রোববারে আমরা শাহবাগে বসে আড্ডা দিই। আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তু থাকে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন আবিষ্কার, বিভিন্ন বই নিয়ে।
গত রোববারের আড্ডায় আমাদের সাথে পিকলু দা’ও ছিলেন। পিকলুদা হলেন আমাদের সবার কাছে প্রিয় ও পরিচিত একটি মুখ। ক্যাম্পাসে পিকলুদাকে চিনেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কেনোই বা চিনবেনা? যে লোক জাপান, হংকং এবং কানাডা থেকে চার চারবার ফটোগ্রাফিতে গোল্ড মেডেল পায়, তাকে আবার চিনবেনা এমন কেউ থাকতে পারে নাকি?
আমরা পিকলুদাকে একজন উঁচু মাপের ‘ফটোগ্রাফার’ হিসেবে জানলেও, সাজিদের কাছে পিকলুদার কদর অন্য জায়গায়।
সাজিদ পিকলুদাকে একজন উঁচু মানের বই পড়ুয়া হিসেবেই চিনে।
সাজিদের ভাষ্যমতে, পুরো পৃথিবী থেকে যদি তন্ন তন্ন করে খুঁজে সেরা ১০ জন বই পড়ুয়া লোক খুঁজে বের করা হয়, তাহলে পিকলুদার Rank সেখানে সেরা তিনে থাকবে, শিওর….
পিকলুদার সাথে আমাদের চেয়ে সাজিদের সখ্যতাই বেশি।এর কারণ, ঢাবিতে ভর্তির পরে পুরো একবছর সাজিদ আর পিকলুদা হলের একই রুমে ছিলো। মুহসীন হলের ২১০ নম্বর রুম।
সাজিদের কাছে শুনেছি, একবার ঘোর বর্ষার সময়, পিকলুদা ঠিক করলেন যে উনি বান্দরবান যাবেন। চারদিকে করুণ অবস্থা। পানিতে টইটম্বুর সব। ভারি বজ্রপাতের সাথে বিরতিহীন বৃষ্টির ফোয়ারা- এর মধ্যেই পিকলুদা চাচ্ছে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়তে।
সাজিদ খুবই অবাক হলো। বললো,- ‘এরকম পরিস্থিতিতে কেউ কী বাইরে যায় নাকি?’
পিকলুদা কয়েক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বললেন,- ‘Without such environment, you can’t enjoy adventure, my dear…’
সাজিদ দেখলো, সেই যাত্রায় পিকলুদা ব্যাগের মধ্যে ক্যামেরার সাথে শেক্সপিয়ারের ‘A mid Summer Night’s Dream’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের বই দুটোও পুরে নিচ্ছে। সাজিদ আবারো অবাক হলো। বললো,- ‘বৃষ্টি বাদলের মধ্যে ভিজবে নাকি বই পড়বে?’
পিকলুদা সেবার কিছু না বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লো।
পিকলুদা ফিরলো ঠিক দশদিন পরে। জ্বরে কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অন্যকেউ হলে এই মূহুর্তে বেহাল দশা হয়ে যেতো। অথচ, পিকলুদার মুখে অসুখের কোন চিহ্নই নেই। মনে হচ্ছে মনের মধ্যে রাজ্য জয়ের সুখ বিরাজ করছে।
সাজিদ বললো,- ‘কী অবস্থা করে এসেছো নিজের?’
পিকলুদা সাজিদের কথা কানে নিলো বলে মনে হলো না। গোল্ডলীফ সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,- ‘জানিস তো, অনেকগুলো অসাধারণ ছবি তুলে এনেছি এবার। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গিয়েছিলাম। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ ক্রস করে কোন এক পাহাড়ের দেশে ঢুকে পড়েছি।’
পরেরদিন ক্যাম্পাসে পিকলুদা আমাদের অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বান্দরবানের দূর্গম এলাকা থেকে তুলে আনা ছবিগুলো দেখাচ্ছিলেন। আমরাও খুব আগ্রহভরে দেখছিলাম ছবিগুলো। আসলেই সব কয়’টা ছবিই দারুন ছিলো। আমার সাধ্য থাকলে প্রতিটা ছবির জন্য পিকলুদাকে একটা করে গোল্ড মেডেল দিয়ে দিতাম।
আমরা সবাই ছবি দেখাদেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, সাজিদের সেদিকে মোটেও আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে সে পিকলুদার কাছে জানতে চাইলো সাথে নিয়ে যাওয়া বইগুলোর ব্যাপারে। পিকলুদা ফিক করে হেসে দিলেন। এরপর, সাতখন্ড রামায়ণ পাঠের মতো করে উনি শেক্সপিয়ারের ‘A mid summer night’s dream’ এবং রবি ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা শুরু করলেন। আমরাও আগ্রহ ভরে শুনছিলাম আর আবিষ্কার করছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পিকলুদাকে। যিনি কেবল ছবির মাঝেই ডুব দেন না, বইয়ের মাঝেও অসাধারণভাবে ডুব দিতে পারেন……
বলছিলাম গত রোববারের আড্ডার কথা। সে আড্ডায় আমাদের সাথে পিকলুদাও ছিলেন। ছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সোহেল রানা এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সৌরভ ধর। আরো ছিলো ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের আহমেদ ইমতিয়াজ এবং রসায়নের সুমন্ত বর্মণ দা। সুমন্ত দা খুব ভালো গিটার বাজাতে পারেন। তিনি যখন গিটারে তাল ধরেন, তখন সবাই সমস্বরে মান্না দা’র সেই বিখ্যাত গানটা গেয়ে উঠে-
‘কাকে যেন ভালোবেসে, আঘাত পেয়েছে শেষে, পাগলা গারদে আছে রমা রায়
অমলটা ধুঁকছে দূরন্ত ক্যান্সারে, জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়…… কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই….’
কফি হাউজের আড্ডাটা না থাকতে পারে, আমাদের রোববারের আড্ডাটা ঠিকই রয়ে গেছে।
আমাদের আড্ডা শুরুর প্রাক্কালে, সৌরভ পিকলুদার কাছে জিজ্ঞেস করলো,- ‘দাদা, তুমি কী সালমান রুশদীর ‘The Satanic Verses’ পড়েছো?’
পিকলু দা ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নেড়ে জানালেন যে উনি পড়েছেন।
এরপর সৌরভ সাজিদের কাছে জানতে চাইলো যে সে পড়েছে কিনা এই বই। সাজিদও ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লো। পিকলুদা সাজিদের কাছে জানতে চাইলো,- ‘তোর কেমন লাগলো রে এই বই?’
সাজিদ বাদাম ছিলে মুখে দিতে দিতে বললো,- ‘ফিকশনাল বই হিসেবে বলতে গেলে এটা একটা দারুন বই।’
পিকলুদা খানিকটা অবাক হলেন বলে মনে হলো। বললেন,- ‘মানে কী?’
– ‘কিছুই না। ফিকশনাল বই হিসেবে এটা একটা দারুন বই। সাহিত্যমানের বিচারে বলতে গেলে বইটাকে আমি দশের মধ্যে ৯ দেবো।’
পিকলুদা আরো খানিকটা অবাক হলেন। বললেন,- ‘বইটাতে রুশদী যে ইনফরমেশন ব্যবহার করেছে, সে ব্যাপারে তোর আপত্তি আছে?’
সাজিদ বললো,- ‘আলবৎ আছে।’
– ‘কিন্তু তুই কী জানিস অই বইতে রুশদী যা ইনফরমেশন ব্যবহার করেছে তার সবটাই ইসলামিক সোর্স থেকে নেওয়া?’- পিকলুদা বললেন।
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তুই বলতে চাচ্ছিস এসব ইসলামিক সোর্সে ভুল ইনফরমেশন দেওয়া আছে?’
– ‘থাকতেও পারে। দুনিয়ায় কোরআন ছাড়া বাকিসব গ্রন্থ মানুষের লেখা। আর মানুষের লেখায় ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক।’- সাজিদের উত্তর।
( পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে আমি ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে নিই।এরপরে আমরা আবার ঘটনায় চলে যাবো।
ইন্ডিয়ান লেখক সালমান রুশদী একটি বই লিখে খুবই বিতর্কিত হয়ে পড়েন। বইটার নাম- ‘The Satanic Verses’ (শয়তানের আয়াত)।
রুশদী সেই বইতে কিছু ইসলামিক (সীরাত) সোর্স থেকে দলিল টেনে ইসলামকে আক্রমণ করে এবং প্রমাণের চেষ্টা করে যে কোরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাজিল হওয়া না, শয়তান থেকে প্রাপ্ত কিতাব। রুশদী সোর্স হিসেবে উল্লেখ করে ‘আল তাবারি’ এবং ‘ইবন সা’দ’ এর মতো সীরাত গ্রন্থকে।
আল তাবারি এবং ইবন সা’দ এ একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। ঘটনাটি হলো এরকম,- ‘রাসূল (সা:) মক্কায় যখন দাওয়াত প্রচার শুরু করলেন, তখন একদিন তিনি ক্বাবা শরীফের প্রাঙ্গণে বসে সদ্য ইসলামে দাখিল হওয়া মুসলিমদের মাঝে বক্তৃতা রাখছিলেন। সেখানে মক্কার অন্যান্য পৌত্তলিক কুরাইশরাও ছিলো।
ঠিক এমন সময়ে, হজরত জ্বিবরাঈল (আঃ) ওহী নিয়ে রাসূল (সাঃ) এর কাছে আগমন করেন। সেদিন জ্বিবরাঈল সূরা ‘আন নাজম’ নিয়ে অবতীর্ণ হন। তাবারি এবং ইবন সা’দ বলছে,- সেদিন সূরা আন নাজমের ১৯ এবং ২০ নাম্বার আয়াতের পর রাসূল সাঃ আরো বাড়তি দুটি আয়াত তিলাওয়াত করেন, যা আদতে জ্বিবরাঈল আঃ ওহী হিসেবে নিয়ে আসেন নি। এই দুই আয়াত মূলত শয়তান রাসূল সাঃ কে ধোঁকা দিয়ে কোরআনের আয়াতের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলো।
পরে, জ্বিবরাঈল রাসূল সাঃ কে এ ব্যাপারে সতর্ক করলে রাসূল সাঃ তা ওহী ছিলো না বলে বাদ দেন।
সূরা আন নাজমের ১৯ এবং ২০ নাম্বার আয়াতে হলো মুশরিকদের পূজিত সবচে বড় তিন দেবী- লাত, উযযা এবং মানাতকে নিয়ে।
সূরা আন নাজমের ১৯ এবং ২০ নাম্বার আয়াত হলো- ‘তোমরা কী ভেবে দেখেছো লাত ও উযযা সম্পর্কে?’
‘এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?’
তাবারি এবং ইবন সা’দ বলছে, এই দুই আয়াতের পরে আরো দুটি বাড়তি আয়াত ছিলো যা পরে রাসূল সাঃ ভুল বুঝতে পেরে বাদ দিয়েছিলেন।সেই আয়াত দুটি এরকম,-
‘ These are the high-flying ones,
whose intercession is to be hoped for!’
( ‘তাঁরা হলেন খুব-ই উঁচু পর্যায়ের (ক্ষমতাবান দেবী।তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়’…)
তাহলে, সূরা আন নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াতের সাথে বাদ পড়া (তাবারি এবং ইবন সাদ এর বর্ণনামতে) আয়াত দুটো জুড়ে দিলে কী রকম শোনায় দেখা যাক-
‘তোমরা কী ভেবে দেখেছো লাত ও উযযা সম্পর্কে?’
‘এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?’
‘তাঁরা হলেন খুব-ই উঁচু পর্যায়ের(ক্ষমতাবান দেবী)
‘এবং, তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়’…
ইবন সাদ এবং তাবারির দাবি,পরের দুই আয়াত শুনে মক্কার মুশরিকরা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তারা ভাবলো, মুহাম্মদ সাঃ এবার তাদের দেবীদের প্রশংসা করলেন। তার মানে, মুহাম্মদ সাঃ তাদের দেবীদের প্রভূ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাই, সেদিন মুহাম্মদ সা: এবং অন্যান্য মুসলিমদের সাথে মক্কার মুশরিকরাও সিজদা করেছিলো মক্কা প্রাঙ্গণে।
তাবারি এবং ইবন সা’দ এর এই রেফারেন্সগুলোকে ইসলাম বিদ্বেষীরা এবং খ্রিষ্টান মিশনারীরা লুফে নেয়। তারা এই ঘটনাকে (অর্থাৎ, মুহাম্মদ সাঃ শয়তানের কাছ থেকেও অহী নিতেন) সত্য প্রমাণ করার জন্য সূরা আল হাজ্ব এর ২২ নম্বর আয়াতকে রেফারেন্স হিসেবে দাখিল করে থাকে।)
সাজিদের এরকম উত্তর শুনে পিকলুদা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তিনি বললেন, – ‘ সালমান রুশদীর কথা বাদ দে। তুই কী বলতে চাইছিস ইবন সা’দ আর আল তাবারির বর্ণনা ভুল?’
– ‘দাদা, আগেও বলেছি, ইবন সা’দ হোক বা আল তাবারি হোক বা অন্য যেকোন কেউ, তাদের কাছে তো আর ওহী আসতো না। যেহেতু তাদের গ্রন্থগুলো আসমানী কিতাব নয়, তাই তার মধ্যে ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে।অস্বাভাবিক না তো…..’
এতোক্ষণ পরে সোহেল রানা ভাই মুখ খুললেন। বললেন,- ‘আচ্ছা সাজিদ, ধরেই নিলাম তুমি ঠিক বলছো। ইবন সা’দ বা আল তাবারির বর্ণনা ভুল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো তাদের বর্ণনা ভুল বা তোমার কাছে ভুল মনে হচ্ছে?’
এবার আমরা সবাই নড়েচড়ে বসলাম। এরই মধ্যে আড্ডায় চলে এসেছে পঙ্কজ দা, ইসলামিক স্ট্যাডিজের ইবরাহিম খলীল এবং ফিন্যান্সের শরীফ ভাই।
সোহেল ভাইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে সৌরভ বললো,- ‘Yes, explain, why you think renowned author both Al Tabari & Ibn Saad are wrong according to u…’
সচরাচর কোন দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করার আগে সাজিদ খানিকটা ঝেড়ে কেশে নেয়। আজও ঠিক তাই করলো। ঝেঁড়ে প্রথমে কেশে নিলো। এরপর সে বলতে শুরু করলো-
‘প্রথমে, আমাদের বুঝতে হবে, ইবন সা’দ এবং আল তাবারির গ্রন্থে যা আছে, তা মানুষের রচনা। এরমধ্যে যেমন শুদ্ধ জিনিস, শুদ্ধ বর্ণনা আছে, ঠিক তেমনি ভুল জিনিস, ভুল বর্ণনা থাকাটাও স্বাভাবিক।কারণ, ইবন সা’দ বা আল তাবারি, কেউ-ই রাসূলের যুগের প্রত্যক্ষ সাক্ষী না।
তারা রাসূলের জীবনী লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে যেখানে, যার কাছে যা পেয়েছেন, তাই লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন। ভুল-শুদ্ধ কতোটুকু- তা নির্ণয়ের চেয়ে আপাতত সংরক্ষণ করে ফেলতে পারাটাকেই তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
তাদের রচনায় যে ভুল থাকতে পারে, তা স্বয়ং তারা নিজেরাও স্বীকার করে গেছেন।
আল তাবারি উনার কিতাবের শুরুতেই বলেছেন,- ‘ Hence, if I mention in this book a report about some men of the past, which the reader of listener finds objectionable or worthy of censure because he can see no aspect of truth nor any factual substance therein, let him know that this is not to be attributed to us but to those who transmitted it to us and we have merely passed this on as it has been passed on to us’
অর্থাৎ, তিনি শুধু তা-ই কিতাবে স্থান দিয়েছেন যা তাঁর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন কেউ যদি তার কিতাবে কোন আপত্তিকর বিষয়াদি খুঁজে পায় যা ইসলামের ফান্ডামেন্টাল জিনিসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অন্যান্য সহী সূত্রে তা বাতিলযোগ্য দেখা যায়- তাহলে তাঁর দায় আল তাবারীর নয়, তিনি যার কাছ থেকে পেয়েছেন, কেবলই তার।তিনি এখানে কেবল একজন ‘লিখিয়ে’র ভূমিকায়…..
সুতরাং, আল তাবারির বর্ণনা যে ভুল ‘হতেও’ পারে, তা আল তাবারিই বলে গেছেন। সেইম কথা, সেইম ব্যাপার ইবন সা’দ এর ক্ষেত্রেও।
এতোটুকু বলে সাজিদ থামলো। পিকলুদা বললেন, – ‘ভুল হতেও পারে মানে এটা প্রমাণ হয় না যে- তিনি ভুল। ভুল হতেও পারে এর পরের শর্ত কিন্তু সঠিকও হতে পারে। আমরা তাহলে কোনটা ধরে নেবো? উনি ভুল না শুদ্ধ?’
সাজিদ হাসলো। এরপরে বললো,- ‘দেখা যাক কী হয়…’
সাজিদ আবার বলতে শুরু করলো-
সকল ইতিহাসবিদদের মতে, সূরা আন নাজম নাজিল হয় রাসূল সাঃ নব্যুয়াত লাভের পঞ্চম বছরে, রজব মাসে, যে বছর প্রথম একটি মুসলিম দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করে। অর্থাৎ, রাসূল সাঃ এর মদিনায় হিজরতের আরো ৮ বছর আগে।
এখন, সালমান রুশদী এবং খ্রিষ্টান মিশনারীদের দাবি, রাসূল সাঃ শয়তান থেকে ওহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন পরে, আল্লাহ কোরআনের ওহীর মাধ্যমে রাসূল সাঃ কে সংশোধন করে দেন।
তাদের দাবি, সূরা আল হাজ্বের ৫৩ নাম্বার আয়াত সেদিনই (যেদিন তথাকথিত Satanic Verses নাজিল হয়) নাকি অই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেখানে বলা হচ্ছে-
‘আমি তোমার পূর্বে যে সব রাসূল কিংবা নবী পাঠিয়েছি, তাদের কেউ যখনই কোন আকাঙ্ক্ষা করেছে তখনই শয়ত্বান তার আকাঙ্ক্ষায় (প্রতিবন্ধকতা, সন্দেহ-সংশয়) নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু শয়ত্বান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা মুছে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কারণ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রেষ্ঠ হিকমতওয়ালা।’
সালমান রুশদী এবং খ্রিষ্টান মিশনারীদের দাবি, এই আয়াত দিয়েই আল্লাহ মুহাম্মদ সাঃ কে তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে দেন এবং মুহাম্মদ সঃ সূরা আন নাজমের সাথে মিশিয়ে ফেলা ওই আয়াত দুটো বাতিল করে দেন।
শত্রুপক্ষ এই গল্প খুব সুচতুরভাবে বানিয়েছে বলা যায়। কিন্তু ঘাপলা রেখে গেছে অন্য জায়গায়। সেটা হলো, সূরা আন নাজমের সাথে সূরা আল হাজ্ব এর নাজিলের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান।
সূরা আন নাজম নাজিল হয় রাসূল নবুয়্যাত লাভ করার ৫ম বছরে, মক্কায়। সূরাটিও মাক্কী সূরার অন্তর্গত। আর, সূরা আল হাজ্ব নাজিল হয় রাসূল সাঃ নব্যুয়াত লাভের প্রায় ১২-১৩ বছরের পরে, হিজরতের প্রথম বছরে। সূরাটি মাদানী সূরা।
অর্থাৎ, তাদের কথানুযায়ী, রাসূল সাঃ ভুল করেন নব্যুয়াত লাভের ৫ম বছরে, আর সূরা আল হাজ্ব নাজিল হয় নব্যুয়াত লাভের ১৩ তম বছরে। দুই সূরার মধ্যে সময় ব্যবধান ৮ বছর।
অর্থাৎ, তাদের দাবিনুযায়ী, রাসূল সাঃ ভুল করেছেন আজ, আর আল্লাহ তা সংশোধন করেছেন ৮ বছর পরে…
সাজিদ জোরে বলতে লাগলো,- ‘আচ্ছা বলুন তো, পাগল না হলে, কোন মানুষ কী এই গল্প বিশ্বাস করবে? ভুল করেছে আজ, আর তা সংশোধন হলো আরো ৮ বছর পরে।
এই আট বছরের মধ্যে, রাসূল সাঃ সূরা আন নাজমে লাত, উযযা, মানাতের মতো দেবীর প্রশংসা করেছেন (তাদের মতে), আবার কালেমায় বলেছেন- ‘লা ইলাহা ইল্লাহহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই)।
একদিকে দেবীদের কাছে সাহায্য চাওয়ার বৈধতা, আবার অন্যদিকে ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ বলে তাদের বাতিল করে দেওয়া- এতোসব কাহিনী করার পরেও কীভাবে তিনি সেখানে ‘আল আমীন’ হিসেবে থাকতে পারেন? হাউ পসিবল?
ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম যে, সূরা হাজ্বের সেই সংশোধনী আয়াত আল্লাহ সেই রাতেই নাজিল করেছিলেন এবং সেই রাতেই রাসূল উনার ভুল শুধরে নিয়েছিলেন এবং পরে ঘোষণা করলেন যে, লাত, উযযা, মানাতের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না।’
খেয়াল করুন, দিনে বলেছেন এরকম-
‘তাঁরা হলেন খুব-ই উঁচু পর্যায়ের(ক্ষমতাবান দেবী)
‘এবং, তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়…’
আবার রাতে নিজের সেই কথাকে উইথড্র করে নিয়ে বলছেন, লাত, উযযা, মানাতরা বাতিল।
এমতাবস্থায়, মক্কার কাফির, পৌত্তলিকদের কাছে রাসূল সাঃ কী একজন ঠক, প্রতারক, বেঈমান বলে গন্য হবার কথা না?
অথচ, ইতিহাসের কোথাও কী তার বিন্দু পরিমাণ প্রমাণ পাওয়া যায়? যায় না।
যাদের সাথে তিনি মূহুর্তেই এতোবড়ো বেঈমানি করলেন, তাদের কারো কাছেই তিনি ‘ঠক’ ‘প্রতারক’ ‘মিথ্যুক’ সাব্যস্ত হলেন না – এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের। রাসূল সাঃ কে অপমান করার এতোবড়ো সুযোগটা কীভাবে শত্রুপক্ষ মিস করলো?
তাছাড়া, ইতিহাস থেকে জানা যায়, মদীনায় হিজরতের আগের রাতে, রাসূল সাঃ হজরত আলী রাঃ কে উনার ঘরে রেখে যান, যাতে রাসূল সাঃ এর কাছে গচ্ছিত আমানত প্রাপকদের কাছে (যারা মুশরিক ছিলো) যথাযতভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
ভাবুন তো, যিনি একদিনে দু রকম কথা বলতে পারে, (একবার দেবীদের প্রশংসা করে, আবার তা বাতিল করে) তাকে কিন্তু তখনও মক্কার কুরাইশরা বিশ্বাস করছে, ভরসা করে আমানত গচ্ছিত রাখছে। কীভাবে? একজন ঠক, প্রতারককে (যদি Satanic Verses incident সত্য হয়) কীসের ভিত্তিতে এতো বিশ্বাস?
আদৌ কী সেদিন Satanic Verses জাতীয় কিছু নাজিল প্রাপ্ত হয়েছিলো রাসূলের উপর? উত্তর- নাহ।
দ্বিতীয় প্রমাণ, তর্কের খাতিরে আবার ধরে নিই যে, Satanic Verses সত্য।
তাহলে চলুন, আরেকবার পাঠ করি সেই আয়াতগুলো-
(১৯) – ‘তোমরা কী ভেবে দেখেছো লাত ও উযযা সম্পর্কে?’
(২০) – ‘এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?’
(২১)- ‘তাঁরা হলেন খুব-ই উঁচু পর্যায়ের(ক্ষমতাবান দেবী)
(২২)- ‘এবং, তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়’…
(২৩)- ‘এগুলো তো কেবল (এই যে লাত, উযযা, মানাত এসব) কতকগুলো নাম যে নাম তোমরা আর তোমাদের পিতৃ পৃরুষরা রেখেছ, এর পক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। তারা তো শুধু অনুমান আর প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, যদিও তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।’
খেয়াল করুন, ২১ এবং ২২ নম্বর আয়াত (সালমান রুশদী এবং খ্রিষ্টান মিশনারীদের ভাষ্যমতে) এর ঠিক পরে, আল্লাহর কাছ থেকে কোনরকম সংশোধনী আসার আগেই ঠিক ২৩ নাম্বার আয়াতে এসে বলা হচ্ছে- ‘এগুলো (লাত, উযযা, মানাত ইত্যাদি) তো কেবল কতোগুলো নাম মাত্র যা তোমরা (মুশরিকরা) এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছো। এদের (ক্ষমতার) পক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাজিল করেন নি।’
বড়ই আশ্চর্যের, তাইনা? একটু আগে বলা হলো,- তারা হলেন খুব-ই উঁচু পর্যায়ের। তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়।’
তার ঠিক পরেই বলা হচ্ছে- ‘এগুলো কেবল কিছু নাম যা তোমাদের মস্তিষ্কপ্রসূত।’
What a double stand! হাহাহাহাহা।
এরকম ডিগবাজী দেওয়ার পরেও, যারা একত্ববাদে বিশ্বাস রেখে নতুন ইসলামে এসেছে, তারা কী মুহাম্মদ সা: কে ছেড়ে তৎক্ষণাৎ চলে যেতো না?
আর, কুরাইশরা এতো পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও এটা বুঝতে পারলো না যে, মুহাম্মদ সঃ তাদের সাথে মাইন্ড গেইম খেলছে? হাহাহা।’….
সাজিদ হাসি থামালো। পঙ্কজ দা জিজ্ঞেস করলেন,- ‘তাহলে, বলা হয় যে, আবিসিনিয়ায় হিজরত করা একটি দল এই ঘটনা শুনে (মুহাম্মদ (সাঃ) কুরাইশদের দেব দেবীকে মেনে নিয়েছেন) ফেরত আসলো, তাদের ব্যাপারে কী বলবে?’
সাজিদ বললো, – ‘হ্যাঁ, তারা ফেরত এসেছিলো ঠিকই, কিন্তু তারা ফেরত এসেছে এই ঘটনা শুনে নয়, অন্য ঘটনা শুনে। নব্যুয়াতের ৫ম বছরে তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ লোক উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এবং হামজা (রাঃ) এর মতো প্রভাবশালীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে শোনার পরে, মক্কার পরিস্থিতিকে কিছুটা নিরাপদ ভেবে, তারা ফেরত এসেছিলো। তথাকথিত Satanic Verses নাজিলের কথা শুনে নয়।প্রত্যেক সহী রেওয়াতেই এটার বর্ণনা পাওয়া যায়।’
সবাই চুপ করে আছে। সাজিদ বললো,- ‘পিকলু দা?’
– ‘হু’
– ‘আচ্ছা, তুমি ইশ্বরে বিশ্বাস করো?’
– ‘নাহ।’
– ‘ঠিক তো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘বিশ্বাস করো যে, ইশ্বর বলে কেউ নেই?’
– ‘হুম। ইশ্বর বলে কেউ নেই।’
– ‘আচ্ছা, তুমি কী বিশ্বাস করো শয়তান বলে কেউ আছে যাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, বোঝা যায় না?’
– ‘আরে নাহ! আমি অমন ফাউ জিনিসে বিশ্বাস টিশ্বাস করি না।’
– ‘ঠিক বলছো তো?’
– ‘হ্যাঁ।’
এবার সাজিদ হোঁ হোঁ করে হাসা শুরু করলো। এরপরে বললো,- ‘তাহলে কী করে তুমি সালমান রুশদীর Satanic Verses কে বিশ্বাস করছো যেখানে তুমি ‘শয়তান’ বলে কিছুতে বিশ্বাস-ই করো না? সালমান রুশদীকে বিশ্বাস করতে হলে তোমাকে আগে শয়তানের উপরে ঈমান আনতে হবে। তারপরেই না Satanic Verses (শয়তানের আয়াত) বিশ্বাস করা যাবে। হাহাহাহা……’
এতোক্ষণের নীরবতা ভেঙে সবাই এবার হাসিতে ফেঁটে পড়লো। অট্ট হাসিতে ভরে উঠলো আমাদের আড্ডা।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। পিকলুদা, পঙ্কজ দা আর সৌরভ উঠে হাঁটা ধরলো। আমরা মসজিদের পথ ধরলাম।
দূরে পাখিরা নিজ নিজ আলয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমি আর সাজিদ পাশাপাশি হাঁটছি। ভাবছি, ইশ! আজকের আড্ডাটা আরেকটু দীর্ঘ হলেও পারতো……!
============
‘স্যাটানিক ভার্সেস এবং বাংলা নাস্তিকদের শয়তানের উপর ঈমান আনয়নের গল্প’/
সাজিদ সিরিজ, পার্ট- ০২, পর্ব- ০২
============
লেখকঃ আরিফ আজাদ
Related search: দি স্যাটানিক ভার্সেস, satanic verses in bangla, দ্য স্যাটানিক ভার্সেস, সালমান রুশদি, দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস সালমান রুশদি, শয়তানের বাণী satanic verses সালমান রুশদীর জীবনী, দি স্যাটানিক ভার্সেস শয়তানের বাণী, satanic verses in bangla, সালমান রুশদীর জীবনী satanic verses স্যাটানিক ভার্সেস এর মিথাচার, Satanic Verses online pdf.
masaallah
ReplyDeleteHa ha ha
ReplyDeletePost a Comment