মুরাবাহা কী?
ফকীহবৃন্দ ফিকহের কিতাবে বিভিন্ন রকম ক্রয়-বিক্রয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, এবং মূল্য/ পণ্য/ চুক্তির ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়কে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন।
তন্মধ্যে একটি হলো, আমানতের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রকার। আমানত বলতে, বিক্রেতা তার ক্রেতার কাছে ক্রয়মূল্য উল্লেখ করা বা না করা। সে হিসেবে যে কোনো বিক্রয় চুক্তি প্রথমত দুই প্রকার:
১. সাধারণ বিক্রয় (দরদাম করে যেখানে মূল্য নির্ধারণ করা হয়)
২. আমানতের বিক্রয় (যেখানে ক্রয়মূল্য উল্লেখ করা হয়)
এটা আবার তিন প্রকার:
ক. মুরাবাহা - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হয়, এবং বিক্রেতার তাতে লাভ থাকে। যেমন ১২০ টাকায় বিক্রয়ের জন্য কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে বলল, এই পণ্যটা আমার কেনা পড়েছে ১০০ টাকা (কাজেই অতিরিক্ত ২০ টাকা আমার লাভ।) বা বলল, এতে আমার ২০ টাকা লাভ (কাজেই ১০০ টাকা আমার খরচ)।
খ. ওয়াদিয়া - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হয়, এবং বিক্রেতার তাতে লস থাকে। যেমন ১২০ টাকায় বিক্রয়ের জন্য কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে বলল, এই পণ্যটা আমার কেনা পড়েছে ১৩০ টাকা (কাজেই অতিরিক্ত ১০ টাকা আমার লস।) বা বলল, এতে আমার ১০ টাকা লস (কাজেই ১৩০ টাকা আমার খরচ)।
গ. তাউলিয়া - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হবে, এবং কোনো লাভ/লস থাকবে না। বরং যা খরচ তাতেই বিক্রয় করা হবে।
সারাংশ হলো, মুরাবাহা এমন এক বিক্রয় চুক্তি, যেখানে বিক্রেতা ক্রেতার কাছে তার ক্রয়মূল্য/ খরচ এবং লাভ ডিসক্লোজ করেন।
মুরাবাহা কেন?
ইসলামী ব্যাংকিং যখন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে শুরু হয় (মিশরের মিট গামার ব্যাংক), তখন কেবল মুশারাকা-মুদারাবা (প্রফিট-লস শেয়ারিং চুক্তি) দিয়েই শুরু হয়। কিন্তু উভয় চুক্তিতেই লাভ অনির্দিষ্ট (variable return) হওয়ায় এবং মুদারিব ও শেয়ার হোল্ডারের আমানতের সম্পর্ক থাকায়, এবং উভয় পক্ষ প্রফিট-লস শেয়ারে আগ্রহী কম হওয়ায়, একই সাথে সুদভিত্তিক ঋণ সহজলভ্য হওয়ায়, ফিক্সড রিটার্নের শরীয়াহ মোতাবেক বিকল্প হিসেবে মুরাবাহা বিক্রয়কে সামনে আনা হয়।
তবে মুরাবাহা যেহেতু একটি বিক্রয় চুক্তি, তাই কেবল যেসব ক্ষেত্রে গ্রাহকের কোনো কিছু ক্রয়ের জন্য টাকার প্রয়োজন হয়, সেসব ক্ষেত্রেই মুরাবাহা করা যায়। শুধু ক্যাশ প্রয়োজন হলে মুরাবাহা করার সুযোগ নেই।
উদাহরণস্বরূপ, গ্রাহকের গাড়ি ক্রয়ের জন্য টাকা প্রয়োজন, বা ফ্রিজ কেনার জন্য, অথবা অফিস ফার্নিচার - ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মুরাবাহার হার ৬৯% এর মতো। বিশ্বে কোথাও কোথাও তা ৯৯% -ও আছে।
মুরাবাহা কীভাবে?
পূর্বেই বলা হয়েছে, মুরাবাহা এমন একটি বিক্রয় চুক্তি, যেখানে বিক্রেতা ক্রেতাকে তার ক্রয়মূল্য/ খরচ বলে দেয়। আমাদের বাজারে এর ব্যবহার প্রচুর। বিক্রেতা পণ্যের দরদামের মাঝে হঠাৎ করেই বলে ফেলেন, “ভাই, এইডা আমার কেনা দাম!” বা “ভাই, আমার লাভ থাকবো দশ টাকা”। - যদিও এক্ষেত্রে অনেক সময় তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তবে এভাবে ক্রয়মূল্য বা লাভ উল্লেখ করলেই চুক্তিটা মুরাবাহা বিক্রয় হয়ে যায়।
তবে প্রচলিত এ মুরাবাহা আর ব্যাংকিং মুরাবাহার মাঝে একটু পার্থক্য আছে। প্রচলিত মুরাবাহায় বিক্রেতা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে, ক্রেতা এসে দাম জিজ্ঞাসা করে, দরদামের পর ক্রয় করে নিয়ে যায়।
কিন্তু ব্যাংকের বিষয়টি এমন নয়। ব্যাংকের মূল কাজ financial intermediary বা আর্থিক লেনদেনে মধ্যস্থতা করা। পণ্য বিক্রয় ব্যাংকের কাজ নয়। কাজেই ব্যাংকের কাছে সাধারণত পণ্য থাকে না।
কাজেই এখানে ক্রেতা প্রথমে তার কাঙ্ক্ষিত পণ্যের বিবরণ পেশ করে, এরপর ব্যাংক এক বা একাধিক সাপ্লায়ারের (বিক্রেতা) কাছ থেকে পণ্যটির কোটেশন বা মূল্য বিবরণী নেয়। ইতোমধ্যে ক্রেতা একটি ওয়াদা প্রদান করেন যে, ব্যাংক যদি পণ্যটি ক্রয় করে, তাহলে তিনি তা ব্যাংকের কাছ থেকে ক্রয় করবেন।
এরপর ব্যাংক মূল বিক্রেতার কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এবং বিক্রেতা পণ্যটি ব্যাংককে হস্তান্তর করে (বিস্তারিত সামনে আসছে)। এখন পণ্যটির মালিক ব্যাংক। এ পর্যায়ে ব্যাংক গ্রাহকের সাথে মুরাবাহা চুক্তি করে, অর্থাৎ পণ্যের ক্রয়মূল্য/ খরচ ও লাভ উল্লেখপূর্বক তা গ্রাহকের কাছে বিক্রয়ের চুক্তি করে। সবশেষে গ্রাহক পণ্য বুঝে নেয় এবং চুক্তি অনুযায়ী একবারে বা একাধিক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করে।
বুঝা গেল, ব্যাংকিং মুরাবাহায় তিনটি পক্ষ। গ্রাহক, ব্যাংক ও মূল বিক্রেতা বা সাপ্লায়ার। এবং দুটো চুক্তি। প্রথম চুক্তি ব্যাংক ও মূল বিক্রেতার মাঝে। এটা মুরাবাহা হতে পারে বা সাধারণ বিক্রয় চুক্তিও হতে পারে। দ্বিতীয় চুক্তি ব্যাংক ও গ্রাহকের মাঝে। এটা মুরাবাহা। এবং এ জন্যই এ বিনিয়োগকে মুরাবাহা বলা হয়।
তবে বাজারের প্রচলিত মুরাবাহার সাথে এর পার্থক্য থাকায়, এবং কেবল গ্রাহকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে যেহেতু ব্যাংক মুরাবাহা করে থাকে, তাই এই মুরাবাহকে Murabaha to the purchase orderer (المرابحة للآمر بالشراء) বা ‘ক্রেতার অনুরোধ/ নির্দেশে মুরাবাহা’ বলা হয়ে থাকে। অনেকে এটাকে ব্যাংকিং মুরাবাহাও বলেন।
_____
লিখেছেন: শাইখ ইউসুফ সুলতান
ফকীহবৃন্দ ফিকহের কিতাবে বিভিন্ন রকম ক্রয়-বিক্রয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, এবং মূল্য/ পণ্য/ চুক্তির ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়কে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন।
তন্মধ্যে একটি হলো, আমানতের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রকার। আমানত বলতে, বিক্রেতা তার ক্রেতার কাছে ক্রয়মূল্য উল্লেখ করা বা না করা। সে হিসেবে যে কোনো বিক্রয় চুক্তি প্রথমত দুই প্রকার:
১. সাধারণ বিক্রয় (দরদাম করে যেখানে মূল্য নির্ধারণ করা হয়)
২. আমানতের বিক্রয় (যেখানে ক্রয়মূল্য উল্লেখ করা হয়)
এটা আবার তিন প্রকার:
ক. মুরাবাহা - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হয়, এবং বিক্রেতার তাতে লাভ থাকে। যেমন ১২০ টাকায় বিক্রয়ের জন্য কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে বলল, এই পণ্যটা আমার কেনা পড়েছে ১০০ টাকা (কাজেই অতিরিক্ত ২০ টাকা আমার লাভ।) বা বলল, এতে আমার ২০ টাকা লাভ (কাজেই ১০০ টাকা আমার খরচ)।
খ. ওয়াদিয়া - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হয়, এবং বিক্রেতার তাতে লস থাকে। যেমন ১২০ টাকায় বিক্রয়ের জন্য কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে বলল, এই পণ্যটা আমার কেনা পড়েছে ১৩০ টাকা (কাজেই অতিরিক্ত ১০ টাকা আমার লস।) বা বলল, এতে আমার ১০ টাকা লস (কাজেই ১৩০ টাকা আমার খরচ)।
গ. তাউলিয়া - যেখানে ক্রয়মূল্য/ খরচ উল্লেখ করা হবে, এবং কোনো লাভ/লস থাকবে না। বরং যা খরচ তাতেই বিক্রয় করা হবে।
সারাংশ হলো, মুরাবাহা এমন এক বিক্রয় চুক্তি, যেখানে বিক্রেতা ক্রেতার কাছে তার ক্রয়মূল্য/ খরচ এবং লাভ ডিসক্লোজ করেন।
মুরাবাহা কেন?
ইসলামী ব্যাংকিং যখন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে শুরু হয় (মিশরের মিট গামার ব্যাংক), তখন কেবল মুশারাকা-মুদারাবা (প্রফিট-লস শেয়ারিং চুক্তি) দিয়েই শুরু হয়। কিন্তু উভয় চুক্তিতেই লাভ অনির্দিষ্ট (variable return) হওয়ায় এবং মুদারিব ও শেয়ার হোল্ডারের আমানতের সম্পর্ক থাকায়, এবং উভয় পক্ষ প্রফিট-লস শেয়ারে আগ্রহী কম হওয়ায়, একই সাথে সুদভিত্তিক ঋণ সহজলভ্য হওয়ায়, ফিক্সড রিটার্নের শরীয়াহ মোতাবেক বিকল্প হিসেবে মুরাবাহা বিক্রয়কে সামনে আনা হয়।
তবে মুরাবাহা যেহেতু একটি বিক্রয় চুক্তি, তাই কেবল যেসব ক্ষেত্রে গ্রাহকের কোনো কিছু ক্রয়ের জন্য টাকার প্রয়োজন হয়, সেসব ক্ষেত্রেই মুরাবাহা করা যায়। শুধু ক্যাশ প্রয়োজন হলে মুরাবাহা করার সুযোগ নেই।
উদাহরণস্বরূপ, গ্রাহকের গাড়ি ক্রয়ের জন্য টাকা প্রয়োজন, বা ফ্রিজ কেনার জন্য, অথবা অফিস ফার্নিচার - ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মুরাবাহার হার ৬৯% এর মতো। বিশ্বে কোথাও কোথাও তা ৯৯% -ও আছে।
মুরাবাহা কীভাবে?
পূর্বেই বলা হয়েছে, মুরাবাহা এমন একটি বিক্রয় চুক্তি, যেখানে বিক্রেতা ক্রেতাকে তার ক্রয়মূল্য/ খরচ বলে দেয়। আমাদের বাজারে এর ব্যবহার প্রচুর। বিক্রেতা পণ্যের দরদামের মাঝে হঠাৎ করেই বলে ফেলেন, “ভাই, এইডা আমার কেনা দাম!” বা “ভাই, আমার লাভ থাকবো দশ টাকা”। - যদিও এক্ষেত্রে অনেক সময় তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তবে এভাবে ক্রয়মূল্য বা লাভ উল্লেখ করলেই চুক্তিটা মুরাবাহা বিক্রয় হয়ে যায়।
তবে প্রচলিত এ মুরাবাহা আর ব্যাংকিং মুরাবাহার মাঝে একটু পার্থক্য আছে। প্রচলিত মুরাবাহায় বিক্রেতা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে, ক্রেতা এসে দাম জিজ্ঞাসা করে, দরদামের পর ক্রয় করে নিয়ে যায়।
কিন্তু ব্যাংকের বিষয়টি এমন নয়। ব্যাংকের মূল কাজ financial intermediary বা আর্থিক লেনদেনে মধ্যস্থতা করা। পণ্য বিক্রয় ব্যাংকের কাজ নয়। কাজেই ব্যাংকের কাছে সাধারণত পণ্য থাকে না।
কাজেই এখানে ক্রেতা প্রথমে তার কাঙ্ক্ষিত পণ্যের বিবরণ পেশ করে, এরপর ব্যাংক এক বা একাধিক সাপ্লায়ারের (বিক্রেতা) কাছ থেকে পণ্যটির কোটেশন বা মূল্য বিবরণী নেয়। ইতোমধ্যে ক্রেতা একটি ওয়াদা প্রদান করেন যে, ব্যাংক যদি পণ্যটি ক্রয় করে, তাহলে তিনি তা ব্যাংকের কাছ থেকে ক্রয় করবেন।
এরপর ব্যাংক মূল বিক্রেতার কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এবং বিক্রেতা পণ্যটি ব্যাংককে হস্তান্তর করে (বিস্তারিত সামনে আসছে)। এখন পণ্যটির মালিক ব্যাংক। এ পর্যায়ে ব্যাংক গ্রাহকের সাথে মুরাবাহা চুক্তি করে, অর্থাৎ পণ্যের ক্রয়মূল্য/ খরচ ও লাভ উল্লেখপূর্বক তা গ্রাহকের কাছে বিক্রয়ের চুক্তি করে। সবশেষে গ্রাহক পণ্য বুঝে নেয় এবং চুক্তি অনুযায়ী একবারে বা একাধিক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করে।
বুঝা গেল, ব্যাংকিং মুরাবাহায় তিনটি পক্ষ। গ্রাহক, ব্যাংক ও মূল বিক্রেতা বা সাপ্লায়ার। এবং দুটো চুক্তি। প্রথম চুক্তি ব্যাংক ও মূল বিক্রেতার মাঝে। এটা মুরাবাহা হতে পারে বা সাধারণ বিক্রয় চুক্তিও হতে পারে। দ্বিতীয় চুক্তি ব্যাংক ও গ্রাহকের মাঝে। এটা মুরাবাহা। এবং এ জন্যই এ বিনিয়োগকে মুরাবাহা বলা হয়।
তবে বাজারের প্রচলিত মুরাবাহার সাথে এর পার্থক্য থাকায়, এবং কেবল গ্রাহকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে যেহেতু ব্যাংক মুরাবাহা করে থাকে, তাই এই মুরাবাহকে Murabaha to the purchase orderer (المرابحة للآمر بالشراء) বা ‘ক্রেতার অনুরোধ/ নির্দেশে মুরাবাহা’ বলা হয়ে থাকে। অনেকে এটাকে ব্যাংকিং মুরাবাহাও বলেন।
_____
লিখেছেন: শাইখ ইউসুফ সুলতান
Post a Comment