ইসলামে যাকাতের গুরত্ব:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল বলেন, ইসলাম ৫টি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা - এ সাক্ষ্য দেওয়া যে ১. আল্লাহ তা’আলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. রামাযানে রোযা রাখা এবং ৫. হজ করা। ’ [আস-সহীহ আল-বুখারী, ১/১১, হাদিস:৮]
১. যাকাত ফরয ইবাদত: ইসলামের অন্যান্য ফরয হুকুমের ন্যায় যাকাতও একটি ফরয হুকুম। যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে আল্লাহর বাণী: তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা করো যাকাত প্রদান করো রুকুকারীগণের সাথে রুকু করো। [সূরা আল-বাকারা ২:৪৩]
২. ইসলামের রুকন: ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম রুকন হলো যাকাত।
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ঈমানি জীবনে একান্ত কামনা। সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। আল্লাহর বাণী: তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’। [সূরা আল-ইনসান ৭৬: ৯]
৩. আর্থিক ইবাদত: যাকাত হলো ইসলামের আর্থিক ইবাদত। কারণ অর্থ সম্পদের নির্দিষ্ট একটা অংশ আল্লাহর রাস্তায় নিঃশর্তভাবে দান করার নামই যাকাত।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়: যাকাত জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়। কেননা যাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৫. তাকওয়ার গুণ অর্জন: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়। কেননা মুসলমানগণ একমাত্র আল্লাহর ভয় এবং নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়েই নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর আল্লাহকে ভয় করে কোনো কাজ করার নামই তাকওয়া।
৬. আত্মিক শান্তি লাভ: ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আল্লাহর হুকুম ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আর্থিক ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে আত্মিক প্রশান্তি।
৭. সফলতার চাবিকাঠি: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভ করতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী: মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয় নম্ন; যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা যাকাত দান করে থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। [সূরা আল-মুমিনুন ২৩:১-৪]
৮. ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ: মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে বিভিন্ন পরীক্ষায় নিপতিত করেন। যাকাত প্রথা সম্পদশালীদের জন্য একটি ঈমানী পরীক্ষা। সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলমান ব্যক্তি ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
৯. যাকাত সম্পদ ও ব্যক্তিকে পবিত্র করে: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দাতা ব্যক্তির চরিত্র যেমন পবিত্র হয়, তেমনি সম্পদও পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর বাণী: তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। [সূরা আত-তাওবা ৯:১০৩]
১০. আল্লাহর নিয়ামতের শুকর: ধন সম্পদ আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। আর নিয়ামতের শুকর করাই ঈমানদারদের একান্ত কর্তব্য। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিয়ামতের শুকর আদায় হয়।
আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের গুরুত্ব:
আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা হলো :
১. ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ: যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ধনী দরিদ্রের মধ্যে বিরাজমান গগনচুম্বী বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে আসে এবং সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. অভাব মোচন: সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নির্দেশমত নির্দিষ্ট খাতে যাকাত আদায় করে তাহলে সমাজে কোনো মানুষ অন্ন বস্ত্র এবং গৃহহীন থাকতে পারে না। তাই সমাজের সামগ্রিক আর্থিক অভাব মোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সহৃদয়তা ও সহনশীলতার উন্মেষ ঘটে।
৪. সহানুভূতি সৃষ্টি: সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জনসমষ্টির প্রতি বিত্তবানদের সহানুভূতি প্রকাশের উত্তম মাধ্যম হলো যাকাত। এ ব্যবস্থায় গরিব জনগোষ্ঠী ধনীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ফলে শ্রেণীবিভেদ দ্রুত কমে আসে।
৫. সমাজে শান্তি স্থাপন: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয় না। অসহায় লোকদের চাহিদা পূরণের ফলে সমাজে প্রশান্তি বিরাজ করে।
৬. ভালোবাসার উদ্ভাবক: যাকাত প্রদানে ধনী ব্যক্তির সাথে তার সমাজ সমষ্টির ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, যা কখনো ম্লান হয় না।
৭. সহনশীলতার সৃষ্টি: ধনীরা গরিবের দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করত যাকাতের মাধ্যমে তা মোচনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যে দিয়ে গরিবদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
৮. ধনীর ব্যক্তিত্ব বিকাশ: যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। ফলে সমাজে তার মর্যাদাপূর্ণ স্থান অর্জিত হয়।
৯. পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদীদের ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পায়। এতে ধীরে ধীরে জাতি পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
১০. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি সম্পাদন: যাকাতের অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার মাধ্যমে বহু সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন সম্ভব হয়।
১১. অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধকরণ: যাকাতের অর্থে মিলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গরিব বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে সমাজে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ইত্যাদি হ্রাস পাবে।
১২. সাম্য ও মানবতাবোধ সৃষ্টিকারী: যাকাত ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে উঁচু নিচু ভেদাভেদ দূর করে সকলের মধ্যে সমতা আণয়ন করে। এটা পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ দূর করে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটায়।
১৩. মানব চরিত্রের অনুপম পরীক্ষা: যাকাত মানব চরিত্রে অর্থলোলুপতা দূর করে তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করতে উৎপাদিত করে যাকাত প্রদান করে মানুষ এ অনুপম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের গুরুত্ব:
যাকাত দারিদ্র বিমোচনে একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। দারিদ্র দূরীকরণে যাকাতের অবদান বিস্ময়কর। যাকাতের দ্বারা গরিব, অক্ষম, অভাবগ্রস্ত লোকদের পূর্ণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. জাতীয় আয়: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস। বিত্তবান ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ জাতীয় তহবিলে প্রদান করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দান করে।
২. অর্থনৈতিক ভারসাম্য: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য দূর হয়। ব্যক্তিরা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ সম্পদ থেকে কিছু দরিদ্র জনগণের মাঝে বিতরণ করায় উভয় শ্রেণীর মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়।
৩. সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: যাকাত মানুষের সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। অক্ষম ও অসামর্থ্য ব্যক্তিদের জাতি ধর্ম বর্ণ যাকাতের অর্থ দিয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুতরাং যাকাত সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. অর্থনৈতিক অভাব বিমোচন: যাকাত সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন বিমোচনের এবং জীবন জীবিকার যোগদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. কর্মসংস্থান: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। যাকাতের অর্থ ব্যয়ে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
৬. ঋণমুক্তি: যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়। ঋণের শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার বিধান আল্লাহ যাকাতের মাধ্যমে দান করেছেন।
৭. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আণয়ন: যাকাত সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা আণয়নে ও মুনাফাখোরী নিয়ন্ত্রিত হলে সম্পদ কোথাও পুঞ্জিভূত হতে পারে না। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও স্থিতিশীলতা আছে।
৮. মজুতদারী দূরীকরণ: যাকাত অলসভাবে অর্থ মজুদ রাখার প্রবণতা নাশ করে এবং সঞ্চিত সম্পদ বিনিয়োগে উৎসাহ যোগায়। এতে অর্থনৈতিক মজুদদারী দূরীভূত হয়।
৯. অপচয় রোধ: সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর আর্থিক অপচয় হয়, কিন্তু যাকাতের উদ্দেশ্য এবং ব্যয়ের খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এজন্য এ খাতে অপচয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
১০. ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ: আধুনিক কর ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু যাকাতে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা বিরল। মহান আল্লাহর ভয়ে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে মানুষ যাকাত দেয়। সুতরাং এ অনুভূতি সর্বক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা রোধ করে।
১১. বেকারত্ব দূরীকরণ: সরকার যাকাত আদায়ের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় খুলে অনেক লোকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করতে পারে।
১২. জাতীয় উন্নতি: যাকাত সরকারের জন্য জাতীয় উন্নতি বিধানে একটি অনন্য ব্যবস্থা। যাকাতের নির্দিষ্ট ব্যয়খাতে যাকাতের অর্থ বিনিয়োগ করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন করা সম্ভব।
১৩. সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ রহিত: যাকাত প্রদান করলে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকে না, বরং তা গরিবদের মাঝে পৌঁছে যায়। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, সাথে সাথে বাজার চাহিদা উৎপাদন ইত্যাদিও বৃদ্ধি পায়।
১৪. অর্থ অহমিকার বিলোপ সাধন: যাকাত প্রদান করলে ব্যক্তির মন থেকে অর্থের অহমিকা বিলুপ্ত হয়।
১৫. পুঁজিবাদের অবসান: ইসলামি রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে পুঁজিবাদীদের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পেয়ে পুঁজিবাদের অবসান ঘটে।
১৬. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা: শতকরা আড়াই টাকা গরিব জনসাধারণকে দেওয়ার ফলে বিত্তশালীদের মন-মানসিকতার সুস্থ বিকাশ ঘটে। নির্দিষ্ট ব্যয় খাতে যাকাতের অর্থের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে রাস্তাঘাট হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়।
১৭. যাকাত অর্থনৈতিক ভিত্তি: ইসলামের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে ওঠেছে যাকাতের ওপর ভিত্তি করে। আর যাকাতই ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।
১৮. অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: যাকাত প্রদানের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সম্পদের অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল বলেন, ইসলাম ৫টি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা - এ সাক্ষ্য দেওয়া যে ১. আল্লাহ তা’আলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. রামাযানে রোযা রাখা এবং ৫. হজ করা। ’ [আস-সহীহ আল-বুখারী, ১/১১, হাদিস:৮]
১. যাকাত ফরয ইবাদত: ইসলামের অন্যান্য ফরয হুকুমের ন্যায় যাকাতও একটি ফরয হুকুম। যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে আল্লাহর বাণী: তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা করো যাকাত প্রদান করো রুকুকারীগণের সাথে রুকু করো। [সূরা আল-বাকারা ২:৪৩]
২. ইসলামের রুকন: ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম রুকন হলো যাকাত।
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ঈমানি জীবনে একান্ত কামনা। সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। আল্লাহর বাণী: তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’। [সূরা আল-ইনসান ৭৬: ৯]
৩. আর্থিক ইবাদত: যাকাত হলো ইসলামের আর্থিক ইবাদত। কারণ অর্থ সম্পদের নির্দিষ্ট একটা অংশ আল্লাহর রাস্তায় নিঃশর্তভাবে দান করার নামই যাকাত।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়: যাকাত জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়। কেননা যাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৫. তাকওয়ার গুণ অর্জন: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়। কেননা মুসলমানগণ একমাত্র আল্লাহর ভয় এবং নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়েই নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর আল্লাহকে ভয় করে কোনো কাজ করার নামই তাকওয়া।
৬. আত্মিক শান্তি লাভ: ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আল্লাহর হুকুম ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আর্থিক ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে আত্মিক প্রশান্তি।
৭. সফলতার চাবিকাঠি: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভ করতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী: মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয় নম্ন; যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা যাকাত দান করে থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। [সূরা আল-মুমিনুন ২৩:১-৪]
৮. ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ: মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে বিভিন্ন পরীক্ষায় নিপতিত করেন। যাকাত প্রথা সম্পদশালীদের জন্য একটি ঈমানী পরীক্ষা। সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলমান ব্যক্তি ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
৯. যাকাত সম্পদ ও ব্যক্তিকে পবিত্র করে: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দাতা ব্যক্তির চরিত্র যেমন পবিত্র হয়, তেমনি সম্পদও পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর বাণী: তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। [সূরা আত-তাওবা ৯:১০৩]
১০. আল্লাহর নিয়ামতের শুকর: ধন সম্পদ আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। আর নিয়ামতের শুকর করাই ঈমানদারদের একান্ত কর্তব্য। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিয়ামতের শুকর আদায় হয়।
আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের গুরুত্ব:
আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা হলো :
১. ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ: যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ধনী দরিদ্রের মধ্যে বিরাজমান গগনচুম্বী বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে আসে এবং সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. অভাব মোচন: সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নির্দেশমত নির্দিষ্ট খাতে যাকাত আদায় করে তাহলে সমাজে কোনো মানুষ অন্ন বস্ত্র এবং গৃহহীন থাকতে পারে না। তাই সমাজের সামগ্রিক আর্থিক অভাব মোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সহৃদয়তা ও সহনশীলতার উন্মেষ ঘটে।
৪. সহানুভূতি সৃষ্টি: সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জনসমষ্টির প্রতি বিত্তবানদের সহানুভূতি প্রকাশের উত্তম মাধ্যম হলো যাকাত। এ ব্যবস্থায় গরিব জনগোষ্ঠী ধনীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ফলে শ্রেণীবিভেদ দ্রুত কমে আসে।
৫. সমাজে শান্তি স্থাপন: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয় না। অসহায় লোকদের চাহিদা পূরণের ফলে সমাজে প্রশান্তি বিরাজ করে।
৬. ভালোবাসার উদ্ভাবক: যাকাত প্রদানে ধনী ব্যক্তির সাথে তার সমাজ সমষ্টির ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, যা কখনো ম্লান হয় না।
৭. সহনশীলতার সৃষ্টি: ধনীরা গরিবের দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করত যাকাতের মাধ্যমে তা মোচনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যে দিয়ে গরিবদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
৮. ধনীর ব্যক্তিত্ব বিকাশ: যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। ফলে সমাজে তার মর্যাদাপূর্ণ স্থান অর্জিত হয়।
৯. পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদীদের ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পায়। এতে ধীরে ধীরে জাতি পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
১০. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি সম্পাদন: যাকাতের অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার মাধ্যমে বহু সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন সম্ভব হয়।
১১. অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধকরণ: যাকাতের অর্থে মিলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গরিব বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে সমাজে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ইত্যাদি হ্রাস পাবে।
১২. সাম্য ও মানবতাবোধ সৃষ্টিকারী: যাকাত ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে উঁচু নিচু ভেদাভেদ দূর করে সকলের মধ্যে সমতা আণয়ন করে। এটা পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ দূর করে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটায়।
১৩. মানব চরিত্রের অনুপম পরীক্ষা: যাকাত মানব চরিত্রে অর্থলোলুপতা দূর করে তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করতে উৎপাদিত করে যাকাত প্রদান করে মানুষ এ অনুপম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের গুরুত্ব:
যাকাত দারিদ্র বিমোচনে একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। দারিদ্র দূরীকরণে যাকাতের অবদান বিস্ময়কর। যাকাতের দ্বারা গরিব, অক্ষম, অভাবগ্রস্ত লোকদের পূর্ণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. জাতীয় আয়: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস। বিত্তবান ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ জাতীয় তহবিলে প্রদান করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দান করে।
২. অর্থনৈতিক ভারসাম্য: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য দূর হয়। ব্যক্তিরা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ সম্পদ থেকে কিছু দরিদ্র জনগণের মাঝে বিতরণ করায় উভয় শ্রেণীর মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়।
৩. সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: যাকাত মানুষের সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। অক্ষম ও অসামর্থ্য ব্যক্তিদের জাতি ধর্ম বর্ণ যাকাতের অর্থ দিয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুতরাং যাকাত সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. অর্থনৈতিক অভাব বিমোচন: যাকাত সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন বিমোচনের এবং জীবন জীবিকার যোগদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. কর্মসংস্থান: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। যাকাতের অর্থ ব্যয়ে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
৬. ঋণমুক্তি: যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়। ঋণের শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার বিধান আল্লাহ যাকাতের মাধ্যমে দান করেছেন।
৭. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আণয়ন: যাকাত সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা আণয়নে ও মুনাফাখোরী নিয়ন্ত্রিত হলে সম্পদ কোথাও পুঞ্জিভূত হতে পারে না। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও স্থিতিশীলতা আছে।
৮. মজুতদারী দূরীকরণ: যাকাত অলসভাবে অর্থ মজুদ রাখার প্রবণতা নাশ করে এবং সঞ্চিত সম্পদ বিনিয়োগে উৎসাহ যোগায়। এতে অর্থনৈতিক মজুদদারী দূরীভূত হয়।
৯. অপচয় রোধ: সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর আর্থিক অপচয় হয়, কিন্তু যাকাতের উদ্দেশ্য এবং ব্যয়ের খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এজন্য এ খাতে অপচয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
১০. ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ: আধুনিক কর ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু যাকাতে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা বিরল। মহান আল্লাহর ভয়ে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে মানুষ যাকাত দেয়। সুতরাং এ অনুভূতি সর্বক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা রোধ করে।
১১. বেকারত্ব দূরীকরণ: সরকার যাকাত আদায়ের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় খুলে অনেক লোকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করতে পারে।
১২. জাতীয় উন্নতি: যাকাত সরকারের জন্য জাতীয় উন্নতি বিধানে একটি অনন্য ব্যবস্থা। যাকাতের নির্দিষ্ট ব্যয়খাতে যাকাতের অর্থ বিনিয়োগ করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন করা সম্ভব।
১৩. সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ রহিত: যাকাত প্রদান করলে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকে না, বরং তা গরিবদের মাঝে পৌঁছে যায়। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, সাথে সাথে বাজার চাহিদা উৎপাদন ইত্যাদিও বৃদ্ধি পায়।
১৪. অর্থ অহমিকার বিলোপ সাধন: যাকাত প্রদান করলে ব্যক্তির মন থেকে অর্থের অহমিকা বিলুপ্ত হয়।
১৫. পুঁজিবাদের অবসান: ইসলামি রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে পুঁজিবাদীদের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পেয়ে পুঁজিবাদের অবসান ঘটে।
১৬. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা: শতকরা আড়াই টাকা গরিব জনসাধারণকে দেওয়ার ফলে বিত্তশালীদের মন-মানসিকতার সুস্থ বিকাশ ঘটে। নির্দিষ্ট ব্যয় খাতে যাকাতের অর্থের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে রাস্তাঘাট হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়।
১৭. যাকাত অর্থনৈতিক ভিত্তি: ইসলামের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে ওঠেছে যাকাতের ওপর ভিত্তি করে। আর যাকাতই ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।
১৮. অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: যাকাত প্রদানের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সম্পদের অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত হয়।
Post a Comment