চিকিৎসার জন্য ক্বুরআনী তাবীয

 


ক্বুরআনের আয়াত দ্বারা তাবীয লিখে তা গলায়, হাতে বা কোমরে ব্যবহার করা বৈধ নয়। বৈধ নয় ক্বুরআনের আয়াতকে কোন প্রকার অসম্মান ও অপবিত্রতার স্থানে পতিত করা।

ক্বুরআন শিফা ঠিকই, কিন্তু শিফা গ্রহণের যে পদ্ধতি হাদীসে নিষিদ্ধ হয়েছে অথবা বর্ণিত হয়নি অথচ তাতে ক্বুরআনের অবমাননা হয়, সে পদ্ধতিতে ক্বুরআনের আয়াত প্রয়োগ ক'রে চিকিৎসা করা বৈধ নয়।


আব্দুল্লাহ বিন আমর কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ আতঙ্ক ও ভয়কালে (দুআ স্বরূপ) সাহাবাগণকে কিছু কথা শিখাতেন,

((أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُون))।

আর আব্দুল্লাহ বিন আমর তাঁর সন্তানদের মধ্যে যারা মুখস্থ করতে পারে, তাদেরকে তা শিখিয়ে দিয়ে রাতে ঘুমাবার আগে পড়তে বলতেন এবং যারা অবোধ শিশু, যাদের মুখস্থ করার ক্ষমতা নেই, তাদের জন্য লিখে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিতেন। (আহমাদ ৬৬৯৬, আবূ দাঊদ ৩৮৯৫, তিরমিযী ৩৫২৮, ইবনে আবী শাইবাহ ২৩৫৪৭নং)


উক্ত হাদীস থেকে তাবীয-ব্যবসায়ীরা দলীল পেয়েছেন যে, ক্বুরআনী আয়াত বা হাদীসী দুআর তাবীয লিখে গলায়-হাতে লটকানো যায়।


কিন্তু নিরপেক্ষ মন নিয়ে একবার কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখুনঃ-

প্রথমতঃ হাদীসে ক্বুরআনের আয়াতকে তাবীয ক'রে লটকানোর কথা বলা হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ অন্য হাদীসে আমভাবে তাবীয লটকাতে নিষেধ করা হয়েছে।

উক্ববাহ বিন আমের (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল ﷺ-এর নিকট (বাইআত করার উদ্দেশ্যে) ১০ জন লোক উপস্থিত হল। তিনি ন'জনের নিকট থেকে বাইয়াত নিলেন। আর মাত্র একজন লোকের নিকট হতে বাইআত নিলেন না। সকলে বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! আপনি ন'জনের বাইআত গ্রহণ করলেন, কিন্তু এর করলেন না কেন?' উত্তরে তিনি বললেন, “ওর দেহে কবচ রয়েছে তাই।” অতঃপর সে নিজ হাতে তা ছিঁড়ে ফেলল। সুতরাং তার নিকট থেকেও বাইআত নিলেন এবং বললেন,

((مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ))।

“যে ব্যক্তি কবচ লটকায়, সে ব্যক্তি শির্ক করে।” (আহমাদ ১৭৪২২, হাকেম, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪৯২নং)

ঈসা বিন আব্দুর রহমান তাবেঈ বলেন, আমি সাহাবী আবূ মা'বাদ জুহানীর নিকট গেলাম। তখন তাঁর মুখমন্ডল ও দেহে ফুলে ওঠা লাল লাল (একটা রোগ) হয়েছিল। আমি বললাম, 'আপনি কোন তাবীয বাঁধেন না কেন?' তিনি বললেন, 'নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক (তার থেকে আল্লাহর পানাহ)! মৃত্যু তার চেয়ে বেশি নিকটবর্তী। আল্লাহর রসূল ﷺ বলেছেন,

((مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ))।

“যে ব্যক্তি যা লটকাবে (বা দেহে ধারণ করবে), তাকে তার দিকেই সঁপে দেওয়া হবে।” (তিরমিযী ২০৭২, হাকেম ৭৫০৩, আহমাদ ১৮৭৮১, সহীহ তারগীব ৩৪৫৬নং)


এখানে কিন্তু শির্কী-অশির্কী কিছু লটকানোর কথা বলা হয়নি। আমভাবে তাবীয লটকানো নিষেধ এবং তাবীয শির্ক হওয়ার কথাই স্পষ্ট।

তৃতীয়তঃ ক্বুরআনী তাবীয শির্ক না হলেও তা শির্কী তাবীয ব্যবহারের ছিদ্রপথ হতে পারে। পরন্তু তার সঠিক কোন দলীল নেই।

চতুর্থতঃ ক্বুরআনী আয়াত দেহে ধারণ করলে তার অবমাননা হতে পারে। ধারণকারী তা নিয়েই প্রস্রাব-পায়খানা করবে, যৌন-মিলন করবে, অপবিত্রতা ও ঋতুর সময় বেঁধে রাখবে, আর তাতে নিশ্চয় ক্বুরআনী আয়াতের অসম্মান হবে।

পঞ্চমতঃ হাদীসটি আসলে যয়ীফ। কিন্তু দুআর হাদীসটি অন্য সাক্ষী সূত্র থাকার ফলে 'হাসান' বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ বিন আমরের আমলের ব্যাপারটার কোন সাক্ষী না থাকায় সেটা যয়ীফ।


মুহাদ্দিস আলবানী বলেছেন, 'আর আব্দুল্লাহ বিন আমর তাঁর সন্তানদের---' এ কথা ছাড়া হাদীসটি হাসান।

শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ বলেছেন, 'আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে উক্ত আষার (শুদ্ধ) প্রমাণিত নয়। কেননা তাতে ইসহাক 'আন' শব্দে বর্ণনা করেছেন (এবং তিনি মুদাল্লিস)। কিন্তু এই দুআর কথা অন্য সূত্রে এসেছে যা তার প্রমাণ ও সাক্ষী হতে পারে। কিন্তু আষারটি (শুদ্ধ) প্রমাণিত নয়। পরন্তু তা তাবীয ব্যবহারের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক নিষেধ হওয়ার হাদীসসমূহের পরিপন্থী। (শারহু সুনানি আবী দাঊদ)


ষষ্ঠতঃ যদিও আষারটিকে 'হাসান' ধরে নেওয়া যায়, তবুও তাতে তাবীয বাঁধার দলীল নেই। যেহেতু তাতে এ কথা নেই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে এ কাজ করতে দেখেছেন এবং তাতে মৌনসম্মতি দিয়েছেন।


সপ্তমতঃ উক্ত হাদীস ও আষার থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, দুআ পড়ে জিন-শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং তার জন্য মুখস্থ ক'রে উক্ত দুআটি পড়লে কাজে লাগে। অবশ্য অবোধ শিশু, যার পড়ার বা মুখস্থ করার ক্ষমতা নেই, তার গলায় দুআর তাবীয বানিয়ে লটকানো যায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি যে, তাবীয-ব্যবসায়ীরা তাকে সর্ব-সাধারণের জন্য জায়েয বানানোর দলীল মনে ক'রে থাকেন। ফলে ব্যাপকভাবে তাঁরা বড়-ছোট, পুরুষ-মহিলা, কাফের-ফাসেক সকলকেই তাবীয বিক্রি ক'রে থাকেন। আর তাতে যে কত বড় খারাবি, তা অনুমেয়।


অষ্টমতঃ উক্ত আমলটি আব্দুল্লাহ বিন আমর (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর একান্ত নিজস্ব। যেহেতু অন্যান্য সাহাবা কর্তৃক প্রমাণিত নেই যে, তাঁদের কেউ তাঁর মতো আমল করেছেন।

কোন কোন সাহাবীর ব্যক্তিগত ইজতিহাদী এমন একক আমল, যার ব্যাপারে উলামাগণ আমলযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। যেমন ইবনে উমারের সেই সেই জায়গায় নামায পড়া, যে সব জায়গায় নবী ﷺ নামায পড়েছেন। আবূ হুরাইরার উযূতে বগল পর্যন্ত হাত এবং প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পা ধোয়া, জাবেরের বুধবারে যোহর ও আসরের মাঝে দুআ কবুল হয় ধারণা করা ইত্যাদি।


সাহাবী আমর বিন আল-আস তাঁর মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, 'আমার কবরের পাশে ততক্ষণ অবস্থান করো, যতক্ষণ একটি উঁটনী যবেহ ক'রে তার গোশ্ত ভাগ করতে সময় লাগে। যাতে আমি তোমাদেরকে কাছে পেয়ে আমার আতঙ্ক দূর করতে পারি এবং আমার প্রতিপালকের দূতকে কী জওয়াব দেব, তা ভেবে নিতে পারি।'

এ ব্যাপারে উলামাগণ বলেছেন, এটা ছিল তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদ। নচেৎ ঐরূপ বিধেয় হলে অবশ্যই নবী ﷺ তা সকলের জন্য নির্দেশ দিয়ে যেতেন। (দেখুন, আসইলাতুন অআজবিবাতুন আ'ন আলফাযিন অমাফাহীমা ফী মীযানিশ শারীআহ, ইবনে উষাইমীন ২/৬০-৬১)


ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'ইবাদত, বৈধ, ওয়াজেব বা হারামের ব্যাপারে এককভাবে যে আমল কোন কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে, যাতে অন্য কোনও সাহাবীর সহমত নেই; বরং নবী ﷺ থেকে যা প্রমাণিত তা তার পরিপন্থী এবং তার অনুবর্তী নয়, সে ক্ষেত্রে তাঁর সে একক আমল সুন্নাহ নয়, যা মুসলিমদের জন্য পালন করা জরুরী। তাতে বড়জোর এ কথা বলা যায় যে, সেটা এমন বিষয় যাতে ইজতিহাদী মতামত থাকতেই পারে এবং যাতে উম্মাহর মাঝে মতানৈক্য আছে, যা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া ওয়াজেব।' (মাজমূউ ফাতাওয়া ১/২৭৯)

ইবনে তাইমিয়্যাহ-বিরোধী এক বিদাআতী হুজুর তো চায়ের কাপে তুফান তুলে দাবী করেছেন, অজ্ঞদের জানা নেই যে, সাহাবীর ছেলে সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমরের তাবীয লটকানোর ব্যাপারে সাহাবার 'ইজমা সুকূতী' (মৌন ইজমা') আছে! যেহেতু তিরমিযীতে আছে, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন,

"كنَّا نُعَلِّمُ صبياننا الآياتِ من القرآن، ومن لم يَبلُغْ نكتبها على ورقة ونُعَلِّقُها على صدره"।

'আমরা আমাদের শিশুদেরকে ক্বুরআনের আয়াত শিক্ষা দিতাম। তাদের মধ্যে যে নাবালক হতো, তার জন্য কাগজে লিখে তার বুকে ঝুলিয়ে দিতাম।'


এখানে 'আমরা' মানে সাহাবারা। সুতরাং সাহাবাগণ সকলেই ক্বুরআনের আয়াত শিশুদের বুকে লটকাতেন। অতএব হয়ে গেল কিস্তিমাত, হয়ে গেল ইজমা। হয়ে গেল তাবীয লটকানো জায়েয!

কিন্তু প্রশ্ন থাকবে ঐ হুজুরের কাছে, 'আপনার কাছে যে তিরমিযী আছে, সেই তিরমিযীতে কি ঐ আষার আছে, যেটা আপনি উদ্ধৃত করেছেন? নাকি আপনার মনের মতো বলে আন্দাজে-অনুমানেই তীর মেরেছেন?'

আমাদের কাছে যে তিরমিযী রয়েছে, তাতে তো নেই। হাদীসের কোন কিতাবেই ঐ শব্দাবলী নেই।


তারপর আরো একটা প্রশ্ন থাকবে, তিরমিযীতে বা অন্য কিতাবে যদিও থাকে, তাহলে সেটা সহীহ তো? আপনি আপনার মনোমতো 'সহীহ' বললেই চলবে তো? নাকি মুহদ্দিসীনদেরকে তা বলতে হবে?

এর উত্তর জানার জন্য কি মানতেক-ফালসাফা জানতে হবে হুজুর?


[মহাগ্রন্থ আল-ক্বুরআন]


Resource Person: Shaikh Abdul Hamid Faizi Al-Madani


Post a Comment

Previous Post Next Post