রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মিথ্যাবাদী ছিলেন না


হৃদয়,
তোমাকে এই চিঠিতে ‘তুমি’ করে লিখছি একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে। সেটা হচ্ছে, এই চিঠিতে আমি তোমার শিক্ষক বলতে পার। তোমাকে বেশ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার ভাবতে শেখানোর চেষ্টা আমি করব শিক্ষক হিসেবে। এবং শিক্ষক হিসেবে আমি যেহেতু ছাত্রদেরকে ‘তুমি’ ডেকেই অভ্যস্ত তাই এখানে সেই সম্বোধনই ব্যবহার করব। আশা করছি, চিঠি হওয়ায় তোমার কাছে এটা একটুও দৃষ্টিকটু লাগবে না। আর যদি লাগেও, কিচ্ছু করার নাই এখন, কারণ টাইম নাই এটা ঠিক করার। মূল চিঠি আমি লিখে ফেলেছি। এটাচমেন্ট হিসেবে এই চিঠির প্রথমাংশের পরে সংযুক্তও করে দিয়েছি। অসম্ভব হাত ব্যথা করছে।

মূল আলোচনায় তোমাকে আমার পাঁচটা পয়েন্ট বলার কথা ছিল, মনে আছে? কী নিয়ে তা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মিথ্যাবাদী ছিলেন না, সত্যবাদী, ফলে সত্য নবী ছিলেন, এটার পক্ষেই উনার জীবনী থেকে পাঁচটা পয়েন্ট দেয়ার কথা ছিল ভাবার জন্য, বুঝার জন্য। আমি পাঁচটার বেশি পয়েন্ট এখানে তোমাকে লিখেছি। থ্যাঙ্কস টাইপের চেহারা বানানোর কিছু নাই, কারণ এটা কোন ব্যাপার না। আসল ব্যাপার হচ্ছে, তোমার কল্পনাশক্তি এবং ভাবনাশক্তির ব্যবহার। অসম্ভব শক্তিশালী একটা ইতিহাসকে তোমার এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে, বুঝতে হবে, নিজেকে প্রফেট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জায়গায় হুবহু দাঁড়া করাতে পারতে হবে, উনার পরিস্থিতিটা উনার চোখ দিয়েই দেখবার চেষ্টা করতে হবে, একজন মানুষের হৃদয় নিয়ে এই ইতিহাসকে অনুভব করার সাহস থাকতে হবে।

পারবে তুমি? তোমাকে পারতে হবে। যিনি সর্বস্নেহশীল এবং নিরন্তর মমতাময়, আমি তাঁর দরবারে প্রার্থনা করছি তিনি যেন তোমাকে এই ইতিহাসকে, ইতিহাসের সত্যকে নিজের হৃদয় দিয়ে দেখবার, বুঝবার, সত্যি সত্যি অনুভব করবার সামর্থ্য দেন, ইন্দ্রিয়ের ফাঁদ আর চাওয়া পাওয়ার নীচতাকে অতিক্রম করে সত্যকে বুঝার পর একে সত্যের মর্যাদা দিয়ে মাথা পেতে মেনে নিয়ে সম্মানিত হবার সততা আর সৎসাহস দেন।

আর শোন, চিঠিটা এখনই পড়বার দরকার নেই। ভাল করে পবিত্র হয়ে, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে, খোলামন নিয়ে তারপরে পড়তে বসবে প্লিজ। ঠিক আছে? একটাই অনুরোধ, একটা পয়েন্ট ভালভাবে সততার সাথে বুঝে নিয়ে শেষ করার আগে, পরের পয়েন্টে যাবে না, তাড়াহুড়া করবে না। ওকে?

প্রথম চিন্তা
একজন মানুষ মিথ্যা কথা কেন বলে? কিছু অর্জনের জন্যেই তো? তো একজন পুরুষ জীবনে কী কী অর্জন করতে চাইতে পারে? কর্তৃত্ব-ক্ষমতা, ধন-সম্পদ, জায়গা-জমি এবং নারী, ফলশ্রুতিতে উন্নত সামাজিক স্ট্যাটাস, সম্মান। এইতো? তো, মুহাম্মাদকে তো এর সবগুলোই সম্মান আর মর্যাদার সাথে তৎকালীন ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে অফার করা হয়েছে, তাই না? বিনিময়ে জাস্ট মানুষকে সত্য জানানোর ব্যাপারে চুপ থাকতে বলা হয়েছে। মিথ্যা কথা বলার মাধ্যমে এক জীবনে সর্বোচ্চ যা কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখা সম্ভব, তার সবগুলোই যখন অনায়াসে পাওয়া যাচ্ছে শুধুমাত্র সসম্মানে আপোষের চুক্তির মাধ্যমে, তখনতো আর মিথ্যা বলার প্রশ্নই আসে না। তাই না?
কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে দেখ। উনার উত্তর ছিল কড়া ঋণাত্মক এবং আপোষহীন। কেন? কারণ, উনি একজন নির্বাচিত বার্তাবাহক, মানবজাতির শিক্ষক। এই নির্বাচন উনার নিজের করা না, এই গুরুদায়িত্ব উনি নিজে নেননি, কেউই নিবে না। মানবজাতিকে ভয়ংকর পঙ্কিলতার অন্ধকার থেকে তুলে সেবা-যত্ন, ভালবাসা, এমনকি প্রয়োজনে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তুলবার এই পবিত্র দায়িত্ব যিনি দিয়েছেন, সেই অসম্ভব ক্ষমতাবানের কথার বাইরে যাবার দুঃসাহস কোন সুস্থ মানুষেরই হবে না ভয়ে, আর উনিতো সত্য নবী, যিনি আল্লাহকে চিনেন, জানেন, বুঝেন, ফলে অসম্ভব ভয়ও করেন!
তাই না?

দ্বিতীয় পয়েন্ট
একটা মানুষ। সৎ মানুষ, ভাল মানুষ, নরম মনের মানুষ হিসেবে পুরোটা জীবন কাটিয়েছেন। তিনি যদি বার্তাবাহক হবার ব্যাপারে মিথ্যা বলতেন, তাহলে কি অন্যায়ভাবে এতগুলো কাছের মানুষকে চোখের সামনে প্রতিদিন নির্যাতিত হতে দেখে, খুন হতে দিয়ে, ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে হলেও সত্যকে লালন করবার কষ্ট-যন্ত্রণা দেখে চুপ থাকতে পারতেন? কোন সাধারণ ভাল মানুষই তো এইক্ষেত্রে চুপ থাকতে পারবে না, ঠুনকো মিথ্যার বেসাতি থেকে বেরিয়ে আসবে, নিজের মিথ্যার কারণে মানুষের নির্যাতন, শাস্তি, যন্ত্রণা আর খুন একজন ভাল মানুষকে কুরেকুরে খাবে। আর সেখানে ইতিহাসের পাতা সাক্ষী যে, তিনি ছিলেন ঐ সময়ের সবচাইতে ভাল মানুষ, আস্থাবান মানুষ, কোমল হৃদয়ের মানুষ। সারাজীবন মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি, ভালবাসা, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো আর গোত্রবাদ-জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে হলেও ন্যায়প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার তরুণদের নিয়ে তরুণ বয়স থেকেই হিলফুল-ফুযুল নামক সংগঠনের সূচনা, এগুলো কি কাছের মানুষগুলোর অযথা নির্মম অত্যাচার মুখ বুজে সইবার সাথে সাংঘর্ষিক না? সৎভাবে চিন্তা করে দেখ, দেখবে একটাই উত্তর পাবে বারবার। হ্যাঁ, একটাই উত্তর-
উনি সত্য নবী ছিলেন।

তিন নং খোরাক
মক্কার সব কিছু ছেড়েছুড়ে মদীনা চলে যাওয়ার পরেও শান্তি ছিল না। মদীনার ইহুদীরা আর মক্কার কুরাইশরা যেকোন সময় গুপ্ত হামলা করে জীবন শেষ করে দিতে পারে, এমন বেশ কিছু ঘটনা আর ইঙ্গিত পাওয়ার পর উনার এবং উনার সাথীদের সবার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। রাতে উনিও ঘুমাতে পারেন না, উনার সাথীরাও না। কারণ, অসাধারণ এই মানুষটার সত্যতা তাঁর কাছের সাথীদের চাইতে বেশি আর কে দেখেছে, কে বুঝেছে? ফলে, পৃথিবীতে উনার প্রয়োজনীয়তা যারা বুঝে, উনার অসাধারণ স্নেহময় আর ব্যক্তিত্ববান চরিত্র যারা কাছ থেকে দেখে প্রতিদিন, তারা যে উনাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসে! আর তাই তাদের চোখেও টেনশানে ঘুম আসে না। উনার তাঁবুর পাশে তাই সশস্ত্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রাত কাটানোতেই যে শান্তি! নিরাপত্তা দিয়ে উনাকে ঘুমানোর সুযোগ করে দেয়াটাই যে একজীবনের পরম সৌভাগ্য!

তো, এক রাতে কী হল, উনি বললেন আর পাহারার প্রয়োজন নেই। কেন? কোন নেতা কি এরকম ভয়াবহ অবস্থায়ও পাহারার প্রয়োজন নেই বলবে? কেন তিনি চলে যেতে বললেন পাহারার দরকার নেই বলে? কারণ, ঐশীবাণী এসেছে যে! যে বাণীতে বলা হয়েছে উনার জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিজেই নিয়ে নিয়েছেন। কী? আল্লাহই উনার নিরাপত্তা দিবেন! আচ্ছা, ভেবে দেখ তো, একজন মিথ্যাবাদী লোভী নেতা কি কখনোই নিজের পাহারাদারকে বিদায় দিয়ে নিজের বিপদকে ডেকে আনবে? নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি নিবে? কক্ষনো না। কিন্তু উনিতো আর মিথ্যাবাদী নেতা নন। আয়াতের ব্যাপারেও মিথ্যা তিনি বলেননি, বলতে পারেন না। আর তাই সেই সত্য আয়াতে উনার আস্থাই সবচাইতে বেশি ছিল। নিশ্চিন্তে সবাইকে বিদায় করে দিয়ে উনি নিজে শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছিলেন, উনার সাথীরাও। এটাই কি প্রমাণ করে না যে উনি সত্য নবী, মিথ্যাবাদী নন? মিথ্যাবাদী হলে তো ইচ্ছেমত আয়াতের কথা বলে তিনি আরো নিরাপত্তা আর সশস্ত্র পাহারাদারের ব্যবস্থা করতেন, তাই না? তিনি সত্য নবী বলেই, সত্য আয়াতের ধারক-বাহক বলেই আয়াত অনুযায়ী কাজ করেছিলেন নিশ্চিন্তে আর জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত উনার জীবনকে আল্লাহ সব শত্রুর হাত থেকে আসলেই হিফাজাত করেছিলেন।

উনি যে সত্য নবী ছিলেন, এটা মেনে নিয়ে সত্যের কাছে মাথা নুইয়ে দেবার জন্য এই একটা ঘটনাই তো একজন সৎ আর বিবেকবান বুদ্ধিমান মানুষের জন্য যথেষ্ঠ!

ঘটনা চার
যুদ্ধের ডামাডোল আর খাবারের অভাবে গরীব সাথীদের যখন ক্ষুধায় অস্থির লাগছে তখন মিথ্যাবাদী নেতা হিসেবে উনার আয়েশ করার কথা। কিন্তু না, উনি সাথীদের সাথে একসাথে ময়দানে নেমে এসেছেন। সবার আপত্তি সত্ত্বেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাদা-পানি-ধুলায় মাখামাখি হয়ে কাজ করেছেন একসাথে। যেটা এখন তো বটেই, তৎকালীন নেতারাও করতেন না। কিন্তু তিনি যে নেতা হয়ে কর্তৃত্ব ফলিয়ে সম্মানের আসনে বসতে চাননি সেই প্রমাণ এখানেই।

সেই ভয়ংকর দূর্দিনে সবার ক্ষুধার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে অনেকেই পেটের ব্যথাকে চাপা দিতে পেটে একটা করে পাথর বেঁধেছিল। আর উনি? উনার ব্যথা ছিল এর চাইতে অনেকগুণ বেশি। এত বেশি ছিল যে অন্যদের চাইতে শারিরীক ভাবে মজবুত হওয়া সত্ত্বেও ব্যথার তীব্রতায় উনার পেটে বাঁধা ছিল দু’টো পাথর। এরপরেও যদি কেউ বলে যে উনি এই কারণে, সেই কারণে মিথ্যা বলেছেন, তাহলে এর চাইতে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে? সাথীদের নির্যাতন, খুন হওয়া দেখে, দেশছাড়া হতে দেখে, নিজে নির্বাসনে গিয়ে, নিজে দেশ ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়েও, বারবার যুদ্ধে আর স্বজন হারানোর ব্যথার মুখোমুখি হয়েও পনের বছরের বেশি সময় ধরে একটা মিথ্যাকে চালিয়ে নেবেন এমন কোন মানুষ কি হতে পারে? কক্ষনো না। কেউ মিথ্যাবাদী হলে এমন দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার অনেক অনেক আগেই যে হাল ছেড়ে দিয়ে জীবনের মায়ায়, ভোগের লোভে ঠিক হয়ে যেত, কিংবা নতুন জীবন শুরু করত! কিন্তু উনি তা করেননি। কেন?

কারণ একটাই। উনি সত্য ছিলেন। নবী ছিলেন।

পঞ্চম অনুরণন
এখানে পাঁচ নং পয়েন্টে কয়েকটা ভাবনার খোরাক দিব। যদিও আর পয়েন্ট দেয়ার প্রয়োজন নেই। একজন ঠান্ডা মাথার চিন্তাশীল মানুষের জন্য এতক্ষণ দেয়া উদাহরণগুলো যথেষ্টর চাইতেও বেশি। উপরের পয়েন্টগুলো আবার ভাবো। ভেবে দেখ, কিসের লোভে উনি মিথ্যা বলবেন? কেন মিথ্যা বলবেন? নির্ঝঞ্ঝাট জীবন বাদ দিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তায় আর অসম্ভব নির্যাতনের মুখে নিজের জীবন, নিজের পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথীর জীবনকে ঠেলে দেয়ার জন্য? নিজেকে নির্বাসনের অনিশ্চিত জীবনে অনিশ্চিত সময়ের জন্য ঠেলে দিয়ে কি বছরের পর বছর কেউ মিথ্যায় অটল থাকে? অথচ যেহেতু উনার জীবনী তুমি পড়েছো, তুমি ভালভাবেই জান মক্কার সেই নির্বাসনের সময়টা কী দুঃসহ যন্ত্রণার ছিল। এরপরে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য ভূমিতে চলে যেতে বাধ্য হওয়া। তবুও একটা বার্তাকে সত্য জেনে আঁকড়ে ধরে থাকা। কেন?

সেই নতুন ভূমিতে গিয়েও তো শান্তি মেলে না! গুপ্তহত্যার টেনশান, ইহুদীদের একের পর এক কুৎসিত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা, মক্কা থেকে কুরাইশদের একের পর এক হামলা। সেই যুদ্ধগুলোর প্রথমটাতেই অংশগ্রহণ করতে হয় সামরিকভাবে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায়। তবুও কেন তিনি অংশ নিয়েছিলেন? কেন পালাননি? কিভাবে সেই গুটিকয়েক সাথী নিয়ে সামরিক সাজে সজ্জিত তিনগুণের চাইতেও বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন? কার উপর আস্থা রেখে? আল্লাহ বিজয় তো দিয়েছেন পরে, কিন্তু তাঁর সাহায্যের উপরে আস্থা রেখে কোন মিথ্যেবাদী বুদ্ধিমান কি প্রস্তুতি ছাড়াই রণক্ষেত্রে অংশ নিবে এক বিশাল প্রস্তুত আর্মির বিরুদ্ধে? কখনোই না। তাহলে কেন?

কারণ উনি একজন সত্য নবী ছিলেন। উনি জানতেন আল্লাহর জন্য, সত্যের জন্য যে লড়াই, সেখানে সত্যপন্থীরা কখনোই পরাজয় বরণ করতে পারে না।

নিজের হৃদয়ের চোখের আরও একটা ভীষণ যুদ্ধক্ষেত্রের চলচ্চিত্র গড়ে নাও আজকে, যেখানে তোমার সঙ্গীসাথীর বিশাল এক অংশ, বলা যায় প্রায় সবাই দিশেহারা হয়ে পালাচ্ছে ছত্রভঙ্গ হয়ে। কী চিন্তা আসবে ঐ মূহুর্তে তোমার? আমি হলে তো পালানোটাকেই যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি বলতাম! আর যদি মিথ্যাবাদী, ভোগী, লোভী হতাম? তাহলেতো সেই পালিয়ে যাওয়া সাথীদের মাঝে আমি নিজেই সবার আগে থাকতাম। কারণ, বেঁচেই যদি না থাকি, যুদ্ধক্ষেত্রে যদি মারাই যাই, তাহলে লোভের সম্পদ, এই সুন্দর জীবনটা ভোগ কে করবে? কিন্তু হুবহু এমন পরিস্থিতিতে তিনি ঠিক উল্টোটা করেছিলেন।

সবাই যখন তিরবৃষ্টিতে দিশেহারা হয়ে পালাচ্ছে পড়িমরি করে, তখন তিনি নিজের ঘোড়াকে হাঁকিয়ে দিয়েছেন শত্রুদের দিকেই। তিরবৃষ্টির তীব্র ধারাকে উপেক্ষা করে কে এভাবে এগিয়ে যেতে পারে? কে মৃত্যুর মুখে নিজে দাঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া সাথীদেরকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে নির্দ্বিধায় এই বলে চিৎকার করে যে-

“আনান নাবিয়্যু, লা- কা-জিব, আনা-বনু আব্দুল মুত্তালিব”
“মিথ্যাবাদী নই, নবি আমি, আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র আমি”

একজন মিথ্যাবাদী কি মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দিতে পারবে? কখনোই না। উনার এই রণচিৎকার শুনে সাথীদের হুঁশ ফিরেছিল। তারা দলেদলে আবার ময়দানে যোগ দিয়ে বীরবিক্রমে বিজয়লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে ফিরে আসেন দলে দলে। কেন? কারণ, তারা ভালভাবেই জানতেন যে উনি সত্য নবী। উনার রণহুঙ্কার শুনে জীবনভয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর হুঁশ ফিরে আসে, মনে পড়ে যায় যে সত্য নবীর পাশে থাকার সম্মান ছেড়ে কোন জিল্লতির জীবনকে আমরা বেছে নিচ্ছি? কোথায় গিয়ে বাঁচবো, কে আমাদেরকে সত্যি সত্যি বাঁচাবে যদি আল্লাহর প্রেরিত সত্য নবীকেই ছেড়ে উনাকে বিপদের মুখে রেখে পালিয়ে যাই? কোন আসমান আমাকে ঠাই দিবে, কোন জমীনের উপরে আমি দাঁড়াবো, যদি বাঁচতে গিয়ে খোদ আল্লাহর ক্রোধকেই কিনে নিই? তাকিয়ে দেখলেন, নির্ভীক আহবান জানাতে জানাতে তিরের দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে তীব্রবেগে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রাণের চাইতে প্রিয় নবীজি আর সেটা দেখার পরেও আমি কিনা পালাবো? কক্ষনো না। কোনদিনও না।

স্ট্যাটাস আর সম্পদ ভোগের জন্য মিথ্যা? কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যা? নিজের পরিবার পরিজন সহ, সঙ্গীসাথী সবার জীবনকে মৃত্যুর সামনে সঁপে দিয়ে? সম্ভব? নেতা হবার জন্য মিথ্যা? যে মানুষটা মদীনায় নেতা হবার পর অন্যের জন্য সব বিলিয়ে দিয়ে এমন অবস্থায় দিন কাটাতেন যে সেই নেতার ঘরেই টানা দুই মাস চুলায় রান্না করার মত খাবার থাকত না, শুধু খেজুর আর পানি দিয়ে মাসের পর মাস পার করতে হতো, কখনোবা টানা দুই-তিন দিন পেটে একটা দানা পড়তো না, তবুও সত্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে তিনি একদিনের জন্যেও পিছু হটেননি, সেই তাঁকে যারা লোভী আর মিথ্যাবাদী বলবে তাদেরই তো লজ্জায় অপমানে মরে যাওয়া উচিৎ।

এই মানুষটাই তো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন বিনয়ী হবার জন্য, বিনয়ীদের মাঝে মৃত্যুবরণ করার জন্য। যে মানুষটা মনেপ্রাণে এই দুয়া করতেন, গরীবদের মাঝে থাকতেই ভালবাসতেন সাদাসিধে হয়ে, একসাথে বৈঠকে থাকা অবস্থায় যে নেতাকে বাইরের মানুষ এসে আলাদা করে নেতা হিসেবে কখনো চিনে নিতে পারতো না, সেই মানুষটা ক্ষমতা আর সম্পদের লোভে উদ্ধত হয়ে মিথ্যা বলবেন, এও কি সম্ভব?
এক বেদুইন মহিলা যে মানুষটাকে খুঁজতে এসে পেয়ে সম্মানে, ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে, যে মানুষটা তখন এই বলে উনাকে আশ্বস্ত করেছেন, সহজ করে নিয়েছেন যে, ‘আরে! আমিতো এমন এক সাধারণ মহিলার সন্তান যে কিনা শুকনো মাংস খেত!’ সেই মানুষটাকে যদি কেউ বলে যে “এ লোক খ্যাতি-প্রতিপত্তি আর সম্মানের লোভে মিথ্যা বলছে”, তাহলে আমিও জগতের কাছে প্রশ্ন করতে চাই, এই সাদাসিধে সবাইকে আপন করে মানুষটা যদি মিথ্যাবাদী হয় তবে এ জগতে সত্যবাদী কে?

আর কত বলবো? কত উদাহরণ চাও তুমি? উনার জীবনীর পবিত্র অধ্যায়গুলো থেকে যে বড় ঘটনা ইচ্ছে নিয়ে এসো, প্লিজ। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব যে তিনি সত্য নবী ছিলেন।

ঐশী বার্তাবাহক আর শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হবার সেই প্রথম ক্ষণটার বর্ণণা আরেকবার মনে করে দেখ। হৃদয়ের আয়নায় নিজেকে সেখানে কল্পনা কর। পড়তে, লিখতে জানতেন না যে মানুষটা, যে মানুষটার কোন শিক্ষক ছিলো না, সেই মানুষটা পাহাড়ের কোলের নির্জন গুহায় দিনযাপন বেছে নিয়েছিলেন। অন্তরের অস্থিরতাকে অনুভবের স্থিতিতে নিতে, জীবনের উদ্দেশ্যকে চিন্তার মাত্রা ছাড়িয়ে অনুভবে পৌঁছাতে, অন্তরের শূন্যতা পূরণ করতে যাকে প্রয়োজন তাঁকে হৃদয়ের গহীনে খুঁজে পাওয়ার জন্য, বুঝে নেয়ার জন্য হৃদয়কে যে স্থির আর শান্ত হতে হবে আগে! মানুষের যান্ত্রিক কোলাহল আর আত্মিক দূষণে তা যে অসম্ভব! আর তাই মানবিক দূষণের ধূম্রজাল পেরিয়ে প্রকৃতির নির্মলতার কোলেই ফিরে যেতে হয়, আর সেই হিসেবে পাহাড়ের কি বিকল্প আছে? সেই পাহাড়েই যখন পবিত্র মানুষটার কাছে ঐশী বার্তা নেমে এল তখন ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। মারাই যাচ্ছিলেন প্রায়। সেই অবস্থাতেই কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে এসেছিলেন তিনি, মিথ্যা নবুওয়্যাত প্রাপ্তির আনন্দে নাচতে নাচতে নয়।

প্রিয়তমা স্ত্রী উনাকে তৎকালীন প্রাজ্ঞ স্কলার ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে নিয়ে যান। সব বর্ণণা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশদ শুনে বুঝে বিজ্ঞ স্কলার যখন বলেন, এ যে সেই ফেরেশতা, সেই এইঞ্জেল, যে তোমার আগে অন্য নবীদের কাছে বার্তা নিয়ে আসতো, তখন মুহাম্মাদের মুখে হাসি ফোটেনি। আনন্দের ছাপের জায়গায় সেই পবিত্র মুখে ছিল অপার বিস্ময় আর ভয়। অজানার ভয়। তিনি যে এই ফেরেশতার কথা আগে শুনেননি, পূর্ববর্তী নবীদেরকে চিনেন না! কী হবে এখন? স্কলার যখন আরো যোগ করেন, তোমার জাতির লোকেরা তোমাকে বের করে দেবে, তখন কষ্টে অবিশ্বাসে তিনি কিছুই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিভাবে মানবেন? তিনি যে সবার শ্রদ্ধেয়, সবার ভালবাসার মানুষ! আর তাঁকেই কিনা তারই জাতির লোকেরা অপমান করবে, বের করে দেবে? কিভাবে সম্ভব? ওয়ারাকা এই ঘোষণা দিতেও ভুলেননি যে, যখন সত্যপ্রচারের এই দায়িত্ব মুহাম্মাদকে বুঝিয়ে দেয়া হবে, দুঃসহ দিনগুলি নেমে আসবে, বেঁচে থাকলে ওয়ারাকা অবশ্যই সেই দিনগুলিতে মুহাম্মাদের পাশে থাকবেন নিজের সবটুকু নিয়ে।

জীবনীর এই জায়গাতে আমরা মানব মুহাম্মাদের নবী হয়ে উঠার সংবাদ পড়ে আনন্দে উদ্বেলিত হই, শিহরিত হই। ওদিকে মুহাম্মাদের মুখে সেইদিনের বর্ণণায় কেন এত উদ্বিগ্নতা খুঁজে পাই আমি? কারণ, এরপর থেকে যাকে সবাই রাসুলুল্লাহ বলে ডাকবে, যার নামের শেষে সসম্মানে সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে তাঁর উপরে রহমত আর শান্তি বর্ষিত হবার জন্য দুয়া করবে, সেই মানুষটার চোখের সামনে ছিল দুঃসহ আর কঠিন সব যাত্রা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। ওয়ারাকা বিন নাওফাল নামক এই বিদগ্ধ জ্ঞানীর কথাগুলো কি সত্যি? জানেন না তিনি। তিনি যে জীবনে এই প্রথমবার শুনলেন কথাগুলো! পূর্ববর্তী নবীদের সত্যিকারের অনুসারীরা সবাই উনার আগমনী বার্তার জন্যেই যুগযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল, এমনকি ইহুদিরাও, কারণ, তাদের সবার কিতাবে উনার আগমনের চিহ্নগুলো বিস্তারিত বর্ণিত ছিল। কিতাবগুলো কালের বিবর্তনে মানুষ নিজ নিজ স্বার্থে বিকৃত করে ফেলার পরেও এই সত্যের ঐটুকু ছিটেফোঁটা তখনও বাকি ছিল যা দিয়ে উনাকে চিনে ফেলা সম্ভব। অথচ কী নির্মম পরিহাস! উনি সততা আর সত্যতা প্রমাণের প্রয়োজনে সেই উনাকেই বিধানদাতা এই ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞ রেখে গড়ে তুলেছিলেন, ফলে সব শুনে তিনি পুরোপুরি নির্বাক, নিস্তব্ধ।

কারণ, কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে অসহনীয় এই যাত্রার পূর্বাভাস যে ওয়ারাকার বাকি কথাতেই লুকিয়ে আছে। সম্মানিত এই মানুষটাকে সর্বোচ্চ অসম্মান করতে, এমনকি শহরছাড়া করতেও দ্বিধা করবে না তাঁর নিজের কমিউনিটির লোকেরাই! যে লোকেরা আজ তাঁকে সবচাইতে বেশি ভালবাসে, তারাই! এমনটাই নাকি বারবার ঘটেছিল পূর্ববর্তী বার্তাবাহকদের জীবনে!

মানুষ সত্যকে মানতে পারে না, কারণ সত্য সবসময়েই জীবনকে আমূল বদলে দেয়। চড়া দাম নেয়। হয় সেই সত্যকে গ্রহণ করার কারণে এই জীবনটা দুর্গম-অসহ্য হয়ে আসে পারিপার্শ্বিক সব অনিয়মের ভীড়ে, দুঃশাসনের অত্যাচারে, অথবা এই সত্যকে ত্যাগ করে পরবর্তী জীবনকে পুরোপুরি বিষাক্ত করে ধ্বংস করে রক্তাক্ত করবার দায়িত্বটা নিজের হাতেই তুলে নিতে হয়। যে সত্য এমন চড়া মূল্য দাবী করে বসে জীবনের কাছে, সেই সত্যের বাহককে যে নির্মম অত্যাচারে রক্তাক্ত হতেই হবে! আর সেটাই আমরা বারবার সত্যি হয়ে উঠতে দেখি প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে।

সবার চোখের মণি, স্নেহময় চল্লিশোর্ধ মানুষটাকে এরপর আমরা দেখি মানুষের কাছে সত্যের বাণী নিয়ে যেতে। শুধুমাত্র এক আল্লাহর উপাসনা করবার আহবান নিয়ে যেতে। যিনি সবার প্রার্থনা শোনেন, সবার যত্ন নেন, সবার প্রতিপালন করেন, সেই একমাত্র মালিকের দাসত্বের দিকে আহবান করতে। নিজের মনমত চললে যে নিজের আত্মা কলুষিত হয়, হৃদয়ের ক্ষতি হয়, জগতের ক্ষতি হয়, মানুষের ক্ষতি হয়, অন্যায় আর ইন্দ্রিয় ভোগের জোয়ারে অবিচার মাথা তুলে দাঁড়ায় চারপাশে, প্রতিষ্ঠা পায়। দূর্বল মার খাওয়া শুরু করে সবলের বাহুজোরে, অসহায় আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে বিত্তশালীর বিষম অত্যাচারে। নিজের মনের দাসত্ব ঝেড়ে, অন্য মানুষের দাসত্ব ফেলে এমনকি নিজের ইচ্ছের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙ্গে এক আল্লাহর ইচ্ছেকে সানন্দে মেনে নিয়ে তাঁর দাস হতে হবে? সেই আল্লাহর দেখানো পথেই জীবনকে সাজিয়ে সুন্দর করতে হবে, মনুষ্যত্বের পূর্ণতায় পৌঁছাতে হবে? সত্য আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মনোনীত শিক্ষক আর বার্তাবাহক হিসেবে মুহাম্মাদকে মেনে নিতে হবে? এতে সত্য জিতবে ঠিক আছে, ন্যায় আর সুবিচার প্রতিষ্ঠা হবে, শান্তি আসবে দুনিয়ায় বুঝলাম, কিন্তু আমার ইচ্ছেমত চলার পথে যে সেটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে! আমার আরামের ইন্দ্রিয় ভোগে আর বিলাসিতায় যে তাতে ভাটা পড়ে যাবে! আমি তা মানবো কেন? সত্য প্রতিষ্ঠা হোক, কিন্তু সেই পথে গেলে আমার যে ত্যাগের অর্ঘ্য দিতে হবে, তা আমি মানতে পারব না।

ভোগে মত্ত হয়ে বুঁদ হয়ে শরীরের পশুত্বে বশ হয়ে থাকা মানুষগুলো তাই সত্যকে চায়নি। চাইবে না। চারপাশে তাকিয়ে দেখ, এখনো চায় না। আর তাই এতদিনের ভালবাসার মানুষটাকেই এরপর আমরা দেখি কা’বার প্রাঙ্গণে সর্বসমক্ষে অপমানিত হতে। সম্মানিত পরিবারের ব্যক্তিত্ববান আর রুচিশীল কাউকে দেখেছ কখনো? না দেখলে কল্পনা করে নাও এমন কোন পরিচিত মুখ। চল্লিশোর্ধ সহানুভূতিশীল একটা মানুষকে সবার সামনে মৃত উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে হেনস্থা হবার কথা কল্পনা যে তোমাকে করতেই হবে। অন্তত নিজেকে যে সে জায়গায় ভাবতে হবে, নইলে কোনদিনও বুঝবে না, অনুভব করতে পারবে না এই সত্যের দাম। যে দাম আমার প্রিয় নবিজীকে দিতে হয়েছে নিজের কমিউনিটির দিবানিশি অত্যাচার আর নির্বাসনের যন্ত্রণা মেনে নিয়ে।
এমন কোন পঞ্চাশোর্ধ প্রিয় মানুষ আছে তোমার যাকে অসম্ভব সম্মান কর তুমি? তাহলে সেই মানুষটার সম্মানিত সৌম্য মুখটাকে ভাব এবার। হয়তো তোমার বাবা কিংবা জ্যাঠা কিংবা মুরুব্বী কেউ। ভাব। কল্পনা কর যে এই মানুষটার সবচাইতে কাছের মানুষ, সবচাইতে প্রিয় মানুষ নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মারা গেছে। জীবনের সুখে দুঃখে যিনি সহযোদ্ধার মত পাশে ছিলেন, সেই স্ত্রী মারা গেছেন। কল্পনা করে নাও, সেই চাচা মারা গেছেন যিনি নেতৃস্থানীয় হওয়ায় এলাকার মানুষের অসহ্য অত্যাচারের পরেও পরের দিন আরেকবার বের হবার সাহস করা যেত। হৃদয়ের গহীনে এই দুইটা বটগাছ হারানোর ব্যথা তোমাকে অনুভব করতে হবে, সেই দমবন্ধ হয়ে আসা, চোখে অন্ধকার দেখা পরিস্থিতি তোমাকে অনুধাবন করতে হবে।

এবার চিন্তা কর, এই মানুষটাকে, হ্যাঁ, এই মানুষটাই যখন মানুষকে সত্যের পথে আহবান করার পর রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তখন তাঁকে প্রতি পদক্ষেপে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা অবিরাম পাথরের বৃষ্টিতে মাথা আর শরীরের রক্তে পায়ের পাতার নীচে পর্যন্ত ভিজে থ্যাকথ্যাকে হতে হয়েছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে যখন পবিত্র শরীরটা নিয়ে বসার সুযোগ পেলেন, তখন পায়ের স্যান্ডেল খুলতে গিয়ে দেখেন খোলা যাচ্ছে না। শক্ত হাতে টেনে ছিলে আনতে হয়েছে পা থেকে জমাট বাঁধা রক্তের কারণে। এরপর অসহ্য যন্ত্রণা আর অপমানে কেঁদে কেঁদে অসম্ভব সম্মানিত এই মানুষটা তাঁর মালিককে অনুনয় বিনয় করে কী বলেছেন মনে পড়ে?

বলেছেন, “এরা বুঝে না হে প্রভু, তাই দয়া কর তুমি, ক্ষমা কর এদের।” কিভাবে পেরেছিলেন তিনি প্রশ্ন জাগে না মনে? উত্তরটা হৃদয় ঠিকই জানে যে, তিনি সত্য নবী। মানুষকে অনন্তকালের অনন্ত ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে, সেই তিনি ঐ অত্যাচারীদেরকে দুনিয়ার বুকেও বাঁচাতে চেয়েছেন যেন তাদেরকে পরকালের অসীম আর তীব্র কঠিন শাস্তির থেকে বাঁচানোর সুযোগটা পাওয়া যায়।

এরপরে মাদীনায় যাওয়ার পরেও যুদ্ধ। রক্তপাত। থৈ থৈ ভালবাসা বুকে নিয়ে ঘোরা মানুষটাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পর্যন্ত যেতে হল! দাঁড়াতে হল অন্যায়কে রুখতে, জুলুমের ঘনীভূত অন্ধকারকে আলোতে ভাসাতে, যুগের পর যুগের বেহিসাব রক্তপাত থামাতে তাঁকেও রক্তপাতের পথে দাঁড়াতে হল! আহ! একজন শল্যচিকিৎসক যখন সার্জারীর কাচি-ছুরি হাতে নেন, তখন তাঁকে বাধ্য হয়ে, নিরুপায় অবস্থাতেই তা নিতে হয়। একজন সৎ পুলিশ যখন আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডান্ডা নিয়ে রাজপথে নামেন, একজন সৈনিক যখন অন্যায়ভাবে ধেয়ে আসা শত্রুকে রুখে দিতে, থামাতে রণক্ষেত্রে জীবনবাজি রেখে দাঁড়ান, তখন সেটা বাঁচবার জন্য, মানবতাকে বাঁচানোর জন্যই প্রয়োজন। দেহ থেকে বিষাক্ত অংশকে বের করে না দিলে পুরো দেহটাই যে হারাতে হয়। তাই কখনো রোগের পরে, আর সম্ভব হলে রোগের আগেই প্রতিরোধ করে শক্ত হাতে রুখে দিতে হয় মরণব্যাধিকে। উনাকেও দাঁড়াতে হয়েছিল এই প্রতিরোধকারীর ভূমিকায়। কিভাবে বুঝলাম যে এই ভূমিকা নির্মম কসাইয়ের নয়, বরং নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের হাতে প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসার? বলছি।

মক্কা বিজয়ের দিন। সবাই যুদ্ধের নিয়ম জানে। যুদ্ধেরপরাজিত পরিণাম শত্রুরও জানা। আর এই শত্রুরাতো কেবল যুদ্ধাপরধী নয়, তাদের অপরাধ আরও জঘন্য, আরো বেশি মারাত্মক। কীরকম?

এরা আল্লাহর নির্বাচিত সর্বশেষ সত্যের বাহককে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছে, মুছে দিতে চেয়েছে চিরতরে। উনাকে বারবার আক্রমণ করেছে, মানসিক, শারিরীক নির্যাতন করেছে। সবার সামনে প্রকাশ্যে অপমান করেছে, খুন করতে চেয়েছে। উনাকে সহ উনার পরিবারবর্গকে সামাজিকভাবে একঘরে করে রেখেছে, উনার সন্তান-পরিজনদেরকেও অত্যাচার করেছে, নিগৃহীত করেছে অন্যায়ভাবে। উনাকে সহ উনার সব সাথীদেরকে অন্যায়ভাবে ঘর-ভিটা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে, আবার ঘর ছেড়ে মদীনায় যাওয়ার পথে মাল-সামানও কেড়ে নিয়েছে নির্মম ডাকাতের মত। মদীনায় যাওয়ার পর এরাই দেশদ্রোহীতা উষ্কে দিয়েছে, আবারও গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছে, প্রকাশ্যেও হত্যা করতে এসেছে বিষমাখা তরবারী নিয়ে। এরা বারবার ষড়যন্ত্রের চাষ করেছে আর ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে।

মক্কায়-মদীনায় সত্যপন্থীদের উপরে গোপনে-প্রকাশ্যে নির্মম অত্যাচার করতে, বারবার আক্রমণ করে সবাইকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য ২০ বছরের টানা নিরলস চেষ্টায় একবারও এদের হাত কাঁপেনি। দূর্বল অসহায়দের একের পর এক খুনের চেষ্টা করেছে জানোয়ারের মত। সত্য প্রকাশে বাধা দিয়ে সুবিচার আর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য পৃথিবীর সর্বশেষ সুযোগ, সর্বশেষ নির্বাচিত মানুষটাকেই চিরতরে সরিয়ে দেয়ার বারবার চেষ্টা করা ক্রিমিনালগুলো ভালভাবেই নিজের অপরাধের শাস্তি জানত। সত্যকে চিনেও, চোখের সামনে দেখেও, সেটাকে দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা শাইত্বানের সাথে হাত মেলানো মানুষগুলো আজ পরাজিত, মৃত্যুর মুখোমুখি।

নিজের ভিটেমাটি হারানো, প্রিয় সাথীদের একের পর এক লাশ হতে দেখা, প্রাণপ্রিয় চাচার খুন হওয়ার পরেও সেই দেহকে বিকৃত হতে দেখার যন্ত্রণাসহ আরো অসহ্য সব স্মৃতির কারণ এই জঘন্য কুৎসিত অপরাধীগুলোর ঘাড়ের শাহরগ আজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর তাঁর সাথীদের ধারালো তরবারীর নীচে থরথর করে কাঁপছে। এদের জঘন্য কুৎসিত সব অপরাধের শাস্তিতো একটাই- মৃত্যুদন্ড, আর সেটা এই নিষ্ঠুর অপরাধীদের চাইতে ভাল আর কেউই জানে না।

তবুও ইতিহাসের পাতা চিৎকার করে আজও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহানুভবতার সাক্ষী দিচ্ছে, দিবে। আর তাই তিনি এই বিজয়ের দিনকে স্বাভাবিক সুবিচার আর ন্যায়সঙ্গত বদলার রক্ত দরিয়ায় না ভাসিয়ে পবিত্র হৃদয় থেকে উৎসরিত ভালবাসায় বলে উঠলেন-
“যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম...”
কেন?

কারণ, তিনি যে সত্য নবী! তিনি যে মানবজাতির এই রুগ্ন দেহকে দক্ষ আর স্নেহময় ডাক্তার হয়ে বাঁচাতে এসেছেন, হৃদয়গুলোকে বাঁচিয়ে তোলার সম্ভাবনা অনুভব করা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ডের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তো তাঁকে নির্বাচন করা হয়নি। তেমন মানুষ-ই যে তিনি নন!

চিন্তাশীল, সৎ এবং বিবেকবান একজন মানুষের জন্য এটুকুই যথেষ্ট আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ বার্তাবাহক এবং শিক্ষক হিসেবে উনার সত্যতা বুঝে নেয়ার জন্য, সর্বশেষ এই নবীকে হৃদয়ের উপচে পড়া হ্রদের গহীন থেকে ভালবাসার জন্য, উনার স্নেহ আর আকুলতাকে অনুভব করার জন্য, পুরো জীবনটাকে উনার মাধ্যমে দেখানো-শেখানো সত্যের পথে সাজিয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণতাকে পবিত্র হয়ে ছুঁয়ে দেবার জন্য।

এরপরেও কারও হৃদয় যদি মৃত হয়েই থাকে, মস্তিষ্কের চিন্তার এতগুলো ধাক্কাতেও যদি সে হৃদয় না জাগে, না ভাসে, তাহলে এই সত্য নবীর ব্যাপারে পরবর্তী প্রশ্নগুলোর সমাধানে আমাকে যে যেতেই হবে!

সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আ-লিহি ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লাম।


Writer: Brother Mohammed Touaha Akbar 

Post a Comment

Previous Post Next Post