মুসলমানদের কোরবানি ঈদ এবং একজন আরজ আলি মাতব্বরের অযাচিত মাতবরি!


পদ্মার বুক চিরে আমাদের লঞ্চ চলছে।
দু’পাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।সাধারণত, লঞ্চগুলোর মাথার উপর বিশাল সাইজের একটি ছাউনি থাকে।কিন্তু আমাদের লঞ্চটির উপরিভাগ খালি। কোন ছাউনি নেই।
আকাশটা একদম উদোম। উপরে তারা-নক্ষত্র ভর্তি সুবিশাল আকাশ, নিচে আছে স্রোতস্বিনী পদ্মা।
চাঁদের প্রতিফলিত আলোতে নদীর পানি ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য!
আমরা যাচ্ছি রসুলপুর গ্রামে। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম।
সাজিদের অনুরোধ, এবারের কোরবানির ঈদটা তার সাথে তাদের বাড়িতে করতে হবে। তাই যাওয়া।
তাছাড়া, যখন শুনলাম পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থল এর উপর দিয়ে যাওয়া হবে, তখন আর লোভ সামলানো গেলো না। আমি এর আগে কখনো এই নদীদুটোকে স্বচক্ষে দেখিনি। তাই বিনা অজুহাতে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
লঞ্চে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ। আমি, সাজিদ এবং একজন লঞ্চ চালক। মধ্যবয়স্ক এই লোকটার নাম মহব্বত আলি। যারা নৌকা চালায় তাদের মাঝি বলা হয়। যারা জাহাজ চালায় তাদের বলে নাবিক। যারা লঞ্চ চালায় তাদের কি বলে? আমি জানি না।
মহব্বত আলি নামের এই লোক লঞ্চের এক মাথায় জড়োসড়ো হয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। মাঝিদের মতো তার বৈঠা চালানোর চিন্তা নেই। তেলের ইঞ্জিন।
আমি আর সাজিদ লঞ্চের একেবারে মাঝখানে বসে আছি। একটি চাদর পাতা হয়েছে।সাথে আছে পানির বোতল, চিনা বাদাম, ভাজা মুড়ি।
মাথার উপরে আকাশ।
হঠাৎ করে আমার তখন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে গেলো।আমি সাজিদকে প্রশ্ন করলাম,- ‘তুই কি মানিক দার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়েছিস?’
সাজিদ বললো,- ‘হু’।
আমিও কতোবার পড়েছি এই উপন্যাস। সব চরিত্রগুলোর নাম আমার ঠিক মনে নেই।তবে, উপন্যাসের নায়কের বউটা ল্যাঙরা ছিলো এবং নায়কের সাথে তার শ্যালিকার প্রেম ছিলো, এই ঘটনাগুলো আবছা আবছা মনে করতে পারি।
সাজিদ আমাকে বললো,- ‘হঠাৎ উপন্যাসে চলে গেলি কেনো?’
– ‘না, এমনি।’
এইটুক বলে দু’জনে খানিক্ষন চুপচাপ ছিলাম।এরপর আমি জিজ্ঞেস করলাম,- ‘আচ্ছা, অই উপন্যাসের কোন চরিত্রটি তোর কাছে সবচে ইণ্টারেষ্টিং লেগেছে?’
আমি ভাবলাম, সাজিদ হয় উপন্যাসের নায়ক কিংবা নায়কের শ্যালিকার কথাই বলবে। কিন্তু সাজিদ বললো,- ‘ অই উপন্যাসে ইণ্টারেষ্টিং ক্যারেক্টার আছে কেবল একটিই। সেটি হলো হোসেন মিয়া।’
আমি খানিকটা অবাক হলাম। অবাক হলাম কারন, সাজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও ভাবেনি। কতো আগে পড়া একটি উপন্যাস থেকে সে এমন একটি ক্যারেক্টারের নাম বলেছে, যেটি উপন্যাসটির কোন মূল চরিত্রের মধ্যেই পড়েনা।হোসেন মিয়া নামে এই উপন্যাসে কোন চরিত্র আছে, সেটিই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম,- ‘হোসেন মিয়া? নায়কটা নয় কেনো?’
সাজিদ বললো,- ‘কুবের মাঝির মতো কতো শতো মাঝি পদ্মাপাড়ে অহরহ দেখা যায়, যাদের ঘরে মালার মতো একটি খোঁড়া পা ওয়ালা, কিংবা অন্ধ স্ত্রী আছে, আছে তিন চারটে করে পেটুক সন্তান। আছে কপিলার মতো সুন্দরি শ্যালিকা। তাদের মাঝেও পরকীয়া আছে, দৈহিক সম্পর্ক আছে।
কিন্তু হোসেন মিয়া? হোসেন মিয়ার মতো কোন চরিত্র আছে এই পদ্মাপাড়ে? যে কিনা নিজের মতো করে একটি দ্বীপ সাজিয়ে তুলে, সেখানে মানুষজনকে বিনা পয়সায় থাকতে দেয়? আছে? কি বাস্তবে, কি সাহিত্যে……………’
আমি আরো একবার সাজিদের সাহিত্য জ্ঞান দেখে বিমুগ্ধ হলাম। সে এমনভাবে চরিত্রগুলোর নামধাম বলে গেলো, যেন সে এইমাত্র উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছে।
আমরা রসুলপুরে পৌঁছাই ভোর সাড়ে চার’টে তে। তখন কিছু কিছু জায়গায় ফজরের আজান পড়ছে।যেখানে নেমেছি, সেখান থেকে বেশকিছু পথ হাঁটতে হবে।
খানিকটা হেঁটে একটা মাটির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম, এটা মসজিদ।ভেতরে একটি কুপি বাতি মিটমিট করে জ্বলছে।
ব্যাগপত্র রেখে দু’জনে ওজূ করে নিলাম। মসজিদে মানুষও আমরা তিনজন। আজব! তিন সংখ্যাটা দেখি একদম পিঁছু ছাড়ছেনা।লঞ্চেও ছিলাম তিনজন। মসজিদে এসেও দেখি আমরা তিনজন।
নামাজ শেষ হয়েছে একটু আগে। আমরা বসে আছি মসজিদের বারান্দায়।আরেকটু আলো ফুঁটলে বেরিয়ে পড়বো। ঈমাম সাহেব আমাদের পাশে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছেন। মাঝারি বয়স। দাঁড়িতে মেহেদি লাগিয়েছেন বলে দাঁড়িগুলো লালচে দেখাচ্ছে। উনি সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করছেন। ‘ফাবি আইয়্যি আলা-য়্যি রাব্বিকুমা তুকাযযিবান’ অংশটিতে এসে খুব সুন্দর করে টান দিচ্ছেন। পরান জুড়ানিয়া।
আর রাহমান তিলাওয়াত করে উনি কোরআন শরীফ বন্ধ করলেন। বন্ধ করে কোরআন শরীফে দুটি চুমু খেলেন।এরপর সেটাকে একবার কপালে আর একবার বুকে লাগিয়ে একটি কাপড় দিয়ে পেঁছিয়ে একটা কাঠের তাকে তুলে রাখলেন।
আমরা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। লোকটা আমাদের দিকে ফিরে বললেন,- “আমনেরা কি শহর হইতে আইছেন?”
সাজিদ বললো,- ‘জ্বি।’
-“আমনেরা কি লেহাপড়া করেন?”
সাজিদ আবার বললো,- ‘জ্বি।’
-“মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। আমনেরা শহরে পইড়্যাও বিগড়াইয়া যান নাই। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।”
লোকটার কথা আমি ঠিক বুঝিনি। সাজিদ বুঝেছে। সে জিজ্ঞেস করলো,- ‘চাচা, শহরে পড়াশুনা করলে বিগড়িয়ে যায়, আপনাকে কে বললো?’
লোকটা হঠাৎ গম্ভীরমুখ করে বললেন,- ‘হেইয়া আবার কেডায় কইবে বাপ! মোর ঘরেই তো জন্মাইছে একখান সাক্ষাৎ ইবলিশ।’
– ‘কি রকম?’- সাজিদের প্রশ্ন।
– ‘মোর এক্কুয়াই পোলা। পড়ালেহা করতে পাডাইল্যাম ঢাকার শহরে। হেইনে যাইয়া কি যে পড়ালেহা করসে! এহন কয়,
আল্লা-বিল্লা কইয়া বোলে কিস্যু নাই। এই যে, এহন তো বাড়ি আইছে। আইয়া কইতেয়াছে কি বোঝঝেন, কয় বোলে কোরবানি দিয়া মোরা ধর্মের নামে পশুহত্যা হরি। এইগুলা বোলে ধর্মের নাম ভাইঙ্গা খাওনের ধান্দা হরি মোরা। কিরপিক্যা যে এইডারে ঢাকায় পড়তে পাডাইল্যাম বাপ! হালুডি হরাইলে আইজ এই দিন দেহা লাগতে না!”
লোকটার সব কথা আমি বুঝতে পারিনি। তবে, এইটুকু বুঝেছি যে, লোকটার ছেলে ঢাকায় পড়ালেখা করতে এসে নাস্তিক হয়ে গেছে।
সাজিদ বললো,- ‘আপনার ছেলে এখন বাড়িতে আছে?’
– ‘হ’
সাজিদ আমার দিকে ফিরে বললো, – ‘দেখেছিস, পদ্মার বুকেও কিন্তু নাস্তিকদের বসবাস আছে। হা হা হা।’
সিদ্ধান্ত হলো ছেলেটার সাথে দেখা করে যাবো।
সকাল ন’টায় ছেলেটার সাথে আমাদের দেখা হলো।বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হবে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ছেলেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ছে। ফাষ্ট ইয়ারে। নাম- মোঃ রফিক।
সাজিদ রফিক নামের ছেলেটার কাছে জিজ্ঞেস করলো,- ‘কোরবানি নিয়ে তোমার প্রশ্ন কি?’
ছেলেটা বললো,- ‘এইটা একটা কু-প্রথা। এভাবে পশু হত্যা করে উৎসব করার কোন মানে হয়?’
সাজিদ বললো,- ‘তুমি কি বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু জানো?’
ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বললো,- ‘আপনি কি আমাকে বিজ্ঞান শিখাচ্ছেন নাকি? ইণ্টারমিডিয়েট লেভেল পর্যন্ত আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম।’
সাজিদ বললো,- ‘তা বেশ। খাদ্যশৃঙখল সম্পর্কে নিশ্চই জানো?’
– ‘জানি। জানবো না কেনো?’
– ‘খাদ্যশৃঙখল হলো, প্রকৃতিতে উদ্ভিদ আর প্রাণীর মধ্যকার একটি খাদ্যজাল। যেসব উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করে নেয়, তাদের বলা হয় উৎপাদক। এই উৎপাদককে বা সবুজ উদ্ভিদকে যারা খায়, তারা হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর খাদক…….’
ছেলেটা বললো,- ‘মশাই, এসব আমি জানি। আপনার আসল কথা বলুন।’
ছেলেটার কথার মধ্যে কোনরকম আঞ্চলিকতার টান নেই।তাই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছেনা।
পাশ থেকে ছেলেটার বাবা বলে উঠলেন,- ‘এ, হেরা বয়সে কোলং তোর চাইয়া বড় অইবে! মান-ইজ্জত দিয়া কথা কইতে পারোনা?’
ছেলেটা তার বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে পড়াশুনা জানা ছেলের মূর্খ বাবার প্রতি অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট।
সাজিদ বললো,- ‘বেশ। তোমাদের গরু আছে?’
– ‘আছে।’
– কয়টা?’
ছেলেটার বাবা বললেন,- ‘হ বাপ, মোগো গরু আছে পাঁচখান। দুইডা গাই, এক্কুয়া ষাঁড় গরু। লগে আবার বাছুরও আছে দুইডা!
– ‘আচ্ছা রফিক, ধরো- তোমাদের যে দুটি গাভি আছে, তারা এইবছর দুটি করে বাচ্চা দিলো। তাহলে তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা হবে ৯ টি।ধরো, তোমরা পশু হত্যায় বিশ্বাসী নও।তাই, তোমরা গরুগুলো বিক্রিও করো না। কারন, তোমরা জানো, বিক্রি হলেই গরুগুলো কোথাও না কোথাও কোরবানি হবেই।ধরো, এরপরের বছর গরুগুলো আরো দুটি করে বাচ্চা দিলো।মোট গরু তখন ১৩ টি। এরপরের বছর দেখা গেলো, বাচুরগুলোর মধ্য থেকে দুটি গাভি হয়ে উঠলো, যারা বাচ্চা দিবে।এখন মোট গাভির সংখ্যা ৪ টি। ধরো, ৪ টি গাভিই এরপরের বছর আরো দুটি করে বাচ্চা দিলো।তাহলে, সে বছর তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা কতো দাঁড়ালো?’
ছেলেটির বাবা আঙুলে হিসাব কষে বললেন,- ‘হ, ১৯টা অইবে!’
সাজিদ বললো,- ‘বলোতো রফিক, ১৯ টা গরু রাখার মতো জায়গা তোমাদের আছে কিনা? ১৯ টা গরুকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য, পর্যাপ্ত ভূষি, খৈল, ঘাস আছে কিনা তোমাদের?’
– ‘না’- ছেলেটা বললো।
– ‘তাহলে, আল্টিমেইটলি তোমাদের কিছু গরু বিক্রি করে দিতে হবে। এদের যারা কিনবে তারা তো গরু কিনে গুদামে ভরবে না, তাই না? তারা গরুগুলোকে জবাই করে মাংশ বিক্রি করবে। গরুর মাংশ আমিষের চাহিদা পূরণ করবে,আর চামড়াগুলো শিল্পের কাজে লাগবে, তাই না?’
– ‘হুম’
– ‘এটা হলো প্রকৃতির ব্যালেন্স। তাহলে,প্রকৃতির ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য পশুগুলোকে জবাই করতেই হচ্ছে।সেটা এমনি হোক, অথবা কোরবানে।’
ছেলেটা বললো,- ‘সেটা নিয়ে তো আপত্তি নেই।আপত্তি হচ্ছে, এটাকে ঘিরে উৎসব হবে কেনো?’
সাজিদ বললো,- ‘বেশ! উৎসব বলতে তুমি হয়তো মিন করছো, যেখানে নাচ-গান হয়, ফূর্তি হয়, আড্ডা,ড্রিংকস হয়। মিছিল হয়, শোভাযাত্রা হয়, তাই না? কিন্তু দেখো, মুসলমানদের এই উৎসব সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নাচ-গান নেই,আড্ডা-মাস্তি নেই।ড্রিংক’স নেই, মিছিল-শোভাযাত্রা নেই।আছে ত্যাগ আর তাকওয়ার পরীক্ষা।আছে, অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা-তদবির।সমাজ থেকে শ্রেণী বৈষম্য দূর করে, ধনী-গরীব সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। এরকম উৎসবে সম্ভবত কার্ল মার্ক্সেরও দ্বিমত থাকার কথা না। কার্ল মার্ক্স কে চিনো?’
ছেলেটা এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলো।তারপর বললো,- ‘আরজ আলি মাতুব্বরকে চিনেন আপনি?’
সাজিদ বললো,- ‘হ্যাঁ, চিনি তো।’
– ‘কোরবানি নিয়ে উনার কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন আছে।’
– ‘কি প্রশ্ন, বলো?’
ছেলেটা প্রথম প্রশ্নটি বললো। সেটি ছিলো-
‘আল্লাহ ইব্রাহীমের কাছে তার সবচাইতে প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, ইব্রাহীমের কাছে সবচাইতে প্রিয় বস্তু তার ছেলে ইসমাঈল না হয়ে তার নিজ প্রান কেন হলো না?’
সাজিদ মুচকি হেসে বললো,- ‘খুবই লজিক্যাল প্রশ্ন বটে।
আমি যদি আরজ আলি মাতুব্বরের সাক্ষাৎ পেতাম, তাহলে জিজ্ঞেস করতাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে, তাদের কাছে তাদের নিজের প্রাণের চেয়ে দেশটা কেনো বেশি প্রিয় হলো? কেন দেশ রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণটাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিলো?
দুটো জিনিসই সেইম ব্যাপার। ইব্রাহিমের কাছে নিজের চেয়েও প্রিয় ছিলো পুত্রের প্রাণ, আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিজের চেয়ে প্রিয় ছিলো নিজের মাতৃভূমি।
কিন্তু, পরীক্ষার ধরন ছিলো আলাদা। ইব্রাহিমকে বলা হলো, প্রিয় জিনিস কুরবানি করতে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হলো- প্রিয় জিনিস রক্ষা করতে।কিন্তু, আমরা দেখতে পেলাম – দু দলের কারো কাছেই প্রিয় বস্তু নিজের প্রাণ নয়।
সুতরাং, আরজ আলি মাতুব্বরের মাতব্বরিটা এইখানে ভুল প্রমানিত হলো।’
ছেলেটা কাঁচুমাচু করে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো।
আরজ আলি মাতুব্বর বলেছেন,- ‘আল্লাহ পরীক্ষাটা করেছেন ইব্রাহিমকে।ইব্রাহিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই পরীক্ষাটা কেন তার অনুসারীদের দিতে হবে?’
সাজিদ বললো,- ‘এইটাও খুব ভালো প্রশ্ন। আমরা মুহাম্মদ সাঃ কে অনুসরন করি। তাহলে, আমরা কি বলতে পারি যে,- কই, আমাদের উপর তো জিব্রাঈল আঃ ওহী নিয়া কখনোই আসে নাই। তাহলে, মুহাম্মদের উপরে আসা ওহি আমরা কেনো মানতে যাবো? বলো, প্রশ্নটা কি আমরা করতে পারি?’
ছেলেটা চুপ করে আছে। সাজিদ বললো,- ‘আরজ আলি মাতুব্বরের Leader & Leadership বিষয়ে আদতে কোন জ্ঞানই ছিলো না। তাই তিনি এইরকম প্রশ্ন করে নিজেকে সক্রেটিস বানাতে চেয়েছিলেন।’
ছেলেটা তার তৃতীয় প্রশ্ন করলো-
‘আরজ আলি মাতুব্বর বলেছেন,- নবী ইব্রাহিমকে তো কেবল পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করা সংক্রান্ত পরীক্ষায়ই দিতে হয়নি, অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবার মতো কঠিন পরীক্ষাও তাকে দিতে হয়েছিলো। তাহলে, মুসলমানরা ইব্রাহিমের স্মৃতি ধরে রাখতে পশু কোরবানি করলেও, ইব্রাহিমের আরেকটি পরীক্ষা মতে- মুসলমানরা নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে না কেনো?’
আরজ আলি মাতুব্বরের আগের প্রশ্নগুলো আমার কাছে শিশুসুলভ মনে হলেও, এই প্রশ্নটিকে অনেক ম্যাচিউর মনে হলো। আসলেই তো। দুইটাই ইব্রাহীম আঃ এর জন্য পরীক্ষা ছিলো। তাহলে, একটি পরীক্ষার স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা যদি পশু কোরবানি করি, তাহলে নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করি না কেনো?
পদ্মা থেকে সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস আসতে শুরু করেছে।
সাজিদ বললো,- ‘রফিক, তার আগে তুমি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কি শেখ মুজিবকে ভালোবাসো? তার আদর্শকে?’
ছেলেটা বললো,- ‘অবশ্যই। তিনি না হলে তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকতো না। তিনি আমাদের জাতির পিতা।’
– ‘তুমি ঠিক বলেছো। শেখ মুজিব না হলে বাংলাদেশ হয়তো কোনদিন স্বাধীনই হতো না। সে যাহোক, শেখ মুজিবকে জীবনে দুটি বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো।
প্রথমে, একটা দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে সামনে থেকে নের্তৃত্ব দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, স্বপরিবারে খুন হওয়া। আমি কি ঠিক বললাম রফিক?’
– ‘হু’
– ‘এখন, তুমি শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারন করো। তুমি ৭১ এর চেতনায় নিজেকে বলিয়ান ভাবো। তুমি ৭ ই মার্চে বিশাল মিছিলে যোগদান করো। ১৬ ই ডিসেম্বরে সভা-সমাবেশে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে শ্লোগান দাও। কিন্তু, ১৫- ই আগষ্টে রাস্তায় বেরিয়ে কোনদিন বলেছো- হে মেজর ডালিমের বংশধর, হে খন্দকার মোস্তাকের বংশধর, তোমরা কে কোথায় আছো, এসো- আমাকেও মুজিবের মতো স্বপরিবারে খুন করো’, বলো কি?’
আমি সাজিদের কথা শুনে হো হো হো করে হাসা শুরু করলাম। ছেলেটার মুখ তখন একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সাজিদ আবার বলতে শুরু করলো,- ‘তুমি এটা বলো না।শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারন করে এরকম কেউই এটা বলেনা। যদি কেউ এরকম বলে, তাহলে তাকে মানুষে বলবে,- ‘কি ব্যাপার? লোকটাকে কি ভাদ্র মাসের কুকুরে কামড়িয়েছে নাকি?’
সাজিদের কথা শুনে এবার রফিকের বাবাও হা হা হা করে হাসতে লাগলো। ছেলেকে পরাজিত হতে দেখে পৃথিবীর কোন বাবা এত খুশি হতে পারে, এই দৃশ্য না দেখলে বুঝতামই না।
আমরা রসুলপুরের পথে হাঁটা ধরলাম।পদ্মাপাড়ের জনবসতিগুলো দেখতে একেবারে ছবির মতো। নিজেকে তখন আমার হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের বাসিন্দা মনে হচ্ছিলো। আর সাজিদ? তাকে আপনারা আপাতত হোসেন মিয়া রূপেই ভাবতে পারেন।

=====================================
লেখকঃ আরিফ আজাদ

আরো পড়ুন এখানে

রিলেটেড সার্চ: কোরবানি ঈদ ,পশুহত্যা, অমানবিক।

Post a Comment

Previous Post Next Post