ক্বালব’ বা অন্তরের সুস্থতা এবং পবিত্রতার জন্য দুয়া



(১) হেদায়েতের উপর অটল থাকা, অন্তর যেন দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তার জন্য দুয়াঃ

আরবীতে হৃদয়কে বলা হয় ‘ক্বালব’, যার একটা অর্থ হচ্ছেঃ যেই জিনিস খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ, মানুষের হৃদয় খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়, একারণে মানুষ আজকে যাকে ভালোবাসে, কাল তাকে ঘৃণা করে। কেয়ামতের পূর্বে এমন হবে যে, মানুষ সকালবেলা ঈমানদার থাকবে, কিন্তু সন্ধ্যা সময় সে কাফের হয়ে যাবে। আবার মানুষ সন্ধ্যাবেলায় ঈমানদার থাকবে, কিন্তু সকালবেলা কাফের হয়ে যাবে। এইজন্য হৃদয় যাতে দ্বীনের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে, ফেতনায় পড়ে হৃদয় যেন পরিবর্তন হয়ে না যায়, পাপাচার, কুফুরী, আল্লাহর নাফরমানির দিকে ঝুকে না পড়ে সেই জন্য আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম নীচের এই দুয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতেন।

=> আনাস রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এই দুয়া অধিক পরিমাণে পাঠ করতেনঃ

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ

উচ্চারণঃ ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব! সাব্বিত ক্বালবী আ’লা দ্বীনিক।

অর্থঃ হে হৃদয় সমূহের পরিবর্তন করার মালিক! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর অবিচলভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখো। তিরমিযীঃ ২১৪০, ইবনে মাজাহঃ ৩৮৩৪, সহীহ।

=> শাহর ইবনু হাওশাব রহি’মাহুল্লাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহাকে বললাম, “হে উম্মুল মু’মিনীন! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার কাছে অবস্থানকালে অধিকাংশ সময় কোন দুয়াটি পাঠ করতেন?”

উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সময় এই দুয়া পাঠ করতেনঃ

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ

হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।

উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহা বলেন, “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি অধিকাংশ সময় “হে মনের পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ” এই দুয়াটি কেন পাঠ করেন?”

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে উম্মে সালামাহ! এরূপ কোন মানুষ নেই, যার হৃদয় আল্লাহ তাআ’লার দুই আঙ্গুলের মধ্যবর্তীতে অবস্থিত নয়। যাকে ইচ্ছা তিনি (দ্বীনের উপর) স্থির রাখেন এবং যাকে ইচ্ছা (দ্বীন হতে) বিপথগামী করে দেন।” তিরমিযীঃ ৩৫২২। সহীহঃ যিলালুল জান্নাহঃ ২২৩।

=> ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “এই দুয়াটি আয়িশাহ, নাওয়াস ইবনু সামআ’ন, জাবির, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ও নুআ’ইম ইবনু হাম্মার (আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন) সাহাবী থেকেও বর্ণিত হয়েছে।”

___________________________________

(২) অন্তরের বক্রতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য ক্বুরআনে বর্ণিত দুয়াঃ

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

উচ্চারণঃ রব্বানা লা তুযিগ ক্বুলুবানা বাঅ’দা ইয হাদাইতানা ওয়াহাব লানা মিল্লাদুনকা রাহ’মাহ, ইন্নাকা আনতাল ওহহাব।

অর্থঃ হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে হেদায়েত দান করার পর তুমি আমাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিয়োনা এবং তোমার নিকট থেকে আমাদেরকে রহমত দান করো। নিশ্চয়ই তুমি অত্যন্ত দয়ালু। সুরা আলে ইমরানঃ ৮।

*অন্তরকে বাঁকা অর্থ হচ্ছে অন্তরে মুনাফেকী, কুফুরী, পাপাচার বা আল্লাহর অবাধ্যতা প্রবেশ করা।

___________________________________

(৩) হাদীসে বর্ণিত সুন্দর একটি দুয়ার অংশ বিশেষঃ

اللّٰهُمَّجْعَلَ القُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِي، وَنُوْرَ صَدْرِي، وَجَلاَءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّيْ

অর্থঃ আল্লা-হুম্মাজআ’লাল ক্বুরআ-না রবীআ’ ক্বালবী, ওয়া নূরা ছদরী, ওয়া জালা-আ হুযনী, ওয়া যাহা-বা হাম্মী।

অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি ক্বুরআনকে বানিয়ে দাও আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার বক্ষের নূর (জ্যোতি), আমার দুঃখের অপসারণকারী এবং দুঃশ্চিন্তার দূরকারী।

উৎসঃ মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯১, নং-৩৭১, শায়খ আলবানী রহি’মাহুল্লাহ তাঁর সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ গ্রন্থে ১/৩৩৭ একে সহীহ বলেছেন।

“ক্বুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে দাও” কথাটির অর্থ কি?

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “এই দুয়ার অর্থ হচ্ছে, যেমন বসন্তকালে বৃষ্টির পানি দ্বারা জমীনের গাছ-পালা প্রাণ ফিরে পেয়ে সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে, ঠিক তেমনিভাবে ক্বুরআন যেন দুয়াকারীর অন্তরে প্রাণ ফিরিয়ে আনে।”

ইমাম আলী ক্বারী রহি’মাহুল্লাহ বলেন, “যেমন বসন্তকালে মৃত যমীনের মধ্য থেকে প্রাণের বিকাশের মাধ্যমে আল্লাহর দয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তেমনিভাবে ক্বুরআন যেন দুয়াকারীর হৃদয়ের অন্ধকার ও কুফুরী দূর করে ঈমান ও ইলম আনয়নের মাধ্যমে আল্লাহর ক্বুদরতের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।”

___________________________________

(৪) হৃদয়ের কুপ্রবৃত্তি থেকে সৃষ্ট অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য দুয়াঃ

আবু আহমাদ শাকাল ইবনু হুমাইদ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমাকে একটি দুয়া শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, তুমি বলোঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِي، وَمِنْ شَرِّ بَصَرِي، وَمِنْ شَرِّ لِسَانِي، وَمِنْ شَرِّ قَلْبِي، وَمِنْ شَرِّ مَنِيِّي

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’উযু বিকা মিন শাররি সামঈ, ওয়া মিন শাররি বাস্বারী, ওয়া মিন শাররি লিসানী, ওয়া মিন শাররি ক্বালবী, অমিন শাররি মানিইয়্যী।

অর্থঃ হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি তোমার নিকট আমার কর্ণ, চক্ষু, জিহবা, অন্তর এবং বীর্য (যৌনাঙ্গের) অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আবু দাউদঃ ১৫৫১। হাদীসটি সহীহ। তিরমিযীঃ ৩৪৯২, নাসায়ীঃ ৫৪৫৯, আহমাদঃ ৩/৪২৯, হাকিমঃ ১/৫৩২।

এই দুয়া নামাযে সালাম ফেরানোর পূর্বে কিংবা যেকোন মুনাজাতে পড়া যাবে।

___________________________________

(৫) সুস্থ এবং পবিত্র অন্তর চাওয়ার জন্য দুয়াঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি তুমি লোকদেরকে স্বর্ণ ও রূপা জমা করতে দেখো, তাহলে তুমি এই দুয়াটা অনেক বেশি পরিমাণে পড়োঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الثَّبَاتَ فِي الْأَمْرِ، وَالْعَزِيمَةَ عَلَى الرُّشْدِ، وَأَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ، وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ شُكْرَ نِعْمَتِكَ، وَحُسْنَ عِبَادَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ قَلْبَاً سَلِيمَاً، وَلِسَانَاً صَادِقَاً، وَأَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ مَا تَعْلَمُ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا تَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا تَعْلَمُ، إِنَّكَ أنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস-আলুকাস্-সাবা-তা ফিল আমরি ওয়াল আ’যীমাতা আ’লার্-রুশদি। ওয়া আস্-আলুকা মু-জিবাতা রহ’মাতিকা ওয়া আ’যাইমা মাগফিরাতিক। ওয়া আস্-আলুকা শুকরা নি’মাতিকা ওয়া হু’সনা ই’বা-দাতিক। ওয়া আস্-আলুকা ক্বলবাং সালীমা-ওঁয়ালিসা-নাং ছ-দিক্বা। ওয়া আস্-আলুকা মিন খয়রি মা- তাঅ’লামু ওয়া আ’ঊযুবিকা মিং শাররি মা- তাঅ’লাম। ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা- তাঅ’লাম। ইন্নাকা আংতা আ’ল্লামুল গুয়ুব।

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করি (দ্বীনের কাজে) অবিচল থাকা এবং সৎপথে দৃঢ় থাকা। আমি প্রার্থনা করি তোমার রহমত এবং ক্ষমা এনে দেয় এমন কাজে অটল থাকা। আমি প্রার্থনা করি তোমার দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং সুন্দরভাবে তোমার ইবাদাত করার যোগ্যতা। আমি তোমার নিকট আরো প্রার্থনা করি বিশুদ্ধ অন্তর এবং সত্যবাদী জিহবা। আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করি তোমার জানা সমস্ত কল্যাণ এবং আশ্রয় চাই তোমার জানা সমস্ত অকল্যাণ হতে। আমি ক্ষমা চাই তোমার জানা (আমার কৃত) সমস্ত খারাপ কাজ থেকে। নিশ্চয়ই তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞাত। হাদীসটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহি’মাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন। সিলসিলাহ সহীহাহঃ ৩২২৮।

এই দুয়া নামাযে সালাম ফেরানোর পূর্বে কিংবা যেকোন মুনাজাতে পড়া যাবে।

___________________________________

(৬) অন্তরে নূর চাওয়ার জন্য দুয়াঃ

আমাদের অন্তরে যাতে আল্লাহ নূর দান করেন তার জন্য একটা দুয়া আছে, যা প্রত্যেকবার মসজিদে যাওয়ার সময় পড়া সুন্নত। তাই ভাইদের উচিত এই দুয়াটা মুখস্থ করা এবং মসজিদে যাওয়ার সময় পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর বোনদের মসজিদে যাওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু তারাও এই দুয়াটা মুখস্থ করে যেকোন মুনাজাতে বা দুয়া মাসুরা হিসেবে পড়তে পারেন।

মসজিদে যাওয়ার সময় দুয়াঃ

اللّهُـمَّ اجْعَـلْ في قَلْبـي نورا ، وَفي لِسـاني نورا، وَاجْعَـلْ في سَمْعي نورا، وَاجْعَـلْ في بَصَري نورا، وَاجْعَـلْ مِنْ خَلْفي نورا، وَمِنْ أَمامـي نورا، وَاجْعَـلْ مِنْ فَوْقـي نورا ، وَمِن تَحْتـي نورا .اللّهُـمَّ أَعْطِنـي نورا

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাজআ’ল ফী ক্বলবী নূরা, ওয়া ফী লিসানী নূরা, ওয়াজআ’ল ফী সাময়ী’ নূরা, ওয়াজআ’ল ফী বাসারী নূরা, ওয়াজআ’ল মিন খলফী নূরা, ওয়া মিন আমামী নূরা, ওয়াজআ’ল মিং ফাওক্বী নূরা, ওয়া মিং তাহ’তী নূরা, আল্লা-হুম্মা আ’তিনী নূরা।

অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে নূর (বা আলো) দান করুন, আমার যবানে নূর দান করুন, আমার শ্রবণশক্তিতে নূর দান করুন, আমার দর্শনশক্তিতে নূর দান করুন, আমার সামনে নূর দান করুন, আমার পেছনে নূর দান করুন, আমার উপরে নূর দান করুন, আমার নীচে নূর দান করুন। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করুন। সহীহ মুসলিমঃ ৭৬৩।

Post a Comment

Previous Post Next Post