ছুঁয়ে দিলো মন

খুব ভারী বর্ষণে মনটা কেমন করে উঠলো,একটা অন্যরকম অনুভূতি সাথে নাকে আসছে হালকা ভেজা মাটির গন্ধ। জানালাগুলো বন্ধ করেই বাইরে তাকিয়ে ছিলাম,হালকা একটু খুলতেই বৃষ্টির ফোটা এসে শরীরে স্পর্শ করে। একটা সময় ছিল, মুষলধারায় বৃষ্টি পড়া মানেই ছিলো লাউডস্পিকার বা হেডফোন কানে দিয়ে গান শোনা। এখন বৃষ্টিটা আর তেমন না,স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রায়ই খুব প্রিয় কিছু দোয়া চলে আসে মুখ দিয়ে, রবের রহমত বর্ষণের সময় রবের কাছে রহমত চেয়ে নেয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চলে। হঠাৎ আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে ভীষণ চাপা একটা কষ্ট হচ্ছিলো, পাশের রুম থেকে লাউড স্পিকারে আসা গানের শব্দই বোধ হয় এমন অনুভূতির উদ্রেককারী। হাবীব, অর্নব, তাহসান, বালাম, হৃদয় খান থেকে শুরু করে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস এর গান শুনে শুনে মুখস্ত করা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাতা/ডায়েরীতে লিখে বারবার চেষ্টা করা এবং বন্ধুদের আড্ডায় প্রায় সব গানেই গলা মেলাতে পারার ক্রেডিট নিতে চাওয়া ছেলেটা এখন গান শুনলে কেন মন খারাপ করে, ঐ জায়গায় থাকতেও চায় না,চলে যেতে চায় দ্রুত অন্যখানে! গান শোনা বা গান গাওয়া কি এতটাই খারাপ কিছু?

বছরের শুরুর দিকের ঘটনা, স্কুলের কিছু পুরনো বন্ধু প্রতি বছরের মত এবারও এস এম এস করে, কেউবা ফোন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। হোস্টেলের এক দুজনের মনে পড়লে সবাইকে নিয়ে হইহুল্লোড় করে উইশ করার জন্য রুমে আসে। পছন্দ করছি না বিষয়টা জানতে পেরে একটু মুখ গম্ভীর করেই প্রস্থান, যেন আমি খুব অন্যায় একটা কিছু করলাম, সবার সাথে ভাব নিলাম এই টাইপ। মাস খানেক পরেই পাশের রুমের এক প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন, খুব গোপনে অন্য বন্ধুরা মিলে কেক আনে, ১২.০১ মিনিটে খুব চিৎকার আর উল্লাসে উইশ জানানো, কেক কাটা,কোকাকোলার বোতল ঝাঁকিয়ে বার্থডে উদযাপনের রাতের পর্ব শেষ। ভীড়ের মাঝে আমাকে খুঁজে না পেয়ে আমার রুমে গিয়ে কেক খাওয়ানোর জোর চেষ্টা, কিন্তু আমি কিছুতেই খাবো না।বার্থডে কেক খাওয়া কি এমন অপরাধ!! দিনের বেলা কাছের বন্ধুরা মিলে ভাল একটা রেস্টুরেন্ট এ ভাল মানের খাবার খাওয়ার প্ল্যান। আমি সেখানেও যাবো না, বার্থডের দিন একটু ভাল খাবার খাওয়াতে নিষেধ কোথায়!!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন নামকরা শিক্ষক মারা গেছেন গত বছর, শিরক ছাড়া মারা গেলে আল্লাহ তায়ালা উনার ভুলগুলোকে ক্ষমা করুন। মারা যাওয়ার কিছুদিন পর তার জন্য স্মরণসভা আয়োজন করা হয়,আমি অনুপস্থিত দেখে বন্ধুরা অবাক,কান্নাকাটি করে সবাই খুব গম্ভীর ও মন খারাপ করে বের হলো, দুপুরে যোহরের সালাতের পরে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। আমি সালাত শেষ করে বের হয়ে আসলাম। রুমে এসে প্রশ্ন, স্মরণ সভায় গেলি না কেন? কি যে মিস করছোস! স্যার কে নিয়ে সবাই স্মৃতিচারন করলেন। তাছাড়া তুই তো মিলাদ ও দোয়াতেও ছিলি না! মিষ্টি দিলো, আনলি না কেন? এইসব ভাল কাজে তুই থাকবি না আমরা তো ভাবতেই পারি না!!

এতগুলো প্রশ্ন? উত্তর না দিয়েই কখনো প্রস্থান করেছি, কখনো বুঝানোর চেষ্টা করেছি। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আলাদা করে দেওয়ার আগে আসলে মুল একটা বিষয় জেনে নিতে হবে। প্রথম প্রশ্নটা তাই হবে, তুই কিসের জন্য এগুলো করিস না? উত্তর আমি একজন মুসলিম তাই। খুব স্বাভাবিক পরের প্রশ্নটা হবে,আমরা কি মুসলিম না? আসলে জন্মগত,নামধারী মুসলিম হওয়া আর সত্যিকার মুসলিম হওয়ায় পার্থক্য আছে। মুসলিম মানে হচ্ছে যিনি আত্মসমর্পণ করেন তার সমস্ত কিছু তার সৃষ্টিকর্তা একক ও অদ্বিতীয় সত্তা আল্লাহ সুবহান ওয়া তায়ালার কাছে। দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে তার রবের প্রতিই তার ভালবাসা অনেকগুন বেশি থাকবে। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থাকে যারা আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সবকিছুতে বিশ্বাসী। তারা ভাল কিছু পেলেও তাদের রবের নিয়ামতের শুকরিয়া করে আবার প্রচন্ড কঠিন মুহুর্তেও তাদের মুখে থাকে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা, সর্বাবস্থায় তারা তাদের মালিকের পবিত্রতা বর্ননা করার চেষ্টা করে। তার রবের দয়াশীলতা আর ক্ষমাশীলতা তার জন্য হয়ে উঠে সঠিক পথে চলার জন্য আশার আলো। আর তার রবের কঠোর শাস্তি আর অনু পরিমান কাজের হিসাব গ্রহনের হুশিয়ারী তার মনে ভয়ের সঞ্চার করে। কিন্তু কোনটাই একজন মুসলিমের বেশি হয় না, সে সমান পরিমান আশা আর ভয় নিয়েই দিন যাপন করে। সে যেমন জানে তার রব অত্যন্ত দয়ালু, তেমনি জানে আগের মানুষদেরকে কী পরিমান ভয়ংকর আযাব দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিলো। নবী রাসুল আর সাহাবাদের কষ্টের দিনগুলোর বর্ননা তাকে ব্যথিত করে,কষ্টের সময় চলার সাহস যোগায়। এত ভালভাবে জীবনযাপনের পরেও অতৃপ্তির/অপ্রাপ্তির কথা বলাটা আসলেই অযৌক্তিক মনে হয়।

একটা ধর্ম-একটা জীবনব্যবস্থা,
একটা গ্রন্থ-একটা পথ নির্দেশিকা,
একজন রাসুল(স)-সারাজীবনের রোল মডেল,
আর এসব কিছুই যিনি আমাদের সুন্দরভাবে জীবন যাপনের জন্য পাঠিয়েছেন তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহান ওয়া তায়ালা -একক ও অদ্বিতীয়। ইসলাম আমাকে এই দুনিয়ার সবকিছুর দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছে আর সবকিছুর রবের গোলামী করে এই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে ছুটে চলার পথ দিয়েছে। আর এই পথে চলার শুরুতেই রবের যেই কথাটা ছুঁয়ে দিলো মন,


"বলুন, হে আমার বান্দাগন, যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তারঁ আজ্ঞাবহ হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।"
(সূরা যুমারঃ ৫৩,৫৪)


রবের এই অফারটা দুনিয়ার সেরা অফার,ফিরে আসলেই সকল গুনাহ ক্ষমা করার অফার। এই অফারটা যে ইসলামে সকল পাপী বান্দাদের আসার জন্য অত্যন্ত সহজ রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আর তাই তো একজন পাপী বান্দা প্রতিনিয়ত আল্লাহ সুবহান ওয়া তায়ালার বিভিন্ন নিদর্শন দেখে আর প্রতিনিয়ত নতুন করে তারঁ প্রেরিত জীবন বিধান ইসলামের প্রেমে পড়ে।

______
লিখেছেন: মাহফুজুর রহমান (ডাক্তার)

1 Comments

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন, সুবহানাল্লাহ। আল্লাহতায়ালা

    আমাদের হেদায়েত দান করুন আমিন ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post