ইসলামী শরীয়তে সুদের বিধান


সুদের বিধান :

ইমাম নাববি রহ. বলেন, 'সুদ হারামের ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত; যদিও এর সংজ্ঞা ও মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।[৪৪] আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ হারামের ক্ষেত্রে ছয়টি জিনিসের নাম নির্দিষ্ট করেছেন। সেগুলো হলো, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর ও লবণ।

আসহাবে জাহিরি বলেছেন, এ ছয়টি জিনিসের বাইরে কোনো কিছুতে সুদ নেই। প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের সনাতন যে নীতি রয়েছে তারই ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।

আসহাবে জাহিরি বাদে অন্যরা বলেছেন, সুদ এ ছয়টি জিনিসেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ ছয়টির কারণের মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত সবগুলোর হুকুম অভিন্ন। তবে তারা মতবিরোধ করেছেন এ ছয় ধরনের জিনিসে বিদ্যমান হারাম হওয়ার ইল্লত বা কারণ নিয়ে।

ইমাম শাফেয়ি রহ. মনে করেন, সোনা এবং রুপায় 'ইল্লত' হলো এদুয়ের মূল্যমান। তাই পরিমাপযোগ্য ও অন্যান্য জিনিস এ দুয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে না ইল্লত অনুপস্থিত থাকার কারণে। আর বাকি চার জিনিসে ইল্লত হলো, এসবের খাদ্য জাতীয় হওয়া। এ জন্য প্রত্যেক খাদ্যদ্রব্যই সুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।

ইমাম মালেক রহ. সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তবে অবশিষ্ট চারটির ব্যাপারে বলেছেন এসবের মধ্যে ইল্লত হলো, এসবের সংরক্ষণ এবং খাবারযোগ্য হওয়া।

ইমাম আবু হানিফার রহ. মতে সোনা ও রুপার ইল্লত মওযুনি বা ওজনযোগ্য হওয়া আর বাকি চারটির ইল্লত মাকিলি বা (শস্যের) পরিমাপযোগ্য হওয়া। সুতরাং প্রত্যেক মাকিলি এবং মওযুনি বস্তুতেই সুদের এ বিধান প্রযোজ্য।

সাইদ বিন মুসাইয়াব এবং ইমাম আহমদ ও শাফেয়ির পুরাতন মতানুসারে চারটির ইল্লত হলো একই সঙ্গে ওজন ও খাদ্য জাতীয় হওয়া।[৪৫]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'সকল সাহাবি, তাবেয়ি এবং ইমাম চতুষ্টয় একমত যে, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর এবং আঙ্গুর সমগোত্রের সামগ্রীর বিনিময়ে কেবল সমান সমান বিক্রি জায়িয। কেননা কমবেশি করা অবৈধ সম্পদ ভক্ষণের নামান্তর।[৪৬]

উলামায়ে কিরাম একমত যে, রেবা জাতীয় দ্রব্যকে তার সমগোত্রীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রি বৈধ নয় যখন এক তরফে বাকি থাকে। তারা আরও একমত যে, একই গোত্রভুক্ত দ্রব্যকে নগদে কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা বিক্রির সময়। তেমনি তারা একমত যে, একই জাতীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রির সময় পণ্য হস্তগত করা পর্যন্ত ক্রয় মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা, খেজুরের পরিবর্তে খেজুর অথবা অন্য জাতীয় তবে একই ইল্লত বিশিষ্ট জিনিস যেমন- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং গমের বিনিময়ে যব। (এমন কেনাবেচার সময় হস্তগত হওয়ার আগে মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়।)[৪৭]

ইমাম ইবনে কুদামা সুদের বিধান সম্পর্কে বলেছেন, 'এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমার দ্বারা প্রমাণিত হারাম।[৪৮]

সারকথা, সোনা এবং রুপায় সুদের হুকুম বর্তানোর কারণ এর মূল্যমান সমৃদ্ধ হওয়া আর বাকি চারটি এ জন্যে যে পরিমাপ, ওজন ও ভক্ষণযোগ্য। যেমন-গম, যব, চাল ইত্যাদি। আর যা ওজন, মাপ বা ভক্ষণ কোনো জাতীয়ই নয় তদুপরি বিক্রি হয় অন্য জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে সেটাতে কোনো সুদ নেই। এমনটিই বলেছেন অধিকাংশ উলামা। যেমন-(আংটির) পাথর, (খেজুরের) বীচি ইত্যাদি।


যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে

(ক) কম-বেশি করা জায়িয যখন 'ইল্লত' অনুপস্থিত থাকবে :
ইমাম নাববি রহ. বলেন, আলেমগণ একমত যে, রেবা জাতীয় পণ্যকে রেবা জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে কমবেশি করে এবং বাকিতে বিক্রি করা বৈধ যদি উভয়ের ইল্লত ভিন্ন হয়। যেমন- গমের বিনিময়ে সোনা বিক্রি এবং যবের বদলে রুপা ইত্যাদি পরিমাপযোগ্য পণ্য বিক্রি। তেমনি জাত ভিন্ন হলে নগদে কমবেশি করে বেচা-কেনা জায়িয এ ব্যাপারেও তাঁরা একমত। যেমন- এক সা' গমের বিনিময়ে দুই সা' যব কেনা ইত্যাদি।[৬০]
(খ) অপরিমাপযোগ্য জিনিসের মাঝে কমবেশি করে বিক্রি জায়িয :
ফিকাহবিদগণ প্রাণীকে প্রাণীর বদলে বাকিতে বিক্রির বৈধতা সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন। অধিকাংশ উলামার মতে, এটা বৈধ। তাদের দলিল আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. এর হাদিস। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উটের পালের পিঠে আমাকে একটি সৈন্যদল পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। আমি লোকদের উটের পিঠে চড়ালাম। এক পর্যায়ে আমার উট শেষ হয়ে গেল। বাকি রয়ে গেল কয়েকজন- আমি তাদের বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি আমার পক্ষে কয়েকটি উট কেন সদকার উট দিয়ে আমি তা পরিশোধ করে দেব। যাতে এ দলটি পূর্ণ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ রা. বলেন, তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা মত আমি একেকটি উট কিনতে থাকি দুটি তিনটি করে উটের বিনিময়ে। এমনকি দল পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, যখন সদকার উট বাটোয়ারা শুরু হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিশোধ করে দিলেন।[৬১]

জাবের রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'একজন দাস এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হিজরতের বাইয়াত করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টের পান নি যে সে একজন গোলাম। পরে দাসের মুনিব এসে তাকে চাইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, একে আমার কাছে বিক্রি করে দাও। অতপর তিনি তাকে দুইজন হাবশি গোলামের বিনিময়ে কিনে নেন। পরবর্তীতে তিনি কাউকে বাইয়াত করতেন না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করেন (সে কারো দাস কি না)।[৬২]

এ থেকে বুঝা যায়, দুই গোলামের বিনিময়ে এক গোলাম বিক্রি করা জায়িয আছে। চাই এদের মূল্য একই রকম হোক বা ভিন্ন। এটা নগদ হলে সবাই এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রেও একই বিধান।[৬৩]

কেউ যদি এক গোলাম দুই গোলামের বিনিময়ে কিংবা এক উট দুই উটের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করে তাহলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুযায়ী তা বৈধ। এটাই ইমাম শাফেয়ি এবং জমহুরের মত।[৬৪]

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুসারে বাকিতে বা কমবেশি করে প্রাণীর বদলে প্রাণী বিক্রি করা জায়িয। কয়েকজন সাহাবি এবং তাবেয়ির বক্তব্যও প্রমাণ করে এমনটি। ইমাম বুখারি রহ. তদীয় সহি বুখারিতে বলেন-

১-ইবনে উমর রা. একটি সাওয়ারি প্রাণী খরিদ করেছেন নিজের জিম্মায় চারটি উটের দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি দিয়ে দিয়েছেন রাবাযা নামক স্থানে।
২-রাফে বিন খাদিজ রা. দুই উটের বিনিময়ে এক উট কেনেন। তাকে একটি উট দেন আর বলেন, অপরটা তোমাকে কাল দেব ইনশাআল্লাহ।
৩-ইবনে আব্বাস রা. বলেন, 'এক উট কখনো দুই উটের চেয়ে উত্তম হয়।'
৪-ইবনে মুসাইয়াব বলেন, বাকিতে এক উটের মোকাবেলায় দুই উট কিংবা এক ছাগলের বিনিময়ে দুই ছাগল বেচায় কোনো সুদ নেই।[৬৫]


মুসলমান মাত্রেই চায় শরিয়তের বিষয়গুলো দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে।
তাই সে ওয়াজিবগুলো পালন করে। হারাম এবং মাকরুহ বিষয়গুলো বর্জন করে। সচেষ্ট থাকে মুস্তাহাব কাজগুলো বেশি বেশি করতে। মুবাহ কাজগুলোর মধ্যে নিজ অবস্থা ও প্রয়োজন অনুপাতে কোনোটা করে আবার কোনোটা ছাড়ে। আর দূরে থাকে অস্পষ্ট এবং শংকাপূর্ণ কাজ থেকে। কারণ সে জানে অস্পষ্ট কাজগুলোই সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত করে।

নুমান বিন বাশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বলতে শুনেছি (এ কথা বলে তিনি আঙ্গুল দিয়ে নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করেন; অর্থাৎ নিজ কানে শুনেছি।)- 'নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট; এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয়াবলি- যা অধিকাংশ লোকই জানে না। সুতরাং যে অস্পষ্ট বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে তা তার সম্মান ও দীনদারি উভয়ের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে যে এতে পতিত হবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন- রাখাল সংরক্ষিত এলাকা থেকে সভয়ে দূরে থাকে যাতে সে এতে ঢুকে না পড়ে। মনে রেখ প্রত্যেক রাজারই কিছু সংরক্ষিত স্থান থাকে আরও মনে রেখ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা (যার সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ) হলো, তাঁর হারাম ঘোষিত বিষয়গুলি। তোমরা মনে রেখ, নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সারা দেহ সুস্থ আর সেটা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। মনে রেখ সেটা হলো কলব বা আত্মা।'[৭৩]

ইমাম নাববি রহ. বলেন, 'এ হাদিসের সীমাহীন গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের ব্যাপারে আলেমগণ একমত। এটি সে হাদিসসমূহের অন্যতম যেগুলোর ওপর শরিয়তের ভিত্তি। একদল আলেম বলেছেন, হাদিসটি ইসলামের এক তৃতীয়াংশ। অপর দুই তৃতীয়াংশের একটি 'নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল'[৭৪] এবং মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হলো, সে অনর্থক কাজ পরিহার করবে শীর্ষক হাদিস।[৭৫]

ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন, পুরো ইসলাম চারটি হাদিসকে ঘিরে আবর্তিত। উল্লেখিত তিনটি এবং 'তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে নিজের জন্য যা করে'[৭৬] শীর্ষক হাদিস। কেউ বলেছেন, চতুর্থ হাদিসটি হলো, তুমি দুনিয়ার ব্যাপারে বিরাগ হও আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন আর মানুষের হাতে যা রয়েছে তা থেকে বিরাগ হও লোকে তোমাকে ভালোবাসবে।[৭৭]

উলামায়ে কিরাম বলেন, (নুমান বিন বাশির রা. বর্ণিত) হাদিসটি অবর্ণনীয় গুরুত্বের দাবিদার এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে বস্ত্র, আহার্য ও পানীয়সহ মৌলিক সবকিছু সংশোধন করার কথা বলেছেন। তাগিদ দিয়েছেন অস্পষ্ট বিষয় থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার প্রতি। কারণ তা ধার্মিকতা ও সম্মান রক্ষায় সহায়ক। সতর্ক করেছেন সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে। উপরন্তু বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছেন সংরক্ষিত স্থানের চমৎকার এক দৃষ্টান্ত পেশ করে। অবশেষে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হলো, আত্মার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাঁর কথা, আত্মা শুদ্ধ থাকলে সারা দেহ ঠিক এর ব্যতিক্রম হলে পুরো দেহে সমস্যা দেখা দিবে।


_________
[৪৪]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৫]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৬]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া : ২০/৩৪৭, আশ শারহুল কাবির : ১২/১১, শরহুয যারাখশি : ৩/৪১৪
[৪৭]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৮]. আল মুগনি : ৬/৫১
[৬০]. শারহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৬১]. মুসনাদে আহমদ : ২/২১৬, আবু দাউদ : ৩৩৫৭
[৬২]. মুসলিম : ১৬০২, শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৩]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৪]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৫]. চারটি হাদিসই দেখুন ফাতহুল বারি : ৪/৪১৯
[৭৩]. বুখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯
[৭৪]. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭
[৭৫]. মুয়াত্তা মালেক : ৩/৯০৩
[৭৬]. বুখারি : ১৩, মুসলিম : ৪৫
[৭৭]. ইবনে মাজাহ : ৪১০২, ইমাম নাববি বলেন, ইবনে মাজা র. এ হাদিসটি হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। শরহুন নাববি ১১/২৮

Post a Comment

Previous Post Next Post