আমাদের দেশে সুন্নী দাবীদারের কোনো অভাব নেই। বিশেষতঃ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত একমাত্র মুক্তি প্রাপ্ত দল হিসাবে রাসুল (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার পর যুগে যুগে অনেক গোমরাহন্দল নিজেদেরকে এই দলভূক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মূলতঃ অনেক সাধারণ মুসলামানই জানেন না আহলুস সুন্নাহ তথা সুন্নী কারা?
আহলুস সুন্নাহ তাঁরাই যারা সুন্নাতের উপর আমল করে। যেমন খুশি তেমন আমল করা যাবে না। বিদআতে লিপ্ত এবং বিদআতের উৎসাহ দানকারী অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন বর্তমানে নিজেরদের খেয়াল-খুশিমতো আমল তৈরি করে নিয়েছে এবং তা সুন্নাত হিসেবে, ভালো কাজ হিসেবে চালিয়ে দিচেছ। এসব লোক রাসুল (স) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা) যা করেননি, তা ইবাদত ও নেক কাজ বলে যেমন গুরুত্ব সহকারে করে তেমনি যারা তাদের অনুকরণ করতে চায় না তাদেরকে নবীর শত্র“, রাসুলের শত্র“, ওয়াহবীর বাচ্চা, কাফির, ইয়াজিদের বংশধর ইত্যাদি গালি দেয়। রাসুল (স) ও সাহাবীগণের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলার পরও তারা নিজেদেরকে আশেকে রাসুল, মুর্শিদে বরহক, রাহবারে শরীয়াত ও তরীকাত, সুন্নী জামায়াতের নয়নের মণি ইত্যাদি উপাধিতে নির্লজ্জের মতো ভূষিত করে। যা অত্যান্ত হাস্যকর ও দুঃখজনক। তাকদীরকে অস্বীকার করার পরও যেমন কাদারিয়া ফেরকার লোকেরা কাদারী বলে পরিচয় দেয় তেমনি সুন্নাতের বিপরীত পথে চলা এবং সুন্নাতকে অস্বীকার করার পরও বর্তমানে কিছু লোক নিজেদেরকে সুন্নী হিসেবে পরিচয় দিয়ে সরলপ্রাণ প্রকৃত মুমিনদেরকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে নয়। মীলাদ-কিয়াম, জশনে জুলুস, আখেরী চাহার সম্বাহ ইত্যাদি নানা বিদআতী কর্মকান্ডকে সুন্নী হওয়ার মানদণ্ড হিসেবে হৃদয়গ্রাহী করে আবেগময় ভাষায় উপস্থাপন করে শ্রোতাসাধারণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত সুন্নত অনুসারীদেরকে গালি দিয়ে অকথ্য ভাষা প্রয়োগসহ ক্ষেত্র বিশেষে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার চেষ্টা চায়ায়, যা ঈমানবিরোধী কাজ। সাহাবী ও তাবেয়ীগণ যারা সুন্নাতের বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছেন, আমল করেছেন তেমনিভাবে যাঁরা পরস্পরায় সুন্নাতকে ধরে রেখেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত ধরে রাখবেন তারা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত হিসেবে সালফে সালেহীনদের সময় হতেই পরিচিত ছিলেন। যাঁরা বিদআত করেননি, দীনকে পরিবর্তন করেননি, আল্লাহর দীনে নতুন কিছু সংযোজন করেননি, রাসুলের হাদীস ও সাহাবীগণের আমল অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে তাঁরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। তাঁরাই কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁরা নানা অত্যাচারের শিকার হোন!
রাসুল (স)-এর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরার কারণে এবং সে অনুযায়ী আমল করার কারণে এবং সাহাবীগণের পূর্ণ অনুসরণ করায় তাঁদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত কোনো স্থান বা কালের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। কোনো এলাকায় তারা সংখ্যায় বেশি আবার কোনো এলাকায় কমও হতে পারে। কোনো যুগে তাদের সংখ্যা বাড়তে পারে আবার কোনো যুগে কমতেও পারে। কিন্তু কখনোই তাঁরা নিঃশেষ হয়ে যাবেন না।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য :
আললুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত হকপন্থি, সত্যবাদী, সুন্নাতের অনুসারী। তাঁদের ভিন্ন কোনো পরিচয়োর প্রয়োজন পড়ে না। তবে সালফে সালেহীন তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে, যা নিম্নরূপ
১. তারা আল্লাহর রজ্জুকে মযবুতভাবে আঁকড়ে ধরে। আবু বকর (রা) বলেন,
সুন্নাত হলো আল্লাহ্ তায়ালার মযবুত রশি। যে সুন্নাত বর্জন করল সে আল্লাহর সাথে তার রশি (সর্ম্পক) ছিন্ন করল।’
২. তাঁরা হকের উপর থাকেন এবং মানুষদেরকে সিরাতে মুস্তাকিম দেখান। যারা তাদের অনুসরণ করবে তারা দীন সর্ম্পকে বুঝতে পারবে, হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। ফুদাইল ইবনে আয়াজ বলেন,
‘আল্লাহর এমন অনেক বান্দাহ রয়েছেন, যাদের দ্বারা তিনি জনপদকে জীবিত করেন আর তারা সুন্নাতের অনুসারী।
ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি আল্লাহ্ তাআলার বাণী-
‘যেদিন কিছুসংখ্যাক চেহারা উজ্জ্বল এবং কিছু চেহারা কালো হবে। এর তাফরীসের বলেন,
‘যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং যাদের চেহারা কালো হবে তারা বিদয়াতী এবং গোমরাহ।
৩. তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত ব্যতীত অন্য নামে পরিচয় দেয় না। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, যারা নতুন (ফির্কা) নামে নিজেদেরকে নামকরণ করল (যেমন রাফেযী, খারেজী, মু’তাজীল, কাদিয়ানী, রেজভী, কাদরী ইত্যাদি) সে ইসলামের রজ্জুকে নিজের গলদেশ হতে সরিয়ে দিল।
ইমাম মালেক (র)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, জনাব! আহলুস সুন্নাহ কে? তিনি বললেন, যাদের পরিচয়ের জন্য কোনো লকব নেই (যেমন জাহমী, রাফেযী বা কাদরী) তারাই আহলুস সুন্নাহ।
৪. তারা বিদয়াত ও বিদয়াতকারী হতে লোকদেরকে বারণ করবে। ফুদাইল ইবনে আয়াজ বলেন, আমি উত্তম লোকদেরকে পেয়েছি তারা সবাই সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন। লোকদেরকে বেদয়াতীদের কাছ থেকে বিরত রাখতেন। আবু বকর ইবনে আইয়্যাশকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সুন্নী কে? তিনি বললেন,
যিদি গোমরাহগণের আকীদাকে গ্রহণ করেন না।
আইউব আস্ সাখতিয়ারী আমারাহ ইবনে জাসানকে বলেন, হে আমারাহ! কেউ যখন সুন্নাত এবং জামায়াতের অনুসারী হয় তখন তার অবস্থা সর্ম্পকে প্রশ্ন করবে না।
৫. তারা সংখ্যায় স্বল্প হবেন। মানুষের আকীদা-বিশ্বাস বিনষ্ট হয়ে গেলে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়ের অনুসারীগণ সংখ্যা নগণ্য হবেন। বেদয়াতী এবং গোমরাহ আকীদার লোকজনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। হাসান বসরী (র) বলেন,
‘আহলুস সুন্নাগণের যাঁরা ইন্তিকাল করেছেন তাঁরা সংখ্যায় কম ছিলেন এবং যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও সংখ্যায় কম। যারা গোমরাহ ও বেদয়াতী লোকদের দলভূক্ত হননি। বরং মৃত্যু পর্যন্ত সুন্নাতের উপর ধৈর্যধারণ করেছিলেন।'
সুফিয়ান ছাওরী বলেন, তুমি যদি জানতে পার যে, পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে একজন এবং পশ্চিম প্রান্তে একজন সুন্নাতের অনুসারী রয়েছে তাহলে তাদের উভয়কে সালাম পৌঁছিও এবং তাদের জন্য দু’আ করো, কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের (লোকজনের) সংখ্যা কতই না কম।
৬. কোনো মুসলমানকে কাফির সম্বোধন করবে না। গালি দেবে না, দীন ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ঝগড়া করবে না।
৭. গুনাহগার ও নেককার মুমিনের পেছনে নামায আদায় করবে।
৮. আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে; বাড়াবাড়ি কিংবা কমতি করা হতে বিরত থাকবে।
৯. কুরআন মুখস্থ করবে, বোঝার চেষ্টা করবে, সর্বোপরি তা বাস্তবায়নে প্রাণান্তকর চেষ্টা করবে। হাদীসের যথাযথ গুরুত্ব দেবে।
১০. সাহল ইবনে আবদুল্লাহ্ তসতরীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন লোক কখন বুঝতে পারবেন যে তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অর্ন্তভূক্ত? তিনি বললেন, যখন নিজের মধ্যে দশটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবে। জামায়াত পরিত্যাগ করবে না। নবী কারীম (স)-এর সাহাবীদের গালি দেবে না। উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে বের হবে না। কদর বা ভাগ্যকে অস্বীকার করবে না। ঈমানের বিষয়ে সন্দিহান হবে না। দীনকে নিয়ে ঝগড়া ও বড়াই করবে না। গুনাহ নিয়ে কোনো আহলে কিবলা ইন্তেকাল করলেও তারা জানাযা হতে বিরত থাকবে না। মোজার উপর মাসেহ করা বর্জন করবে না। ওয়ালী প্রশাসক চাই জালিম হোক বা ন্যায়পরায়ণ তার পেছনে নামায পড়া হতে বিরত থাকবে না।
১১। সুফিয়ান ইবনে উমাইনা বলেন, সুন্নাত হলো দশটি যার মধ্যে এই দশটি পাওয়া গেল সে সুন্নাতকে পূর্ণ করল। আর যে ব্যক্তি তা হতে কিছু বর্জন করল সে সুন্নাতকে পরিত্যাগ করল। তাকদীরে বিশ্বাস করা, (সাহাবাদের মধ্যে) আবু বকর ও ওমর (রা.)-কে প্রাধান্য দেওয়া, হাউজ, শাফায়াত, মীযান, সীরাত বিশ্বাস করা, ঈমান বলা ও আমল করার নাম, কুরআন আল্লাহর কালাম, আযাবুল কবর, কিয়ামতে পুনরুত্থান ইত্যাদি বিষয়ই হলো সুন্নাত।
১২। কুরআন ও হাদীসের মনগড়া অপব্যাখ্যা করবে না যেমন পূর্বে কাদারিয়া, মু’তাজিলা, শিয়া এবং বর্তমানে কাদিয়ানী, বাহায়ী, ইসমাঈলী ও আহমদ রেজা খানের অনুসারীগণ করে থাকে।
রাসুল (স)-এর সুন্নাত, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের পথ, পদ্ধতি ও আকীদা-বিশ্বাস যারা পোষণ করে এবং বিদআতকে পূর্ণাঙ্গরূপে বর্জন করে তারা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অর্ন্তভূক্ত।
আকাঈদের নতুন উদ্ভূত মাসয়ালায় যাদের ফায়সালা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট ব্যাখ্যায় অতি নিকটবর্তী এবং সালফে সালেহীন সাহাবী ও তাবেয়ীগণের ব্যাখ্যা ও ফতোয়ার সাথে অধিক সামাঞ্জস্যশীল বা অনুরূপ তারা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়ত হিসেবে গণ্য হবেন।
কাজেই যে ব্যক্তি যত বেশি নিখুঁতভাবে কুরআন-সুন্নাহ ও সাহাবীগণের পথ-পদ্ধতি অনুযায়ী আমল করবে, আকীদা পোষণ করবে সে ব্যক্তি তত মানসম্পন্ন সুন্নী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যথায় নামস্বর্বস্ব ও পোশাকী সুন্নী মুল্যহীন।
জাযাকাল্লাহ খাইরান ফা-ইন্নাল্লাহা শাকিরুণ
ReplyDeletePost a Comment