বসনিয়ার মায়েদের দুঃখের সেই দিনগুলো



বেটি, তুমি ক্রোয়েশিয়া যাও। গিয়ে সেখানকার প্রতিটি পুরুষকে জিজ্ঞেস করো—তুমি কি আমার জন্মদাতা পিতা?

এই কথাটি কার—জানেন? কথাটি বসনিয়ার মায়েদের। নব্বুইয়ের দশকে বসনিয়ার মুসলিম মায়েরা তাদের মেয়েদেরকে সম্বোধন করে এই কথাটি বলত। কারণ, ক্রোয়েশীয় সৈন্যরা তাদেরকে এত পরিমাণ ধর্ষণ করেছে যে, তাদের সকলেরই গর্ভে চলে এসেছিল ক্রোয়েশীয় সেনাদের বাচ্চা!

আপনি জানলে অবাক হবেন যে, ১৯৯২ সাল থেকে নিয়ে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত—এই চারটি বছরের বসনিয়া যুদ্ধে সার্বিয়ান ও ক্রোয়েশীয় সেনারা প্রায় ৫০ হাজার মুসলিম কিশোরী, যুবতী ও নারীকে ধর্ষণ করেছে!

তাদের একে একে বাসে তুলে পাঠানো হতো সার্ব-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, যেখানে তাদের ওপর চালানো হতো যৌন নিপীড়ন। শুধু কারাগার বা বন্দিশিবিরগুলোতে ধর্ষণ করা হতো না; বরং ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে সর্বত্র।

কারণ, এটা ছিল জাতিগত মুসলিম নিধনের সুদূরপ্রসারী টার্গেটের একটি অন্যতম এজেন্ডা। তাই সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম নারীদের নির্বিচারে গণধর্ষণ করা হয়েছিল।

সার্বিয়ানদের বন্দিশিবিরে উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার একজন নারী নুসরেতা সিভাচ। বসনিয়ার প্রিয়েডোর শহরে ১৯৯২ সালে একজন সম্মানিত বিচারক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। এত সম্মানিতা হওয়া সত্ত্বেও তিনিও রেহাই পাননি পাশবিক নির্যাতন থেকে! তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওমার্‌স্কা নির্যাতন-শিবিরে। সার্ব-প্রধান এক গ্রামের কাছে সেটা ছিল পুরনো একটা খনি এলাকা। হাজার হাজার ক্রোয়াট আর প্রধানত বসনিয়াক পুরুষদের সেখানে আটক রাখা হয়েছিল।

নুসরেতা সিভাচ নিজেই নিজের হৃদয়বিদারক কাহিনি বর্ণনা করেন—যে ঘরে আমরা ঘুমাতাম, সে ঘরের দরজায় কোনো তালা দেওয়া থাকত না। রাতের বেলা ওরা আসত এবং আমাদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে নিয়ে যেত। আমরা ভয়ে এমন সিঁটিয়ে থাকতাম, যে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারতাম না। এই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিয়ে নিজেদের মধ্যেও আমরা কোনো আলোচনা করতাম না। আমরা প্রচণ্ড ভয়ে থাকতাম।

নুসরেতা বলেন—একজন উচ্চপদস্থ রক্ষী আমাকে ধর্ষণ করত। সে ছিল কুখ্যাত। সবচেয়ে জঘন্য মানুষ। নির্মম। মেয়েদের সে যেভাবে অত্যাচার করত, তা ভাবাও যায় না। তাকে দেখলে আমার শরীর অবশ হয়ে যেত! চারিদিকে দেখতাম শুধু মৃত্যু আর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। তবু সবসময় মনে হতো, মরলে শান্তি পাব। মনে হতো, অন্যরা যেভাবে নির্মম, ভয়াবহ মৃত্যুর শিকার হচ্ছে, আমার কপালে যেন তেমনটা না হয়। যেন ওরা আমাকে পিটিয়ে না মারে। যেন ধর্ষণ করে ওরা আমাকে মেরে না ফেলে।

নুসরেতা সিভাচকে যে নির্যাতন-শিবিরে বন্দি করা হয়েছিল,

সেখানে আটক বেশ কিছু পুরুষ যেমন তার পরিচিত ছিল। তেমনি যারা তাকে জেরা ও নির্যাতন করেছিল, তাদেরকেও তিনি চিনতেন। এরা ছিল পুলিশ কর্মকর্তা, যাদের সঙ্গে তিনি একসময় পেশার সুবাদে কাজ করেছেন।

নুসরেতা আরও বলেন—যাদের আপনি জীবনভর চিনতেন, যাদের সঙ্গে একসাথে বাস করেছেন, স্কুলে গেছেন, বছরের পর বছর একসাথে কাজ করেছেন, তারা কীভাবে রাতারাতি আপনার শত্রু হয়ে গেল? কীভাবে এই জঘন্য কাজ করতে পারল?

নির্যাতন-শিবিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল কারামান্স হাউজ। সেখানে বন্দি ছিল শতশত নারী। সার্বিয়ান সেনা ও পুলিশরা এই শিবিরে নিয়মিত আসাযাওয়া করত। এসে প্রত্যেকেই যার যার পছন্দমতো একজন বা দুইজন নারীকে নিয়ে যেত। এরপর তাদের ওপর চালাতো পাশবিক নির্যাতন। নির্যাতিতার কান্না আর গোঙানিতে আশেপাশের বন্দিরা পর্যন্ত চোখেরজল বিসর্জন দিত।

কখনও বা অন্যান্য বন্দিদের সামনেই ধর্ষণ করা হতো! অনেক সময় একজন মেয়েকে কয়েকজন মিলে গণধর্ষণ করত। পাশবিকতা সইতে না পেরে শেষপর্যন্ত মেয়েটি মারাই যেত!

এরকম একটি সেনাক্যাম্পে বন্দি ছিল সামিরা। ফুলের মতো সুন্দর এ মেয়েটিকে সার্বিয়ান সেনারা উপর্যুপরি ধর্ষণ করতে করতে গর্ভবতী করে ফেলেছিল। ধর্ষিতা সামিরা তার বড় আপুর কাছে চিঠিতে লিখেছিল—

আপু! আমি আর পারছি না।ওরা আমার গর্ভে কাফির সন্তান জন্ম দিতে চায়! কিন্তু আমি কোনো খ্রিষ্টান সন্তান ভুমিষ্ঠ হতে দেব না! আপু, অনুগ্রহপূর্বক আমার জন্য গর্ভনিরোধক ঔষধ পাঠাও!

সার্বীয় সেনাদের হাতে বসনীয় ধর্ষিতা নারীদের সংখ্যা শুরুতে ২০ হাজার বলা হলেও এখন সে সংখ্যা ৫০ হাজার বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

নোট : এটা মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যাদানকারী ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের যতকিঞ্চিৎ হিস্টরিমাত্র; খুব বেশি নয়।

আফসোসজনক হলেও সত্য যে, এই ক্রোয়েশীয় ফুটবলাররাই যখন বিশ্বকাপে সামান্য একটি ফুটবলে নৈপুণ্যের সাথে লাত্থি মারে, তখন আমাদের মুসলিমরা উল্লাসে মেতে ওঠে! হায়রে ইমান! কই গেল উম্মাহবোধ!

[১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের এই দিনগুলোতেই সার্ব ও ক্রোয়েশীয় সেনারা সবচেয়ে বেশি বসনিয়ান মুসলমানদেরকে নির্যাতন করেছে]

____________

(১) bbc-বাংলা: ১৭/০৬/২০১৭।

(২) نون بوست : ১৫/০৯/২০১৬।

(৩) উইকিপিডিয়া (আরবি)।


© R. A Khan

Post a Comment

Previous Post Next Post