আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসায়মিন রহি’মাহুল্লাহ বলেন,
পুল সিরাত পার হওয়ার পদ্ধতি একেক জনের একেক রকম হবে। কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুতের বেগে, কেউ বাতাসের বেগে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার বেগে, কেউবা উট, কেউবা দৌড়িয়ে বা পায়ে হাটার বেগে আবার কেউবা হামাগুড়ি দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে পৌঁছাবে। অনেকে পুল সিরাত থেকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ পুলসিরাত পার হনা। যারা কাফির তারা পুল সিরাত পার হবেনা, কেননা বিচারের দিন তাদেরকে সরাসরি জাহান্নামে দেওয়া হবে।” রিয়াদুস সালেহীনের ব্যাখ্যাঃ ১/৪৭০।
পুলসিরাতে রয়েছে ভয়ংকর কাটা, শিকল ও আংটা, যেইগুলো পাপী মুসলমানদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করবে এবং তাদের অনেককে পুলের নীচে জাহান্নামের গভীর গর্তে ফেলে দিবে।
ইমাম নববী রহি’মাহুল্লাহ বলেন,
“পুল সিরাতে মানুষ তিন শ্রেণীতে ভাগ হবে। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা পুল সিরাত অত্যন্ত নিরাপদে পার হবে, তাদের কোন ক্ষতি বা কষ্ট হবেনা। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা পুল সিরাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে তবে তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা পুল সিরাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে এবং তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাঃ ৩/২৯।
ক্বুরআনুল কারীমের সুরা মারিয়ামের ৭১, ৭২ নাম্বার আয়াতে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এবং আরো কিছু বিশুদ্ধ হাদীসে পুল সিরাতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِنۡ مِّنۡکُمۡ اِلَّا وَارِدُہَا ۚ کَانَ عَلٰی رَبِّکَ حَتۡمًا مَّقۡضِیًّا
ثُمَّ نُنَجِّی الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا وَّ نَذَرُ الظّٰلِمِیۡنَ فِیۡہَا جِثِیًّا
“আর তোমাদের প্রত্যেকেই তার (জাহান্নামের) উপর দিয়ে অতিক্রম করবে, এটা আপনার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। অতঃপর আমরা উদ্ধার করব তাদেরকে, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে আর যালেমদেরকে সেই (জাহান্নামে) নতজানু অবস্থায় রেখে দেব।” সুরা মারইয়ামঃ ৭২-৭২।
পুল সিরাত সংক্রান্ত দুইটি সহীহ হাদীসঃ
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আখেরাত সম্পর্কিত দীর্ঘ এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
ثُمَّ يُؤْتَى بِالْجَسْرِ فَيُجْعَلُ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْجَسْرُ قَالَ مَدْحَضَةٌ مَزِلَّةٌ عَلَيْهِ خَطَاطِيفُ وَكَلاَلِيبُ وَحَسَكَةٌ مُفَلْطَحَةٌ لَهَا شَوْكَةٌ عُقَيْفَاءُ تَكُونُ بِنَجْدٍ يُقَالُ لَهَا السَّعْدَانُ الْمُؤْمِنُ عَلَيْهَا كَالطَّرْفِ وَكَالْبَرْقِ وَكَالرِّيحِ وَكَأَجَاوِيدِ الْخَيْلِ وَالرِّكَابِ فَنَاجٍ مُسَلَّمٌ وَنَاجٍ مَخْدُوشٌ وَمَكْدُوسٌ فِي نَارِ جَهَنَّمَ حَتَّى يَمُرَّ آخِرُهُمْ يُسْحَبُ سَحْبًا
“এমন সময় জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। সহাবীগণ বললেন, সেই পুলটি কেমন হবে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেনঃ দুর্গম পিচ্ছিল স্থান। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটা বিশিষ্ট হবে, যা নাজ্দ দেশের সাদান বৃক্ষের কাঁটার মত হবে। সে পুলের উপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো। তবে মুক্তিপ্রাপ্তরা কেউ নিরাপদে চলে আসবেন, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। এ কবারে শেষে অতিক্রম করবে যে লোকটি, সে হেঁচড়িয়ে কোন ভাবে পার হয়ে আসবে।"
সহীহ বুখারীঃ ৭৪৩৯, সহী মুসলিমঃ ৩৪০, মুসনাদে আহমাদঃ ১১১২৭।
পুল সিরাত সংক্রান্ত দ্বিতীয় হাদীসঃ
আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা সকল মানুষকে একত্রিত করবেন। মু'মিনগণ দাঁড়িয়ে থাকবে। জান্নাত তাদের নিকটবর্তী করা হবে। অবশেষে সবাই আদামের নিকট এসে বলবে, আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দেয়ার প্রার্থনা করুন। আদাম (আঃ) বলবেন, তোমাদের পিতা আদামের পদস্খলনের কারণেই তো তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং আমি এর যোগ্য নই। আমার পুত্র ইবরাহীমের নিকট যাও। তিনি আল্লাহর বন্ধু। এরপর সবাই ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট এলে তিনি বলবেন, না, আমিও এর যোগ্য নই, আমি আল্লাহর বন্ধু ছিলাম বটে, তবে তা ছিল দূরে দূরে থেকে। তোমরা মূসার নিকট যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপ করেছেন। সবাই মূসার নিকট আসবে। তিনি বলবেনঃ আমিও এর যোগ্য নই বরং তোমরা ঈসার নিকট যাও। তিনি আল্লাহর কালিমাহ ও রূহ। (সবাই তার নিকট আসলে) তিনি বলবেনঃ আমি তার উপযুক্ত নই। তখন সকলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসবে।
তিনি দু'আর নিমিত্ত দাঁড়াবেন এবং তাকে অনুমতি প্রদান করা হবে। আমানাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক, পুল-সিরাতের ডানে-বামে এসে দাঁড়াবে। আর তোমাদের প্রথম দলটি এ সিরাতে, বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে। সাহাবা বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হোক। আমাকে বলে দিন “বিদ্যুৎ গতির ন্যায়” কথাটির অর্থ কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আকাশের বিদ্যুৎ চমক কি কখনো দেখনি? চোখের পলকে এখান থেকে সেখানে চলে যায় আবার ফিরে আসে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর পরবর্তী দলগুলো যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই তার আমাল হিসেবে তা অতিক্রম করবে। আর তোমাদের নাবী সে অবস্থায় পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দু'আ করতে থাকবে, আল্লাহ এদেরকে নিরাপদে পৌছিয়ে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌছিয়ে দিন।
এরূপে মানুষের আমাল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ সিরাত অতিক্রম করতে থাকবে। শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে সে নিতম্বের উপর ভর করে পথ অতিক্রম করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, সিরাতের উভয় পাশে ঝুলানো থাকবে কাটাযুক্ত লৌহ শলাকা। এরা আল্লাহর নির্দেশক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে পাকড়াও করবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে; অতঃপর সে নাজাত পাবে। আর কতক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে। আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) বলেন, শপথ সে সত্তার যার হাতে আবূ হুরাইরাহর প্রাণ! জেনে রেখ, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খারীফ (অর্থাৎ- সত্তর হাজার বছরের পথের ন্যায়।) সহীহ মুসলিমঃ ৩৭০।
উপরে ক্বুরআন, হাদীস এবং আলেমদের বক্তব্য দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, পুল সিরাত আখেরাত বাস্তব একটা জিনিস, যা আখেরাতে জাহান্নামের উপর স্থাপন করা হবে। এটা দুনিয়ার কোন বিষয় নয় বা রূপক বা উপমা নয়। ক্বুরআন ও হাদীসে পুল সিরাত এতো স্পষ্ট একটা বিষয় যে, পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত মুসলমানদের ঘরে প্রতিটা ছোট শিশুও জানে যে, কেয়ামতের দিন জাহান্নামের উপর পুল সিরাত অতিক্রম করে জান্নাতে যেতে হবে। অথচ, মুনকারিনে হাদীসের লোকেরা পথভ্রষ্ট লোকদের দ্বারা ব্রেইন ওয়াশড হয়ে বলতে আরম্ভ করেছে, “পুল সিরাত আখেরাতের কোন বিষয় নয়।” আল্লাহু মুস্তাআ’ন।
Post a Comment