মানুষ জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামে যাবে তা তো আগে থেকেই তাকদিরে লেখা; তাহলে মানুষের অপরাধ কী? যারা অমুসলিম পরিবারে জন্মায় তাদের কি দোষ? যাদের কাছে কখনো ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি তাদের কী হবে?


#নাস্তিক_প্রশ্ন : মানুষ জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামে যাবে, তা তো আগে থেকেই তাকদিরে লেখা। আর এর ব্যতিক্রমও ঘটবে না। আল্লাহর হুকুম ছাড়া নাকি কোনো গাছের পাতাও পড়ে না; পৃথিবীর সব অপরাধ তো তাহলে আল্লাহর হুকুমেই হয়। অমুসলিমরা অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আর মুসলিমরা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। কেউ যদি হিন্দু বা নাস্তিক হওয়ার জন্য জাহান্নামে যায়—এটা তো সেই ব্যক্তির দোষ না। এটা সৃষ্টিকর্তারই দোষ।
.
ওয়েবসাইট থেকে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানেঃ http://response-to-anti-islam.com/…/তাকদির-আগে-থেকে-নির্…/41
.
#উত্তর : আরবি ‘তাকদির’ (تقدير) শব্দটি ‘কদর’ (قدر) শব্দের সাথে সম্পর্কিত। শাব্দিকভাবে ‘কদর’ এর অর্থ : পরিমাপ, পরিমাণ, মর্যাদা, শক্তি। আর ‘তাকদির’ এর অর্থ : পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা, সীমা নির্ণয় করা ইত্যাদি। [১] তাকদির হচ্ছে, সর্বজ্ঞানী হিসাবে আল্লাহ তা’আলার পূর্ব জ্ঞান ও হিকমতের দাবি অনুযায়ী সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য সবকিছু নির্ধারণ। [২]
আল-কুরআন আমাদের জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুর ব্যাপারে জানেন। বলা হয়েছে :
.
❏ “আকাশসমূহ এবং পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়াদির জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে রয়েছে।...” [আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬ : ৭৭]

❏ “তুমি কি জানো না, আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন? এ সব বিষয় একটি কিতাবে সংরক্ষিত আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।” [আল-কুরআন, সুরা হাজ, ২২ : ৭০]
❏ “আর তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা-কিছু আছে—সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। কোনো গাছের এমন কোনো পাতা ঝরে না—যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনো শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনো জিনিস নেই—যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই।” [আল-কুরআন, সুরা আন‘আম, ৬ : ৫৯]
❏ “এগুলো অদৃশ্যের খবর, যা ওহীর মাধ্যমে আমি তোমার [মুহাম্মাদ (ﷺ)] কাছে প্রেরণ করি। তুমি তাদের কাছে ছিলে না, যখন তারা ষড়যন্ত্র করে নিজেদের সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিল।” [আল-কুরআন, সুরা ইউসুফ, ১২ : ১০২]
❏ “তিনিই সেই সত্তা, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন যথোচিত। যেদিন তিনি বলবেন, ‘হয়ে যাও!’ তখন হয়ে যাবে। তাঁর কথা সত্য। যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার করা হবে, সেদিন আধিপত্য হবে তাঁরই। তিনি অদৃশ্য বিষয়ে এবং প্রত্যক্ষ বিষয়ে জ্ঞাত। তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।”[আল-কুরআন, সুরা আন‘আম, ৬ : ৭৩]
❏ “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না, কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।” [আল-কুরআন, সুরা লুকমান, ৩১ : ৩৪]
❏ “তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।” [আল-কুরআন, সুরা তাগাবুন, ৬৪ : ১৮]
.
➽ পৃথিবীর সব অপরাধ কি আল্লাহর হুকুমেই হয়?
হুকুম মানে নির্দেশ। আল্লাহ তা’আলা কখনোই অপরাধ বা খারাপ কাজের নির্দেশ দেন না। আল্লাহ বলেন :
.
❏ “... আল্লাহ মন্দ কাজের আদেশ দেন না। তোমরা এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ করো, যা তোমরা জানো না?” [আল-কুরআন, সুরা আ’রাফ, ৭ : ২৮]
.
আল্লাহ তা’আলা সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। পাপ কিংবা পুণ্য মানুষের সকল কর্মও আল্লাহর সৃষ্টি। পৃথিবীতে যা ঘটে এবং মানুষ যা করে, এগুলোর সবগুলোই আল্লাহর অনুমতিক্রমে বা ইচ্ছায় হয়।
আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ২ প্রকারের। [৩] যথা :
১। কাউনিয়্যাহ
২। শারইয়্যাহ
.
১। কাউনিয়্যাহ : এ ধরনের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হয়। তবে জিনিসটি আল্লাহ তা’আলার কাছে পছন্দনীয় হওয়া জরুরি নয়। আর এটা দ্বারাই ‘মাশিয়াত’ বা ইচ্ছা বোঝানো হয়। যেমন, আল্লাহ তা’আলা বলেন :
❏ “...আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা পরস্পর লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।” [আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ, ২ : ২৫৩]
২। শারইয়্যাহ : এ ধরনের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত জিনিস বা বিষয়টি তাঁর পছন্দনীয়। আর এটা দ্বারাই ‘মাহাব্বাত’ বা পছন্দ বোঝানো হয়। যেমন, আল্লাহ তা’আলা বলেন :
❏ “আর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিতে চান।... ” [আল-কুরআন, সুরা নিসা, ৪ : ২৭]
.
● উদাহরণ :
আবু বকর (রা.) এর ঈমান আনা : এই ঘটনাটি একই সাথে আল্লাহর কাউনিয়্যাহ ও শারইয়্যাহ ইচ্ছার উদাহরণ। এটি কাউনিয়্যাহ ইচ্ছা এ জন্য যে, এটি সংঘটিত হয়েছিল। শারইয়্যাহ ইচ্ছা এই জন্য যে, এটি আল্লাহর পছন্দনীয় ছিল।
.
আবার ফিরআউনের কুফরী : এটি শুধু আল্লাহর কাউনিয়্যাহ ইচ্ছার উদাহরণ। এটি কাউনিয়্যাহ ইচ্ছা এই কারণে যে, এটি সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এটি শারইয়্যাহ ইচ্ছা নয় কেননা এর পেছনে আল্লাহর কোনো অনুমোদন বা সন্তুষ্টি ছিল না। আল্লাহ মুসা (আ.)কে তার নিকট ঈমানের দাওয়াত দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। [৪]
.
আল্লাহ মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন যাকাত আদায় করার, তিনি মানুষকে চুরি করতে নিষেধ করেছেন। এ নির্দেশগুলো পালন করা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। মানুষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যা দ্বারা সে এ আদেশগুলো মানতেও পারে আবার ভঙ্গও করতে পারে। মানুষ যদি নিজ ইচ্ছাশক্তি দ্বারা যাকাত আদায় না করে কিংবা চুরি করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে জোর করে যাকাত আদায় করতে বাধ্য করেন না কিংবা চুরি করা আটকে দেন না; যদিও আল্লাহর এ ক্ষমতা আছে, পরিপূর্ণরূপেই আছে। মানুষ যদি যাকাত আদায় না করে কিংবা যদি চুরি করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তা হতে দেন। কিন্তু এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি নেই।
.
যেহেতু মানুষের সকল কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি, কাজেই পুণ্যের সাথে সাথে পাপও আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে হয়। তবে তা কেবল এ অর্থে যে, আল্লাহ এগুলোকে (পাপ) নির্ধারিত করেছেন; এ অর্থে নয় যে, আল্লাহ এগুলো অনুমোদন করেন বা আদেশ দেন। পৃথিবীতে যত খারাপ কাজ বা অপরাধ সংঘটিত হয়, এগুলোর ওপর আল্লাহ তা’আলার কোনো সন্তুষ্টি নেই। আল্লাহ এগুলো ঘৃণা করেন, অপছন্দ করেন এবং এগুলো থেকে বিরত হবার আদেশ দেন। [৫]
.
পৃথিবীতে যত অপরাধ সংঘটিত হয়, এগুলোর ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি না থাকা সত্ত্বেও কেন আল্লাহ এগুলো সংঘটিত হতে দেন এর উত্তরে বলা যেতে পারে : কুফর যদি না থাকত, তাহলে মু’মিন ও কাফির আলাদা করা যেত না বরং সবাই মু’মিন হতো। [৬] একই ভাবে, পাপ যদি না থাকতো, তাহলে পুণ্য বলে কিছু থাকতো না, সৎকর্ম ও মহত্ত্বেরও কোনো মানে থাকতো না। যদি অশুভ শক্তি না থাকতো, তাহলে শুভ ও কল্যাণকর জিনিসের কোনো মূল্য থাকতো না। অন্ধকার আছে বলেই আলোর গুরুত্ব আছে। পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা বা নৃশংসতা না থাকলে মানবতারও কোনো আলাদা অস্তিত্ব বা অর্থ থাকতো না। কাজেই পৃথিবীতে অন্যায়, পাপ ইত্যাদির অস্তিত্ত্বও আল্লাহর সৃষ্টির অসামান্য হিকমতের পরিচায়ক।
.
এ ব্যাপারে একটি কবিতা খুবই প্রাসঙ্গিক :
“আলো বলে, “অন্ধকার তুই বড় কালো,”
অন্ধকার বলে, “ভাই তাই তুমি আলো।” ”
.
➽ মানুষের কর্ম তার পরিণতির কারণঃ
কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা এটি সাব্যস্ত হয়েছে : মানুষ যে কর্ম করবে ঠিক সে অনুযায়ী প্রতিদান পাবে। মানুষের প্রতিদান নির্ধারিত হবে তার কর্মের ভিত্তিতে।
.
❏ “নিশ্চয়ই আমি [আল্লাহ] মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।” [আল-কুরআন, সুরা বালাদ ৯০:৪]
❏ “সেখানে প্রত্যেকে যাচাই করে নিতে পারবে, যা-কিছু সে ইতিপূর্বে করেছিল এবং তাদেরকে আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তিত করা হবে, যিনি তাদের প্রকৃত মালিক, আর যেসব মিথ্যা উপাস্য তারা বানিয়ে রেখেছিলো, তারা সবাই তাদের থেকে দূরে সরে যাবে।” [আল-কুরআন, সুরা ইউনুস, ১০ : ৩০]
❏ “আর নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক প্রত্যেককেই তাদের আমলের প্রতিফল অবশ্যই পুরোপুরি দান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের যাবতীয় কার্যকলাপের খবর রাখেন।.....“আর ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পুণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” [আল-কুরআন, সুরা হুদ, ১১ : ১১১, ১১৫]
❏ “আজকের দিনে [শেষ বিচারের দিন] কারও প্রতি জুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা করবে কেবল তারই প্রতিদান পাবে।” [আল-কুরআন, সুরা ইয়াসিন, ৩৬ : ৫৪]
❏ “যে মন্দ কর্ম করে, সে কেবল তার অনুরূপ প্রতিফল পাবে, আর যে পুরুষ অথবা নারী মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে, তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তাদের বেহিসাব রিযিক দেয়া হবে।” [আল-কুরআন, সুরা মু’মিন (গাফির), ৪০ : ৪০]
.
আল কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, মানুষ তার সৎকাজের জন্য পুরস্কার পাবে। মানুষ দুনিয়াতে যে কর্ম করে, পরকালে তার প্রতিফলস্বরূপ জান্নাত লাভ করবে।
.
❏ “তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা আমল করে তাদের জন্য কতই না চমৎকার প্রতিদান।” [আল-কুরআন, সুরা আলি ইমরান, ৩ : ১৩৬]
❏ “আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে সৎকাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মু’মিন (বিশ্বাসী), তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুর বিচির আবরণ পরিমাণ জুলুমও করা হবে না।” [আল-কুরআন, সুরা নিসা, ৪ : ১২৪]
❏ “তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, কখনো তা শেষ হবে না। যারা ধৈর্য ধরে, আমি তাদের প্রাপ্য প্রতিদান দেবো তাদের উত্তম কর্মের প্রতিদানস্বরূপ, যা তারা করতো। যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং যে ঈমানদার—সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক—আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করবো এবং প্রতিদানে তাদের তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেবো যা তারা করতো।” [আল-কুরআন, সুরা নাহল, ১৬ : ৯৬-৯৭]
❏ “যে কষ্ট স্বীকার করে, সে তো নিজের জন্যেই কষ্ট স্বীকার করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্ববাসীর ওপর প্রাচুর্যশীল। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেবো এবং তাদের কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেবো।” [আল-কুরআন, সুরা আনকাবুত, ২৯ : ৬-৭]
❏ “ নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ, এরপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করতো, এটা তারই প্রতিদান।” [আল-কুরআন, সুরা আনকাবুত, ২৯ : ৬-৭]
❏ “নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ, অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করতো, এটা তারই প্রতিদান।” [আল-কুরআন, সুরা আহকাফ, ৪৬ : ১৩-১৪]
❏ “এটা তোমাদের প্রতিদান। তোমাদের প্রচেষ্টা স্বীকৃতি লাভ করেছে।” [আল-কুরআন, সুরা দাহর (ইনসান) ৭৬ : ২২]
.
পক্ষান্তরে, মানুষ তার কর্মের জন্যই পরকালে শাস্তির সম্মুখীন হবে।
.
❏ “বস্তুত যারা মিথ্যা জেনেছে আমার আয়াতসমূকে এবং আখিরাতের সাক্ষাতকে, তাদের যাবতীয় আমল ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমন বদলাই সে পাবে যেমন আমল করতো।” [আল-কুরআন, সুরা আ’রাফ, ৭ : ১৪৭]
❏ “পার্থিব জীবনে সামান্যই লাভ, এরপর আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন আমি তাদের আস্বাদন করাবো কঠিন আযাব—তাদেরই কৃত কুফরির বদলাতে।” [আল-কুরআন, সুরা ইউনুস, ১০ : ৭০]
❏ “যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করবো এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্র করবো, তারপর তাদের কাউকে ছাড়বো না। তারা তোমার প্রভুর [আল্লাহ] সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধভাবে এবং বলা হবে—তোমরা আমার কাছে এসে গেছো; যেমন তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোনো প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করবো না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে, তার কারণে তুমি অপরাধীদের ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবে। তারা বলবে : “হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি; বরং সবকিছুই সংরক্ষিত রেখেছে!” তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রভু কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” [আল-কুরআন, সুরা কাহফ, ১৮ : ৪৭-৪৯]
❏ “হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও। হে আদমসন্তান! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের দাসত্ব করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং আমার দাসত্ব করো। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বোঝোনি? এই সেই জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদের দেয়া হতো। তোমাদের কুফরের কারণে আজ এতে প্রবেশ করো।” [আল-কুরআন, সুরা ইয়াসিন, ৩৬ : ৫৯-৬৪]
.
তাদের কর্মই তাদের জিম্মাদার। এবং এই কর্ম আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে হয়ে থাকে। এই আয়াত ও হাদিসগুলোতে পুরো ব্যাপারটি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
.
❏ “এখন মুশরিকরা বলবে, ‘যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা; আর না আমরা কোনো বস্তুকে হারাম করতাম।’ এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, পরিশেষে তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। বলো, তোমাদের কাছে কি কোনো জ্ঞান আছে, যা আমাকে দেখাতে পারো? তোমরা যে-সবের পেছনে চলছো, তা ধারণা-অনুমান ছাড়া কিছু না। তোমরা শুধু অনুমান করেই কথা বলো। বলে দাও : অতএব, পরিপূর্ণ যুক্তি আল্লাহরই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে পথপ্রদর্শন করতেন।” [আল-কুরআন, সুরা আন‘আম, ৬ : ১৪৮-১৪৯]
.
● আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) একখণ্ড কাঠ হাতে নিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি তা দ্বারা যমিনে টোকা দিচ্ছিলেন। এরপর তিনি তার মাথা উঠালেন। তখন তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার জান্নাত ও জাহান্নামের ঠিকানা পরিজ্ঞাত (নির্ণীত) নয়। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (ﷺ)! তাহলে আমরা কাজ-কর্ম ছেড়ে কি ভরসা করে বসে থাকবো না? তিনি বললেন, না, বরং আমল করতে থাকো। যাকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে তার জন্য সহজ করা হয়েছে।
এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন : “সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকি হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দেবো সহজ পথ। এবং কেউ কার্পণ্য করলে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে, এবং যা উত্তম তা বর্জন করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দেবো কঠোর পরিণামের পথ।” (আল কুরআন, সূরা লাইল, ৯২ : ৫-১০)
[সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৯২]
.
● আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, একজন ব্যক্তি বলল, “হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ), আমি কি আমার উট বেঁধে আল্লাহর ওপর ভরসা করবো, নাকি আমি ওটাকে না বেঁধে ছেড়ে রেখেই আল্লাহর ওপর ভরসা করবো?” তিনি [রাসুল (ﷺ)] বললেন, “ওটাকে বাঁধো এবং [এরপর আল্লাহর ওপর] ভরসা করো।”
[সুনান তিরমিযি, হাদিস : ২৫১৭, হাসান]
.
কাজেই—“আল্লাহ না চাইলে তো পাপ কাজ করতাম না, তাকদিরে আছে বলেই পাপকাজ করেছি”—এ জাতীয় কথা বলার কোনো মানে নেই। কারণ, এরূপ কথা বলার অর্থ হচ্ছে—গায়েবের জ্ঞান থাকার দাবি করা। “তাকদিরে পাপ করার কথা আছে”—এটা তো কেউ আমাদের বলে দেয়নি। এই জ্ঞান তো আমাদের কারও নেই। কাজেই এ ধরনের কথা বলার অর্থ হচ্ছে, আন্দাজের অনুসরণ করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পাপকাজে লিপ্ত হওয়া।
.
➽ মানুষের কি আদৌ কোনো ইচ্ছাশক্তি আছে, নাকি তাকে বাধ্য করা হচ্ছে? আল্লাহ কি কাউকে জোর করে জাহান্নামে পাঠাবেন?
.
কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে এটা আল্লাহ তা‘আলা স্বাভাবিকভাবেই আগে থেকে জানেন।
“আল্লাহ কিছু মানুষকে জান্নাত এবং কিছু জাহান্নামের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। যাদের জান্নাতের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা করেছেন তাদের প্রতি তাঁর রাহমাহ হিসেবে। যাদের জাহান্নামের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা করেছেন তাঁর আদালত অনুযায়ী।” [৭]
.
তবে এটা এ অর্থে নয় যে আল্লাহ জোর করে কাউকে জাহান্নামে পাঠাবেন। এটা আল্লাহ কর্তৃক সকল কিছুর নির্ধারণ অর্থে। আল্লাহ কারও প্রতি যুলুম করেন না, কারও প্রতি অবিচার করবেন না। মানুষের কর্ম ও বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের বিচার করা হবে।
.
কুরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে—
.
❏ “…আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান নষ্ট করে দেবেন। নিশ্চয়ই মানুষের প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত স্নেহশীল, করুণাময়।” [আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ, ২ : ১৪৩]
❏ “তিনিই (আল্লাহ) প্রথম বার অস্তিত্ব দান করেন এবং পুনরায় জীবিত করেন। তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়, মহান আরশের অধিকারী।” [আল-কুরআন, সুরা বুরুজ, ৮৫ : ১৩-১৫]
.
● “উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী (ﷺ)-এর নিকট কিছুসংখ্যক বন্দি আসে। বন্দিদের মধ্যে একজন মহিলা ছিলো। তার স্তন দুধে পূর্ণ ছিল। সে বন্দিদের মধ্যে কোনো শিশু পেলে তাকে ধরে কোলে নিতো এবং দুধ পান করাতো। নবী (ﷺ) আমাদের বললেন, “তোমরা কি মনে করো, এ মহিলা তার সন্তানকে আগুনে ফেলে দিতে পারে?” আমরা বললাম, “না। ফেলার ক্ষমতা রাখলেও সে কখনো ফেলবে না।” তারপর তিনি বললেন, “এ মহিলাটি তার সন্তানের ওপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি এর চেয়েও বেশি দয়ালু।”
[সহীহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৫৪]
.
● “আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা করে অথচ এখনো তা সম্পাদন করেনি, তার জন্য একটি সাওয়াব লেখা হয়। আর যে ইচ্ছা করার পর কার্য সস্পাদন করে, তবে তার ক্ষেত্রে দশ থেকে সাত শ গুণ পর্যন্ত সাওয়াব লেখা হয়। পক্ষান্তরে যেকোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করে আর তা না করে, তবে কোনো গুনাহ লেখা হয় না; আর তা করলে (একটি) গুনাহ লেখা হয়।”
[সহীহ মুসলিম, খণ্ড ১, হাদিস : ২৩৬]
.
○ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া (র) মানুষের কর্মের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন : মানুষ প্রকৃতই কর্ম করে এবং আল্লাহ তাদের কর্মের স্রষ্টা। কোনো ব্যক্তি মু’মিন অথবা কাফির হতে পারে, পুণ্যবান কিংবা পাপী হতে পারে, সলাত আদায় ও সিয়াম পালন করতে পারে–মানুষের তার কর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। আর আল্লাহ তার এ নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাশক্তির স্রষ্টা। যেরূপ আল্লাহ বলেছেন—“[এটা] তার জন্যে, যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়। তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি জগৎসমূহের প্রভু আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।” (সুরা তাকওয়ির, ৮১ : ২৮-২৯) [৮]
.
○ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (র.) বলেছেন : “...যেসব কাজ মানুষের ইচ্ছাধীন সেগুলোর ক্ষেত্রে মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে। যেমন মানুষের খাওয়া ও পান করার ক্ষমতা আছে। যেমন : ফজরের আযান শুনতে পেলে কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় (ওযু করতে) পানির দিকে যায়। একইভাবে যখন ঘুম আসে, মানুষ স্বেচ্ছায় বিছানায় যায়।...
এভাবে প্রতিটি কর্মের ক্ষেত্রেই মানুষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া আছে।
যদি তা না হতো, তাহলে পাপীকে শাস্তি দেয়া অন্যায্য হতো। কীভাবে মানুষকে এমন কিছুর জন্য শাস্তি দেয়া যেতে পারে যার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যদি তা না হতো, তাহলে কীভাবে পুণ্যবানকে পুরস্কার দেয়া যেতে পারে, যেখানে ঐ কর্মের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না? ...
কাজেই মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে, তবে সে এমন কোনো কিছু করে না যা আল্লাহর নির্ধারণকৃত তাকদিরের বাইরে। কেননা, তার (মানুষের) কর্তৃত্বের ওপর আরও একটি কর্তৃত্ব (আল্লাহ্‌র কর্তৃত্ব) আছে। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে বাধ্য করেন না। সুতরাং মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আছে এবং এ অনুযায়ী মানুষ কাজ করে।
.
তাই, যদি মানুষের ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কাজ সংঘটিত হয়, তবে এ কাজ তার ওপর আরোপ করা হয় না। আল্লাহ গুহাবাসীদের (আসহাবে কাহফ) ব্যাপারে বলেছেন : “তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি [আল্লাহ] তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। ...” ( সুরা কাহফ ১৮ : ১৮) এখানে তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করার কর্মটি আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা হয়েছে; কারণ, তারা ছিল ঘুমন্ত এবং নিজেদের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেছেন, “যদি কেউ ভুলক্রমে খায় ও পান করে তবে সে যেন তার সিয়াম (রোজা) পূর্ণ করে নেয়; কেননা, আল্লাহ তা‘আলাই তাকে এ পানাহার করিয়েছেন।” [বুখারী : ১৯৩৩; মুসলিম : ১১৫৫] এখানে খাওয়া ও পান করার কর্মগুলো আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা হয়েছে; কারণ, মানুষ রোজা অবস্থায় ভুলবশত এ কাজগুলো করে ফেলে। সে নিজে থেকে খেয়ে বা পান করে নিজের রোজা নষ্ট করবার সিদ্ধান্ত নেয়নি।” [৯]
.
ইসলামবিরোধীরা অভিযোগ করতে চায় : ইসলাম বলে মানুষের কর্মের কোনো ভূমিকা নেই; বরং শুধু পূর্বনির্ধারণের জন্যই মানুষ জান্নাত লাভ করে বা জাহান্নামে যায়। তাদের মতে সবকিছু পূর্ব নির্ধারণ অনুযায়ী সংঘটিত হয়, এতে মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রচণ্ড বাতাসে কারও ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া আর সিঁড়ি বেয়ে স্বেচ্ছায় নিচে নেমে আসা একই কথা। অথচ এগুলো ছিল একটি বাতিল ফির্কা (heretic) ‘জাবারিয়াহ’দের আকিদা। [১০] মুসলিম আলিমগণ এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস খণ্ডন করে কলম ধরেছেন। যে ধরনের বিশ্বাস ইসলামে নেই এবং যে বিশ্বাসকে খণ্ডন করে মুসলিম আলিমগণ কলম ধরেছেন, সেই বিশ্বাস ইসলামের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে যারা ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের উদ্যেশ্য অবশ্যই সৎ নয়।
.
➽পার্থিব জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষা
আল্লাহ মানুষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, ভালো-খারাপ উভয় পথই মানুষের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, এবং এটিই মানুষের জন্য পরীক্ষা।
.
❏ “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। এজন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।” [আল-কুরআন, সুরা দাহর (ইনসান), ৭৬ : ২-৩]
❏ “আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুই চক্ষু? আর জিহ্বা ও দুই ঠোঁট? এবং আমি কি তাকে দুইটি পথই দেখাইনি?” [আল-কুরআন, সুরা বালাদ, ৯০ : ৮-১০]
.
তাকদিরের এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, মুসলিমরা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। আবার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরা নিজ নিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। আবার অনেকের কাছে হয়তো আদৌ ইসলামের দাওয়াতই পৌঁছেনি। এদের কী হবে? ইসলাম এসব ব্যাপারে খুব পরিষ্কারভাবে আমাদের অবহিত করেছে।
.
➽মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারীরা মুসলিম আর অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারীরা অমুসলিম; মানুষের পরিণতি কি তবে জন্মের ভিত্তিতে?
.
যারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা জন্মের জন্য জান্নাতে যাবে না; বরং তাদের বিশ্বাস ও কর্মের জন্য জান্নাতে যাবে। অনেক মানুষ আছে, যারা মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও সলাত (নামায) আদায় করে না, অথচ সলাত ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী। [১১] আবার অনেকেই মুসলিম পরিবারে জন্মেও ইসলাম ত্যাগ করে। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া অবশ্যই জান্নাতের গ্যারান্টি নয়। আর যে অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তার জন্য সেটি একটি পরীক্ষা। সে যদি সঠিক ও অবিকৃতভাবে ইসলামের দাওয়াত পায়, তাহলে ইসলাম গ্রহণ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য হবে।
.
❏ “যিনি (আল্লাহ) সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।” [আল-কুরআন, সুরা মুলক, ৬৭ : ২]
❏ “...তারপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়েত অনুসারে চলবে, তার ওপর না কোনো ভয় আসবে, না (কোনো কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে। আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী; তারা অনন্তকাল সেখানে থাকবে ।” [আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ, ২ : ৩৮-৩৯]
○ এ প্রসঙ্গে ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী(র) {১৩৩১-১৩৯০ খ্রি./৭৩১-৭৯২ হি.} বলেছেন, “...কেউ যদি সত্যের প্রমাণ সন্ধান ছাড়াই অন্ধভাবে বাবা-মা’কে অনুসরণ করে এবং তার সামনে প্রকাশ হয়ে যাওয়া সত্যকে অগ্রাহ্য করে, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ করছে। এ থেকে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, “এবং যখন তাদের বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুসরণ করো, তখন তারা বলে : বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যা আমাদের পিতৃ-পুরুষগণ হতে প্রাপ্ত হয়েছি; যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিলনা এবং তারা সুপথগামীও ছিল না।” (সুরা বাকারাহ, ২ : ১৭০) এই একই ব্যাপার মুসলিম পরিবারে জন্মানো অনেকের জন্যও সত্য। তারা বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে তাদের বাপ-দাদাদেরই অনুসরণ করে যায়। এগুলো যদি ভুলও হয় তবুও তারা সে ব্যাপারে সচেতন হয় না। এরা পরিবেশের দ্বারা মুসলিম, পছন্দের দ্বারা নয়। যখন এমন কাউকে কবরে জিজ্ঞেস করা হবে : “কে তোমার প্রভু?” সে বলবে : “হায়, আমি জানি না। আমি জানি না। আমি লোকজনকে কিছু জিনিস বলতে শুনতাম এবং আমিও তা-ই বলতাম।” [১২]
.
➽যাদের কাছে পৌঁছেনি সত্য ধর্মের দাওয়াত
এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন আসে যে, অনেকের কাছে তো ইসলামের দাওয়াতই পৌঁছায় না। পৃথিবীতে অনেক দুর্গম জায়গা আছে যেখানে হয়তো ইসলামের দাওয়াত যায়নি। আবার অনেকে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্য (যেমন বার্ধক্য, জ্ঞান লোপ হওয়া) ইসলামের দাওয়াত থেকে বঞ্চিত হয়। এসব ব্যাপারেও ইসলাম আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে অভিহিত করে। আল্লাহ কারও প্রতি সামান্যতম অন্যায় করবেন না। এটি আল্লাহর সিফাত বা গুণ নয় যে তিনি বান্দার প্রতি বিন্দুমাত্রও জুলুম করেন।
.
❏ “নিশ্চয়ই আল্লাহ কারও প্রতি বিন্দুমাত্রও জুলুম করেন না; আর যদি তা (মানুষের কর্ম) সৎকর্ম হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন।” [আল-কুরআন, সুরা নিসা, ৪ : ৪০]
❏ “...বস্তুত আল্লাহ তাদের ওপর কোনো অন্যায় করেননি, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যাচার করছিলো।” [আল-কুরআন, সুরা আলি ইমরান, ৩ : ১১৭]
❏ “তারপর এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ পাপের কারণে আমি পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারও ওপর আমি পাথরকুচির ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে পাকড়াও করেছে বিকট আওয়াজ, কাউকে আবার মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছি আর কাউকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ এমন নন যে, তাদের ওপর জুলুম করবেন; বরং তারা নিজেরা নিজেদের ওপর জুলুম করতো।” [আল-কুরআন, সূরা আনকাবুত, ২৯ : ৪০]
❏ “আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদের এবং নিজের ওপর তাদের প্রতিজ্ঞা করালেন, ‘আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই?’ তারা বললো, ‘অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি।’ আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু করো যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।” [আল-কুরআন, সুরা আ‘রাফ, ৭ : ১৭২]
❏ “কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” [আল-কুরআন, সুরা বনী ইসরাইল (ইসরা), ১৭ : ১৫]
.
● “চার প্রকারের লোক কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করবে। প্রথম হলো বধির লোক, যে কিছুই শুনতে পায় না। দ্বিতীয় হলো সম্পূর্ণ নির্বোধ ও পাগল লোক, যে কিছুই জানে না। তৃতীয় হলো অত্যন্ত বৃদ্ধ, যার জ্ঞান লোপ পেয়েছে। চতুর্থ হলো ঐ ব্যক্তি, যে এমন যুগে জীবন যাপন করেছে যে যুগে কোনো নবী আগমন করেননি বা কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও বিদ্যমান ছিলো না। বধির লোকটি বলবে, “ইসলাম এসেছিলো, কিন্তু আমার কানে কোনো শব্দ পৌঁছেনি।” পাগল বলবে, “ইসলাম এসেছিলো বটে, কিন্তু আমার অবস্থা তো এই ছিলো যে শিশুরা আমার ওপর গোবর নিক্ষেপ করতো।” বৃদ্ধ বলবে, “ইসলাম এসেছিলো, কিন্তু আমার জ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিলো, আমি কিছুই বুঝতাম না।” আর যে লোকটির কাছে কোনো রাসুল আসেনি এবং সে তাঁর কোনো শিক্ষাও পায়নি সে বলবে, “আমার কাছে কোনো রাসুল আসেননি এবং আমি কোনো সত্যও পাইনি। সুতরাং আমি আমল করতাম কীভাবে?”
তাদের এসব কথা শুনে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নির্দেশ দেবেন—“আচ্ছা যাও, জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ো।” রাসুল (ﷺ) বলেন, “যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি তারা আল্লাহর আদেশ মেনে নেয় এবং জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ে, তবে জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য ঠান্ডা আরামদায়ক হয়ে যাবে।” অন্য বিবরণে আছে যে, যারা জাহান্নামে লাফিয়ে পড়বে তা তাদের জন্য হয়ে যাবে ঠান্ডা ও শান্তিদায়ক। আর যারা বিরত থাকবে, তাদের হুকুম অমান্যের কারণে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”
ইমাম ইবন জারির (রহ.) এই হাদিসটি বর্ণনা করার পরে আবু হুরাইরা (রা.) এর নিম্নের ঘোষণাটি উল্লেখ করেছেন, “এর সত্যতা প্রমাণ হিসেবে তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহ তা‘আলার وَ مَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا (কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।) বাক্যও পাঠ করতে পারো।” [১৩, ১৪]
.
● “কিয়ামতের দিন অজ্ঞ ও বোধহীন লোকেরা নিজেদের বোঝা কোমরে বহন করে নিয়ে আসবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার সামনে ওজর পেশ করে বলবে, “আমাদের কাছে কোনো রাসুল আসেননি এবং আপনার কোনো হুকুমও পৌঁছেনি। এরূপ হলে আমরা মন খুলে আপনার কথা মেনে চলতাম।”
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, “আচ্ছা, এখন যা হুকুম করবো তা মানবে তো?” উত্তরে তারা বলবে, “হাঁ, অবশ্যই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবো।” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেন, “আচ্ছা যাও, জাহান্নামের পার্শ্বে গিয়ে তাতে প্রবেশ করো।” তারা তখন অগ্রসর হয়ে জাহান্নামের পার্শ্বে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে যখন জাহান্নামের উত্তেজনা, শব্দ এবং শাস্তি দেখবে তখন ফিরে আসবে এবং বলবে, “হে আল্লাহ! আমাদের এর থেকে রক্ষা করুন।” আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, “দেখো, তোমরা অঙ্গীকার করেছো যে, আমার হুকুম মানবে। আবার এই নাফরমানি কেন?” তারা উত্তরে বলবে, “আচ্ছা, এবার মানবো।”
অতঃপর তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নেয়া হবে। তারপর এরা ফিরে এসে বলবে, “হে আল্লাহ, আমরা তো ভয় পেয়ে গেছি। আমাদের দ্বারা তো আপনার এই আদেশ মান্য করা সম্ভব নয়।” তখন প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলবেন, “তোমরা নাফরমানি করেছো। সুতরাং এখন লাঞ্ছনার সাথে জাহান্নামী হয়ে যাও।” রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন যে, “প্রথমবার তারা যদি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জাহান্নামে লাফিয়ে পড়তো, তবে তার অগ্নি তাদের জন্য ঠান্ডা হয়ে যেতো এবং তাদের দেহের একটি লোমও পুড়তো না।” [১৫]
❏“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না; সে তা-ই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তা-ই তার ওপর বর্তায় যা সে করে।…”। [আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ, ২ : ২৮৬]
.
ইসলাম বলে—মানবজাতির কাছ থেকে তাদের জন্মের পূর্বেই আল্লাহ তাঁর একত্ববাদের সাক্ষ্য নিয়েছিলেন। আল্লাহ আদি যুগ থেকে নবী-রাসুল প্রেরণ করে মানুষকে একত্ববাদের ধর্মের দিকে আহ্বান করেছেন। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর মাধ্যমে এই ধর্মের প্রচার আজও আছে। যুগে যুগে প্রত্যেকের কাছেই আল্লাহর পক্ষ থেকে দূত এসেছে। যারা তাদের নিজ যুগের নবীকে মেনেছে বা মানবে, তারা মুক্তি পাবে। আর যাদের কাছে আদৌ এই আহ্বান পৌঁছেনি, তাদের ফয়সালার কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
.
❏ “(শুরুতে) সকল মানুষ একই জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলো, তখন) আল্লাহ তা‘আলা নবীদের পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসাবে। আর তাঁদের সাথে অবর্তীণ করলেন সত্যসংবলিত কিতাব, যাতে তারা মানুষের মধ্যে সেসব বিষয়ে মীমাংসা করে দেন, যা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিলো। আর (পরিতাপের বিষয় হলো,) অন্য কেউ নয়; বরং যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলো, তারাই সমুজ্জ্বল নিদর্শনাবলি আসার পরও কেবল পারস্পরিক রেষারেষির কারণে তাতেই (সেই কিতাবেই) মতভেদ সৃষ্টি করলো। তারপর যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের, তারা যে বিষয়ে মতভেদ করতো, সে বিষয়ে নিজ ইচ্ছায় সঠিক পথে পৌঁছে দেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে সরল-সঠিক পথে পৌছে দেন।” [আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ, ২ : ২১৩]
❏ “আমি তোমার [মুহাম্মাদ (ﷺ)] পূর্বে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাসুল প্রেরণ করেছি।” [আল-কুরআন, সুরা হিজর, ১৫ : ১০]
❏ “আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত (আল্লাহ ব্যতীত যার উপাসনা করা হয়) থেকে নিরাপদ থাকো। এরপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যককে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেলো। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যারোপকারীদের কীরূপ পরিণতি হয়েছে।” [আল-কুরআন, সুরা নাহল, ১৬ : ৩৬]
❏ “যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎপথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” [আল-কুরআন, সুরা ইসরা, ১৭ : ১৫]
❏ “তোমরা কুফর অবলম্বন করলে নিশ্চিত জেনে রেখো, আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন; তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফর পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তাহলে তিনি তা তোমাদের জন্য পছন্দ করবেন। আর কোনো ভারবাহী অন্যের বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের প্রভুর নিকটেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন, তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করে যাচ্ছিলে। নিঃসন্দেহে অন্তরের ভেতরে যা আছে, সে সম্বন্ধে তিনি সম্যক অবগত।” [আল-কুরআন, সুরা যুমার, ৩৯ : ৭]
.
এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ফতোয়ার ওয়েবসাইট islamqa থেকে শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ (হাফিজাহুল্লাহ) এর এই ফতোয়াটি দেখা যেতে পারে :
“The fate of kuffaar who did not hear the message of Islam” [১৬]
.
➽ অমুসলিমদের মারা যাওয়া শিশু সন্তানদের পরিণতি কী হবে?
.
প্রত্যেক মানুষকেই স্রষ্টা আল্লাহ সঠিক ফিতরাত বা স্বভাবধর্মের ওপর সৃষ্টি করেন। আর সেটি হচ্ছে একত্ববাদ, স্রষ্টার প্রতি পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ বা ইসলাম। পরবর্তীতে মানুষ পিতামাতা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস লাভ করে। বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায় (হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি) এর শিশু-সন্তানের ব্যাপারে ইসলাম যা বলে :
.
●আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের ওপর। এরপর তার মা-বাপ তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজারিরূপে গড়ে তোলে। যেমন : চতুষ্পদ পশু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাদের মধ্যে কোনো (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও?” পরে আবু হুরায়রা (রা.) তিলাওয়াত করলেন—
فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
“আল্লাহর দেয়া ফিতরাতের (অর্থাৎ, ইসলামের) অনুসরণ করো, যে ফিতরাতের ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন।” (সুরা রূম, ৩০ : ৩০)
[সহীহ বুখারি, হাদিস: ৯৫৩১]
● সামুরা ইবন জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) প্রায়ই তাঁর সাহাবীদের (রা.) বলতেন, তোমাদের কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছো কি? রাবি বলেন, যাদের বেলায় আল্লাহর ইচ্ছা, তারা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করতো। তিনি [রাসুলুল্লাহ (ﷺ)] একদিন সকালে আমাদের বললেন, গত রাতে আমার কাছে দু-জন আগন্তুক আসলেন। তাঁরা আমাকে উঠালেন। আর আমাকে বললেন, চলুন। ......তাঁরা আমাকে বললেন, চলুন, চলুন। তিনি বলেন, আমরা চললাম এবং একটা সজীব-শ্যামল বাগানে উপনীত হলাম, যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের থেকে অধিক উঁচু দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে, যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চতুষ্পার্শে এত বিপুলসংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত বেশি আর কখনো আমি দেখিনি। আমি [মুহাম্মাদ (ﷺ)] তাদের বললাম, উনি কে? এরা কারা? তাঁরা আমাকে বললেন, চলুন, চলুন।
.... আর ঐ দীর্ঘকায় ব্যক্তি, যিনি বাগানে ছিলেন, তিনি হলেন, ইবরাহিম (আ.)। আর তাঁর আশেপাশের বালক-বালিকারা হলো ঐসব শিশু, যারা ফিতরাত (স্বভাবধর্মের) ওপর মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি বলেন, তখন কিছুসংখ্যক মুসলিম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ)! মুশরিকদের(বহু ঈশ্বরবাদী/পৌত্তলিক) শিশু সন্তানরাও কি? তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, মুশরিকদের শিশু সন্তানরাও। ...”
[সহীহ বুখারি; খণ্ড : ৯, অধ্যায় : ৮৭ (স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান অধ্যায়), হাদিস নং : ১৭১]
● রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে।” মানুষেরা তখন উচ্চস্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “মুশরিকদের শিশুরাও কি?” উত্তরে তিনি বলেন, “মুশরিকদের শিশুরাও।”
[হাফিজ আবু বকর বারকানি (রহ.), আল মুস্তাখরিজ ‘আলাল বুখারি]
● রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, মুশরিকদের শিশুদের জান্নাতবাসীদের খাদেম বানানো হবে। [১৭]
.
শিশু অবস্থায় মারা গেলে সেটি তাদের জন্য ওজর হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যে কোনো মানুষের বুদ্ধি ও বিবেক থাকে। এই সময়ে যদি তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছায় এবং সে যদি তা গ্রহণ না করে, তাহলে হিন্দু, খ্রিষ্টান বা নাস্তিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা তার জন্য অজুহাত হতে পারে না। নিজ কর্মের জন্যই সে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়। তার জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার দ্বারা। পৃথিবীতে বহু মানুষ এই পরীক্ষায় কৃতকার্য হচ্ছে, অমুসলিম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে।
.
➽ উপসংহার:
আমরা উপসংহারে বলতে পারি : দুনিয়াতে যার নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে এবং সে তা অস্বীকার করেছে, পরকালে তার আর কোনো ওজর পেশ করার সুযোগ নেই। যাদের নিকট দুনিয়াতে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, পরকালে তাদের একপ্রকারের পরীক্ষা হবে এবং তাতে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা মুক্তিলাভ করবে। সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে, কারও প্রতি সামান্যতম জুলুমও করা হবে না। পৃথিবীতে অন্যায় আছে বলেই ন্যায়ের মহিমা প্রকাশ পায়। পাপ না থাকলে পুণ্য বলে কিছু থাকতো না, পুণ্যবানের পুণ্যের কোনো মূল্য থাকতো না। পৃথিবীতে যত অন্যায়-অপরাধ হয়, এর কোনোটির ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই। আল্লাহ মানুষের তাকদির নির্ধারণ করেছেন। মানুষকে ইচ্ছাশক্তিও দিয়েছেন, মানুষের বিশ্বাস ও কর্ম দ্বারা সে জান্নাত বা জাহান্নামের উপযোগী হয়। আল্লাহ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুমও করেন না। পরিণতি জানা সত্ত্বেও আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ার পরীক্ষাক্ষেত্রে পাঠান, তার ভালো-মন্দ পরীক্ষা করার জন্য। মানুষের কর্ম অনুযায়ী আল্লাহ এর প্রতিদান দেন। আল্লাহ সব থেকে বড় ন্যায়বিচারক। মানুষকে চেতনা, বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি এজন্য দিয়েছেন যেন মানুষ তা ব্যবহার করে। সুনির্দিষ্টভাবে সাহাবীদের—“ তাহলে আমরা কাজ-কর্ম ছেড়ে কি ভরসা করে বসে থাকব না?”—প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (ﷺ) এটি করতে নিষেধ করেছেন এবং সাধ্যানুযায়ী সৎকর্মের উপদেশ দিয়েছেন। মানুষ যদি এরপরেও তাকদিরের ওপর দোষ দিয়ে বসে থাকে ও সৎকর্ম না করে, তবে এজন্য আল্লাহ মোটেও দায়ী নন। কারণ তাকে তো তার তাকদির জানিয়ে দেয়া হয়নি। কে তাকে বলে দিয়েছে যে, সে জাহান্নামেই যাবে? বরং এই বসে থাকাটাই তার জন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
এবং আল্লাহই ভালো জানেন।
.
====
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার [ফেসবুক id: Muhammad Mushfiqur Rahman Minar]
#সত্যকথন
.
.
[১] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৫/৫৬;
‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’, খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (র); পৃষ্ঠা : ৩৩৯
[২] ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা’, শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (র), পৃষ্ঠা : ৮২ (islamhouse);
ডাউনলোড লিঙ্কঃ http://bit.ly/2jsTGEP অথবা https://goo.gl/aBwSFN
[৩] ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা’, শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (র), পৃষ্ঠা : ২০-২২ (islamhouse)
[৪] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page:27-29;
ডাউনলোড লিংক: https://islamhouse.com/en/books/373557
[৫] ‘শারহ আকিদা আত ত্বহাওয়ী’, ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী (র); পৃষ্ঠা : ৩৮ (ইংরেজি অনুবাদ)
[৬] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page : 32
[৭] ৯১ নং আকিদা; 'আকিদা আত ত্বহাওয়ী’, ইমাম আবু জাফর আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ আত-ত্বহাওয়ী (র)
[৮] আল ওয়াসিত্বিয়া মা’আ শারহ হাররাস, পৃষ্ঠা : ৬৫;
“Is man’s fate pre-destined or does he have freedom of will?” (islamqa),https://islamqa.info/en/20806
[৯] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page : 54-55।
মূল আরবির জন্য দেখুন ‘শারহ হাদিস জিবরিল’ {মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (র)} ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/PMHc5J অথবাhttp://bit.ly/2jjYxnQ
[১০] ‘ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম’, শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (র); পৃষ্ঠা : ১০৫-১০৬;
‘তাক্বদীর—আল্লাহর এক গোপন রহস্য’, আব্দুল আলীম ইবন কাওছার; পৃষ্ঠা : ৩১
[১১] সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২৬১৯-২৬২৩
[১২] ‘শারহ আকিদা আত ত্বহাওয়ী’, ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী (র); পৃষ্ঠা : ১৯০ (ইংরেজি অনুবাদ)
[১৩] মুসনাদ আহমাদ, তাফসির ইবন কাসির {তাফসির পাবলিকেশন কমিটি (ড. মুজিবুর রহমান)}, সুরা বনী ইসরাইল ১৫ নং আয়াতের তাফসির
[১৪] ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া যাহলী (র) কর্তৃক বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে নবীশূন্য যুগের লোক, পাগল ও শিশুর কথাও এসেছে
[১৫] মুসনাদ বাযযার, ইমাম ইবন কাসির (রহ.) এর মতে ইমাম ইবন হিব্বান (রহ.) নির্ভরযোগ্যরূপে বর্ণনা করেছেন; তাফসির ইবন কাসির {তাফসির পাবলিকেশন কমিটি (ড. মুজিবুর রহমান)}; সুরা বনী ইসরাইল ১৫ নং আয়াতের তাফসির, ইয়াহইয়া ইবন মুঈন (রহ.) ও নাসাঈ (রহ.) এর মতে এতে (সনদের ব্যাপারে) ভয়ের কোনো কারণ নেই।
[১৭] তাবারানি, তাফসির ইবন কাসির {তাফসির পাবলিকেশন কমিটি (ড. মুজিবুর রহমান)}, সুরা বনী ইসরাইল ১৫ নং আয়াতের তাফসির

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ shottokothon.com  এবং response-to-anti-islam.com

ফেসবুক পেজঃ fb.com/shottokothon1

Post a Comment

Previous Post Next Post