কে অগ্রাধিকার পাবে- স্ত্রী নাকি মা ?

রাসূল(সা) এর যুগে আলকামা নামে মদীনায় এক যুবক বাস করতো। সে নামায, রোযা ও সাদকার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বন্দেগীতে অত্যন্ত অধ্যবসায় সহকারে লিপ্ত থাকতো। একবার সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তার স্ত্রী রাসূল(সা)এর কাছে খবর পাঠালো যে, “আমার স্বামী আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় আছে। হে রাসূল, আমি আপনাকে তার অবস্থা জানানো জরুরী মনে করছি।” রাসূল(সা) তৎক্ষণাৎ হযরত আম্মার, সুহাইব্ ও বিলাল(রা) কে তার কাছে পাঠালেন।

তাদেরকে বলে দিলেন যে, “তোমরা তার কাছে গিয়ে তাকে কালেমায়ে শাহাদাত পড়াও।” তারা গিয়ে দেখলেন, আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় আছে। তাই তারা তাকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়াতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সে কোনো মতেই কলেমা উচ্চারণ করতে পারছিল না।

অগত্যা তারা রাসূল(সা) এর কাছে খবর পাঠালেন যে, আলকামার মুখে কলেমা উচ্চারিত হচ্ছে না। যে ব্যক্তি এই সংবাদ নিয়ে এসেছিল, তার কাছে রাসূল (সা) জিজ্ঞাসা করলেনঃ “আলকামার পিতামাতার মধ্যে কেউ কি জীবিত আছে?”

সে বললো, “হাঁ রাসূল, তার বৃদ্ধ মা কেবল বেঁচে আছেন।”

রাসূল (সা) তাকে তৎক্ষণাৎ আলকামার মায়ের কাছে পাঠালেন এবং তাকে বললেন, “তাকে গিয়ে বল যে, তুমি যদি রাসূল(সা) এর কাছে যেতে পার তবে চল, নচেত অপেক্ষা কর, তিনি তোমার সাথে সাক্ষাত করতে আসছেন।”

দূত আলকামার মায়ের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূল(সা) যা বলেছেন তা জানালে আলকামার মা বললেন, “রাসূল(সা) এর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক। তার কাছে বরং আমিই যাবো। বৃদ্ধা লাঠিতে ভর দিয়ে রাসূল(সা) এর কাছে এসে সালাম করলেন।

রাসূল(সা) সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ওহে আলকামার মা, আমাকে আপনি সত্য কথা বলবেন। আর যদি মিথ্যা বলেন, তবে আল্লাহর কাছ হতে আমার কাছে ওহী আসবে। বলুনতো, আপনার ছেলে আলকামার স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল?”

বৃদ্ধা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! সে প্রচুর পরিমাণে নামায, রোযা ও সাদকা আদায় করতো।”

রাসূল(সা) বললেনঃ “তার প্রতি আপনার মনোভাব কী?”

বৃদ্ধা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।”

রাসূল(সা) বললেন, “কেন?”

বৃদ্ধা বললেন, “সে তার স্ত্রীকে আমার উপর অগ্রাধিকার দিত এবং আমার আদেশ অমান্য করতো।”

রাসূল(সা) বললেন, “আলকামার মায়ের অসন্তুষ্ট হেতু কলেমার উচ্চারণে আলকামার জিহবা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।”

তারপর রাসূল(সা) বললেন, “হে বিলাল যাও, আমার জন্য প্রচুর পরিমাণে কাষ্ঠ জোগাড় করিয়া নিয়া আস।”

বৃদ্ধা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, কাষ্ঠ দিয়ে কী করবেন?”

রাসূল(সা) বললেন, “আমি ওকে আপনার সামনেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব।”

বৃদ্ধা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল। আমার সামনেই আমার ছেলেকে আগুন দিয়ে পোড়াবেন। আমি তা সহ্য করতে পারবো না।”

রাসূল(সা) বললেন, “ওহে আলকামার মা, আল্লাহর আযাব এর চেয়েও কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এখন আপনি যদি চান যে, আল্লাহ আপনার ছেলেকে মাফ করে দিক, তাহলে তাকে আপনি মাফ করে দিন এবং তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। নচেত যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ তার কসম, যতক্ষণ আপনি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, ততক্ষণ নামায, রোযা ও সাদকা দিয়ে আলকামার কোনো লাভ হবে না।”

একথা শুনে আলকামার মা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহকে, আল্লাহর ফেরেশতাদেরকে এবং এখানে যে সকল মুসলমান উপস্থিত তাদের সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি আমার ছেলে আলকামার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি।”

রাসূল(সা) বললেনঃ “ওহে বিলাল, এবার আলকামার কাছে যাও। দেখ, সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলতে পারে কিনা। কেননা, আমার মনে হয়, আলকামার মা আমার কাছে কোনো লাজ লজ্জা না রেখে যথার্থ কথাই বলেছে।” হযরত বিলাল(রা) তৎক্ষণাত গেলেন। শুনতে পেলেন, ঘরের ভেতর থেকে আলকামা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করছে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”।

অতঃপর বিলাল গৃহে প্রবেশ করে উপস্থিত জনতাকে বললেনঃ শুনে রাখ, আলকামার মা অসন্তুষ্ট থাকার কারণে সে প্রথমে কলেমা উচ্চারণ করতে পারে নি। পরে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার জিহবা কলেমা উচ্চারণে সক্ষম হয়েছে। অতঃপর আলকামা সেদিনই মারা যায় এবং রাসূল(সা) নিজে উপস্থিত হয়ে তার গোসল ও দাফনের নির্দেশ দেন, জানাযারণনামায পড়ান ও দাফনে শরীক হন।

অতঃপর তার কবরে দাঁড়িয়ে রাসূল (সা) বললেন, “হে আনসার ও মুহাজেরগণ! যে ব্যক্তি মায়ের উপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দেয় তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও সকল মানুষের অভিসম্পাত! আল্লাহ তার পক্ষে কোনো সুপারিশ কবুল করবেন না। কেবল তওবা করে ও মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করে তাকে সন্তুষ্ট করলেই নিস্তার পাওয়া যাবে। মনে রাখবে, মায়ের সন্তুষ্টিতেই আল্লাহর সন্তোষ এবং মায়ের অসন্তোষেই আল্লাহর অসন্তোষ।”

ইমাম তাবরানী ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন।
সূত্রঃ হাদীসের কিসসা, আকরাম ফারুক।

Post a Comment

Previous Post Next Post