আলোচক: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট ।
প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানী আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আজকের প্রবন্ধে আমরা ঈদুল আযহা ও কুরবানীর বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। দুই পর্বের আলোচনার এটা প্রথম পর্ব।
যুলহাজ্জ মাসে ১০ তারিখে আমরা ঈদুল আযহার সালাত ও কুরবানী আদায় করি। ঈদ শব্দের অর্থ পুনরাগমণ। যে উৎসব বা পর্ব নির্ধারিত দিনে বা সময়ে প্রতি বৎসর ঘুরে ঘুরে আসে তাকে ঈদ বলা হয়। প্রতি সপ্তাহে জুমুআর দিনকে সপ্তাহিক ঈদ বলা হয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে বাৎসরিক ঈদ হিসেবে দুটি দিন দিয়েছেন: ঈদুল ফিতরের দিন এবং ঈদুল আযহা দিন। আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/২৯৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৪। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
ইসলাম সামাজিক আনন্দ ও উৎসবকে ইবাদত ও জনকল্যাণের সাথে সংযুক্ত করেছে। ঈদুল ফিতরের দিনে প্রথমে ফিতরা আদায়, এরপর সালাত আদায়এবং এরপর সামাজিক আনন্দ, উৎসব ও শরীয়ত সম্মত খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঈদুল আযহায় প্রথমে সালাত আদায়, এরপর কুরবানী করা ও গোশত বিতরণ করা এবং এরপর আনন্দ, খেলাধুলা বা বৈধ বিনোদনের নিয়ম করা হয়েছে। যেন আমাদের আনন্দ পাশবিকতায় বা স্বার্থপরতায় পরিণত না হয়।
ঈদ, কুরবানী, হজ্জ ইত্যাদি সমাজ ও রাষ্ট্র কতৃক পরিচালিত হতে হবে। কেউ কেউ অন্য দেশের চাঁদ দেখার উপর ঈদ করতে চান এবং এভাবে সমাজে বিভক্তি ও দলাদলি সৃষ্টি করেন, যা কঠিন হারাম ও অন্যায়। নিজের মতামত এমনকি নিজের চাঁদ দেখার ভিত্তিতেও রাষ্ট্র বা সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বিরোধিতা করা বৈধ নয়। হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো, চাঁদ দেখলেই ঈদ হয় না, রাষ্ট্র প্রশাসনের নিকট চাঁদ দেখা প্রমাণিত হতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ যে দিন ঈদ করবেন সেদিনেই ঈদ করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, এক্ষেত্রে ভুল হলেও ঈদ, হজ্জ, কুরবানী সবই আদায় হয়ে যাবে। ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।
এক্ষেত্রে ভুলের জন্য মুমিন কখনোই দায়ী হবেন না। এ বিষয়ক দলাদলি বন্ধ করে সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরী।
ঈদুল আযহার দিনে গোসল করা, যথাসাধ্য পরিস্কার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করা, এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জানি। ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে খালিপেটে সালাতুল ঈদ আদায় করতে যাওয়া সুন্নাত। সম্ভব হলে ঈদের সালাতের পরে দ্রুত কুরবানী করে কুরবানীর গোশত দিয়ে “ইফতার” করা বা ঈদের দিনের পানাহার শুরু করা ভাল।
রাসূলুল্লাহ সা. সাধারণভাবে সূর্যোদয়ের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ঈদের সালাত আদায় করতেন। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, ঈদুল ফিতরের সালাত তিনি একটু দেরী করে সূর্যোদয়ের ১ বা দেড় ঘন্টা পরে পড়তেন এবং ঈদুল আযহার সালাত একটু তাড়াতাড়ি সূর্যোদয়ের আধাঘন্টা থেকে একঘন্টার মধ্যে আদায় করতেন। আমাদেরও সুন্নাত সময়ে সালাতুল ঈদ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তবে প্রয়োজনে কিছু দেরী করা নিষিদ্ধ নয়। তবে সর্বাবস্থায় ঈদুল আযহার সালাত একটু আগে আাদয়ের চেষ্টা করতে হবে, যেন কুরবানীর দায়িত্ব পালন করে যথাসময়ে কুরবানীর গোশত খাওয়া ও বণ্টন করা সম্ভব হয়।
ঈদুল আযহার অন্যতম ইবাদত “আযহা” বা কুরবানী আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ وَجَدَ سَعَةً لأَنْ يُضَحِّيَ فَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَحْضَرْ مُصَلاَنَا
“যার সাধ্য ছিল কুরবানী দেওয়ার, কিন্তু কুরবানী দিল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়।” ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।
উট, গরু বা মহিষ, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কুরবানী দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. সাধারণত কাটান দেওয়া বা খাসী করা পুরুষ মেষ, ভেড়া বা দুম্বা (ৎধস/সধষব ংযববঢ়) কুরবানী দিতেন:
إِنَّ النَّبِيَّ كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ اشْتَرَى كَبْشَيْنِ عَظِيمَيْنِ سَمِينَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مَوْجُوأَيْنِ فَيَذْبَحُ أَحَدَهُمَا عَنْ أُمَّتِهِ مِمَّنْ شَهِدَ بِالتَّوْحِيدِ وَشَهِدَ لَهُ بِالْبَلاغِ وَذَبَحَ الآخَرَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ
রাসূলুল্লাহ সা. যখন কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন দুটি বিশাল বড় সাইযের সুন্দর দেখতে খাসী করা বা কাটান দেওয়া পুরুষ মেষ বা ভেড়া ক্রয় করতেন। তাঁর উম্মাতের যারা তাওহীদের ও তাঁর রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে একটি কুরবানী করতেন এবং অন্যটি মুহাম্মাদ সা. ও মুহাম্মাদে সা.-এর পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।” আবূ দাউদ ৩/৯৫; ইবনু মাজাহ ২/১০৪৩; আহমদ, আল-মুসনাদ ৬/২২০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১। হাদীসটি হাসান।
এছাড়া তিনি গরু ও উট কুরবানীও দিয়েছেন। গরু ও উটের ক্ষেত্রে একটি পশুর মধ্যে সাত জন শরীক হওয়ার অনুমতি তিনি দিয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্যবান ভাল পশু কুরবানী দিতে উৎসাহ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে রোগা, অসুস্থ, খোড়া, কানা ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু কুরবানী দিতে নিষেধ করেছেন।
কুরবানীকারী হজ্জে না যেয়েও হজ্জের কর্ম পালনের অর্জনের সুযোগ পান। এজন্যই হাজীর অনুকরণে তাকে কুরবানীর আগে নখ-চুল কাটতে নিষেধ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلالَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ … حَتَّى يُضَحِّيَ
“যদি তোমাদের কেউ কুরবানীর নিয়্যাত করে তবে যুলহাজ্জ মাসের নতুন চাঁদ দেখার পরে সে যেন কুরবানী না দেওয়া পর্যন্ত তার চুল ও নখ স্পর্শ না করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫৬৫-১৫৬৬।
হজ্জ ও ঈদুল আযহার কুরবানী ইবরাহীম (আ)-এর কুরবানীর অনুসরণ। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে, খৃস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে ইরাকের “ঊর” নামক স্থানে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা, পরিবার, রাষ্ট্র ও সামজের সকলের বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মুখে তিনি তাওহীদের প্রচারে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ইরাক থেকে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। বৃদ্ধ বয়সের এ প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করতে আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
“অতঃপর যখন তার ছেলে তার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম বলল, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কি অভিমত? পুত্রটি বলল: হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পন করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাবীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ- স্বপ্নাদেশ পালন করেছ- এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান যবেহের বিনিময়ে।” সূরা সাফ্ফাত: ১০২-১০৭ আয়াত।
ইবরাহীম (আ) নবী ছিলেন। এজন্য তাঁর স্বপ্ন ছিল ওহী। স্বপ্নে তিনি দেখেছেন যে, তিনি পুত্রকে কুরবানী করছেন এবং তিনি এবং তাঁর কিশোর পুত্র উভয়েই এ নির্দেশ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনোই কোনোভাবে স্বপ্নের উপর নির্ভর করে শরীয়ত বিরোধী কিছু করতে পারেন না। অনেক সময় সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ স্বপ্নের মাধ্যমে শয়তান মানুষকে শিরক-কুফরের মধ্যে নিপতিত করে। সে স্বপ্ন দেখায়, অমুক মাযারে বা দরগায় মানত কর, ছেলের নাক বা কান ফুড়িয়ে দাও, অমুক দেবতার নামে শিরনী দাও ইত্যাদি। এমনকি যদি কেউ রাসূলুল্লাহ সা.-কে স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নের মধ্যে তিনি তাকে কোনো শরীয়ত বিরোধী কর্মের নির্দেশ দেন তবে সে তা করতে পারবে না। স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সা.-কে দেখলে তা সত্য; কারণ শয়তান তাঁর আকৃতি ধারণ করতে পারে না। তবে ঘুমন্ত অবস্থার শ্রবন ও দর্শন জাগ্রত অবস্থার কর্মের দলীল হবে না। রাসূলুল্লাহ সা. জাগ্রত অবস্থায় সাহাবীদের মাধ্যমে যে শরীয়ত দিয়েছেন ঘুমের মধ্যকার শ্রবণ দিয়ে তার বিরোধিতা করা যাবে না।
এখানে লক্ষ্য করুন! পিতা যখন পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন তখনই আল্লাহ ইবরাহীমকে (আ) বললেন, স্বপ্নাদেশ পালন করা হয়ে গিয়েছে। কারণ এখানে মূলকথা হলো মনের কুরবানী। ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ) মন থেকে আল্লাহর আদেশ মেনে নিয়েছেন। পিতা তাঁর মন থেকে ছেলের মায়া পরিপূর্ণরূপে কুরবানী করে দিয়ে ছেলেকে জবাই করতে প্রস্তুত হয়েছেন। পুত্র তাঁর মন থেকে পিতামাতা ও দুনিয়ার সকল মায়া কুরবানী দিয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁদের মনের এ কুরবানী ছিল নিখাদ। আর এজন্যই শায়িত করার সাথে সাথেই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, তার কুরবানী কবুল হয়ে গিয়েছে। আর এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতী দুম্বা দিয়ে কুরবানীর ব্যবস্থা করলেন।
প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানী আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আজকের প্রবন্ধে আমরা ঈদুল আযহা ও কুরবানীর বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। দুই পর্বের আলোচনার এটা প্রথম পর্ব।
যুলহাজ্জ মাসে ১০ তারিখে আমরা ঈদুল আযহার সালাত ও কুরবানী আদায় করি। ঈদ শব্দের অর্থ পুনরাগমণ। যে উৎসব বা পর্ব নির্ধারিত দিনে বা সময়ে প্রতি বৎসর ঘুরে ঘুরে আসে তাকে ঈদ বলা হয়। প্রতি সপ্তাহে জুমুআর দিনকে সপ্তাহিক ঈদ বলা হয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে বাৎসরিক ঈদ হিসেবে দুটি দিন দিয়েছেন: ঈদুল ফিতরের দিন এবং ঈদুল আযহা দিন। আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/২৯৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৪। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
ইসলাম সামাজিক আনন্দ ও উৎসবকে ইবাদত ও জনকল্যাণের সাথে সংযুক্ত করেছে। ঈদুল ফিতরের দিনে প্রথমে ফিতরা আদায়, এরপর সালাত আদায়এবং এরপর সামাজিক আনন্দ, উৎসব ও শরীয়ত সম্মত খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঈদুল আযহায় প্রথমে সালাত আদায়, এরপর কুরবানী করা ও গোশত বিতরণ করা এবং এরপর আনন্দ, খেলাধুলা বা বৈধ বিনোদনের নিয়ম করা হয়েছে। যেন আমাদের আনন্দ পাশবিকতায় বা স্বার্থপরতায় পরিণত না হয়।
ঈদ, কুরবানী, হজ্জ ইত্যাদি সমাজ ও রাষ্ট্র কতৃক পরিচালিত হতে হবে। কেউ কেউ অন্য দেশের চাঁদ দেখার উপর ঈদ করতে চান এবং এভাবে সমাজে বিভক্তি ও দলাদলি সৃষ্টি করেন, যা কঠিন হারাম ও অন্যায়। নিজের মতামত এমনকি নিজের চাঁদ দেখার ভিত্তিতেও রাষ্ট্র বা সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বিরোধিতা করা বৈধ নয়। হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো, চাঁদ দেখলেই ঈদ হয় না, রাষ্ট্র প্রশাসনের নিকট চাঁদ দেখা প্রমাণিত হতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ যে দিন ঈদ করবেন সেদিনেই ঈদ করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, এক্ষেত্রে ভুল হলেও ঈদ, হজ্জ, কুরবানী সবই আদায় হয়ে যাবে। ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।
এক্ষেত্রে ভুলের জন্য মুমিন কখনোই দায়ী হবেন না। এ বিষয়ক দলাদলি বন্ধ করে সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরী।
ঈদুল আযহার দিনে গোসল করা, যথাসাধ্য পরিস্কার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করা, এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জানি। ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে খালিপেটে সালাতুল ঈদ আদায় করতে যাওয়া সুন্নাত। সম্ভব হলে ঈদের সালাতের পরে দ্রুত কুরবানী করে কুরবানীর গোশত দিয়ে “ইফতার” করা বা ঈদের দিনের পানাহার শুরু করা ভাল।
রাসূলুল্লাহ সা. সাধারণভাবে সূর্যোদয়ের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ঈদের সালাত আদায় করতেন। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, ঈদুল ফিতরের সালাত তিনি একটু দেরী করে সূর্যোদয়ের ১ বা দেড় ঘন্টা পরে পড়তেন এবং ঈদুল আযহার সালাত একটু তাড়াতাড়ি সূর্যোদয়ের আধাঘন্টা থেকে একঘন্টার মধ্যে আদায় করতেন। আমাদেরও সুন্নাত সময়ে সালাতুল ঈদ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তবে প্রয়োজনে কিছু দেরী করা নিষিদ্ধ নয়। তবে সর্বাবস্থায় ঈদুল আযহার সালাত একটু আগে আাদয়ের চেষ্টা করতে হবে, যেন কুরবানীর দায়িত্ব পালন করে যথাসময়ে কুরবানীর গোশত খাওয়া ও বণ্টন করা সম্ভব হয়।
ঈদুল আযহার অন্যতম ইবাদত “আযহা” বা কুরবানী আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَنْ وَجَدَ سَعَةً لأَنْ يُضَحِّيَ فَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَحْضَرْ مُصَلاَنَا
“যার সাধ্য ছিল কুরবানী দেওয়ার, কিন্তু কুরবানী দিল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়।” ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।
উট, গরু বা মহিষ, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কুরবানী দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. সাধারণত কাটান দেওয়া বা খাসী করা পুরুষ মেষ, ভেড়া বা দুম্বা (ৎধস/সধষব ংযববঢ়) কুরবানী দিতেন:
إِنَّ النَّبِيَّ كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ اشْتَرَى كَبْشَيْنِ عَظِيمَيْنِ سَمِينَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ مَوْجُوأَيْنِ فَيَذْبَحُ أَحَدَهُمَا عَنْ أُمَّتِهِ مِمَّنْ شَهِدَ بِالتَّوْحِيدِ وَشَهِدَ لَهُ بِالْبَلاغِ وَذَبَحَ الآخَرَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ
রাসূলুল্লাহ সা. যখন কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন দুটি বিশাল বড় সাইযের সুন্দর দেখতে খাসী করা বা কাটান দেওয়া পুরুষ মেষ বা ভেড়া ক্রয় করতেন। তাঁর উম্মাতের যারা তাওহীদের ও তাঁর রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে একটি কুরবানী করতেন এবং অন্যটি মুহাম্মাদ সা. ও মুহাম্মাদে সা.-এর পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।” আবূ দাউদ ৩/৯৫; ইবনু মাজাহ ২/১০৪৩; আহমদ, আল-মুসনাদ ৬/২২০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১। হাদীসটি হাসান।
এছাড়া তিনি গরু ও উট কুরবানীও দিয়েছেন। গরু ও উটের ক্ষেত্রে একটি পশুর মধ্যে সাত জন শরীক হওয়ার অনুমতি তিনি দিয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্যবান ভাল পশু কুরবানী দিতে উৎসাহ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে রোগা, অসুস্থ, খোড়া, কানা ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু কুরবানী দিতে নিষেধ করেছেন।
কুরবানীকারী হজ্জে না যেয়েও হজ্জের কর্ম পালনের অর্জনের সুযোগ পান। এজন্যই হাজীর অনুকরণে তাকে কুরবানীর আগে নখ-চুল কাটতে নিষেধ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلالَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ … حَتَّى يُضَحِّيَ
“যদি তোমাদের কেউ কুরবানীর নিয়্যাত করে তবে যুলহাজ্জ মাসের নতুন চাঁদ দেখার পরে সে যেন কুরবানী না দেওয়া পর্যন্ত তার চুল ও নখ স্পর্শ না করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫৬৫-১৫৬৬।
হজ্জ ও ঈদুল আযহার কুরবানী ইবরাহীম (আ)-এর কুরবানীর অনুসরণ। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে, খৃস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে ইরাকের “ঊর” নামক স্থানে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা, পরিবার, রাষ্ট্র ও সামজের সকলের বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মুখে তিনি তাওহীদের প্রচারে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ইরাক থেকে ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। বৃদ্ধ বয়সের এ প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করতে আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
“অতঃপর যখন তার ছেলে তার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম বলল, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কি অভিমত? পুত্রটি বলল: হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পন করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাবীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ- স্বপ্নাদেশ পালন করেছ- এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান যবেহের বিনিময়ে।” সূরা সাফ্ফাত: ১০২-১০৭ আয়াত।
ইবরাহীম (আ) নবী ছিলেন। এজন্য তাঁর স্বপ্ন ছিল ওহী। স্বপ্নে তিনি দেখেছেন যে, তিনি পুত্রকে কুরবানী করছেন এবং তিনি এবং তাঁর কিশোর পুত্র উভয়েই এ নির্দেশ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনোই কোনোভাবে স্বপ্নের উপর নির্ভর করে শরীয়ত বিরোধী কিছু করতে পারেন না। অনেক সময় সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ স্বপ্নের মাধ্যমে শয়তান মানুষকে শিরক-কুফরের মধ্যে নিপতিত করে। সে স্বপ্ন দেখায়, অমুক মাযারে বা দরগায় মানত কর, ছেলের নাক বা কান ফুড়িয়ে দাও, অমুক দেবতার নামে শিরনী দাও ইত্যাদি। এমনকি যদি কেউ রাসূলুল্লাহ সা.-কে স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নের মধ্যে তিনি তাকে কোনো শরীয়ত বিরোধী কর্মের নির্দেশ দেন তবে সে তা করতে পারবে না। স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সা.-কে দেখলে তা সত্য; কারণ শয়তান তাঁর আকৃতি ধারণ করতে পারে না। তবে ঘুমন্ত অবস্থার শ্রবন ও দর্শন জাগ্রত অবস্থার কর্মের দলীল হবে না। রাসূলুল্লাহ সা. জাগ্রত অবস্থায় সাহাবীদের মাধ্যমে যে শরীয়ত দিয়েছেন ঘুমের মধ্যকার শ্রবণ দিয়ে তার বিরোধিতা করা যাবে না।
এখানে লক্ষ্য করুন! পিতা যখন পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন তখনই আল্লাহ ইবরাহীমকে (আ) বললেন, স্বপ্নাদেশ পালন করা হয়ে গিয়েছে। কারণ এখানে মূলকথা হলো মনের কুরবানী। ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ) মন থেকে আল্লাহর আদেশ মেনে নিয়েছেন। পিতা তাঁর মন থেকে ছেলের মায়া পরিপূর্ণরূপে কুরবানী করে দিয়ে ছেলেকে জবাই করতে প্রস্তুত হয়েছেন। পুত্র তাঁর মন থেকে পিতামাতা ও দুনিয়ার সকল মায়া কুরবানী দিয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁদের মনের এ কুরবানী ছিল নিখাদ। আর এজন্যই শায়িত করার সাথে সাথেই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, তার কুরবানী কবুল হয়ে গিয়েছে। আর এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতী দুম্বা দিয়ে কুরবানীর ব্যবস্থা করলেন।
Post a Comment