সুদ কি 'রিবা' নয় ?

কিছু বিষয় আছে যেগুলো যথেষ্ট পুরনো এবং মীমাংসিত। এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে কথা বলা এবং প্রসঙ্গ-উত্থাপন আমাদের রুচিতে ভালো লাগে না। এ যেন অনেকটা পুরনো কাসুন্দি নতুন করে ঘাঁটার মতো ব্যাপার। যেমন কিছু দিন আগে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সুদ ও রিবা বিষয়ক বক্তব্য। এ বিষয়ে আমাদের দিক থেকে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আলকাউসারের অনেক পাঠক এবং আমাদের কোনো কোনো শুভার্থী প্রসঙ্গটি নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ চেয়েছেন বলেই সেই পুরনো বিষয়টি নিয়েই নতুন করে কিছু বলা।

গত ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ইসলামী ব্যাংক বিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘সুদ ও রিবা’ ভিন্ন বলে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। ওই বিষয়ে পরদিনের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে তাঁর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ওই বক্তব্যের মূল অডিও-ভিডিও কিংবা লিখিত কপি আমাদের কাছে না থাকায় পত্রিকায় প্রকাশিত ওই বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি আগে তুলে দিচ্ছি।

‘ইসলামী ব্যাংকিং একান্তই একটি ফ্রড (প্রতারণা) ...
তিনি আরো বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংকিং বন্ধ হবে কি হবে না, তা মুসলিম উম্মাহর সচেতনতার ওপর নির্ভর করছে। মুসলিম উম্মাহ যখন বুঝতে পারবে ইসলামের নামে জঘন্য কাজ চলছে, তখনই এটি বন্ধ করা যাবে। তিনি বলেন, ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। কিন্তু রিবা ও সুদ এক নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। এখানে কোনো মানবিকতা নেই। সুদ হচ্ছে কস্ট অব ফান্ড (তহবিলের ব্যয়) বা কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (প্রশাসনিক খরচ)। ধর্ম নিয়ে যাঁরা বেশি কথা বলেন, তাঁরা সুদ আর রিবাকে এক করে ফেলেন।’ [প্রথম আলো/২ ফেব্রুয়ারি-১৫]

এছাড়াও অপর কোনো কোনো পত্রিকায় মূল বক্তব্য বা ভাব অক্ষুন্ন রেখেই আরো কিছু কথা ছাপা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে দুটি অংশ রয়েছে, যার প্রথমটি দাবি এবং দ্বিতীয়টি তার দৃষ্টিতে ঐ দাবির দলিল।
১. ইসলামী ব্যাংকিং ফ্রড এবং ইসলামের নামে চালুকৃত একটি জঘন্য প্রথা। ২. সুদ ও রিবা এক জিনিস নয়। ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ, সুদ নয়। অর্থাৎ তার ভাষায়  সুদ আর রিবা এক কথা নয়!! আজ আমরা তার বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ সুদ ও রিবা বিষয়ক কথা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করব। ইসলামী ব্যাংকিং এবং প্রচলিত ইসলামী ব্যাংক নিয়ে এ লেখায় আলোচনা হবে না।

একশ্রেণীর লোকের সুদ বিষয়ক এ ধারণাটি নতুন কিছু নয়। বহু বছর আগেই কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এ ধারণা আবিষ্কার করেছেন। তাছাড়া এ ধারণায় পৃথিবীর দু’চারজন মুসলিম স্কলারও প্রভাবিত হয়ে বিচ্ছিন্ন মত অবলম্বন করেছেন। তাদের এ বক্তব্য অযৌক্তিক, অবাস্তব ও ভ্রান্ত হওয়ায় পুরো মুসলিম বিশ্বের কোনো নির্ভরযোগ্য আলেম-ইসলামী গবেষক এটিকে সমর্থন করেননি। বরং কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার দলিল দিয়ে তা খণ্ডন করেছেন, এমনকি সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির নিরিখেও এর অসারতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

 তথাপি পুঁজিবাদী অর্থনীতির কোনো কোনো ধারক-বাহক তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই ভ্রান্ত মতটিকে জিইয়ে রেখেছেন এবং মাঝে মাঝে তারা সেটি নতুন করে প্রচার করে থাকেন।


তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি হল (অথচ সেটি একান্তই মনগড়া) তখনকার রিবার হার ছিল অনেক বেশি এবং বর্তমানে তার হার কম। একথার সপক্ষে তারা কুরআনে কারীমের সূরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতকে পেশ করে থাকে। যার তরজমা হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা দ্বিগুণ-বহুগুণে (আদআফাম-মুদাআফা) সুদ খেয়ো না।”
এ যেন اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ
(তরজমা) তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? (সূরা বাকারা ২ : ৮৫)-এর হুবহু নমুনা।
রিবা সংক্রান্ত কুরআন-হাদীসের অন্যান্য আয়াত ও হাদীসকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে সম্ভবত ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মুসলমানদের মধ্যে সুদের মতো জঘন্যতম হারামের প্রচলনের জন্যই এই পদ্ধতির অবতারণা করা হয়েছে। আসলে কুরআনে ন্যূনতম সুদকেও স্পষ্টভাবে হারাম করা হয়েছে। এই আয়াতে তো সুদের অতি বেশি ভয়াবহ একটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। যাতে সুদের হার হয়ে থাকে অনেক বেশি। কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলোও পড়ুন।

আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ ۚ وَ اِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ اَمْوَالِكُمْ ۚ لَا تَظْلِمُوْنَ وَ لَا تُظْلَمُوْنَ
(তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে অংশই অবশিষ্ট রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি তোমরা মুমিন হও।

যদি তোমরা  না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আর তোমরা যদি তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরাও কারো প্রতি যুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও যুলুম করা হবে না। -সূরা বাকারা ২ : ২৭৮-২৭৯

প্রথম আয়াতে (২৭৮) সুদের যে অংশ বকেয়া ছিল তা ছেড়ে দেওয়ার আদেশ করেছেন। আরো আদেশ করেছেন যে, যদি তোমরা মুমিন হও তবে এই আদেশ পালন করো।

পরবর্তী আয়াতে (২৭৯) বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা এই আদেশ পালন না কর তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। এরপর বলেছেন, যদি তোমরা এই হারাম থেকে তওবা কর তবে তোমরা নিজেদের মূলধনের অধিকারী হবে। যেন তোমাদের দ্বারা কারো প্রতি যুলুম না হয় এবং তোমরাও কারো জুলুমের শিকার না হও।

বোঝা গেল, কুরআন সামান্য সুদকেও হারাম করেছে এবং এটাকে জুলুম সাব্যস্ত করেছে যদিও তা হয় ০.০০১%। আর এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঋণের বিপরীতে মূলধনের অতিরিক্ত সামান্য পরিমাণও কুরআনের দৃষ্টিতে রিবা।

আর রিবার প্রসিদ্ধ আয়াত- وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا
(তরজমা : অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা ২:২৭৫) প্রায় সব মুসলমানেরই জানা। এই আয়াতেও কম-বেশির কোনো পার্থক্য ছাড়া সকল রিবা বা সুদকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য সহীহ হাদীস ও আছারে কম-বেশি, চক্রবৃদ্ধি-সরল নির্বিশেষে সব রকম রিবা বা সুদকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সুতরাং কম এবং বেশি পরিমাণের সাথে রিবা হওয়া না-হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং ঋণের অতিরিক্ত যাই কিছু হোক সেটি রিবার অন্তর্ভুক্ত। তা ইন্টারেস্ট, মুনাফা, লাভ, ফিনান্সিয়াল চার্জ অথবা সুদ যে নামেই ডাকা হোক।

সুদের অসারতা নিয়ে অসংখ্য প্রামাণিক কিতাবাদি যুগে যুগে লেখা হয়েছে। আমরা পত্রিকার এই ক্ষুদ্র পরিসরে এ প্রসঙ্গে সবিস্তার আলোচনার প্রয়োজন মনে করি না। শুধু একটি উদাহরণ পেশ করতে চাই। ব্যবসায়ী যখন ব্যাংক থেকে সুদী লোন নিয়ে ব্যবসায় লোকসান দেয় অথবা নিতান্তই কম পরিমাণে লাভ করে তখন কিন্তু ব্যাংক সে লোকসানের অংশীদার হয় না বা নিজের সুদের হারও কমিয়ে দেয় না। অর্থাৎ ঋণদাতা সর্বাবস্থায় সুদ নেয়াকে অনিবার্য মনে করে থাকে। ব্যাংগুলো তো এর উপরে অনেক ক্ষেত্রে আবার প্রসেসিং ফি নামেও মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকে। সুদ যদি হয়ে থাকে তাদের ভাষায় কস্ট অফ এডমিনিস্ট্রেশন তাহলে প্রসেসিং ফি’টা কী? সুদ যদি কস্ট (খরচ) হয়ে থাকে তাহলে কি ব্যাংকগুলো কখনো লাভ করে না? খরচ পরিমাণ টাকাই কি তবে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতা থেকে উঠিয়ে থাকে?

আমরা মুসলমানদের জন্য স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ইসলামে যে জিনিসগুলো হারাম তার মধ্যে সুদ নিকৃষ্টতম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-এর ভাষায় সুদগ্রহীতা, দাতা, এর লেখক ও সাক্ষীগণ সবাই অভিশপ্ত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮)

অতএব এ ধরনের কথায় বিভ্রান্তিতে না পড়ে সবারই কর্তব্য, নিজেদের ঈমান-আমলের হেফাযত করা।


তথ্যসূত্র: মাসিক আল কাউসার

Post a Comment

Previous Post Next Post