মক্কাভূমির বাইরে ইসলামের দাওয়াত


 ত্বায়িফে রাসূল (সাঃ):

 নবুওয়াতের দশম বছর শাওয়াল মাসে (৬১৯ খ্রীষ্টাব্দে ম মাসের শেষের দিকে কিংবা জুন মাসের প্রথম দিকে) নাবী কারীম (সাঃ) ত্বায়িফ গমন করেছিলেন। ত্বায়িফ মক্কা থেকে আনুমানিক ষাট মাইল দূরত্বে অবস্থিত। যাতায়াতের এ দূরত্ব তিনি অতিক্রম করেছিলেন পদব্রজে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মুক্ত করা দাস ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)। পথ চলাকালে পথিমধ্যে যে কাবিলাহ বা গোত্রের নিকট তিনি উপস্থিত হতেন তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। কিন্তু তাঁর এ আহ্বানে তাদের পক্ষ থেকে কেউ সাড়া দেয় নি।

  ত্বায়িফ গমন করে সাক্বীফ গোত্রের তিন নেতার সঙ্গে, যারা সকলেই সহোদর ছিলেন, তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাঁর নাম ছিল যথাক্রমে আবদে ইয়ালাইল, মাস‘উদ ও হাবীব। ভাতৃত্রয়ের পিতার নাম ছিল ‘আমর বিন ওমাইর সাক্বাফী। তাঁদের সঙ্গে (সাক্ষাতের পর মহানাবী (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার অনুগত হয়ে চলা এবং ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তাঁদের নিকট দাওয়াত পেশ করেন। তদুত্তরে একজন বলেন যে, সে কাবার পর্দা (আবরণ) ফেড়ে দেখাক যদি আল্লাহ তাকে রাসূল করেছেন। দ্বিতীয়জন বললেন, ‘নাবী করার জন্য আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেও পান নি? তৃতীয়জন বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমি কোনক্রমেই কথা বলব না। প্রকৃতই যদি তুমি নাবী হও তবে তোমার কথা প্রত্যাখান করা আমার জন্য বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যা প্রচারে লিপ্ত হও তবে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা সমীচীন নয়।’ তাঁদের এহেন আচরণ ও কথাবার্তায় তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন এবং সেখান থেকে যাবার প্রাক্কালে শুধু বললেন, ‘তোমরা যা করলে এবং বললে তা গোপনেই রাখ।’

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ত্বায়িফে দশদিন অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু সকলের উত্তর একই ‘তুমি আমাদের শহর থেকে বের হয়ে যাও।’ ফলে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে যখন তিনি পা বাড়ালেন তখন তাঁকে উত্যক্ত অপমানিত ও কষ্ট প্রদানের জন্য শিশু কিশোর ও যুবকদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হল। ইত্যবসরে পথের দু’পাশ ভিড় জমে গেল। তারা হাততালি, অশ্রাব্য অশ্লীল কথাবার্তা বলে তাঁকে গাল মন্দ দিতে ও পাথর ছুঁড়ে আঘাত করতে থাকল। আঘাতের ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পায়ের গোড়ালিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে পাদুকাদ্বয় রক্তাক্ত হয়ে গেল।

  ত্বায়িফের হতভাগ্য কিশোর ও যুবকেরা যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর প্রস্তর নিক্ষেপ করছিল তখন যায়দ বিন হারিসাহই তাঁকে (সাঃ) রক্ষার জন্য ঢালের মতো কাজ করেছিলেন। ফলে তাঁর মাথার কয়েকটি স্থানে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবে অমানবিক যুলম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পথ চলতে থাকেন এবং দুরাচার ত্বায়িফবাসীগণ তাদের এ অত্যাচার অব্যাহত রাখে। আঘাতে আঘাতে জর্জ্জরিত রুধিরাক্ত কলেবরে পথ চলতে গিয়ে নাবী কারীম (সাঃ) খুবই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত এক আঙ্গুর উদ্যানে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন।বাগানটি ছিল রাবী‘আহর পুত্র ‘উতবাহ এবং শায়বাহর। তিনি বাগানে প্রবেশ করলে দূরাচার ত্বায়িফবাসীগণ গৃহাভিমুখে ফিরে যায়।

  এ বাগানটি ত্বায়িফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। বাগানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নাবী কারীম (সাঃ) আঙ্গুর গাছের ছায়ায় এক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন।
  কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার ফলে কিছুটা সুস্থতা লাভের পর নাবী কারীম (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার দরবারে হাত তুলে দু‘আ করলেন। তাঁর এ দু‘আ ‘দুর্বলদের দু‘আ’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর দু‘আর এক একটি কথা থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, ত্বায়িফবাসীগণের দুর্ব্যবহারে তিনি কতটা ক্ষুদ্ধ এবং তারা ঈমান না আনার কারণে তিনি কতটা ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি দু‘আ করলেন,
 ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার শক্তির দুর্বলতা, অসহায়ত্ব আর মানুষের নিকট স্বীয় মূল্যহীনতার অভিযোগ প্রকাশ করছি। ওহে দয়াময় দয়ালু, তুমি দুর্বলদের প্রতিপালক, তুমি আমারও প্রতিপালক, তুমি আমাকে কার নিকট অর্পণ করছো, যে আমার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে, নাকি তুমি আমাকে এমন শত্রুর নিকট ন্যস্ত করছো যাকে তুমি আমার যাবতীয় বিষয়ের মালিক করেছ। যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোন আফসোস নেই, তবে তোমার ক্ষমা আমার জন্য সম্প্রসারিত করো। আমি তোমার সেই নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদ্‌দ্বারা অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চতুর্দিক আলোয় উদ্ভাষিত হয়। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় বিষয়াদি তোমার উপর ন্যস্ত। তুমি আমাকে অভিসম্পাত করবে কিংবা ধমক দিবে, তার থেকে তোমার সন্তুষ্টি আমার কাম্য। তোমার শক্তি ব্যতিরেকে অন্য কোন শক্তি নেই।’’
  এ দিকে রাবী‘আহর পুত্রগণ যখন মহানাবী(সাঃ)-কে এমন দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত অবস্থায় দেখতে পেল তখন তাদের মধ্যে গোত্রীয় চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠল। ‘আদ্দাস নামক তাদের এক খ্রীষ্টান ক্রীতদাসের হাতে এক গোছা আঙ্গুর তারা নাবী কারীম (সাঃ)- এর নিকট পাঠিয়ে দিল। সেআই ক্রীতদাসটি যখন আঙ্গুরের গোছাটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর হাতে তুলে দিতে চাইল তিনি তখন ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করলেন এবং খেতে আরম্ভ করলেন
  ‘আদ্দাস বলল, ‘এমন কথা তো এ অঞ্চলের লোকেদের মুখে কক্ষনো শুনিনি? রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বললেন, ‘তুমি কোথায় থাক? তোমার ধর্ম কী?’
  সে বলল, ‘আমি খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী এবং নিনাওয়ার বাসিন্দা।’
  নাবী কারীম(সাঃ) বললেন, ‘ভাল, তাহলে সৎ ব্যক্তি ইউনুস বিন মাত্তার গ্রামে তুমি বাস কর, তাই না?’
  সে বলল, ‘আপনি ইউনুস বিন মাত্তাকে কিভাবে চিনলেন?’
  রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বললেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি নাবী ছিলেন এবং আমিও নাবী’। এ কথা শুনে ‘আদ্দাস নাবী কারীম(সাঃ)- এর দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং তাঁর মাথা ও হাত-পায়ে চুমু দিল।
  এ ব্যাপার দেখে রাবী‘আহ পুত্রদ্বয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘দেখ, দেখ, ঐ ব্যক্তি দেখছি শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্রীতদাসকেও বিগড়িয়ে দিল।’
  এর পর ‘আদ্দাস যখন তাদের নিকট ফিরে গেল তখন ভাতৃদ্বয় তাকে বলল, ‘বলত দেখি ব্যাপারটা কী? ঐ ভদ্রলোক দেখছি তোমাকেও বিগড়িয়ে দিল।’
 সে বলল, ‘হে আমার মনিব! এ ধরাধামে তাঁর চেয়ে উত্তম মানুষ আর কেউই নেই। তিনি আমাকে এমন এক কথা বলেছেন যা নাবী রাসূল ছাড়া অন্য কেউই জানে না।’
  তারা দু’জন বলল, ‘দেখ ‘আদ্দাস, ঐ ব্যক্তি যেন তোমাকে তোমার ধর্ম থেকে ফিরিয়ে না দেয়। কারণ তোমার ধর্ম তার ধর্ম থেকে উত্তম।’

  কিছুক্ষণ অবস্থানের পর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বাগান থেকে  বের হয়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন। তার মিশনের বিফলতাজনিত চিন্তা ও দৈহিক যন্ত্রনার দাপটে হৃদয় মন ছিল অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিশ্রান্ত। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি যখন ‘কারনে মানাযেল’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশে জিবরাঈল(আঃ) সেখানে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশ্‌তামন্ডলী। আল্লাহর তরফ থেকে তাঁরা এ অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন যে, নাবী(সাঃ) যদি ইচ্ছে করেন তা হলে তারা দু’পাহাড়কে একত্রিত করে দূরাচার মক্কাবাসীকে পিশে মারবেন।

  এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বুখারী শরীফে ‘উরওয়াহ বিন জুবাইর থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘আয়িশাহ সিদ্দীকাহ(রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-কে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার জীবনে কি এমন কোনদিন এসেছে যা উহুদের দিন চেয়েও কঠিন ছিল?’

  তিনি উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ’, তোমার সম্প্রদায়ের নিকট থেকে আমাকে যে যে দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল ঐ দিনটি যে দিন আমি ঘাঁটিতে বিচলিত ছিলাম, যখন আমি নিজেকে আবদে ইয়ালীল বিন আবদে কুলালের পুত্রদের নিকট পেশ করেছিলাম।কিন্তু তারা আমার কথায় কর্ণপাত না করায় দুশ্চিন্তা ও ব্যথায় পরিশ্রান্ত হয়ে আমি নিজ পথে গমন করি। এভাবে চলতে চলতে ‘কারনে সায়ালেবে’ যখন এসে পৌঁছি তখন আমার চেতনা ফিরে আসে।

  এ সময় আমার মনে কিছুটা স্বস্তিবোধের সৃষ্টি হয়। সেখানে আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি যে, একখন্ড মেঘ আমাকে ছায়াদান করছে ; ব্যাপারটি আরও ভালভাবে নিরীক্ষণ করলে বুঝতে পারি যে, এতে জিবরাঈল (আঃ) রয়েছেন। তিনি আমাকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং আপনার প্রতি যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুই শুনেছেন এবং দেখেছেন। এখন তিনি পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশ্‌তাগণকে আপনার খেদমতে প্রেরণ করেছেন। আপনি তাঁদের কে যা ইচ্ছে নির্দেশ প্রদান করুন। এরপর পর্বতের ফেরেশ্‌তা আমাকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ(সাঃ)! কথা এটাই, আপনি যদি চান যে এদেরকে আমি দু’পাহাড় একত্রিত করে পিষে মারি তাহলে তাই হবে।  পাহাড় দু’টি হল মক্কায় অবস্থিত। তাদের একটির নাম আবূ কুবাইস এবং এর সামনা সামনি যে পাহাড় তার নাম কু‘আইকিয়ান। নাবী কারীম(সাঃ) বললেন, ‘না, বরং আমার আশা, মহান আল্লাহ এদের পৃষ্ঠদেশ হতে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন যারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং অন্য কাউকেও তাঁর অংশীদার ভাববে না।’

  রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এ উত্তরে তাঁর অসাধারণ মানবত্বপ্রেমে সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্য এবং ক্ষমাশীল অনুপম চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। সাত আসমানের উপর হতে আগত এই গায়েবী মদদের প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফেরেশ্‌তাগণ যখন তাঁর খেদমতে উপস্থিত হন তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র যেন আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে তিনি সুস্থির চিত্তে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন। এভাবে তাঁর মানসাকাশ থেকে চিন্তা ভাবনার মেঘ দূরীভূত হয়ে যায়।

তারপর তিনি মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথে ওয়াদীয়ে নাখলাহয় অবস্থান করেন। এখানে দুটো জায়গা বসবাসের উপযোগী ছিল। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে আসসাইলুল কবীর এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যায়মা। কেননা, সেখানে পানি ছিল কিছুটা সহজলভ্য এবং জায়গা দুটো ছিল শস্য শ্যামল। কিন্তু তিনি এ দুটো জায়গার মধ্যে কোথায় অবস্থান করেছিলেন কোন সূত্র থেকেই তার সন্ধান পাওয়া যায় নি

  ওয়াদী নাখলাহয় তিনি যখন কয়েক দিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন সে সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট জিনদের একটি দলকে প্রেরণ করেন যার উল্লেখ কুরআন মাজীদের দুটো জায়গায় এসেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সূরাহ আল-আহক্বাফে এবং অন্যটি সূরাহ জিনে। সূরাহ আহ্‌ক্বাফের আয়াতগুলো হচ্ছে,
  ‘স্মরণ কর, যখন জিন্নদের একটি দলকে তোমার প্রতি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যারা কুরআন শুনছিল। তারা যখন সে স্থানে উপস্থিত হল, তখন তারা পরস্পর বলল- চুপ করে শুন। পড়া যখন শেষ হল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরুপে। ৩০. (ফিরে গিয়ে) তারা বলল- হে আমার সম্প্রদায়! আমরা একটি কিতাব (এর পাঠ) শুনেছি যা মূসার পরে অবতীর্ণ হয়েছে, তা পূর্বেকার কিতাবগুলোর সত্যতা প্রতিপন্ন করে, সত্যের দিকে আর সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে। ৩১. হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন, আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব থেকে রক্ষা করবেন।’ (আল-আহক্বাফ ৪৬: ২৯-৩১)

 ‘১. বল, ‘আমার কাছে ওয়াহী করা হয়েছে যে, জিন্নদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কুরআন) শুনেছে তারপর তারা বলেছে ‘আমরা এক অতি আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি ২. যা সত্য-সঠিক পথ প্রদর্শন করে, যার কারণে আমরা তাতে ঈমান এনেছি, আমরা কক্ষনো কাউকে আমাদের প্রতিপালকের অংশীদার গণ্য করব না। ৩. আর আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অতি উচ্চ, তিনি গ্রহণ করেন নি কোন স্ত্রী আর কোন সন্তান। ৪. আর আমাদের মধ্যেকার নির্বোধেরা তাঁর সম্পর্কে সীমাতিরিক্ত কথাবার্তা বলত। ৫. আর আমরা ধারণা করতাম যে, মানুষ ও জ্বিন আল্লাহ সম্পর্কে কক্ষনো মিথ্যে কথা বলবে না। ৬. কতিপয় মানুষ কিছু জ্বিনের আশ্রয় নিত, এর দ্বারা তারা জ্বিনদের গর্ব অহঙ্কার বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭. (জ্বিনেরা বলেছিল) তোমরা (জ্বিনেরা) যেমন ধারণা করতে তেমনি মানুষেরা ধারণা করত যে, (মৃত্যুর পর) আল্লাহ কাউকে পুনরুথ্থিত করবেন না। ৮. আর আমরা আকাশের খবর নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম কঠোর প্রহরী বেষ্টিত ও জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডে পরিপূর্ণ। ৯. আমরা (আগে) সংবাদ শুনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্য সে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে লুকিয়ে থাকতে দেখে। ১০. আমরা জানি না (এই পরিবর্তিত অবস্থার মাধ্যমে) পৃথিবীবাসীর অকল্যাণই চাওয়া হচ্ছে, না তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখাতে চান। ১১. আর আমাদের কিছু সংখ্যক সৎকর্মশীল, আর কতিপয় এমন নয়, আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। ১২. আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহ্‌কে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না। ১৩. আমরা যখন হিদায়াতের বাণী শুনতে পেলাম, তখন তার উপর ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের উপর ঈমান আনে তার কোন ক্ষতি বা যুল্‌মের ভয় থাকবে না। ১৪. আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক (আল্লাহ্‌র প্রতি) আত্মসমর্পণকারী আর কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। ১৫. আর যারা অন্যায়কারী তারা জাহান্নামের ইন্ধন।’(আল-জ্বিন ৭২:১-১৫)

 এ ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ এ আয়াতসমূহের প্রাসঙ্গিক আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মহানাবী(সাঃ) জিনদের আগমনের কথা জানতেন না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াতের মাধ্যমে তাঁকে জিনদের আগমনের কথা অবহিত করেন এবং তখন তিনি তা জানতে পারেন। এ থেকে এও বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর নিকট এটাই ছিল জিনদের প্রথম আগমন। বিভিন্ন হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, এরপর থেকে নাবী কারীম(সাঃ)-এর দরবারে তাদের গমনাগমন চলতে থাকে।

  জিনদের আগমন ও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে দ্বিতীয় সাহায্যমূলক ঘটনা যে সাহায্য তিনি করেছিলেন তাঁর অদৃশ্য ভান্ডার থেকে অদৃশ্য বাহিনী দ্বারা। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই অবগতি ছিল না। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাতে নাবী কারীম(সাঃ)-এর দাওয়াতের কামিয়াবির সুসংবাদ রয়েছে। অধিকন্তু এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বের কোন শক্তি তাঁর দাওয়াতের কার্যকারিতার পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। অতএব ইরশাদ হয়েছে,

 ‘আর যে আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দিবে না, দুনিয়াতে সে আল্লাহ্‌কে ব্যর্থ করতে পারবে না, আর আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে নেই তার কোন সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক। তারা আছে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে।’
        (আল আহক্বাফ ৪৬:৩২)

  ‘আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহ্‌কে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না।’
            (আল-জিন ৭২:১২)

  এ সাহায্য ও সুসংবাদের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর যত প্রকারের চিন্তা-ভাবনা, দুঃখ-কষ্ট এবং নৈরাশ্য, ত্বায়িফবাসীদের গালিগালাজ, চাটিমারা ও প্রস্তর নিক্ষেপের কালো মেঘ সব কিছুই মন থেকে মুছে গেল। তিনি সংকল্পবদ্ধ হলেন তাঁকে মক্কায় ফিরে যেতেই হবে এবং নতুনভাবে ইসলামের দাওয়াত ও নবুওয়াতের তাবলীগ পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ করতে হবে।

  এটা ছিল ঐ সময়ের কথা যখন যায়দ বিন হারিসাহ(রাঃ) তাঁকে বলেছিলেন, ‘মক্কাবাসীগণ অর্থাৎ কুরাইশগণ যে অবস্থায় আপনাকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছে সে অবস্থায় কিভাবে আপনি মক্কা প্রত্যাবর্তন করবেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হে যায়দ! তুমি যে অবস্থা দেখছ এর একটা সুরাহা অবশ্যই হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই এ থেকে পরিত্রাণের একটি পথ বের করে দেবেন। তাঁর মনোনীত দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং নিজ নাবী(সাঃ)-কে জয়ী করবেন।

  নাবী কারীম(সাঃ) শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে যাত্রা করলেন এবং মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করলেন। তারপর খুযা‘আহ গোত্রের একজন লোক মারফত আখনাস বিন শারীক্বের নিকট সংবাদ পাঠালেন যে তিনি যেন নাবী কারীম(সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করেন। কিন্তু আখনাস এই বলে আপত্তি করলেন যে, কুরাইশরা হচ্ছেন তাঁর মিত্র। কাজেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুহাম্মদ(সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

  এরপর তিনি সুহায়েল বিন ‘আমর এর নিকট ঐ একই অনুরোধ বার্তা প্রেরণ করলেন। কিন্তু তিনিও এ কথা বলে আপত্তি জানালেন যে, বনু ‘আমিরের আশ্রয় দেয়া বনু কা‘বের জন্য (সঙ্গত) হয় না। অতঃপর নাবী(সাঃ) মুত্ব‘ঈম বিন আদির নিকট বার্তা প্রেরণ করলেন। মুত্ব‘ঈম বললেন, হাঁ, অতঃপর অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজ পুত্রগণ এবং সম্প্রদায়কে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে কা‘বাহ ঘরের নিকটে একত্রিত হয়ে যাও, কেননা আমি মুহাম্মদ(সাঃ)-কে আশ্রয় দিয়ে দিয়েছি। অতঃপর মুত্ব‘ঈম নাবী কারীম(সাঃ)-এর নিকট খবর পাঠালেন মক্কায় আগমনের জন্যতিনি খবর পেয়ে যায়দ বিন হারিসাহকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় আগমন করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। এরপর মুত্ব‘ঈম বিন ‘আদী আপন বাহনের উপর দৌঁড়িয়ে উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা করলেন যে, ‘হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মদ(সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করছি, কেউ যেন তাঁকে আর অনর্থক হয়রান না করে।’

  এরপর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) সোজা হাজারে আসওয়াদের নিকট গিয়ে তা চুম্বন করেন। তারপর দু’রাকায়াত সালাত আদায় করেন এবং অস্ত্রসজ্জিত মুত্ব‘ঈম বিন ‘আদী ও তাঁর লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বলা হয়, এ সময় আবূ জাহল মুত্ব‘ঈমকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি মুহাম্মদ(সাঃ)-কে আশ্রয় দিয়েছ না মুসলিগণের অনুসারী হয়ে গেছ?’ উত্তরে মুত্ব‘ঈম বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি।’ এর উত্তরে আবূ জাহল বলেছিল, ‘তুমি যাঁকে আশ্রয় দিয়েছ, আমিও তাঁকে আশ্রয় দিলাম।’

  মুত্ব‘ঈম বিন ‘আদীর সৌজন্য ও সহৃদয়তার কথা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কখনও ভুলেন নি।যখন বদরের যুদ্ধে মক্কার কাফেরদের একটি দল বন্দী হয়ে আসে এবং কোন বন্দীর মুক্তির জন্য জুবাইর বিন মুত্ব‘ঈম নাবীজী (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন তখন তিনি বললেন,

  ‘অর্থ: যদি মুত্ব‘ঈম বিন ‘আদী জীবিত থাকত এবং এই দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুপারিশ করত তাহলে তাঁর খাতিরে ওদেরকে ছেড়ে দিতাম।’   (বুখারী ২য় খন্ড ৫৭৩ পৃঃ।)

______
তথ্যসূত্র: আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ১৭০-১৭৫

Post a Comment