মুখোশ উন্মোচন: পর্ব-১ [পশ্চিমা সভ্যতা বনাম ইসলাম]


আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড নিজেদেরকে দাবী করে এক মহান সভ্যতার ধারক হিসেবে। দেশীয় নাস্তিক-মুক্তমনা-শাহবাগী, কথিত প্রগতিশীল-সুশীল গোষ্ঠীও তোতা পাখির মতো ফিরিঙ্গি প্রভুদের কথাগুলোর নিরন্তর পুনরাবৃত্তি করে যায়। ঘুরেফিরে, ইনিয়েবিনিয়ে, ছলে-বলে-কৌশলে, শুধু গরু রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্রের মতো যে কোন আলোচনায়, যে কোন বিষয়ে তারা প্রমান করার চেষ্টা করে ইসলামী শরীয়া কতোটা খারাপ, কতোটা বর্বর, কতোটা “মধ্যযুগীয়”। আর উদারনৈতিক গণতন্ত্রের [Liberal Democracy] আদর্শে গড়ে ওঠা আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতাকে তারা উপস্থাপন করে এক মহান, মানবিক এবং অবশ্য অনুসরনীয় সভ্যতা হিসেবে।

.
যার অন্যতম ফিচার গনতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা আর নারীদের সমান অধিকার। পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের তোড়জোড়ের অভাব নেই। war on terror এর নামে তারা মুসলিম দেশ গুলোতে আক্রমণ করতে দুইবার চিন্তা করে না। মুসলিম নারীদের জন্য তাদের মায়াকান্নার শেষ নেই। তারা বলে মুসলিমরা নারীদেরকে বোরখার আড়ালে রেখে,নারীদেরকে ঘরে বন্দী করে রেখে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, তাদেরকে এক অদৃশ্য দাসত্বের শিকলে বেঁধে রেখেছে। তারা মুসলিম নারীদেরকে বোরখার আড়াল থেকে বের করে এনে, শরীয়া আইনের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেংগে ফেলে তাদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দিতে চায় ।
.
অথচ তাদের দেশেই তারা নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়ে নারীদেরকে পন্য বানিয়ে ফেলেছে। তারাই পর্ণ ইন্ড্রাস্টী বানিয়েছে, তারাই সেখানে নারীদের সাথে পশুর মতো আচরণ করছে। বাসায়, স্কুলে, কলেজে, রাস্তাঘাটে, অফিসে, হাসপাতালে , সেনাবাহিনীতে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। সবখানেই নারীরা চরম ভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আমাদের এই সিরিজে আমরা চেষ্টা করব এই পাশ্চাত্য সভ্যতার ভন্ডামী আপনাদের সামনে তুলে ধরার। আমরা চেষ্টা করব সেই সব হতভাগ্য বোনদের বুকফাটা হাহাকার গুলো আপনাদের কাছে পৌঁছে দেবার যারা এই তথাকথিত আধুনিক, মক্তমনা, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সমাজের দ্বারা ভয়ংকর যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ।
.
“আমেরিকান আর্মির মহিলা সদস্যরা শত্রুদের নিয়ে ততোটা বেশী শংকিত থাকে না, যতটা বেশী শঙ্কিত থাকে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের হাতে যৌন নিপীড়িত হবার ভয়ে ......।”
.
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই এই কথা গুলো বললেন ডোরা হারনান্দেজ যিনি প্রায় দশ বছরেরও বেশী সময় ধরে কাজ করেছেন আমেরিকান নেভী এবং আর্মি ন্যাশনাল গার্ড এ। ডোরা হারনান্দেজ সহ আরো কয়েকজন প্রবীণ ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছিল যারা আমেরিকার সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন অনেক বছর , ইরাক এবং আফগানিস্থান যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। এই ফ্রন্টগুলোতে কোনমতে তারা সারভাইভ করতে পেরেছেন কিন্তু পুরো কর্মজীবন জুড়ে তাদেরকে আরোও একটি যুদ্ধ করতে হয়েছে নীরবে-এবং সেই যুদ্ধে তারা প্রতিনিয়তই পরাজিত হয়েছেন। তাদের সেই নীরব যুদ্ধ ধর্ষণের বিরুদ্ধে ।
.
পেন্টাগনের নিজেস্ব রিসার্চ থেকেই বের হয়ে এসেছে যে আমেরিকান সামরিক বাহিণীর প্রতি চার জন মহিলা সদস্যের একজন তাদের ক্যারিয়ার জুড়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
.
ডোরা হারনান্দেজ থেমে যাবার পর মুখ খুললেন সাবিনা র‍্যাংগেল , টেক্সাসে, এলপাসোর অদূরে তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমে বসেই আমাদের কথা হচ্ছিল, “ আমি যখন আর্মির বুট ক্যাম্পে ছিলাম তখন আমি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম এবং যখন নেভীতে গেলাম তখন একেবারে ধর্ষণের শিকার হলাম”।
.
জেমি লিভিংস্টোন ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে কাজ করেছেন ইউ.এস নেভীতে। তিনি বললেন, আমি জানতাম ইউ এস আর্মির কালচারটাই এমন যে সৈনিক এবং অফিসাররা রেপ করাকে তাদের অধিকার মনে করে। তাই আমি রেপের ঘটনা গুলো চেপে যেতাম আর আমার বসই আমাকে রেপ করত, কাজেই আমি কাকে রিপোর্ট করব?
.
ভদ্রমহিলাগন একে একে আমেরিকান আর্মিতে তাঁদের উপর করা যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো বলে চলছিলেন। তারা কেউই পূর্ব পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু আমেরিকান আর্মিতে নিজেদের সহকর্মী এবং বসদের হাতে তাঁরা যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতাই তাদেরকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। হৃদয়ের সবকটা জানালা খুলে দিয়ে তাঁরা একজন অপরজনের দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছিলেন।
.
পেন্টাগনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে (২০১০ সাল,) ইউ এস আর্মিতে প্রতি বছর উনিশ হাজারের মতো যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। (২০১১ সালে এটার পরিমাণ ছিল ছাব্বিশ হাজার)ইউ এস আর্মির মহিলা সদস্যরা আমেরিকার বেসামরিক মহিলাদের থেকে অধিক মাত্রায় যৌন নির্যাতনের ঝুকিতে থাকে। পেন্টাগনের Sexual Assault Prevention and Response office এর প্রধান গ্যারী প্যাটন বলেন, আমাদের অবশ্যই এই কালচারটা পরিবর্তন করতে হবে। যৌন নির্যাতনকে স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে মেনে নিলে চলবে না। ভিক্টিমের ইউনিটের সবাইকে যৌন নির্যাতনের ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
.
সাবিনা র‍্যাংগেল হাইস্কুল শেষ করেই আর্মিতে জোগদান করেছিলেন। তার ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আর্মির বুট ক্যাম্পে একদিন ট্রেনিং করার সময় তার ড্রিল সার্জেন্ট এর দ্বারা। সাবিনা র‍্যাংগেল প্রথমে ভেবেছিলেন তার সার্জেন্ট বোধহয় তাকে ড্রিল করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছেন, কিন্তু আসলে সার্জেন্ট তার শরীরের স্পর্শ কাতর জায়গাগুলোতে হাত বুলানোর চেষ্টা করছিলেন।
.
সাবিনা র‍্যাংগেল বুট ক্যাম্প শেষ করার পর আর আর্মি ছেড়ে চলে আসেন। যৌন নির্যাতনের ঘটনা চেপে যান সবার কাছ থেকে ।
.
পেন্টাগনের পরিসংখ্যান অনুসারে মাত্র ১৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়। বাকী ৮৬ শতাংশ ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। অনেক ভিক্টিম অভিযোগ করেন তার নির্যাতনকারী তার চেয়ে উচু র‍্যাংকের। অনেকে অভিযোগ করেন যৌন নির্যাতনের শিকার হলে যেই কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট করতে হবে, সেই সব কর্মকর্তাই আমাকে যৌন নির্যাতন করেছে। র‍্যাংগেলের ক্ষেত্রেও এইরকমটা হয়েছিল ।
.
র‍্যাংগেল ২০০০ সালের দিকে আবার ইউ এস সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। এইবার তিনি নেভীতে। এল পাসোতে ইউ এস নেভীর একটা ঘাঁটিতে তিনি কাজ করার দায়িত্ব পান।
.
একবার তার বেতনের চেকে কিছুটা সমস্যা হলে তিনি তাঁর কমান্ডার এক সার্জেন্ট মেজরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন । সেই সার্জেন্ট মেজর তাঁকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। তবে তিনি র‍্যাংগেলকে এই প্রস্তাবও দিলেন, “ তুমি যদি আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা কর তাহলে, আমি তোমাকে খুশি করে দিব”।
.
র‍্যাংগেল এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই সার্জেন্ট মেজর এতে একটুকুও না দমে র‍্যাংগেলকে বিছানায় যাবার প্রস্তাব দিতেই থাকলেন।
.
আমি যখন তার অফিসে গেলাম তখন আর কোন উপায় না পেয়ে তার পি.এস (যিনি নিজেও একজন মহিলা) কে বললাম , যখন বস আমাকে ডাকবে এবং আমি যাবার পর ভেতর থেকে দরজা লক করে দিবে, প্লীজ আপনি এই সময়টাতে একটু পর পর দরজায় নক করবেন। তিনি কিছুটা ক্লান্তস্বরে উত্তর দিলেন , “সাবিনা! শুধু তোমার সাথেই না, বস সবার সাথেই এরকম করে ...।
.
আমরা অনেক সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন বা আছেন এমন অনেক অনেক মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি, যারা সবাই একটা ব্যাপারে একমত হয়েছেন – ইউ.এস সামরিক বাহিনীর পুরুষরা, সামরিক বাহিনীর নারীদের ধর্ষণ করাকে তাদের অধিকার মনে করে। সামরিক বাহিনীতে তো একটা কৌতুক প্রচলিতই আছে – পুরুষ সহকর্মী বা অফিসারদের হাতে ধর্ষিত হওয়া নারী অফিসার বা সৈন্যদের পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
.
সাবিনা র‍্যাংগেল একবার এক মিশনের দায়িত্ব পেলেন। সেই মিশনেও এই সার্জেন্ট মেজর ছিলেন । এই সার্জেন্ট মেজর আর একজন সার্জেন্ট মেজরকে নিয়ে সাবিনা র‍্যাংগেল কে ধর্ষণ করতে থাকেন।
.
সাবিনা র‍্যাংগেল বিভিন্ন সময় তার কমান্ডারদের (যাদের মধ্যে একজন মহিলা কমান্ডারও ছিলেন) তার ধর্ষিত হবার ঘটনা জানালে , তারা কোন পদক্ষেপ না নিয়ে সাবিনাকে ঘটনা গুলো চেপে যেতে বললেন। এমনকি কোন কোন অফিসার তাঁকে এই ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে উত্যক্ত করত ।
.
সাবিনা র‍্যাংগেল আস্তে আস্তে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সামরিক বাহিনী ছেড়ে চলে যাবার - ব্যস অনেক হয়েছে আর এই পাশবিক নির্যাতন সহ্য করা যাবে না। তিনি জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন । ধর্ষিত হবার দুঃসহ স্মৃতি গুলো তাঁকে সারাক্ষন তাড়া করে বেড়াতে লাগলো। আত্মহত্যার চেষ্টাও করলেন কয়েকবার......
.
সৌদি আরবে অপরাধ করার কারণে নারীদের দোররা মারলে আমেরিকার মিডিয়াতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে, মুসলিমদের তুলোধুনো করে দেওয়া হয়, নারীবাদীরা মায়া কান্না কাঁদে, নাস্তিক-মুক্তমনারা হই চই শুরু করে দেয় – মুসলিমরা বর্বর, মধ্যযুগীয়, মুসলিমরা নারী স্বাধীনতার বিরোধী ব্লা ব্লা ব্লা...
.
অথচ তাদের নিজেদের দেশে, তাদের স্বপ্নের পসচিমের আর্মিতেই যে ভয়াবহ নারী নির্যাতন হয় সে ব্যাপারে তারা চুপ। কোথায় তাদের মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কোথায় নারী স্বাধীনতা ?
.
#ডাবলস্ট্যান্ডার্ড
===================================
তথ্যসূত্রঃ
=====================================
উৎস: লস্ট মডেস্টি ব্লগ
লস্ট মডেস্টি ব্লগের আর্টিকেলের লিঙ্কঃ http://lostmodesty.blogspot.com/2015/06/blog-post_17.html
প্রবন্ধের কপিরাইট © লস্ট মডেস্টি ব্লগ
পুনঃপ্রকাশ, লস্ট মডেস্টি ব্লগ অনুমোদিত

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ shottokothon.com  এবং response-to-anti-islam.com

ফেসবুক পেজঃ fb.com/shottokothon1

Post a Comment

Previous Post Next Post