মাযহাবী আর লা-মাযহাবীদের মাঝামাঝি

ফিক্বহকে অধ্যয়ন করার দুটো পদ্ধতি।
প্রথম পদ্ধতিটি হলো, ফিক্বহের সাথে সম্পর্কিত ‘মূলপাঠ’(Text) নিয়ে পড়াশুনা করা, যেটিকে “ফাক্বীহদের পদ্ধতি” টেকনিকাল টার্মের আওতায় ফেলা যেতে পারে। যেমন ধরুন, হাম্বলী ফিক্বহের প্রাথমিক ধাপে থাকে ইব্‌ন কুদামাহ-র “উমদাহ্‌” কিংবা ইব্‌ন বাল্‌বান এর “আখছার আল-মুখ্‌তাছারাত” এর টেক্সট নিয়ে পড়াশুনা করা। তারপর দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে থাকে মূসা আল–হাজ্জাওয়ীর “যাদ্‌ আল-মুসতাক্ব্‌নি” অথবা মার’ঈ আল–কারামীর “দালীল আত্‌-ত্বালিব” এর মূলপাঠের অধ্যয়ন। এরপর তৃতীয় ধাপে গিয়ে হয় ইব্‌ন নাজ্জার আল ফুতূহীর “মুন্‌তাহা আল-ইদারাত” নয়তো মূসা আল–হাজ্জাওয়ীর “আল ইক্ব্‌না” পড়তে হয়। আর চতুর্থ ধাপে গিয়ে ইব্‌ন কুদামাহ-র “আল-কাফী” অথবা আল–মাজ্‌দ আব্দুস–সালাম ইব্‌ন তাইমিয়াহ আল–জাদ্দ্‌ এর “আল-মুহার্‌রার” এর মূলপাঠ অধ্যয়ন করতে হয়।

আর ঠিক এভাবেই, প্রতিটি মাযহাবেই ছাত্ররা সে মাযহাবের শায়খদের কাছে মাযহাব অনুসৃত সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশুনা করে ধাপে ধাপে উপরে ওঠে।

আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো, হাদীসের বইগুলো থেকে ফিক্‌হ অধ্যয়ন করা যাকে “মুহাদ্দীসদের পন্থা” টার্ম দেয়া যেতে পারে।
এখানে ছাত্ররা বিধি-বিধান (আহ্‌কাম) সংক্রান্ত যে হাদীসগুলো আছে সেগুলো নিয়ে পড়াশুনা করে থাকে। যেমন, আল–মাক্বদিসীর “উমদাতুল আহ্‌কাম” তারপরে ইব্‌ন হাজার এর “বুলূগুল মারাম” এরপরে ইব্‌ন ‘আব্দিল হাদীর “আল-মুহার‌্‌রার” তারপর ইব্‌ন তাইমিয়াহ আল–জাদ্দ্‌ এর “আল-মুন্‌তাক্বা” এবং এরপরে সাহীহাইন (বুখারী, মুসলিম) আর সুনান্‌ আল্‌-আরবা’আ (চার সুনান যথা: আত-তিরমীযী, নাসাঈ, আবূ দাঊদ, ইব্‌ন মাজাহ্‌) এর মতো হাদীসের বইগুলো ব্যাখ্যাসহ অধ্যয়ন করা।

প্রথম পদ্ধতিটির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এমন কিছু ফাক্বীহকে বের করে আনে যারা মাসাইল বা সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন এবং সেসবকে সাজাতে পারেন, ফিকহের সব শাখাকে ধারণ ও অনুশীলন করতে পারেন, ফিক্‌হবিদদের দুর্বোধ্য বর্ণনাগুলোকে দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করতে পারেন, এমনকি মাযহাবগুলোর বইপত্র ঘেঁটে নিজ থেকে গবেষণা করার সামর্থ্য অর্জন করেন। পাশাপাশি অন্যান্য স্কলারদের সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে সমস্যাগুলোকে বুঝতে ও চিত্রিত করতে পারেন।
.
আর এই সিস্টেমের কিছু সীমাবদ্ধতা হলো, সুন্নাহর উপর যথেষ্ট তথ্যানুসন্ধান এবং প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের নিমিত্তে এ সম্পর্কে প্রাপ্তির ঘাটতির ফলে ‘উলামাদের মাঝে গোঁড়ামীর এবং কোন রায় বা অভিমত এর ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকার উৎপত্তি হওয়া এবং ফলস্বররূপ নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান উদঘাটনের সামর্থ্য ক্ষীণ হয়ে আসা।

আর দ্বিতীয় সিস্টেমটির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো নির্দিষ্ট মতামতের ক্ষেত্রে কট্টরতা বা গোঁড়ামীর অনুপস্থিতি, সুন্নাহ্‌র প্রতি সম্মান প্রদর্শন, উলূম আল-হাদীস অধ্যয়নের ফলে সেসব প্রাপ্তির ব্যাপকতা। আর সেই সাথে হাদীসের রাবী (narrator), হাদীস সংশ্লিষ্ট উপকারিতা, শিষ্টাচার, আখ্‌লাক (নৈতিক চরিত্র) এবং সীরাহ্‌ সম্পর্কে অবহিত হওয়া।

আর এই সিস্টেমের কিছু সীমাবদ্ধতা: ফিক্‌হ কেবল সুন্নাহ (তথা হাদীস) এর মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এতে আহকামের আয়াত, ইজ্‌মা’ (2), ক্বিয়াস্‌ (3), মদীনাবাসীর ‘আমাল (কাজ), মাসালিহ্‌ মুর্‌সালাহ্‌ (4) ইত্যাদি ব্যাপারগুলো জড়ানো থাকে। ফলে দ্বিতীয় সিস্টেমের অধ্যয়নকারীরা এসব ফিক্‌হী বিভিন্ন শাখাগুলো প্রচুর মিস করে যান।

যেমন- “আয যাদ” বইয়ের (উপরে উল্লেখিত) মূলপাঠের (Text) মাসাইল এর সংখ্যার কথাই ধরুন। এটির মূলপাঠে মানতূক (5) মাস্‌আলার সংখ্যা ২৪০০ টি। আর মানতূক এবং মাফহূম (6) উভয়টি মিলিয়ে এর সংখ্যা ৬০০০ এ গিয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে আহকামের হাদীস সংবলিত যেসব বই বিদ্যমান সেসবের ফিক্‌হী মাস্‌আলা উপরে উল্লেখিত সংখ্যার এক চতুর্থাংশের সমানও পৌঁছোয় না। সেই সাথে এই সিস্টেম (অর্থাৎ দ্বিতীয়টি) অধ্যয়নের শুরুর দিকে ছাত্ররা প্রায়ই কনফিউজ্‌ড হয়ে যায়, পাশাপাশি ফাকীহ্‌দের উপর বাড়াবাড়ি এবং যোগ্যতাহীন ইজতিহাদ ও তারজীহ্‌ (একই বিষয়ে একাধিক হুক্‌ম বা বিধানের মধ্যে যেকোনো একটিকে অগ্রাধিকার দেয়া) এর দিকে ধাবিত হয়। পাশাপাশি প্রথম বিষয়টি পুরোপুরি শেষ হবার আগে দ্বিতীয় আরেক বিষয়ে লাফ দেয়ার দরুন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে হয়। যেহেতু প্রথম মাস্‌আলাটি কয়েকটি অধ্যায়জুড়ে বিন্যস্ত থাকে আর একটি কথার একাধিক হাদীসের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি হয়, যেগুলো কখনোই একটি স্থানে একত্রিত থাকে না।
.
এসমস্ত কারণে পরামর্শ হলো, দুটো পদ্ধতিকে সমন্বয় করে পড়াশুনা করা। অর্থাৎ একজন ছাত্র ফিক্‌হ নিয়ে পড়লে চার মাযহাবের যেকোনো একটি মাযহাবের উপর পড়াশোনা করবে, মাযহাব অনুসৃত সিলেবাস অনুযায়ী তার শায়খের নির্দেশনা নিয়ে। সেই সাথে আহকামের আয়াত ও আহকামের হাদীস সংবলিত বই পড়বে। আর খুব ভালো হয় যদি বই দুটো একই ফিকহী মাযহাবের দুজন লেখকের হয়ে থাকে, যাতে করে বৈপরীত্যে ঠাসা মাস্‌আলাগুলোর মাঝে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে না ফেলতে হয়।

চার মায্‌হাবের কোনো একটি মায্‌হাব ধরে সেটির সিলেবাস অনুযায়ী সে মায্‌হাবের শায়খের কাছে পড়াশোনার ব্যাপারটাকেই “মায্‌হাবিয়্যাহ্‌” বলা হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট মায্‌হাবের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি প্রথম পদ্ধতিতেই (ফাকীহ্‌দের পদ্ধতি) সীমাবদ্ধ থাকবে, আর যাদের সক্ষমতা আছে তারা দুটো পদ্ধতিকেই সমন্বয় করবে। আর “লা-মায্‌হাবিয়্যাহ্‌” সীমাবদ্ধ থাকবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতেই (মুহাদ্দিসদের পন্থা)।

কোনো একটা মায্‌হাবের সাথে সম্পৃক্ত থাকাটা উম্মাহ্‌র ফাকীহ্‌দের একটা রীতি। যেমন: ইব্‌ন তাইমিয়াহ্‌, ইব্‌নুল ক্বায়্যিম, ইব্‌ন ‘আব্দিল ওয়াহ্যাব ছিলেন হানাবিলা (হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী); ইব্‌ন কাসীর আর আয-যাহাবী ছিলেন শাফি’ইয়্যাহ্‌ (শা্ফেয়ী মাযহাবের অনুসারী); আত-ত্বহাউই ছিলেন হানাফিয়্যাহ্‌ (হানাফী মাযহাবের অনুসারী); ইব্‌ন ‘আব্দিল বার্‌ ছিলেন মালিকিয়্যাহ্‌ (মালেকী মাযহাবের অনুসারী)। আর এভাবে মাযহাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে, বরঞ্চ তারও আগে সাহাবীদের মধ্যে যারা ফাকীহ ছিলেন তাদের প্রত্যেকের এমন ছাত্র ছিল, যারা বিভিন্ন “ফিক্‌হী মাদ্‌রাসা” গঠন করেছিলেন, যেগুলো মূলত বিভিন্ন মাযহাবেরই মজ্জা তথা মূল অংশ ছিল।

আর একজন ছাত্রের মেধা এবং সাহসের মাত্রা যতই উঁচু হোক না কেন, সে সবকটি মাস্‌আলায় এমন মুজতাহিদ হতে পারবে না যিনি একাধারে হাদীসগত, ভাষাগত, ফিক্‌হসংক্রান্ত সর্বোপরি উসূলসংক্রান্ত সব প্রমাণাদির পড়াশুনা ধারণ করেন। অতএব সেক্ষেত্রে তার উচিৎ মাস্‌আলাগুলোতে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যমত মাযহাবের অনুসরণ করা; দালীল বা প্রমাণাদিগুলো সব সমান সমান হলে এবং একাধিক মতামতের মধ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কোনো মতামত উল্লেখ করা না থাকলে যে মাযহাবটি ছাত্রের জন্য অগ্রাধিকারদাতার ভূমিকা নেবে আর ছাত্র সেই মাযহাবের ইমামকেই অনুসরণ করবে।

সমকালীনদের মাঝে যারা মাযহাবী  আর তাকলিদকে এক হাত দেখে নেন, দিনশেষে গিয়ে তারা ইব্‌ন বায, ইব্‌ন ‘উসায়মীন, আলবানী (আল্লাহ তাঁদের উপর রহমত ঢেলে দিন) প্রমুখদেরই তাকলীদ করেন। তারা চার ইমামের অনুসরণ থেকে পালিয়ে বেড়ান আর ওনাদের বাদ দিয়ে অন্যদের অনুসরণ করেন ঠিকই।

যারা মাযহাব মানেন না তাদের আরেকটা সমস্যা হলো, তারা তাদের সাহচর্যে থাকা মানুষগুলোকে প্রচুর “অপ্রচলিত মত” গ্রহণের দিকে নিয়ে যান। আর “অপ্রচলিত মত” মানে হলো, সালাফ (পুর্ববর্তী) ফুকাহা কিংবা কোনো মাযহাবের ফাকীহ কর্তৃক বিচ্ছিন্ন ও অপ্রচলিত মত প্রদান করা।

পক্ষান্তরে, যারা মাযহাব অনুসরণ করেন তারা চার মাযহাবের যেকোনো একটির “নির্ভরযোগ্য মত” গ্রহণ করে থাকেন। আর কোনো একটি মাযহাবের “নির্ভরযোগ্য মত” কখনো “অপ্রচলিত মত” এ পর্যবসিত হয় না কারণ, প্রতিটি মাযহাব কেবল তার ইমামকেই অনুসরণ করে না বরং এমন প্রতিষ্ঠানের অনুসরণ করে থাকে যে প্রতিষ্ঠানের সাথে সময়ের হাত ধরে হাজার হাজার ফাকীহ সংযুক্ত থাকেন, যারা নির্দিষ্ট মতের উপর নির্ভর করেন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।

আল্লাহ সবাইকে বোঝার তাওফীক দিন।

লেখক: শায়খ ওয়ালীদ আল-মানীসী
ভাবানুবাদ: Shaikhul Abrar
সূত্র: IBANA WAY

_________
(2) ইজ্‌মা: আল্লাহ্‌র রাসূলের ( ﷺ ) যুগের পর যে কোনো যুগে কোন নির্দিষ্ট ফিক্‌হী বিষয়ের উপর মুজতাহিদ ইমামদের একমত পোষণ করাকেই ইজ্‌মা বলে। শার’ঈ দালীল হিসেবে কুরআন–সুন্নাহ্‌র পরে এর অবস্থান। ইজ্‌মা যে শারি’আর অন্যতম একটা দালীল এতে ‘উলামাদের ঐকমত্য তথা ইজ্‌মা রয়েছে।
.
দেখুনঃ উসূলুল ফিক্ব্‌হ , আবূ যাহ্‌রা, (মিসরঃ দারুল ফিক্‌র আল-‘আরাবী), পৃঃ ১৯৭–১৯৮।

(3) ক্বিয়াস: উসূল আল–ফিক্‌হের ‘উলামাদের সংজ্ঞানুযায়ী ক্বিয়াস হলো, কুরআন–সুন্নাহতে স্পষ্ট বিধান উল্লেখ আছে এমন একটা বিষয়ের আলোকে অন্য একটা বিষয়ের জন্য বিধান সাব্যস্ত করা যার উল্লেখ কুরআন–সুন্নাহ্‌তে নেই।
দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮।

(4) মাসালিহ্‌ মুর্‌সালাহ্: শারি’আহ্‌র মাক্বাসিদগুলোকে (যথাঃ দ্বীন, জীবন, ‘আকল [Intellect], বংশগতি, ধন–সম্পদ) সংরক্ষণ করাটাই হলো মাসালিহ্ মুর্‌সালাহ্।
দেখুনঃ
(a) প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৮।
(b) উসূলুল ফিক্ব্‌হিল ইস্‌লামী , ড.ওয়াহ্‌বাহ্‌ আয–যুহাইলী, (দামেশ্‌কঃ দারুল ফিক্‌র), খন্ডঃ২, পৃঃ ৭৫৬।

(5) মান্‌তূক: কোনো একটা বিষয়ের জন্য এমন বিধান সাব্যস্ত হওয়া যেটি নাস্‌ তথা কুরআন–সুন্নাহতে সরাসরি উল্লেখিত আছে।
দেখুনঃ উসূলুল ফিক্ব্‌হিল ইস্‌লামী , ড.ওয়াহ্‌বাহ্‌ আয–যুহাইলী, (দামেশ্‌কঃ দারুল ফিক্‌র), খন্ডঃ১, পৃঃ৩৬০।

(6) মাফ্‌হূম: কোনো একটা বিষয়ের জন্য এমন বিধান সাব্যস্ত হওয়া যেটি নাস্‌ তথা কুরআন–সুন্নাহতে সরাসরি উল্লেখিত নেই, কিন্তু আকার–ইঙ্গিতে উল্লেখিত থাকে।
দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬১।

Post a Comment

Previous Post Next Post