[১]
দ্বীনে প্রবেশের শুরুতে আমার সামনে দুটো সার্কেল এসে হাজির হয়। হাজির হয় বলাটা ঠিক নয় আসলে, দুটো ভিন্ন ধারার সার্কেলের সাথে মিশবার সুযোগ তখন আমার সামনে আসে। এই দুই সার্কেলের যেকোন একটিকে বেছে নিয়ে, জীবনের বাকি পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে।
দুটো সার্কেলের প্রথম সার্কেলের সকলে নামায-কালাম পড়েন, দ্বীন নিয়ে ফিকির করেন, কথা-বার্তাও বলেন, দ্বীন নিয়ে কাজও করেন, কিন্তু একইসাথে আমি আবিষ্কার করলাম— তারা বক্স অফিস হিট করা মুভি না দেখেও থাকতে পারেন না। তারা ওমর মুখতার হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন অন্তরে, তবে মোশাররফ করিমের ঈদের নাটক না দেখলে তারা কেমন যেন শান্তি পান না। দ্বীনের বাহ্যিক ব্যাপারে অনেকবেশি সিরিয়াসনেস আমি তাদের ভিতর দেখেছি ঠিক, কিন্তু দ্বীনের ভেতরে ঢুকে, নিজের জীবনে দ্বীন দ্বারা যে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি, আমার মনে হয়েছে, তা থেকে তারা খানিকটা বিচ্যুত কিংবা পিছিয়ে আছে।
দ্বিতীয় সার্কেলটা মা শা আল্লাহ একেবারে অন্যধারার। আমি তাদেরকে দ্বীনের ভিতরের এবং বাইরের— সকল ব্যাপারে সমান সিরিয়াস হতে দেখেছি। তাদের আলাপে কখনো মুভির কথা থাকে না, তারা মোশাররফ করিমের ভক্তও নয়। নাটক-সিনেমার জন্যও তাদেরকে উদগ্রীব হয়ে থাকতে দেখিনি কোনোদিন। তারা গান তো শুনেই না, বাদ্য-বাজনা সহ যেসব ইসলামি সঙ্গীত বাজারে আছে, তা থেকেও তাদেরকে সর্বদা দূরে থাকতে দেখেছি। পর্দার ব্যাপারে তারা একবিন্দু ছাড় দেয় না।
আমার মনে হলো— এই দুই সার্কেলের মাঝে শেষোক্ত সার্কেলটাই আমাকে দ্বীনের পথে বেশি এগুতে সাহায্য করবে এবং নিজেকে 'আরো ভালো মুসলিম' হিশেবে গড়ে তুলতে আমাকে প্রথম সার্কেলটার তুলনায় দ্বিতীয় সার্কেলটা সাহায্য করতে পারে অনেক বেশি। ফলে, দ্বীনের পথে হাঁটবার জন্য আমি দ্বিতীয় সার্কেলটাকে বেছে নিলাম এবং তাদের সাথেই চলতে ফিরতে শুরু করলাম।
[২]
আপনি বলতে পারেন, 'আপনার এক বন্ধু নাহয় মুভি দেখে, তার সাথে মিশলে যে আপনিও মুভি দেখতে শুরু করবেন, তা কেনো? নিজের ওপর আপনার তো এটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই'।
আপনার এই যুক্তিটার সাথে আমি আসলে জোরালোভাবে দ্বিমত করি, এবং বিশ্বাস করি— এটা যতোখানি না যুক্তি, তারচে বেশি ইবলিশের ওয়াসওয়াসা।
আসলে, ঈমান আর দ্বীন পালন জিনিস দুটো এমন যে— এগুলোর ব্যাপারে ইবলিশকে বিন্দুমাত্র সুযোগও দেওয়া যাবে না। আপনার মুভিখোর, কিন্তু নামাজী বন্ধুটার সাথে মিশলে আপনি হয়তো একদিন, দু'দিন, তিনদিন মুভি না দেখে থাকতে পারবেন, কিন্তু এরইমধ্যে ইবলিশ আপনাকে এমনভাবে ওয়াসওয়াসা দেওয়া শুরু করবে যে— একটা সময় আপনি ভাবতে শুরু করবেন, 'যাক, এই মুভিটার এতো নাম করছে ওরা, আমির খান নাকি একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে! দেখে ফেলি একটু। তবে এটাই শেষ। যতো-ই নাম করুক, আর কোনোদিন আমি মুভি-মুখী হবো না'।
অথবা, কোন নাটক কিংবা এমন ড্রামা সিরিজ যা আপনি দেখতে না চাইলেও, বন্ধু মহলের সকলে সোৎসাহে দেখছে বলে আপনারও একবার মনে হতে পারে— 'একবার দেখেই ফেলি নাহয়'।
এভাবে আপনি ইবলিশের ফাঁদে পা দিয়ে দেন এবং আস্তে আস্তে ওই দুনিয়ায় আসক্ত হয়ে যান। আপনি নামাজ পড়েন, যিকির আযকার করেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন, দ্বীন নিয়েও ভাবেন। তবে একইসাথে আপনি মুভিও দেখেন, গানও শুনেন, নাটক দেখাও বাদ দিতে পারেন না।
কোন মুভি-খোর, নাটক-গান নিয়ে থাকা দ্বীনি বন্ধুটার সাথে মিশে অন্তত আর যা-ই হোক, ইবলিশকে এই সুযোগটা দিতে আমি রাজি নই। নিজের দ্বীনকে হেফাযতের জন্য এ-ধরণের প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে এমন বন্ধুর সাথে নিয়মিত চলাফেরা, ঘোরাফেরা, উঠা-বসা বাদ দিতেই বা কমিয়ে আনতেই আমি বেশি আগ্রহী।
[৩]
যারা দ্বীনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়, দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করে এমন লোকদের সাথেই কেনো আপনার মেশা উচিত সে ব্যাপারে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর বেশ সুন্দর একটা কথা আছে। তিনি বলেছেন—
'দ্বীনদারদের সাথে মিশলে আপনার ছয়টা উপকার হবে।
এক. তাদের সঙ্গ আপনার ভেতরে দ্বীন নিয়ে থাকা সন্দেহ দূর করে আপনার ঈমানকে আরো মজবুত করবে।
দুই. তাদের সঙ্গ আপনার ভেতর থেকে রিয়া দূর করে, তাকওয়া বাড়িয়ে দেবে।
তিন. তাদের সঙ্গ পেলেই আপনার ভেতরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হবে।
চার. তাদের সঙ্গ আপনার ভেতর থেকে দুনিয়ার আসক্তি কমিয়ে, আপনাকে অধিক আখিরাত-মুখী করে দেবে।
পাঁচ. তাদের সাথে থাকলে আপনি উদ্ধ্যত না হয়ে বরং অধিক কোমল আর বিনয়ী হবেন।
ছয়. তাদের সঙ্গ আপনাকে মন্দ ধারণা থেকে বাঁচিয়ে, সু-ধারণার দিকে ধাবিত করাবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর বর্ণনা করা এই লিটমাস টেস্ট দিয়ে যদি আমি আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী-সাথী নির্ধারণ করতে যাই, আমাকে তাহলে মোটাদাগে কয়েকটা জিনিস দেখতে হবে-
১. আমার বন্ধুটাকে দেখলে আমার কি আখিরাতের কথা স্মরণে আসে নাকি দুনিয়াবি বা গতানুগতিক ধারণাই মনে আসে?
২. সে কী আমাকে আল্লাহর কথা বেশি স্মরণ করায়, না দুনিয়ার কথা?
৩. সে কি এমনকিছুতে আসক্ত যা তার এবং আমার— দুজনের দ্বীনের কোন উপকারেই আসবে না? যেমন- মুভি দেখা, গান শোনা, অহেতুক আড্ডাবাজি ইত্যাদি।
৪. সে কি অধিকবেশি নেতিবাচক মনোভাবের? মানুষের ব্যাপারে কটু কথা, কটু-বাক্য প্রয়োগে সে কি লাগামছাড়া?
মোদ্দাকথা, তাকে দেখলে আমার কি অধিক বেশি দ্বীনে ঝুঁকতে আগ্রহ জাগে?
যদি তাকে দেখলে আমার মনে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত না হয়, যদি তার আখলাক আমাকে মুগ্ধ না করে, যদি তার আমানতদারিতায় আমি ভরসা না পাই, যদি তার দ্বীনচর্চা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে আরো উৎসাহি না করে— তাহলে নিশ্চিতভাবে সে আমার ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য নয়। তার সঙ্গ ছেড়ে আরো ভালো সঙ্গ, আরো ভালো সার্কেল খুঁজে নেওয়া তখন আমার জন্য অতীব জরুরি।
[৪]
আসলে, নিজের ঈমানটাকে হেফাযতের উদ্দেশ্যে, নিজের তাকওয়াকে ঠিক রাখতে, নিজের দ্বীন চর্চাকে দিনের পর দিন উন্নত করতেই আমি এমন সার্কেল পছন্দ করি যাদের তাকওয়া থেকে, আমল থেকে, কাজ-কর্ম সহ সবকিছু থেকে প্রতিনিয়ত আমি কিছু না কিছু শিখতে পারবো। যাদের দেখলেই মনে হবে— ইশ! তার মতো যদি আমলদার হতে পারতাম! এমন কাউকে দেখলেই দৌঁড়ে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, 'তুমি কি আমার বন্ধু হবে?'
Post a Comment