহানাল্লাহ ! এই দুজন ব্যক্তি কে ? আমার সাথী বলল, আরো সামনে অগ্রসর হও।

আমরা সামনে অগ্রসর হলাম। দেখলাম একটি লোক চিত হয়ে শুয়ে আছে আর অপর একটি লোক লোহার একটি করাত দিয়ে তার মুখের এক পাশের চোয়াল চিরছে। এক পাশ চিরে যখন অন্য পাশে চিরতে যাচ্ছে তখন পূর্বের চিরা অংশ জোড়া লেগে যাচ্ছে। এভাবে অনবরত উলট-পালট করে তাকে চিরছে।

আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ ! এই ব্যক্তি কে ? আমাকে বলা হলো আরো সামনে চলো।

আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে একটি চুল্লি দেখতে পেলাম। চুল্লির মাঝে খুব হৈ চৈ এর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। চুল্লিতে ঊঁকি মেরে দেখতে পেলাম তাতে উলংগ কিছু নারীপুরুষ রয়েছে। আগুনের লাভা যখন তাদের তলদেশ থেকে উদগীরণ করে তখন তারা চিৎকার করে উঠে, আর দেখলাম সেখানে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে অসহনীয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা ? আমাকে বলা হল আরও সম্মুখে অগ্রসর হও।

সামনে অগ্রসর হয়ে একটি নহর পেলাম। যার পানি রক্তের ন্যায় লালবর্ণের। এ পানিতে একটি লোক সাঁতার কাটছিল। অপর একটি লোক অনেকগুলো পাথর নিয়ে নদীর কিনারে দাঁড়ানো। সাঁতারু লোকটি সাঁতরিয়ে যখন নদীর কিনারে আসে তখন তার মুখ খুলে দেয় এবং কিনারায় লোকটি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এমনটা হচ্ছিল বারবার। আমি জানতে চাইলাম, এই লোকটি কে ? আমাকে বলা হল , আরোও সামনে অগ্রসর হও।

সামনে গিয়ে অত্যন্ত কদাকার একটি লোকের সাক্ষাৎ পেলাম। তার নিকট আগুন ছিল এবং সে আগুন প্রজ্জ্বলিত করছিল এবং চতুর্পাশে চক্কর কাটছিল। আমি জানতে চাইলাম এই লোকটি কে ? জবাব এলো আরো সামনে অগ্রসর হও।

আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে একটি শ্যামল উদ্যানে উপস্থিত হলাম।উদ্যানের মধ্যবর্তী স্থানে এত দীর্ঘকায় একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলাম যে উচ্চতার কারণে তার শির আমাদের নজরে আসছিল না।আর এই দীর্ঘ লোকটির পাশে অনেকগুলো শিশুর সমাগম। আমি ইতোপূর্বে এই শিশুদেরকে কখনো দেখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই সকল লোক কারা ? উত্তর এল আরো সামনে অগ্রসর হও।

অতঃপর আমরা দৃষ্টিনন্দন মনোরম একটি উদ্যানে প্রবেশ করলাম। এত নন্দিত উদ্যান আমি এর আগে কখনো দেখিনি।আমি আমার সঙ্গীটির নির্দেশে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে দেখি স্বর্ণ রূপার নির্মিত একটি শহর।আমরা শহরের প্রধান ফটকের নিকট এলাম। আমাদের জন্য ফটক খোলা হল। অতঃপর ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করার পর আমাদের সামনে কিছু লোক এল যাদের দেহের অর্ধাংশ অত্যন্ত সুন্দর কিন্তু অপরাংশ অত্যন্ত কদাকার। আমার সঙ্গীটি তাদেরকে বলল, তোমরা সামনের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়। তারা যেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীটি ছিল খুবই প্রশস্ত, দুধের ন্যায় শুভ্র ছিল এর জলরাশি। তারা নদী থেকে উঠে আসার পর তাদের দেহের বিকৃতি দুরীভূত হয়ে গেল। সর্বাংগ রূপ ধারণ করল সৌন্দর্য্যের দ্যুতিতে। আমার সঙ্গীটি আমাকে বলল – এটি হল ‘আদন জান্নাত’। এটিই তোমার মূল নিকুঞ্জ। আমি দৃষ্টি উঠালাম। দেখি একটি শুভ্র বর্ণের মহল। সঙ্গীটি বলল, এটিও তোমার নীড়। আমি বললাম, আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুক। আমাকে আমার নিলয়ে একটু প্রবেশ করতে দাও। সে বলল- এখন নহে। তবে তুমি অবশ্যই এই মহলে প্রবেশ করবে।

এরপর আমি প্রথম থেকে এ পর্যন্ত যা কিছু দেখলাম এর রহস্য জানতে চাইলাম। সে বলল-
প্রথম যে ব্যক্তি যার মাথা চূর্ণ হতে দেখেছ সে হলো কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ওই ব্যক্তি যে কোরআনের জ্ঞান অর্জন করে ভুলেও গিয়েছে এবং ফরয নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার সাথে এমন আচরণ কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি যার মুখমন্ডল চিরতে দেখেছ সে হল ঐ ব্যক্তি যে সকালে ঘর থেকে বের হয় এবং দিনভর মিথ্যা কথা বলে বেড়ায়। তার সাথেও কিয়ামত পর্যন্ত এমন আচরণ করা হবে।
তৃতীয়, চুল্লির ভিতর উলংগ নারী পুরুষ জ্বলতে দেখেছ, এরা হল ব্যভীচারী নারী পুরুষ।
চতুর্থ দৃশ্যটি হল সুদ ভক্ষণকারীর যাকে তুমি রক্তের নদীতে সাঁতার কাটতে দেখেছ।
পঞ্চম, যাকে আগুন প্রজ্জ্বলিত করতে দেখেছ সে হল জাহান্নামের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতা।
ষষ্ঠ উদ্যানের দীর্ঘ লোকটি হল, হযরত ইব্রাহীম(আ) । আর আশেপাশের শিশুরা হল ইসলামের মৃত্যু বরণকারী শিশু।
সপ্তম, শ্রেণীর লোক হল পুণ্য অর্জনকারী ওই সকল লোক যারা পুণ্যের পাশাপাশি কিছু পাপের ও মিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অবশেষে আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে এবং মন্দের অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে। রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এরপর এই সাথীরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি হলাম জিবরাঈল(আ) এবং সে মিকাঈল(আ)।

(বুখারি, বায়হাকি)

আলোচনাঃ
উলামাগণ বলেন- এই হাদীসটি কবরের আযাবের সত্যতার ব্যাপারে একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। কেননা নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। হাদীসে বলা হয়েছে যে তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত এ ধরনের আচরণ করা হবে। এ থেকে বোঝা যায় যে, এটি বরযখ জগতের ঘটনা।

Post a Comment

Previous Post Next Post