কুরআনে কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ (Trinity) নিয়ে ভুল তথ্য আছে?


কুরআনের সঠিকত্ব বা accuracy নিয়ে প্রশ্ন তুলে খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কুরআনে ত্রিত্ববাদ(trinity) সম্পর্কিত তথ্য।ইসলাম বিরোধী এসব প্রচারকের দাবি হচ্ছেঃ কুরআনের লেখক খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে জানতেন না(!!), কুরআনে খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদকে নাকি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে(নাউযুবিল্লাহ)।তারা বলে-- কুরআনে নাকি বলা হয়েছে খ্রিষ্ট ধর্মের ত্রিত্ববাদ ঈশ্বর, যিশু{ঈসা(আ)} ও মরিয়মকে নিয়ে গঠিত।অথচ খ্রিষ্টানরা এভাবে ত্রিত্বে বিশ্বাস করে না; তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রিত্ব(trinity) ঈশ্বর, যিশু ও পবিত্র আত্মাকে নিয়ে গঠিত।
.
এই দাবির স্বপক্ষে তারা কুরআনের সুরা মায়িদাহর ১১৬নং আয়াত দেখায়।
.
 “ যখন আল্লাহ বললেনঃ হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি লোকদেরকে বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন; আপনি পবিত্র! আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই পরিজ্ঞাত; আপনি তো আমার মনের কথা ও জানেন এবং আমি জানি না যা আপনার মনে আছে। নিশ্চয় আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত।“
(কুরআন, মায়িদাহ ৫:১১৬)

.
লক্ষ্য করুন, এ আয়াতে ঘুণাক্ষরেও ত্রিত্ব/তিন এরকম কোন কথা নেই। এখানে শুধুমাত্র খ্রিষ্টানদের দ্বারা ঈসা(আ) ও মরিয়ম(আ) এর উপাসনা করার কথা বলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট আয়াত চেক করতেই খ্রিষ্টানদের ভ্রান্ত দাবির অসারতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
.
এখন প্রশ্ন আসতে পারেঃ খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কুরআন কী বলে?
পবিত্র কুরআনে মোট ২টি আয়াত পাওয়া যায় যাতে ত্রিত্ববাদের কথা আলোচিত হয়েছে।চলুন দেখি সে আয়াতগুলোতে প্রকৃতপক্ষে কী বলা হয়েছে।
.
 “নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলেঃ আল্লাহ #তিনের_এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোন উপাস্য নেই। যদি তারা স্বীয় উক্তি থেকে নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরে অটল থাকবে, তাদের উপর যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পতিত হবে।”
(কুরআন, মায়িদাহ ৫:৭৩)
.
 “হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল এবং তাঁর বাণী যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং রূহ-তাঁরই কাছ থেকে আগত। অতএব, তোমরা আল্লাহকে এবং তার রসূলগণকে মান্য কর। আর একথা বলো না যে, আল্লাহ #তিনের_এক, একথা পরিহার কর; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমান সমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তার। আর কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।”
(কুরআন, নিসা ৪:১৭১)
[সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর অনুবাদ নেয়া হয়েছে এই ওয়েবসাইট থেকেঃ https://goo.gl/PRw2Up এবং https://goo.gl/DFwlQn ; অনুবাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ]
.
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ত্রিত্ববাদ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোতে মোটেও মরিয়ম(আ) এর কথা উল্লেখ নেই! 
অর্থাৎ কুরআনে ত্রিত্ববাদবিষয়ক তথ্যে ভুল আছে—নাস্তিক ও খ্রিষ্টান প্রচারকদের এই অভিযোগটি নির্জলা মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। 
.
বিরোধিরা হয়তো বলবেনঃ সরাসরি ত্রিত্বের কথা না থাকলেও কুরআন তো সুরা মায়িদাহর ১১৬নং আয়াতে দাবি করছে খ্রিষ্টানরা মরিয়মের উপাসনা করে। এই তথ্য কতটুকু সঠিক? কোন খ্রিষ্টান কি মরিয়ম(আ) এর নিকট প্রার্থনা করে?
.
এর উত্তরে আমরা মুসলিমরা যা বলব তা হচ্ছে—কুরআনের তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক।
বর্তমান পৃথিবীতে খ্রিষ্টানদের যে দল বা ফির্কা আছে, তার মধ্যে সব থেকে বড় ও প্রধান ৩টি দলের দু’টি দল হচ্ছে ক্যাথোলিক ও অর্থোডক্স চার্চ। [১] এই ২ দলের বিশ্বাস হচ্ছেঃ মরিয়ম হচ্ছেন ঈশ্বরের মা(Mother of God)। [২]
শুধু তাই নয়, ত্রিত্বের অংশ মনে না করলেও এরা মূর্তি সহযোগে মরিয়মের নিকট প্রার্থনা করে।ঈশ্বরের নিকট সুপারিশকারী হিসাবে বিশ্বাস করে। [৩]
.
কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুরআন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে তা বর্তমান সময়ের খ্রিষ্টানদের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
.
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় কুরআনে মরিয়ম(আ)কে ত্রিত্ব বা ট্রিনিটির অংশ বলা হয়েছে, তাহলেও সেটি থেকে কুরআনের ভুল বের করা সম্ভব নয়।
.
কারণ-- খ্রিষ্টবাদের ইতিহাস প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো। এ ২ হাজার বছরের ইতিহাসে খ্রিষ্টানদের মধ্যে অজস্র দল-উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে হাজার হাজার খ্রিষ্টান দল ছিল যেগুলো বর্তমানে নেই{যেমনঃ Basilidians, carpocratians, Ebonites}। আবার বর্তমান যুগে অনেক দল আছে যা ২০০ বছর আগেও ছিল না{যেমনঃ Jehovah’s Witness, Mormon}।
খ্রিষ্টবাদের প্রাচীন যুগ থেকে এমন কিছু দল ছিল যারা মরিয়মকে তাদের ত্রিত্বের অংশ বলে বিশ্বাস করত। Mariamites নামক এক খ্রিষ্টান দলের পরিচয় পাওয়া যায় যাদের ত্রিত্ব গঠিত ছিল পিতা(ঈশ্বর), পুত্র(যিশু) ও মাতা(মরিয়ম) নিয়ে। [৪]
Washington Irving ও Hugh Griffith এর মুহাম্মাদ(স) এর জীবনীমূলক বই ‘Mohammed’ এ উল্লেখ করা হয়েছেঃ Mariamiteগণ পিতা,পুত্র ও মাতা{God the Father, God the Son, God the Virgin Mary} এই ত্রিত্বে বিশ্বাসী ছিল। এ ছাড়া Collyridianনামে আরব অঞ্চলে একটি খ্রিষ্টান দল ছিল যারা কুমারী মরিয়মকে পুজা করতো ও তাঁর জন্য উৎসর্গ করতো। [৫]
এ ছাড়া George Sale, Reverend Gilbert Reid D.D, William Cook Taylor, John Henry Blunt D.D, Allan Freer, John William Draper, Reverend James Gardner সহ আরো অনেক খ্রিষ্টান বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন যেঃ খ্রিষ্টধর্মের প্রাচীনকাল থেকেই বেশ কয়েকটি দল ছিল যারা কুমারী মরিয়মের উপাসনা করত এমনকি সরাসরি ত্রিত্বের অংশ হিসাবে বিশ্বাস করতো। [৬]
.
উপরের আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হল—যারা কুরআন থেকে ভুল বের করতে যায়, তারা নিজেরাই বিশাল এক ভুলের মধ্যে নিপতিত আছে। আল্লাহ্‌ এই অজ্ঞতা ও বিপথগামিতা থেকে সকলকে রক্ষা করুন।
.
 “ মরিয়মের পুত্র মাসিহ{ঈসা(আ)} তো একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তার পূর্বে আরও বহু রাসূল গত হয়েছে, আর তার মা একজন পরম সত্যবাদিনী, তারা উভয়েই খাদ্য আহার করত। লক্ষ্য কর! আমি কিরূপে তাদের নিকট প্রমাণসমূহ বর্ণনা করছি। আবার লক্ষ্য কর! তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে?
বল - তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করবে, যা তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি ও উপকারের ক্ষমতা রাখে না? আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’।
বল - হে আহলে কিতাবগন(খ্রিষ্টান), তোমরা স্বীয় ধর্মে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না এবং ঐ সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।“
(কুরআন, মায়িদাহ ৫:৭৫-৭৭)
.
===
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার [ফেসবুক id: Muhammad Mushfiqur Rahman Minar ]
#সত্যকথন
.
তথ্যসূত্রঃ
[৩] ■ খ্রিষ্টানদের মরিয়মের নিকট প্রার্থনার ছবিঃ https://goo.gl/4BHNls
[৫] ■ বইটির গুগল বুক লিঙ্কঃ https://goo.gl/3cz8y1 
■ Collyridianদের ব্যাপারে আরো দেখুনঃ http://www.biblicalcyclopedia.com/C/collyridians.html 
[৬] বিস্তারিত দেখুনঃ

অফিসিয়াল ওয়েব সাইট ঃ shottokothon.com  এবং response-to-anti-islam.com

ফেসবুক পেজঃ fb.com/shottokothon1

Post a Comment

Previous Post Next Post