প্রশংসা করা ও শোনার বিধিবিধান




প্রশংসা, সুনাম, সুখ্যাতি কে না ভালোবাসে? কিন্তু প্রশংসা করা ও প্রশংসিত হওয়া উভয়েরই ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। চলুন সংক্ষেপে আমরা তা জেনে নিই।


প্রথমতঃ আত্মপ্রশংসা করবেন না

আমিত্ব, আত্মগর্ব প্রকাশ ও আত্মপ্রশংসা করা অহংকারীর পরিচয়। অপরকে 'জিরো' ভেবে নিজেকেই 'হিরো' মনে করা অবশ্যই বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (النجم : ৩২ )

“অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনি সাবধানী (মুত্তাকী) কে তা সম্যক জানেন।” (সূরা নাজম ৩২)

এক জনের নাম বার্রাহ (পুণ্যময়ী) রাখা হলে মহানবী ﷺ বললেন,

” لاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمُ اللَّهُ أَعْلَمُ بِأَهْلِ الْبِرِّ مِنْكُمْ ، سَمُّوهَا زَيْنَبَ ণ্ড।

“তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কারণ আল্লাহই সম্যক জানেন তোমাদের মধ্যে পুণ্যময় কে। বরং ওর নাম যয়নাব রাখ।” (মুসলিম ৫৭৩৩, আল-আদাবুল মুফরাদ বুখারী, আবূ দাঊদ ৪৯৫৩, সিলসিলাহ সহীহাহ ২১০ নং)

যাতে মানুষ আত্মগরিমা প্রচার বা প্রকাশ ক'রে গর্বিত না হয়, তার জন্য মহানবী ﷺ সকলকে বিনয়ী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

(( إِنَّ اللهَ تَعَالَى أَوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَبْغِيَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ ، وَلاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ )) ।

“মহান আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা পরস্পরের প্রতি নম্রতা ও বিনয় ভাব প্রদর্শন কর। যাতে কেউ যেন অন্যের প্রতি অত্যাচার (বা সীমালংঘন) না করতে পারে এবং কেউ কারো সামনে গর্ব প্রকাশ না করে।” (মুসলিম ৭৩৮৯নং)


দ্বিতীয়তঃ কারো মুখোমুখি প্রশংসা করা থেকে দূরে থাকুন

এমন মানুষের মুখোমুখি প্রশংসা করা, যে তা শুনে আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে ওঠে অথবা নিজেকে অনুরূপ উপযুক্ত মনে করে, তাহলে তার জন্য এবং প্রশংসাকারীর জন্যও এই প্রশংসা এক প্রকার জিহ্বার আপদ। সুতরাং তারীফে অতিরঞ্জন ক'রে কাউকে ফুলানো উচিত নয়। যেহেতু এতে উভয়ের ক্ষতি।

নবী ﷺ-এর নিকট এক ব্যক্তি এক জনের মুখোমুখি প্রশংসা করলে তিনি বললেন,

((وَيْحَكَ ! قَطَعْتَ عُنُقَ صَاحِبِكَ))।

“হায় হায়! তুমি তোমার সাথীর গর্দান কেটে ফেললে!”

এইরূপ বারবার বলার পর তিনি বললেন,

(( إِنْ كَانَ أَحَدُكُمْ مَادِحاً لاَ مَحَالَةَ فَلْيَقُلْ : أَحْسِبُ كَذَا وَكَذَا إِنْ كَانَ يَرَى أنَّهُ كَذَلِكَ وَحَسِيبُهُ اللهُ ، وَلاَ يُزَكّى عَلَى اللهِ أَحَدٌ ))।

“তোমাদের মধ্যে যদি কাউকে একান্তই তার সাথীর প্রশংসা করতে হয়, তাহলে সে যেন বলে, 'আমি ওকে এরূপ মনে করি' ---যদি জানে যে, সে প্রকৃতই এরূপ--- 'এবং আল্লাহ ওর হিসাব গ্রহণকারী। আর আল্লাহর (জ্ঞানের) সামনে কাউকে নিষ্কলুষ ও পবিত্র ঘোষণা করা যায় না।” (বুখারী ৬০৬১, মুসলিম ৭৬৯৩-৭৬৯৪নং)

মহানবী ﷺ এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির (সামনা-সামনি) অতিরিক্ত প্রশংসা করতে শুনে বললেন,

(( أَهْلَكْتُمْ أَوْ قَطَعْتُمْ ظَهْرَ الرَّجُلِ )) ।

“তুমি লোকটার পৃষ্ঠ কর্তন করলে অথবা তাকে ধ্বংস ক'রে দিলে।” (বুখারী ২৬৬৩, ৬০৬০, মুসলিম ৭৬৯৬নং)

আল্লাহর রসূল ﷺ বলেছেন,

((إِيَّاكُمْ وَالتَّمَادُحَ فَإِنَّهُ الذَّبْحُ))।

“তোমরা মুখোমুখি প্রশংসা করা ও নেওয়া হতে দূরে থাকো, কারণ তা যবাই।” (আহমাদ ১৬৮৩৭, ইবনে মাজাহ ৩৭৪৩, ত্বাবারানী ১৬১৭২, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ১০৩০৭, সহীহুল জামে ২৬৭৪নং)

এক ব্যক্তি উষমান (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর সামনেই তাঁর প্রশংসা শুরু করলে মিকদাদ হাঁটুর উপর ভর করে চলে তার মুখে কাঁকর ছিটাতে শুরু করলেন। উষমান তাঁকে বললেন, 'কী ব্যাপার তোমার?' বললেন, রসূল ﷺ বলেছেন,

(( إِذَا رَأَيْتُمُ المَدَّاحِينَ ، فَاحْثُوا فِي وُجُوهِهِمُ التُّرَابَ )) ।

“তোমরা (মুখোমুখি) প্রশংসাকারীদের দেখলে তাদের মুখে ধুলো ছিটিয়ে দিয়ো।” (মুসলিম ৭৬৯৮নং)


তৃতীয়তঃ প্রয়োজনে যোগ্য লোকের প্রশংসা করতে পারেন

অবশ্য প্রয়োজনে যথোচিত প্রশংসা করা নিন্দনীয় নয়। কোন কর্মে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদানার্থে একটু তারীফ করা বৈধ এবং ফলপ্রসূ। (শরহে মুসলিম, নওবী) কিন্তু মিথ্যা প্রশংসা ক'রে কারো তোষামদ ও মনোরঞ্জন করা নিশ্চয়ই ঘৃণিত আচরণ। বিশেষ করে 'যখন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার' ভয় থাকে অথবা বেশি হাওয়া দিলে বেলুন ফুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন ঐরূপ প্রশংসা সর্বনাশী।

উপরে উল্লিখিত হাদীসসমূহ নিষেধাজ্ঞামূলক। পক্ষান্তরে বৈধতা সংক্রান্ত বহু বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে। উলামাগণ বলেন, বৈধ-অবৈধ সম্বলিত পরস্পর বিরোধী হাদীসসমূহের বিরোধ নিরসনের উপায় এই হতে পারে যে, যদি প্রশংসিত ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও ইয়াকীনের অধিকারী হয়, আত্মা অনুশীলনী ও পূর্ণ জ্ঞান লাভে ধন্য হয়, যার ফলে সে কারো প্রশংসা শুনে ফিতনা ও ধোঁকার শিকার না হয় এবং তার মন তাকে প্রতারিত না করে, তাহলে এ ধরনের লোকের মুখোমুখি প্রশংসা, না হারাম, আর না মাকরূহ। অন্যথা যদি কারো ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়াদির কিছুর আশংকা বোধ হয়, তবে তা ঘোর অপছন্দনীয়।

বলা বাহুল্য, এই ব্যাখ্যার নিকষে পরস্পর-বিরোধী হাদীসসমূহকে মান্য করতে হবে। (রিয়াযুস স্বালেহীন)

যে সব হাদীসে মুখোমুখি প্রশংসার বৈধতা এসেছে তার একটি এই যে, একদা আল্লাহর রসূল ﷺ আবূ বাকর (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন; “আমার আশা এই যে, তুমিও তাদের একজন হবে।” অর্থাৎ সেই সৌভাগ্যবানদের একজন হবে, যাদেরকে জান্নাতের সমস্ত দ্বার থেকে আহবান জানানো হবে। (বুখারী ১৮৯৭, ৩৬৬৬, মুসলিম ২৪১৮নং)

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় হাদীসটি হচ্ছে এই যে, একদা আল্লাহর রসূল ﷺ আবূ বাকর (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন; “তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও।” অর্থাৎ, ঐসব লোকেদের অন্তর্ভুক্ত নও যারা অহংকারবশতঃ লুঙ্গী-পায়জামা গাঁটের নীচে ঝুলিয়ে পরে। (বুখারী ৩৬৬৫, ৫৭৮৪, মুসলিম ৫৫৭৮নং)

যেমন একদা নবী ﷺ উমার (রায্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, “শয়তান তোমাকে যে পথে চলতে দেখে, সে পথ ত্যাগ ক'রে সে অন্য পথ ধরে।” (বুখারী ৩২৯৪, ৬৩৫৫নং)


চতুর্থতঃ নিজের প্রশংসা শুনলে কি আমল বরবাদ হয়ে যায়?

প্রশংসা শোনার উদ্দেশ্যে, সুনাম নেওয়ার লোভে বা সুখ্যাতি অর্জনের নিয়তে যদি কোন আমল করেন, দাওয়াতের কাজ করেন, লেখা বা বক্তৃতা পোস্ট করেন এবং তাতে যদি লাইক পান, লাভ চিহ্ন পান অথবা বাহবা ও সাবাশি পান, তাহলে তা কি রিয়া হবে অথবা আপনার আমল নষ্ট হয়ে যাবে?

আসলে তা হল মনের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং আপনার নিয়ত ভালো ও পরিচ্ছন্ন থাকলে তা হবে না। যেহেতু আবূ যার্র (রায্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞাসা করা হল; বলুন, 'যে মানুষ সৎকাজ করে, আর লোকে তার প্রশংসা ক'রে থাকে (তাহলে এরূপ কাজ কি রিয়া বলে গণ্য হবে?)' তিনি বললেন,

(( تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى المُؤْمِنِ ))।

“এটা মু'মিনের সত্বর সুসংবাদ।” (মুসলিম ৬৮৯১নং)

অর্থাৎ, আমলকারীর মনে সুনাম নেওয়ার উদ্দেশ্য না থাকলে; লোক-সমাজে তার সুনাম হলেও তা 'রিয়া' বলে গণ্য হবে না। বরং তা হবে তার সওয়াবের একটি অংশ সত্বর প্রতিদান।


পঞ্চমতঃ প্রশংসা শুনলে যা বলতে হয়

কেউ প্রশংসা করলে সাহাবায়ে কিরাম (রায্বিয়াল্লাহু আনহা)গণ বলতেন,

اَللَّهُمَّ لاَ تُؤَاخِذْنِي بِمَا يَقُولُونَ، وَاغْفِرْ لِيْ مَا لاَ يَعْلَمُونَ، وَاجْعَلْنِيْ خَيْراً مِّمَّا يَظُنُّون ।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! ওঁরা যা বলছেন, তাতে আমাকে পাকড়াও করো না, ওঁরা (আমার যে ত্রুটি জানেন না, তা মার্জনা করো এবং ওঁরা যা (আমার ব্যাপারে) ধারণা করছেন, তুমি তার অপেক্ষা আমাকে আরো উত্তম বানাও। (বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ ৭৬১, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৪৮৭৫-৪৮৭৬, ইবনে আবী শাইবাহ ৩৫৭০৩নং)


ষষ্ঠতঃ যে প্রশংসার কাজ আপনি করেননি, তাতে লাইক নেওয়া বা খোশ হওয়া বৈধ নয়

অনেক সময় অনেক লোকে ভুল বুঝে আপনার সেই কাজে প্রশংসা করে, যে কাজ আপনার স্বকৃত নয়।

আপনাকে শায়খ বলা হল, অথচ আপনি শায়খ নন, হাফেয বলা হল, অথচ আপনি হাফেয নন, আপনি চুপ থেকে সে প্রশংসা উপভোগ করলেন, সেটা আপনার জন্য বৈধ নয়।

হয়তো লোকে প্রশংসিত ব্যক্তির নাম ভুল শুনে আপনাকে ধারণা ক'রে আপনার প্রশংসা করেছে।

নচেৎ, আপনি লোককে ভুল ধারণা দিয়েছেন, কারো কাজ বা লেখা চুরি ক'রে (কপি-পেস্ট) ক'রে পোস্ট করেছেন এবং সেটা যে আপনার নয়, সে কথা সেখানে পরিষ্কার করেননি, আর আপনি লোকের প্রশংসা ও লাইক দেখে-শুনে তাদেরকে দুআ দিচ্ছেন। তাদেরকে বলছেন না যে, এ কাজ বা লেখাটি আমার নয়। এ ক্ষেত্রে এটাই লোকে বুঝছে যে, সেটা আপনার কাজ বা লেখা এবং আপনি তাতে মৌনসম্মতি প্রকাশ ক'রে প্রশংসা কুড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন আচরণ মুসলিমের নয়। যে কাজ করেনি, সে কাজে প্রশংসিত হতে মুসলিম পছন্দ করতে পারে না।

নবী ﷺ-এর যামানায় মুনাফিকদের কিছু লোকের অভ্যাস ছিল যে, তিনি যখন যুদ্ধে যেতেন, তখন তারা তাঁর সাথে বের হতো না এবং তার জন্য তারা আনন্দিত হতো। অতঃপর তিনি ফিরে এলে তারা তাঁর নিকট গিয়ে কসম খেয়ে নানা ওজর-ওজুহাত পেশ করত। পরন্তু তারা সেই কাজে প্রশংসিত হতে পছন্দ করত, যা তারা আদৌ করেনি। এরই প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে মহান আল্লাহর এই বাণী,

لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَواْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُواْ بِمَا لَمْ يَفْعَلُواْ فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِّنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (آل عمران : ১৮৮)

'যারা নিজেরা যা করেছে, তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যা করেনি, এমন কাজের জন্য প্রশংসিত হতে ভালবাসে, তারা শাস্তি হতে মুক্তি পাবে, এরূপ তুমি কখনও মনে করো না; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।' (আলে ইমরানঃ ১৮৮, বুখারী ৪৫৬৭, মুসলিম ৭২১০নং)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, উক্ত আয়াত ইয়াহুদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। একদা নবী ﷺ তাদেরকে ডেকে (তাওরাতের) কোন এক বিষয় জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তর গোপন ক'রে অন্য কিছু বলল। অতঃপর তারা তাঁর নিকট থেকে এই মনে ক'রে বের হল যে, তারা তাঁকে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে; পরন্তু তারই বিনিময়ে তাঁর নিকট প্রশংসা কামনা করল এবং সত্য গোপনের জন্য আনন্দিতও হল। (বুখারী ৪৫৬৮, মুসলিম ৭২১১, তিরমিযী ৩০১৪নং)

যাই হোক, আলোচ্য আয়াতে এমন লোকদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা ঘোষিত হয়েছে, যারা কেবল তাদের বাস্তব কৃতিত্ব নিয়েই খোশ নয়, বরং তারা চায় যে, তাদের খাতায় এমন কৃতিত্বও লেখা হোক বা প্রকাশ করা হোক, যা তারা করেনি। এই রোগ যেরূপ রসূল ﷺ-এর যুগে ছিল এবং যার কারণে আয়াত নাযিল হয়, অনুরূপ বর্তমানেও পদাভিলাষী ও যশান্বেষী প্রকৃতির মানুষের মধ্যে এবং প্রোপাগান্ডা ও আরো বিভিন্ন চালাকী ও চাতুর্যের মাধ্যমে নেতৃত্ব লাভকারী নেতাদের মধ্যেও ব্যাপকহারে এ (প্রশংসালোভের) রোগ পাওয়া যায়। আয়াতের প্রসঙ্গসূত্র থেকে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুদীরা আল্লাহর কিতাবে পরিবর্তন ও তা গোপন করার অপরাধে অপরাধী ছিল এবং তারা তাদের এই কুকৃতিত্বে আনন্দিতও ছিল। (আহসানুল বায়ান)

আপনি মুসলিম। আপনার চরিত্র এমন হলে চলবে না। আপনি প্রশংসালোভী হবেন না। বরং এর বিপরীত সলফদের চরিত্র গ্রহণ ক'রে যাতে লোকে আপনার মিথ্যা প্রশংসা করার সুযোগ না পায়, সেই চেষ্টা করবেন অথবা যে প্রশংসার পাত্র আপনি নন, কেউ আপনার সেই প্রশংসা ক'রে ফেললে আপনি তার ভুল ভেঙ্গে দেবেন।

হুস্বাইন বিন আব্দুর রহমান বলেন, একদা আমি সাঈদ বিন জুবাইরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, 'গত রাতে যে নক্ষত্রপতন ঘটেছে (বা উল্কা ছুটেছে) তা তোমাদের কে দেখেছে?' আমি বললাম, 'আমি দেখেছি। তবে আমি নামাযে ছিলাম না। (বা তাহাজ্জুদের জন্য জেগে ছিলাম না।) বরং আমাকে বিচ্ছু দংশন করেছিল!' (আহমাদ ২৪৪৮, মুসলিম ৫৪৯নং)

দেখলেন তো? 'তবে আমি নামাযে ছিলাম না' বলে তিনি শ্রোতার ধারণা ফিরিয়ে দিলেন, যাতে নামায না পড়েও লোকেরা তাঁকে এই ভেবে বসে যে, তিনি তাহাজ্জুদ পড়ছিলেন। যাতে অকারণে তাঁর প্রশংসা ছড়িয়ে না পড়ে।

ইরাকের মুহাদ্দিস বিশর বিন মানসূর সালীমী একদা সুদীর্ঘ নামাযের মাধ্যমে সুন্দর ইবাদত করছিলেন। নামায শেষ ক'রে দেখলেন এক ব্যক্তি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তাকে বললেন, 'আমার যে ইবাদত দেখলে, তা যেন তোমাকে অবশ্যই ধোঁকা না দেয়। কারণ ইবলীস হাজার-হাজার বছর আল্লাহর ইবাদত করেছিল। তারপর তার পরিণতি যা হওয়ার হয়েছিল।' (বাহরুদ দুমু', ইবনুল জাওযী ১৪১পৃঃ)

সলফে সালেহীন গোপনে কাঁদতেন। আল্লাহর ভয়ে চোখে পানি এসে গেলে তা যেন-তেন-প্রকারেণ গোপন করার চেষ্টা করতেন।

মুহাম্মাদ বিন আসলাম ত্বূসীর খাদেম আবূ আব্দুল্লাহ বলেন, মুহাম্মাদ 'রিয়া'কে খুব ভয় করতেন। এই জন্য তিনি নফল নামায বাড়িতে পড়তেন। তিনি বাড়িতে নিজের কামরায় প্রবেশ ক'রে দরজা বন্ধ ক'রে নিতেন। জানি না, তিনি কী করতেন? অবশেষে একদিন তার ছোট বাচ্চাটা তাঁর কান্নার নকল করছে। তা দেখে তার মা তাকে বারণ করল। আমি তাকে বললাম, 'কী ব্যাপার?' সে বলল, 'আবুল হাসান এই ঘরে প্রবেশ ক'রে কুরআন পড়েন ও কান্না করেন। তাই বাচ্চাটা শুনে ওঁর নকল করছে।' তিনি যখন কামরা থেকে বের হতেন, তখন আগে নিজের চেহারা ধুয়ে নিয়ে সুরমা লাগিয়ে নিতেন। যাতে কান্নার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে! (হিলয়াতুল আওলিয়া ৯/২৪৩)

আওযায়ী কোন সময় লোকের সামনে কাঁদতেন না। কিন্তু তাঁর বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে কান্নার আওয়াজ শোনা যেত।

লোকালয়ে আইয়ুব সাখতিয়ানীর কান্না ও চোখে পানি এসে গেলে নাক ঢেকে নিতেন এবং (সর্দির ভান ক'রে গলা ঝেরে) বলতেন, 'সর্দি কঠিন কত!' যাতে লোকে তাঁর কান্না বুঝতে না পারে। (সিয়ার ৬/২০)

হাসান বাসরী বলেন, 'নেক লোকের চোখে পানি এসে গেলে মজলিস থেকে উঠে যান। যাতে কোন মানুষ তাঁর অশ্রু দেখতে না পায়।'

কপি-পেস্টে অভ্যস্ত এক দ্বীনী ভাই লিখেছেন, 'ভাই কপি-পেস্ট করলে সমস্যা কি? আপনার দরকার ছোয়াব। মহান আল্লাহ দেখবেন জে, কার লেখা নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। লেখাটা যেহেতু আপনে লিখেছেন তাই ছোয়াবটা আপনারই হবে। এখানে আপনার নাম দিতে হবে, এটা তো আপনে দুনিয়াতেই তার বিনিময় চাইতেছেন, আখেরাতে না। আমি মনে করি, কোন দিনী ভায়ের এ সব কথা বলা ঠিক না। প্রচার করা দরকার যেখান থেকেই পারবে পাচার করবে!'

বুঝুন ঠেলা। আপনি সমস্যাটাই বুঝেন নি।

আপনি লেখকের নামটা উল্লেখ করলে আপনার সমস্যা কী?

আর সমস্যাটা লেখকের না, সমস্যাটা আপনার মতো পাচারকারীর। ক্ষতি হবে আপনার। পরের জিনিস 'পাচার' ক'রে লাইক, প্রশংসা, বাহবা ইত্যাদি নিলে আপনার ছোয়াব হবে কি? আপনার যদি গোনাহ হয়, তাহলে সমস্যাটা আপনার নয় কি?

'আপনে দুনিয়াতেই তার বিনিময় চাইতেছেন, আখেরাতে না।' এ খবর আপনি কেমনে জানলেন? লেখক তার নিয়ত নিয়ে ছোয়াব পাবেন। আর আপনি? জানেন তো? অন্যের লেখা চুরি ক'রে 'পাচার' করা আন্তর্জাতিক আইনে দন্ডনীয় অপরাধ। তাতে আপনারই সমস্যা হতে পারে।

সুতরাং যিনি সময় দিয়ে কষ্ট ক'রে লিখেছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন। যেহেতু 'যে মানুষের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করল না, সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হলো না।'

আপনি তাঁর জন্য দুআ দিন, যিনি দুআ পাওয়ার উপযুক্ত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করুন, যিনি আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন।

বলা বাহুল্য, এ লেখাটা আপনার মতো বেপরোয়া ভাইদের জন্য। সুতরাং সাবধান। পৌঁছে দিলাম।

পরিশেষে দুআ ক'রে বলি, হে আল্লাহ!

'আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,

তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে।'


লিখেছেন - শাইখ আব্দুল হামীদ আল-ফাইযী আল-মাদানী

Post a Comment

Previous Post Next Post